Now Reading
অনুরাগ: শৈবাল ও সাথীর অসমাপ্ত প্রেমগাথা

অনুরাগ: শৈবাল ও সাথীর অসমাপ্ত প্রেমগাথা

Avatar photo
অনুরাগ - শৈবাল ও সাথীর অসমাপ্ত প্রেমগাথা

অনুরাগ -এর এক অপূর্ণ গল্প। শৈবাল ও সাথীর নিষিদ্ধ প্রেম, সমাজের বাধা, আর এক অনন্ত আকর্ষণের করুণ পরিণতি। জমিদার বাড়ির ছাদে জন্ম নেওয়া প্রেম কি শেষমেশ পরিণতি পায়?

অনুরাগ

আমার বেঁচে থাকা তোমাকে ঘিরে,
আমার পাগলামি তোমাকে ঘিরে,
আমার চাওয়া পাওয়া তোমাকে ঘিরে,
আমার স্বপ্ন তোমাকে ঘিরে,
আমার দুঃখ, কষ্ট ,মান ,অভিমান সব তোমাকে ঘিরে,
ঘুম থেকে উঠে চোখ খোলা থেকে ঘুমোতে যাবার আগের মুহূর্ত অব্দি শুধু তুমি,
ঘুমের মধ্যেও শুধু তোমাকেই খুঁজে বেড়াই,
আমার বিনিদ্র যাচ্ছে জাগরণে ও তুমি,
চারিদিকে শুধু তুমি আকাশে, বাতাসে , জন- কোলাহল মুখর সমাজের নৃশংসতায়, বর্বরতার মাঝেও শুধু তুমিই থাকো আমার চেতনায়,
যেদিকে তাকাই তোমায় দেখি যখন কিছু দেখি না তখন ও তোমাকেই দেখি,
আমার পাতা ঝরা বিকেলের দমকা হাওয়া তুমি, আমার আধার পথের আলো দিশারী তুমি,
আমার মনের শান্তি তুমি, নীরবতার মাঝে কোলাহল তুমি,
তুমি শুরু,তুমিই শেষ ,তুমি মধ্য, তুমি যে অনন্ত।
শৈবালের লেখা কবিতাটা শৈবাল তার প্রেমিকার সাথীর জন্য লিখেছে, আর সেটাই পাঠ করে শোনাচ্ছে সাথীকে। কবিতা পাঠের শেষে সাথী বলে উঠল -ধ্যাত! যতসব !এই কবিতা তুমি আমার জন্য লিখেছ?
সাথীর প্রশ্নের উত্তরে শৈবাল সাথীকে বলল- হ্যাঁ তো, শুধু তোমারই জন্য প্রিয়তমা। তুমি তো আমার জীবনের সমস্তটা জুড়ে। সাথী এবার লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠলো। লজ্জায় এক ছুটে পালিয়ে গেল ছাদ থেকে। শৈবাল বলল- যেও না সাথী !শোনো! যেওনা!
শৈবালের বয়স এখন ৩০ এর দোরগোড়ায়, সাথী ওই কুড়ি কি বাইশের হবে।
বীরেন চট্টরাজের একমাত্র ছেলে শৈবাল চট্টরাজ। বীরেন বাবু এই দেউল গ্রামের জমিদার, অনেক শখ করে ছেলেকে ব্যারিস্টারি পড়তে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু ছেলে শৈবালের মনে তখন বসন্তের হাওয়া বইছে।
সাথী পাশের বাড়ির নবীন খুড়োর একমাত্র মেয়ে, একে তো গরিব তাও আবার নিচু জাত। তাই বীরেন বাবু ঠিক পছন্দ করতেন না ওদের। কিন্তু বীরেন বাবুর স্ত্রী সাথী কে খুব ভালবাসেন নিজের মেয়ের মত। যেহেতু সাথীর মা জন্মের পরই মারা যান , আর বীরেন বাবুর স্ত্রীগৌরী দেবীর খুব মেয়ের শখ ছিল, কিন্তু নিজের মেয়ে না হওয়ায় সাথীকেই তিনি মেয়ের মতো ভালোবাসতেন।
একসাথে খেলাধুলা করেই কেটেছে শৈবাল আর সাথীর শৈশবটা।
সাথীর বয়স এখন অষ্টাদশের দোরগোড়ায়, সদ্য যৌবনা প্রাপ্তা সাথী যেদিন জামা থেকে শাড়ি পরতে শুরু করে, সেই প্রথম শৈবাল সাথীকে দেখে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে এসে।
