Now Reading
জগদ্ধাত্রী -অহংনাশিনী

জগদ্ধাত্রী -অহংনাশিনী

Avatar photo
জগদ্ধাত্রী পুজো

জগদ্ধাত্রী পুজো পশ্চিমবঙ্গের হুগলি, নদীয়া, ও উত্তর ২৪ পরগনার মানুষের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। শ্যামনগরের, চন্দননগর, কৃষ্ণনগর, ভদ্রেশ্বর, ইছাপুর সহ বিভিন্ন স্থানে জগদ্ধাত্রী পুজো বড় পরিসরে পালিত হয়। এই পুজোয় দেবীর মঙ্গলময়ী রূপ এবং আলোর সাজ সমারোহ সকলের মন জয় করে। আসুন, জগদ্ধাত্রী পূজার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ভ্রমণে আপনাকে স্বাগত।

আমরা যারা একটু মফস্বলের দিকে থাকি মানে হুগলি, নদীয়া বা উত্তর ২৪ পরগনার মানুষেরা তাদের কাছে জগদ্ধাত্রী পুজো চারদিন ব্যাপী চলা একটি অন্যতম উৎসব। মায়ের জগৎময়ী রূপ ও আশীর্বাদের অপেক্ষায় আমরা দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর মতোই সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি। যদিও আমাদের কলকাতা ও বঙ্গদেশের দিকে দিকেই এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। জগদ্ধাত্রী পুজোয় দুর্গাপুজোর মতনই ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী তিথি থাকে। কিন্তু স্থান বিশেষে কোথাও কোথাও দেবীকে দুর্গাপুজোর মতনই চারদিন পুজো করা হয় (যেমন চন্দননগর বা উত্তর 24 পরগণায়) আবার কোথাও দেবীকে নবমী তিথিতেই চার তিথির পুজো পুজো একসাথে করা হয় (যেমন কৃষ্ণনগর)।পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর ও হুগলি জেলার চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর, মানকুন্ডু, গুপ্তিপাড়া, নদীয়া জেলার শান্তিপুরের সূত্রাগড় অঞ্চল ,উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ইছাপুরের নবাবগঞ্জ অঞ্চল, শ্যামনগরের মূলাজোড় জগদ্ধাত্রী উৎসবের জন্য জগদ্বিখ্যাত।

দেবী পুজোর প্রারম্ভের ইতিহাসটা একটু ছোট্ট করে বর্ণনা দেওয়া যাক –

জগদ্ধাত্রী কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের প্রাণাত্মিকা। কিন্তু এই জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কি তা নিয়ে রয়েছে বহু মতান্তর। ইদানীং কালে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি তথা নদীয়ার ব্রাহ্মশাসন গ্রামের কাহিনী অনুসারে ও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মতে- এই পূজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০ খৃষ্টাব্দ) দ্বারা শুরু হয়েছে। তিনি নাকি তৎকালীন নবাবের আলীবর্দী খাঁ এর কাছে কর দিতে না পারার কারণে বন্দী হন। এরপর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র যখন ছাড়া পান তখন কৃষ্ণনগর ফেরার সময় দেখতে পান যে দুর্গা দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের প্রক্রিয়া চলছে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মানসিকভাবে প্রচন্ড আঘাত পান যে দুর্গাপুজোয় মাতৃ প্রতিমার মুখ দর্শন করারও সুযোগ পেলেন না।এরপর তিনি তার রাজবাড়ীতে ফিরে সেই রাতেই স্বপ্ন দেখেন যে দেবী দুর্গার মতই এক চতুর্ভুজা দেবী মূর্তি তাকে আদেশ দিচ্ছেন যে একমাস পরে কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে তিনি যেন এই দেবীর পুজোর আয়োজন করেন। সময়কাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনুমানিক সূচনাকাল সর্বপ্রথম কৃষ্ণনগরে। এর পর চন্দননগর বা অন্যান্য স্থানে জগদ্ধাত্রীপূজার সূচনা হয়। তৎকালীন চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ, যা ফরাসডাঙ্গা নামে পরিচিত ছিল।

