Now Reading
সিকিম ডায়েরি পার্ট ৩ – দারাপে দ্বিতীয় দিন

সিকিম ডায়েরি পার্ট ৩ – দারাপে দ্বিতীয় দিন

Avatar photo
Sikkim Diary part 3

এই সিরিজের প্রথম দুই পর্বে পাঠকরা সিকিম -এর নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং লিম্বু সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে পড়েছিলেন। এই পড়বে লেখক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রাকৃতিক শোভা, স্থানীয় খাদ্য, গ্রামীণ জীবন, এবং লিম্বু সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন। প্রবন্ধে স্থানীয় মানুষদের আতিথেয়তা, তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি, এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে মিশে যাওয়া মানসিক অনুভূতির গল্প বর্ণিত হয়েছে।

ভোরের দিকে চোখ লেগে গিয়েছিলো। ঘুম ভাঙ্গলো রামকুমারের হাঁকডাকে।

চোখে মুখে জল দিয়ে বাইরে এসে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ পরিষ্কার। ঘড়িতে সময় পাঁচটা। কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষে আগুন লাগিয়ে দিবসের একচ্ছত্র অধিপতি আপনার আগমন বার্তা সগর্বে ঘোষনা করছেন। রক্তাক্ত কাঞ্চনজঙ্ঘাকে যেন হাত বাড়ালেই মুঠোয় পাওয়া যাবে, এতোই কাছে। ভোরের আকাশ ভরে উঠেছে পাখির গানে গানে। একটু পরে সূর্যোদয় হলো, কিন্তু আমি নড়তে পারলাম না, দাঁড়িয়ে রইলাম মুগ্ধ হয়ে। দেখতে থাকলাম পকাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষে রঙের হোলি।

এক সময়ে সুন্দরী নুমা এককাপ চা হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল। তার‌ও কিছু পরে এসে আমার হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে গেল খাবার টেবিলে। প্রাতরাশ দেওয়া হয়েছে। এক প্লেট মোমো, একটা বাটিতে থুকপা আর ধুংরো। সুন্দরী ধুংরোতে গরম জল দিয়ে আমার সঙ্গেই খেতে বসল। বসলো রামকুমার‌ও। পরশুরাম ভোর বেলাতেই চলে গেছে ইয়ুকসাম।

খাওয়ার পরে রামকুমার বললে, “চলিয়ে সাব, সিকিম কা গাঁও ঘুমনে”। বের হলাম রামকুমারের সঙ্গে, সুন্দরীও পিছু নিলো। পুরো গ্ৰামটাই পাহাড়ের ঢালে। খান ছয়েক কমলার বাগান, তার মধ্যে মধ্যে বড়ো এলাচের চাষ। বড়ো এলাচ বা Black Cardamom এর চাষ হয় একমাত্র পূর্ব হিমালয়ে। সিকিম, নেপাল, ভূটান, দার্জিলিং ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে প্রচুর বড়ো এলাচের চাষ হয়। এর পরাগ মিলনের জন্যে প্রয়োজন Bumble Bee যাকে আমরা বাংলায় ভ্রমর বা ভোমরা বলি। এরা মাটির নিচে বাসা বানিয়ে থাকে। একমাত্র পূর্ব হিমালয় অঞ্চলেই এদের দেখা পাওয়া যায়।

দারাপের কমলালেবু আর বড়ো এলাচের গাছের পাতাগুলো ভিজে, গতকালের বৃষ্টির রেশ কাটেনি এখনও, হয়তো রোদের তেজ বাড়লে কাটবে! বৃষ্টির জলে গা ধুয়ে গাছগুলো যেন সবুজ মাখন। সব বাড়ির সামনেই ফুলের বাগান, আর ধারে ধারে সয়াবিন গাছ। সয়াবিন লিম্বুদের একটা প্রধান খাদ্য। পাহাড়ের গায়ে অল্প একটু সমতল পেলেই সেখানে নানারকম সবজির চাষ, টমেটো, ক্যাপ্সিকাম, বাঁধাকপি। আর যেখানে পর্যাপ্ত সমতল জমি নেই সেখানে ফুটেছে নানা রঙের হরেকরকম ফুল, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে।