শৈবাল , বসার ঘরের বারান্দাটায় আরাম কেদারায় বসে তখন আইনের বই পড়ছে , পরনে সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি।
সাথী খুরি মার কাছে উল বোনা শিখতে আসে। সেই প্রথম দেখা দুই তরুন তরুনীর।
সাথীর পরনে লাল পার হলুদ শাড়ি, মাথার দুপাশে বেনুনি লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা, ফর্সা, সুন্দরী টানা টানা দুটো চোখ, গোলাপের পাপড়ির মতো দুটো ঠোঁট। সাথী শৈবালকে দেখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচল পাকাতে থাকে। আইনের ধারাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকা শৈবাল বই ফেলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সাথীর দিকে। হঠাৎ খুরিমা এসে বলে -ও সাথীমা, তুই এসেছিস! আয় !এই দেখ! তোর সেই খেলার সাথী! সাথী লজ্জায় ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়।
এইভাবে পরিচয় হয়েছিল প্রথমটায় । তারপর আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব গভীর হয়। সাথী শৈবালের সাথে দেখা করত শৈবালদের বাড়ির ছাদ এ ।
ওখানে যেহেতু লোকজন খুব একটা যেত না তাই ওখানে ওরা গল্প করত। সাথীর কোলে শুয়ে শৈবাল আকাশে চাঁদ, তারা দেখতো, সাথীকে কবিতা শোনাতো, গানও শোনাতো। এইভাবে কাটছিল। একদিন বীরেন চট্টরাজের বন্ধু স্থানীয় জমিদার প্রতাপ নারায়ণের একমাত্র মেয়ে সুচন্দ্রার সাথে বিয়ে ঠিক হয় শৈবালের। বীরেনবাবু ঠিক করেন প্রতাপ বাবুর মেয়ের সাথে বিয়ের ছেলের বিয়েটা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে কাল সখ্যতা কুটুম্ব আত্মীয় সম্পর্ক তৈরি হবে। প্রতাপ নারায়ণের মেয়ে সু চন্দ্রা ছিল দাম্ভিক, অহংকারী, অলস, দেখতেও যে খুব একটা ভালো তা নয়। মোটের উপর শৈবালের খুব একটা পছন্দ ছিল না সুচন্দ্রাকে। এদিকে জমিদার প্রতাপ নারায়ণের আবার বীরেন চট্টরাজ এর বিষয় সম্পত্তির দিকে বড় লোভ। বীরেন চট্টরাজের প্রভাব প্রতিপত্তি সবটাই প্রতাপ নারায়ণের তুলনায় বেশি। একদিন প্রতাপ নারায়ন মেয়ে সুচন্দ্রাকে নিয়ে বীরেন বাবুর বাড়ি আসেন। বাড়ির সামনের বাগানটায় শৈবাল সুচন্দা বসে কথা বলছে, এমন সময় সাথী ই চা নিয়ে যায় ওদের দেবার জন্য। সাথী রুপে গুণে ব্যবহারে সবেতে সু চন্দ্রার থেকে বেশি হওয়ায় সু চন্দ্রার সাথী কে পছন্দ হয় না, সাথী চা দিলে, সুচন্দ্রা সাথীর গায়ে চা ফেলে দেয়। গরম চা পড়ে সাথীর হাত পুড়ে গেলেও সাথী কিছু না বলে ছুটে চলে যায়। শৈবালের ব্যাপারটা ভালো না লাগায়, শৈবাল সুচন্দ্রা কে বলে সাথীর কাছে ক্ষমা চাইতে, একেতো অহংকারী তার উপরে দম্ভ ,ক্ষমা সে চাইবে না জানিয়ে দেয়। সেই প্রথম আলাপ তিনজনের।