চন্দননগরের ফরাসীদের দেওয়ান ইন্দ্র নারায়ন চৌধুরী, কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজোয় অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথম চন্দননগরে পুজো শুরু করেন। বর্তমানে যা জগৎ বিখ্যাত। এছাড়াও আরও একটি মতামত রয়েছে শান্তিপুরের তন্ত্রজ্ঞ সাধক, চন্দ্রচূড় তর্ক শিরোমণি নিজের পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে প্রথম মা জগদ্ধাত্রীর রূপ দেখতে পেয়েছিলেন, এবং আজও সেখানে মা জগদ্ধাত্রী তন্ত্র মতে পূজিত হন। এছাড়াও মতভেদে, বঙ্গ তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বংশধর রঘুনাথ আগমবাগীশ ১৬১০ শতাব্দে বা ১৬৮১খৃষ্টাব্দে প্রায় ১৬০ টি তন্ত্র ও প্রায় শতাধীক বেদ বেদান্ত পুরাণাদি গ্রন্থ মন্থন করে রচনা করেন “আগমতত্ব বিলাস” নামক এক অনর্ঘ্য মহাপুস্তক। সেই পুস্তকে স্পষ্টতই জগদ্ধাত্রী দেবীর সম্পূর্ণ মূর্তিবিবরণ, পূজাকাল, পূজা পদ্ধতি, পূজার বীজ মন্ত্র,দীক্ষাবিধি সব সুনিপুণ ভাবে বিস্তৃত উল্লেখ করেছেন।

এবার একটু পুরান মতে দেবীর আবির্ভাব দেখে নেওয়া যাক –

দেবী ভাগবত পুরাণ ও অন্যান্য পুরান মতে উল্লিখিত একটি উপাখ্যান অনুসারে : একবার দেবাসুর সংগ্রামে দেবগণ অসুরদের পরাস্ত করলেন। কিন্তু তারা বিস্মৃত হলেন যে নিজ শক্তিতে নয়, বরং ব্রহ্মের বলে বলীয়ান হয়েই তাদের এই বিজয়। ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও চন্দ্র – এই চার দেবতা অহংকার-প্রমত্ত হয়ে নিজেদের ঈশ্বর মনে করতে শুরু করলেন। তারা বিস্মৃত হলেন যে দেবতা হলেও তাদের স্বতন্ত্র কোনও শক্তি নেই – মহাশক্তি পার্বতীর শক্তিতেই তারা বলীয়ান। দেবগণের এই ভ্রান্তি অপনয়নের জন্য দেবী পার্বতী একটি বালিকা রূপে দেবগনের সামনে প্রকট হলেন। তিনি একটি তৃণখণ্ড দেবতাদের সম্মুখে পরীক্ষার নিমিত্ত রাখলেন। বরুন,অগ্নি ও বায়ু তাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও সেই তৃণখণ্ডটিকে দগ্ধ বা বিধৌত বা ভস্ম করতে পারলেন না। তখন দেবগণ অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে  ইন্দ্রকে বালিকার পরিচয় জানবার নিমিত্ত প্রেরণ করলেন। ইন্দ্র অহংকার-প্রমত্ত হয়ে বালিকার কাছে আসেননি, এসেছিলেন জিজ্ঞাসু হয়ে। তাই বালিকা তার সম্মুখ হতে তিরোহিত হলেন ও কোটি সূর্যের তেজ ও কোটি চন্দ্রের প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন তখন দেবগণ নিজেদের ভুল উপলব্ধি করলেন।তখন দেবী তার তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলেন। এই মূর্তি ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী ও দেব-ঋষিগণ কর্তৃক অভিবন্দিতা এক মঙ্গলময়ী মহাদেবীর মূর্তি। সমগ্র জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে দেবী দেবগণকে এই মূর্তি দেখালেন; দেবগণও তার স্তবে প্রবুদ্ধ হলেন। এই দেবীই পুরাণে জগদ্ধাত্রী নামে পরিচিতি লাভ করেন। জগদ্ধাত্রী অর্থাৎ জগৎ কে ধারণ যিনি করেন। জগদ্ধাত্রী হিন্দু শক্তি দেবী। ইনি দেবী দুর্গার (পার্বতী) অপর রূপ। উপনিষদে তার নাম উমা হৈমবতী। বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও জগদ্ধাত্রী আরাধনা বিশেষত বঙ্গদেশেই প্রচলিত। কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় মানসে রাজসিক দেবী দুর্গা (পার্বতী) ও তামসিক কালীর পরেই স্থান সত্ত্বগুণের দেবী জগদ্ধাত্রীর।

