যেতে নাহি দিব – সিকিম পর্ব ৪
Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks…
বর্ষাকালে গ্যাংটক থেকে কলকাতায় যাত্রার এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিধস, এবং চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাত্রাপথের কাব্যিক রোমাঞ্চ ও মানুষের অদম্য মনোবল। সিকিমের অপরূপ সৌন্দর্য, স্থানীয় নায়ক, আর “যেতে নাহি দিব” গানের স্মৃতিতে ভরা একটি রোমাঞ্চকর কাহিনী।
যেতে যেতে ঘরে ফেরা –
গ্যাংটক ফিরলাম ১৩ই সেপ্টেম্বর। ১৬ই সেপ্টেম্বর সকালের মধ্যে কলকাতা পৌঁছতেই হবে, ঐদিন বিশ্বকর্মা পুজো।
১৫ই সেপ্টেম্বর দার্জিলিং মেলে ফেরার টিকিট কাটা। ট্রেন সন্ধ্যায় জলপাইগুড়ি ছেড়ে পরদিন ভোরে শিয়ালদহ পৌঁছয়। এসএনটির প্রথম বাস সকাল ছটায় রওনা দিয়ে, শিলিগুড়ি পৌঁছয় এগারোটা নাগাদ। সেই বাসে শুধু বিমান যাত্রীদেরই নেওয়া হয়। সেই বাস সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেই বাসে যেতে পারলে হাতে অনেক সময় পাওয়া যাবে। করিৎকর্মা শ্যাম কাকু সেই বাসে আমার জন্য একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে ফেললেন।
১৪ তারিখ সারাদিন, সারারাত বৃষ্টি হলো। ১৫ তারিখ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাস ধরলাম। গ্যাংটক পার হতে না হতেই দুর্ভোগ শুরু হলো।
গ্যাংটকের বাইরেই বিরাট ভূমিধ্বস। সিকিম তখনও ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। রাস্তা সীমান্ত সড়ক কতৃপক্ষের(BRO) নিয়ন্ত্রণাধীন। বিআরও অসম্ভব কর্মদক্ষ। দ্রুত তারা রাস্তা যান চলাচলের উপযোগী করে তুলছিল। এই কদিন সিকিমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেদিন সিকিমের প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপ দেখে শিহরিত হয়েছিলাম।
আগে আগে চলেছে সেনার গাড়ি, পিছনে পিছনে আমাদের গাড়ি। হঠাৎ থেমে গেল সেনাবাহিনীর গাড়ি, তার পিছনে থেমে গেল আমাদের গাড়িও। সঙ্গেসঙ্গেই পিছনে গোটা পনেরো গাড়ির লম্বা লাইন লেগে গেল। সেনার গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে এলো জনাচারেক সেনাকর্মী। একজনের হাতে একটা মাইক ধরা। সে চিৎকার করে সব চালককে গাড়ি পিছিয়ে নিতে বললো। অন্যরাও দৌড়ে এলো পিছনে, লেগে পড়লো যান নিয়ন্ত্রনে। সিকিমের চালকরা এই পরিস্থিতিতে অভ্যস্থ। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সবকটা গাড়িই প্রায় একশো মিটার পিছিয়ে গেল। পিছিয়ে এলো আমাদের বাস ও সেনার গাড়িও। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিরাট ভুমিধ্বস ধসিয়ে নিয়ে গেল আমাদের সামনের রাস্তা চোখের সামনেই। আমার মেরুদন্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। কয়েক মিনিট আগেই যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম এখন সেই রাস্তা এখন নেই।
এভাবে একডজন ছোটবড় ধ্বস পার হয়ে আমরা পৌঁছলাম পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত কালীঝোরায়। ততক্ষণে এগারোটা বেজে গেছে।
প্রতিটা ধ্বসে আটক হয়ে বারবার মনে হয়েছে কেউ যেন বারবার বলছে “যেতে নাহি দেব”। হেন কথা কে পারে বলিতে “যেতে নাহি দিব”!
সেই কন্যাটির মতো
অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি
“যেতে নাহি দিব’। ম্লান মুখ, অশ্রু-আঁখি,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব,
তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব,
তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয়
“যেতে নাহি দিব’। যত বার পরাজয়
তত বার কহে, “আমি ভালোবাসি যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।
এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার
“যেতে নাহি দিব’।
ওরে মোর মূঢ় মেয়ে,
কে রে তুই, কোথা হতে কী শকতি পেয়ে
কহিলি এমন কথা, এত স্পর্ধাভরে–
“যেতে আমি দিব না তোমায়’?