সেদিন পূর্ণিমা। পূর্ণিমার আলোয় সাথীকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে শৈবাল বলে। সুচন্দ্রার চা ছুড়ে ফেলায় সাথীর হাত গরম চা লেগে পুড়ে গেছিল শৈবাল সাথীর ক্ষত হাতে হাত বোলাতে বোলাতে সাথীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে, সাথী ও শৈবালের দিকে চেয়ে থাকে, একে অপরের কাছে আসে, শৈবাল নিজের ঠোঁট, সাথীর ঠোঁটে স্পর্শ করে, ঘনিষ্ঠ হয় ওরা। কোন এক অমগ টানে একে অপরের দিকে আকর্ষিত হয় ওরা। সেদিন শৈবাল আর সাথী দুজন দুজনের কাছে ধরা দেয়। হঠাৎ সাথী শাড়ির আঁচল সামলে লজ্জায় এক ছুটে ছাদ থেকে নেমে নিজের বাড়ি চলে যায়। শৈবাল পাঞ্জাবির বোতাম আটকাতে আটকাতে মুচকি হাসে।
এর দুমাস পর, ২ রা জ্যৈষ্ঠ। বিয়ে ঠিক হয় শৈবালের সু চন্দ্রার সাথে।
শৈবালের প্রথম প্রেম অপূর্ণ থেকে যাবে, সাথীকে নিজের করে পাবেনা শৈবাল, এসব জানা সত্ত্বেও শৈবাল তার পিতা বীরেন বাবুকে সাহস করে কিছু বলতে পারেনা। সাথী আজ সন্তান সম্ভবা। শৈবালের চুপ করে থাকাটা, বিয়েতে রাজি হওয়াটা, মেনে নিতে পারে না সাথী। লোক নিন্দার ভয়ে সাথী নিজের প্রাণের আহুতি দেয়। শৈবাল ভেবেছিল যেদিন ওর বিয়ে সুচন্দ্রার সাথে সেদিনই সাথীকে বিয়ে করবে। কিন্তু সাথী কে জানানোর আগেই সাথী শৈবালকে ছেড়ে চলে যায়।
আজ ২ রা জ্যৈষ্ঠ। শৈবালের বিয়ে। সকাল থেকে সানাই এর আওয়াজ, বাড়িময় লোকজনের সমাগম। গায়ে হলুদ শেষে স্নান সেরে ঘরে এসে শৈবাল সিগারেট খেতে খেতে আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আজ সাথীর কথা বড্ড মনে পড়ছে শৈবালের। চোখের জল বাঁধ মানছে না। বিয়ের লগ্ন সন্ধে ছটায়। বিকেল তখন পাঁচটা। শৈবাল সাদা সিল্কের পাঞ্জাবি, ধুতি, কপালে চন্দন, বরের সাজে সেজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে চেয়ে থাকে। সাথীকে ছাড়া শৈবালের জীবন অপূর্ণ- ভাবতে ভাবতে ছাদের কাছে দাঁড়ায়, সিগারেটটা ধরিয়ে নিজের বাড়ি, লাইট ,সানাইয়ের আওয়াজ, নিজের উঠানে বরণ ডালা সাজাতে ব্যস্ত তার মাকে দেখে চোখটা মুছে, সিগারেটটা ফেলে , একটা গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর বাড়ির পিছনের জঙ্গলের দিকে ঝাঁপ দেয়। ভয়ানক বিকট আওয়াজে সবাই ছুটে এসে দেখে সব শেষ।
এরপর প্রায় ৩০ বছর কেটে যায়। বীরেন বাবু, শৈবালের বাবা, গৌরী দেবী শৈবালের মা, একে একে বয়সের ভারে সবাই চলে যান। গৌরী দেবী অবশ্য শৈবালের মৃত্যুর পর উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। আজ সেই শুক্লপক্ষের পূর্ণিমার রাত। জমিদার বাড়ির ছাদ থেকে ভেসে আসছে একটি পুরুষ কন্ঠ আরেকটি মহিলা কন্ঠ একসাথে গান গাইছে, রবীন্দ্র সংগীত-” আমি তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে….. “।

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
1
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top