লিম্বু মেয়ে
লিম্বু মেয়ে

গ্ৰামের শেষপ্রান্তে একটা পায়েচলা পথ নেমে গেছে নিচের দিকে। রামকুমার চললো সেই পথে। তার হাতে উঠে এলো কোমরে গোঁজা কুকরি।  কি আশ্চর্য, সুন্দরীর হাতেও একটা কুকরি! এ তো, সাংঘাতিক মেয়ে! আগে আগে চলেছে রামকুমার কুকরি দিয়ে আগাছা সাফ করতে করতে, তার পিছনে আমি…., ঢালু পাহাড়ি পথ, আগের দিনের বৃষ্টিতে বড়ই পিচ্ছিল, একটু অসাবধান হলেই পতন অনিবার্য। রামের কাঁধে হাত দিয়ে কোনোরকমে টাল সামলাচ্ছি। আমার পিছনে সুন্দরী। তার হাত আমার কাঁধে।

পথের পাশে ফুটেছে নানা রঙের হরেকরকম ফুল। একধরনের সাদা ফুল, মাঝখানে হালকা হলুদ, তার মাঝে জবা ফুলের মতো খয়েরি কেশর। রামকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘নাম কি এই ফুলের’? রাম বললো, “জানিনা, আমরা বলি ফরা ফেং। ফরা মানে সেতো (নেপালী), সাদা আর ফেং, ফুল”। আমি অস্ফুটে বললেম “নুমা ফেং”। কাঁধের হাতটা সজোরে খামচে ধরলো, জ্যাকেটের ওপর দিয়ে। রাম হেসে উঠলো হোহো করে। বললে, নুমার পুরো নাম নুমাফেং। এবার আমি হেসে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা নরম হাতের কিল পড়লো পিঠে। বাকি পথটুকুতে যতোবারই ফরাফেঙের দেখা পেলাম, বললাম ‘নুমা ফেং’, ততোবারই পিঠে পড়লে নরম হাতের কিল।

Darap Village

হঠাৎই পথ শেষ হলো এক নাতিবিস্তীর্ণ বালুচরে। তার বুক চিরে বয়ে যাচ্ছে একটি জলধারা। স্রোতস্বিনীর উৎস সন্ধানে ডানদিকে চোখ ফেরাতেই দেখতে পেলাম ঝর্ণাটাকে। ছোট্ট ঝরণা কিন্তু বিপুল জলভারে তার শরীর উথালপাথাল। কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো উদ্দামতা নিয়ে অনেক উঁচু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে না মাটির বুকে বরং শ্রোণীভারানতা পূর্ণযুবতীর মতো পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে নেমে আসছে বালুচরে। রামকুমার বললো, লুম্বানী ফলস। দারাপের উত্তরে রিম্বি আর দক্ষিণে লুম্বানী।

বালুচরে কয়েকটা ছোটখাটো জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে। তাতে খেলে বেড়াচ্ছে কিছু ছোটবড়ো মাছ। রামকুমার নেমে গেল মাছ ধরতে। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম ঢালুপথের উপরে। নুমাফেং পিছন থেকে খামচে ধরলে আমার কোমর। আলতো করে তার থুতনিটা নামিয়ে আনলে আমায় কাঁধে, নজর তার রামের দিকে। তার নিঃশ্বাসের হলকা লাগলো আমার কানের নীচে। আমি ভয় পেলাম। এই পাহাড়ী কাঞ্চনজঙ্ঘা সামলানো আমার কম্ম নয়। হাঁক পাড়লাম, “রাম ওয়াপস চলো, দের হো রহা হ্যায়”। কাঁধ থেকে মাথা তুলে আমার পিঠে পড়লো কিল, এবার বেশ জোরেই।

মৎস শিকার অসমাপ্ত রেখে আমরা পিচ্ছিল চড়াই পথে ঘরে ফিরে এলাম। আম্মী দুপুরের খাবার পরিবেশন করলেন। নুমাফেং সামনে এলো না, তার নাকি শরীর খারাপ।

দুপুরের খাবারে ছিল, ভাত, সুঙ্গুর কো খুত্তা ডাল (শুয়োরের টেংরি দিয়ে মসুর ডাল), চেম্বিকেক সুম্বাক (মশলা দিয়ে তেলে ভাজা কিনেমা বা গ্যাঁজানো সয়াবিন), ফাকসা সেকুওয়া (শুয়োরের মাংসের কারি), ফান্দো (সয়াবিন এবং লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে তৈরি চাটনি), নাম্বং মুচি (লঙ্কার শুকনো আচার) আর টোংবা। ক্লান্ত ছিলাম, খেয়ে দেয়ে ঘুম।