কালীঝোরায় বিশাল ধ্বস নেমেছে। রাস্তা পুরো বন্ধ। রাস্তার ওপরেই হাঁটুজল। আশায় ছিলাম আগের আগের বারের মতো সেনাবাহিনী এবারও আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু বিধি বাম। কালীঝোরা সেনা এলাকার শেষ আর রাজ্য পূর্ত দপ্তরের এলাকার শুরু। সেনা কাজ করতে পারবে না আর পূর্ত দপ্তর কাজ করবে না। কেন? জানতে চাইলো সেনা আধিকারিক। পূর্ত আধিকারিক জানালেন, প্রথা ভেঙে কাজ করার জন্য তার শাস্তিমূলক বদলি হয়েছে রাজ্যের শেষ সীমানায়, তাই প্রথা বহির্ভূত কাজ তিনি করবেন না।
সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। কতক্ষণ আটক থাকতে হবে জানিনা। প্রথমে কিছু খাবার চাই। সেই সময় সেখানে মাত্র তিন চারটি টুকিটাকি জিনিসের দোকান ছিল। ইতোমধ্যেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু গাড়ি এসে গেছে। সব গাড়িতেই লোক ভর্তি। শতাধিক লোকের সঙ্গে লড়াই করে আমি জোগাড় করতে পারলাম মাত্র একটা একশো গ্ৰাম ওজনের ব্রিটানিয়া থিন এরারুট বিস্কুটের প্যাকেট।
বুঝলাম এখান থেকে বেরোতে হবে, নয়তো না খেয়ে মরতে হবে, বসে থাকলে হবে না। আমার সঙ্গে দুটো সুটকেস। বন্ধুদের অনুরোধে তার একটা ভর্তি কুকরি হুইস্কিতে, অন্যটা ফুটবল রামে, দুটোই প্রচন্ড ভারী। এছাড়া ছিল একটা রুকস্যাক। ঝিরঝির বৃষ্টি তখনও চলছে। জুতোটা খুলে হাওয়াই চপ্পল পড়ে নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লাম।
রাস্তার একদিকে পাহাড় অন্যদিকে খাদ, খাদের নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা। রাস্তা ও তিস্তা, মাঝে হাঁটু সমান উঁচু দেড়ফুট চওড়া পাঁচিল। পাঁচিলের ওপরটা শ্যাওলায় ঢাকা। ধ্বসে পড়া গাছপাথর রাস্তার ওপরেই পড়ে রয়েছে। লোকজন ঐ পিচ্ছিল পাঁচিলের ওপর দিয়েই পারাপার করছে। আমার ভয় হলো, পদস্খলন হলে সোজা তিস্তায়।
ভাবলাম, ধ্বসে পড়া গাছপাথরের ওপর দিয়ে পার হয়ে যাই। আমি দুই হাতে দুই ভারী সুটকেস ও পিঠে রুকস্যাক নিয়ে বীরবিক্রমে জল পেরিয়ে সেই গাছপাথরের স্তূপের ওপর একটা পা তুলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চোরাবালির মতো সেই স্তূপ আমার পা গ্ৰাস করলো। বেসামাল হয়ে অন্য পাটাও তার ওপরে দিয়ে দিতে হলো। এক্বেবারে ন যযৌ ন তস্হৌ অবস্থা। ‘যেতে নাহি দিব’। হাসির রোল উঠলো সমবেত জনতার মাঝে।
আমার অবস্থা দেখে একটা বাচ্চা নেপালী ছেলে এগিয়ে এলো। বয়স বারো কি তেরো, বড়োজোর চোদ্দ। নেপালী ভাষায় কাঞ্চা। সে জল পেরিয়ে এসে বললো,”সাব আপকা সুটকেস মুঝে দে দিজিয়ে”। আমি ইতস্তত করছি দেখে আরো বললো, “দে দিজিয়ে, নেহি তো নিকাল নেহি পাইয়ে গা, আপ ডরিয়ে মৎ”। দুয়েকটা ছোটখাটো পাথর তখনও আমার আশেপাশে পড়ছে। তার একটাও যদি মাথায় পড়ে তাহলেই ভবলীলা সাঙ্গ। অগত্যা দিয়ে দিলাম দুটো সুটকেস তার হাতে। মাল বাঁচানোর থেকে জান বাঁচানো বুদ্ধিমানের কাজ। জল পেরিয়ে সুটকেস দুটো রেখে, একটা মোটা লাঠি নিয়ে আবার এগিয়ে এলো কাঞ্চা। হুকুম করলো সে, “পিছে কা ব্যাগ ভি দিজিয়ে, আপকো হালকা হোনা হ্যায়”। লাঠির ভয়ে তাও দিয়ে দিলাম। এবার সে লাঠিটা আমার হাতে দিয়ে বললো,”পাঁও চালাকে দেখিয়ে, কোই পেড় মিলতা হ্যায়, কেয়া”। সামনেই একটা গাছের ওপরের অংশটা দৃশ্যমান। নীচের অংশটা কাদাপাথরে ঢাকা। আমি লাঠির ওপর ভর দিয়ে পা চালিয়ে সহজেই তার কান্ডটা পেয়ে গেলাম। লাঠির ওপর ভর করেই দুটো পা তুলে ফেললাম গাছের ওপর। আবারও এগিয়ে এলে কাঞ্চা, বাড়িয়ে দিলো হাত। তার হাত ধরেই বেরিয়ে এলাম সেই গাছ-পাথর-কাদার নাগপাশ থেকে। কিন্তু হাওয়াই চপ্পলজোড়া আর সঙ্গ দিলো না, তারা রয়ে গেল কাদাপাথরের মধ্যেই।