বন্ধু সুদীপ্ত চন্দর বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো
বন্ধু সুদীপ্ত চন্দর বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো | প্রতিমা শিল্পী- চায়না পাল ( কুমোরটুলি ), সাজ – সৌর্য সিংহ।

তত্ব কথা তো অনেক হলো এবার মূল আকর্ষণের কথায় আসি-

আগেই বলেছি যে কৃষ্ণনগরে মা জগদ্ধাত্রী শুধুই নবমীর দিন পূজিত হন, এই নবমীর দিনে দেবীকে ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী এবং নবমী তিথির পুজো একসাথেই করা হয়। পরের দিন দশমী তিথিতে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। কৃষ্ণনগরে রাজবাড়ির ঠাকুর তো বিখ্যাতই তার সাথে কৃষ্ণনগরের কোল আলো করে রয়েছেন মা বুড়িমা। আড়াইশো বছর ধরে মা বুড়িমা কৃষ্ণনগর বাসীর তথা বঙ্গবাসীর মনস্কামনা পূরণ করে চলেছেন। বুড়িমার পুজো এবার 252 বছরে পদার্পণ করল। কৃষ্ণনগরের নিরঞ্জনও দেখার মত বিষয়, এখানে দেবীকে কাঁখে করে অর্থাৎ কাঁধে করে গঙ্গায় নিরঞ্জনের প্রক্রিয়া আজও চলছে।

See Also
Justice

চন্দননগরের রানী মা
চন্দননগরের রানী মা

চন্দননগরের পুজোর বিশেষত্ব হল এখানে মা জগদ্ধাত্রীকে দুর্গাপুজোর মতনই চারদিনব্যাপী পুজো করা হয় এবং দশমীর দিন নিরঞ্জন হয়। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো জগৎবিখ্যাত এখানের আলোর মেলা ও মায়ের ডাকের (থার্মোকল) সাজের জন্য। এই আলোর মেলার মধ্যেও চন্দননগরের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হলেন শিব মন্দির তেমাথা (জ্যোতির মোড়) -র অধিষ্ঠাত্রী ‘মা রানীমা’। যেখানে চন্দননগরের বেশিরভাগ প্রতিমাই ডাকের সাজে সজ্জিত সেখানে এই রানীমা-ই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তিনি সোনালী আভরণে সজ্জিতা। তাই ভক্তকুল তার নাম দিয়েছেন “চন্দননগরের রানী মা “। এছাড়াও বাগবাজার, বড়বাজার, ফটকগোড়া এবং আরো অনেক পুজোই বিখ্যাত। তবে শুধু চন্দননগর নয় তার সংলগ্ন মানকুন্ডু ও ভদ্রেশ্বরেও অসংখ্য জগদ্ধাত্রী পুজো জাজ্বল্যমান। এরমধ্যে ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলায় মা জগদ্ধাত্রী আদি-মা রূপে পূজিত হন। চন্দননগরে দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের কার্নিভাল, পশ্চিমবঙ্গের প্রথম নিরঞ্জন-কার্নিভাল। অধুনা সময়, এখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে কলকাতায় দুর্গাপুজোর কার্নিভাল অনুষ্ঠিত হয়।

বড়বাজার, চন্দননগর
বড়বাজার, চন্দননগর
বাগবাজার, (চন্দননগর)
বাগবাজার, চন্দননগর

হুগলি নদীর এপারে উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দল, শ্যামনগর, ইছাপুর এই অঞ্চলগুলোতেও জগদ্ধাত্রী পুজোর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

মূলাজোড় বড়বাড়ি, শ্যামনগর
মূলাজোড় বড়বাড়ি, শ্যামনগর

দুর্গাপূজো শেষ হয়ে গেলেও আমরা এই অঞ্চলের মানুষরা জগদ্ধাত্রী পূজার অপেক্ষায় বসে থাকি, আমাদের প্রতিবেদন ভালো লাগলে সকলকে অনুরোধ রইল অবশ্যই একবার চন্দননগর তথা হুগলি এবং উত্তর চব্বিশ পরগনা আর অবশ্যই নদীয়াতে কৃষ্ণনগর ও শান্তিপুরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আনন্দে সামিল হবার জন্য। আসলে আমাদের বাঙালিদের তো বারো মাসে তেরো পার্বণ।

What's Your Reaction?
Excited
2
Happy
1
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top