ঘুম ভাঙ্গলো সন্ধ্যার পর। বেরিয়ে এসে দেখি আবার‌ও বৃষ্টি নেমেছে। সবাই বসে আছে পিছনের বারান্দায়। আমি যেতেই নুমাফেং উঠে গেল। আমি বসলাম ওর ছেড়ে যাওয়া আসনে, রামকুমারের পাশে। নুমা এক কাপ চা এনে আমার হাতে দিল। তারপর বসে পড়লো আমার পাশেই। চা শেষ করার আধ ঘন্টাটাক পর আবার উঠে গেল। ফিরলো হাতে চারটে গ্লাস নিয়ে। তাতে রয়েছে কোন জলের মতো স্বচ্ছ পানীয়। সবাইয়ের হাতে গ্লাস দিয়ে শেষে নিজে একটা নিয়ে এল। মুখের কাছে নিতেই অ্যালকোহলের গন্ধ পেলাম। রামকুমারকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে বললো “রাকসী”। সঙ্গে স্নাক্স সুরা-কীক সুম্বাক (মশলা দিয়ে তেলে ভাজা পনির), তেলে ভাজা সাখেক্যা ও রোস্টেড ফাকসা সেকুওয়া।

এক চুমুক দিতে গলা দিয়ে জ্বলতে জ্বলতে সে নামলো। বুঝলাম ভীষন কড়া। রামকুমারকে বললাম, এত কড়া পানীয় খাবার অভ্যাস নেই, খেতে পারবো না। রামকুমার বললো, একবার পরিবেশন করার পর কেউ টোংবা বা রাকসী অস্বীকার করতে পারে না। এটা ওদের ধর্মীয় আচারের সঙ্গে যুক্ত। এবার নুমা এগিয়ে এলো, বসলে আমার পাশে, বললো, “নো রিফিউজ”। বিদেশীদের আনাগোনার জন্য এখানে অনেকেই ইংরেজি বুঝতে পারে, অল্পবিস্তর বলতেও পারে। নুমা তার ইংরেজি জ্ঞান জাহির করছে। সে বললে, “ম্যান স্ট্রং। নো স্ট্রং, নো ম্যান”। একথা বলে নুমা আমার গ্লাসটা নিয়ে দুটো বড় বড় চুমুক দিলো, তারপর জল ঢেলে আবার গ্লাসটা ভরে দিলো।

প্রচুর স্ন্যাকস খাওয়ায় রাতে আর খেতে পারলাম না। শুধু জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন ভোরে রামকুমার আমার ঘুম ভাঙ্গালো। আজ ফিরতে হবে। চা, মোমো আর শেষবারের মতো নুমাফেঙের দেওয়া টোংবা খেয়ে রামকুমারের মোটরসাইকেলে স্বর্গ থেকে বিদায় নিলাম।

See Also
সিকিম ডায়েরি পার্ট ২: দারাপ

কিছুদুর যাওয়ার পর দেখি কমলা বাগানের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে আসছে নুমাফেং। কিছু কি ফেলে এসেছি? গাড়ি দাঁড় করালো রামকুমার।

দৌড়ে এলো নুমা। হাঁফাচ্ছে। ঘামে মুখ চকচক করছে, ঘামতেল লাগিয়েছে যেন। মাথায় লাগিয়েছে দুটো সাদা ফরাফেং। হাতে ধরা দুমুঠো বড় এলাচ। অঞ্জলী ভরে তুলে দিলো আমার হাতে। তাতে এক অদৃশ্য চিরকুটে যেন লেখা,

“তোমায় কিছু দেব ব’লে চায় যে আমার মন,

নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন।”

সে চিরকুট কেবল আমিই পড়লাম। তারপর বার করলো দুটো ‘ঢাকা’ কাপড়ের সাদা রুমাল। তুলে দিলো আমার হাতে। এরপর আর দাঁড়ালো না মুখ ঘুরিয়ে দৌড় লাগালো। কাঁদো, নুমাফেং, কাঁদো। আজ তোমার কান্নার দিন, সুন্দর ফুল….; আমার‌ও।

এরপর, ইয়ুকসাম, পরশুরামের গাড়ি আর সন্ধ্যাবেলায় গ্যাংটক প্রত্যাবর্তন।

রাতে কি খাব, জানতে এলো হোটেলবয় লিম্বু। একটা রুমাল বার করে তাকে দেখালাম। বললাম, “কি লেখা আছে রুমালের কোণায়?” সে বললে, “নুমাফেং, সুন্দর ফুল”। বোকা মেয়ে, জানেনা, রুমাল উপহার দিলে, বিচ্ছেদ আসন্ন।

ভালো থেকো ফুল।

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top