আমার রুকস্যাকটা পিঠে নিয়ে, কাঞ্চা, তারই বয়সী, আরেকজনকে ডাকলো। দুজনে দুটো সুটকেস মাথায় তুলে নিলো। আমায় বললে, “আপ পিছে পিছে, আইয়ে”। তারপর দুজনে অবলীলায় ঐ দেড় ফুটের শ্যাওলাভরা পিচ্ছিল পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। বাধ্য হয়েই আমি তাদের পিছু নিলাম, ভয়ে ভয়ে, থেমে থেমে।
মুহুর্তেই পেরিয়ে গেলাম, ঐ সামান্য অংশটুকু। আবার আমি নেমে এলাম পথে। কাঞ্চারা পাঁচিলের ওপরেই চললো। এগোতে গিয়ে টের পেলাম পায়ে জুতো নেই। হাওয়াই চপ্পলজোড়া রয়ে গেছে কাদাপাথরের স্তুপে। পাহাড়ী পথের কুচি কুচি পাথর সমানে পায়ে বিঁধছে। অস্বস্তি উপেক্ষা করেই এগোলাম। অল্প গিয়েই আবারও ধ্বস, অতো বড় নয়, পাশ কাটিয়ে এগোলাম। এভাবেই ধ্বস কাটিয়ে কাটিয়ে পৌঁছলাম করোনেশন ব্রিজ, বাঘপোল। কালিঝোরা থেকে বাঘপোল মাত্রই সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। তার মধ্যেই ডজনখানেক ছোটবড় ধ্বস। ‘যেতে নাহি দিব, যেতে নাহি দিব’। ধ্বসের মাঝে মাঝেই আটকে পড়েছে অনেকগুলো গাড়ি। উৎরাই পথে কষ্ট কম, তবুও ঐটুকু পথ পেরোতেই সময় লাগলো প্রায় দেড় ঘণ্টা। ক্ষিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। পোলের মুখেই একটা ছোট্ট দোকান, শুধুই চা আছে, তাই দিয়েই বিস্কুটের প্যাকেটটা উদরস্থ করলাম।
করোনেশন ব্রিজের একপ্রান্তে দুটো বাঘের মূর্তি আছে তাই স্থানীয়রা একে বাঘপোল বলে। ব্রিজের একদিকে দার্জিলিং পাহাড় অন্যদিকে কালিম্পং পাহাড়, এখন পশ্চিমবঙ্গের দুই জেলা। দুটো পাহাড়কে চিরে ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুন্দরী তিস্তা।
কাঞ্চারা আর যাবে না। তারা বললো, একটু দাঁড়ালেই গাড়ি পাওয়া যাবে। তাদের কিছু টাকা দিয়ে ছেড়ে দিলাম। গাড়ীর জন্যে অপেক্ষা করতে বসে পড়লাম চায়ের দোকানের বেঞ্চে। সেখানেই, চা খেতে খেতে আলাপ হলো আমারই বয়সী তিনটি ছেলের সঙ্গে। তারা জলপাইগুড়ি রেলওয়ে কলোনির বাসিন্দা, গ্যাংটক গিয়েছিল বিশ্বকর্মা পুজোর আলো লাগাতে। মালিক ও তার দুই কর্মচারী। তারা বললো, গাড়ি পাওয়া মুশকিল। প্রচুর গাড়ি আটকে পড়েছে আর অন্যগুলো সদ্য শিলিগুড়ি গেছে, তিন ঘন্টার আগে ফিরতে পারবে না। তাই তারা হেঁটেই এগোবে। পথে কোন গাড়ি পেলে ভালো। তারা আমায় আশ্বাস দিলো, ট্রেন ছেড়ে গেলেও তারা আমায় রকেট বাসে ব্যবস্থা করে দেবে।
চা-ওয়ালা দুজন লোক ঠিক করে দিলো, যারা মাথায় করে আমার সুটকেস দুটো পৌঁছে দেবে, কিন্তু দুজনে পাঁচশো টাকা নেবে। খুবই বেশি, কিন্তু নান্য পন্থা। মনে রাখবেন সেই সময়ে ব্যাঙ্কের একজন প্রোবেশনারী অফিসারের মাইনে ছিল মাসে ৮৫০/ টাকা।
রাস্তায় আর কিছুই পেলাম না। পায়ে হেঁটে ১৬ কিলোমিটার দুরের সালুগাড়া পৌঁছতেই সাতটা বেজে গেল। ট্রেন ধরা আর সম্ভব নয়। ফলে শিলিগুড়ি বাস আড্ডা থেকে রকেট বাসে চেপেই বিশ্বকর্মা পুজোর সকালে কলকাতা পৌছলাম।
‘যেতে আমি দিব না তোমায়’?
হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে।’
What's Your Reaction?
Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks trade analyst. In the course of his job, he had been posted all across the eastern and northeaster states. He has a great passion for writing. He has written many deeply touching stories about the common men and women he got to meet during his tenure. He is also a specialist contrarian amateur historian especially on issues like the history of Bengal and of the Bengal Renaissance.