আমি বুকুন



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
সাধারণ, অতি সাধারণ পরিবারের ছোট্ট ছেলে বুকুন। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের দোড়গোড়ায় পৌঁছেই জীবনের কঠিন ও কাঁটা ছড়ানো পথে হাঁটতে বাধ্য হয়। কি সেই পথ? কেনই বা সেই পথে এসে পড়া? আদৌ কি সে পথের শেষে কোন আশার আলো আছে? এই নিয়ে গল্প “আমি বুকুন”। কলমে: রাজ কুমার মুখার্জী।
এক ছুটে রাস্তার এপারে চলে এসেছি। চোখ দুটো ভালো করে কচলে নিলাম। মা আমাকে জোর করে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে দিলো। মা চৌকির তলায় ট্রাঙ্কের ভেতর কি যেন খুঁজছে- মা এখনো ঘরের ভিতরে। ঘরের চালটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে গেল। আমাদের ঘরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে।
আমি অর্ক মাইতি। এখানে সবাই আমাকে বলে অক্কো। আমি যতো বলি অক্কো নয়, অক্কো নয় – অরকো। ওরা বুঝতে পারে না। আমার বাবা-মা অবশ্য আমাকে বলে ‘বুকুন’। আমি ক্লাস ফোর অবধি পড়েছি। তারপর আর স্কুলে যাইনি। আমার কত বয়স আমি ঠিক জানিনা। সেদিন মা আমাদের পাশের ঘরের সবিতামাসি কে বলছিল “সামনের বোশেখে আমার দশ পুরে এগারো হবে।” আরজিকর হাসপাতালের পাশে যে বস্তি আছে, আমরা পাঁচ ছয় মাস হলো সেখানে এসেছি। আগে থাকতাম রাজারহাটে একটা মস্ত উঁচু বাড়িতে-‘অজন্তা’। বাড়িটা খুব উঁচু দশ তলায় ছাদ। ঐরকম তিনটে পর পর বাড়ি ছিল। একটা বাড়ির ছাদ থেকে অন্য বাড়ির ছাদে যাওয়া যেত-‘কাই ওয়াক।’
আমার বাবা ওই বাড়িতে কাজ করতো, বাড়িটার মস্ত লোহার গেটের পাশে নীল জামা, কালো প্যান্ট, কালো টুপি পরে একটা কাঁচের ঘরের মধ্যে বসে থাকতো। বাবার সঙ্গে অনিল কাকু, শ্যামল কাকু, বনি মাসি, রেখা মাসি- সবাই ঐরকম পোশাক পরে বসে থাকতো। নতুন কেউ এলে, একটা খাতায় তার নাম লিখতে হতো। তারপর বাবার পাশে রাখা ফোন থেকে বাবা ফোন করতো। এতসব হওয়ার পর অনিল কাকু নয়তো বনি মাসী, কেউ একজন লিফটে করে ওপরে পৌঁছে দিত।
আমরা থাকতাম এই বাড়ির পেছন দিকে, যেখানে পাম্প ঘর আছে, ঠিক তার পাশে। আমি, মা, বাবা। কাছেই একটা ইস্কুলে ভোরবেলা যেতাম। পিঠে ব্যাগ, গলায় জলের বোতল। বাবা আমাকে পৌঁছে দিত, মা নিয়ে আসতো। এই বাড়িতে অনেক লোক থাকে। কোন লোক কত নম্বর ফ্ল্যাটে থাকে-আমি সব জানতাম। আমার ইস্কুলে ভালো লাগত না। বাড়িটা আমাদের খুব সুন্দর।
আমার মা এখানে ব্লক এ, সেভেন ই ফ্ল্যাটে দাদু দিদার ঘরে রান্না করে। আমি মাঝে মাঝে মা’র সঙ্গে যাই। দিদাটা খুব ভালো, আমায় কত কিছু খেতে দেয়-কেক, বিস্কুট। দিদাদের বড় টিভিতে কাটুন চালিয়ে দেয়। আমি মেঝেতে বসে দেখি। দাদু আমার কাছে এসে সোফায় বসে বলে। “কি বুকুন বাবু, ইস্কুলে যাচ্ছ তো?” দাদু সবসময় বই পড়ে। দাদুর কত বই-ইয়া মোটা মোটা। মা মাঝে মাঝে দিদার ঘর থেকে দারুন সব খাবার আনে-সন্দেশ, চপ আরও কত কি! আমি সবার নামই জানিনা। তবে যেদিন দিদা দাদুর কাছে কেউ বেড়াতে আসে, পরের দিন দিদা মাকে খাবার দেয়। মা বলে দিদা নাকি বলেছে “বুকুন বাবুকে দিও।” আমি বাবা-মা সবাই মিলে খাই।
বেসপতিবার, মা গলায় আঁচল পেঁচিয়ে দুপুরবেলা লখ্খী পূজো করে। একটা বই আছে, ওপরে লখ্খী ঠাকুরের ছবি। ওইটা দেখে মা দুলে দুলে পড়ে। আমি পাশে চুপ করে বাবু হয়ে বসে শুনি। মার পুজো শেষ হলে, উপুড় হয়ে নমস্কার করে, গুঁজিয়া দুটো আমার হাতে দেয়। ওই লোভে আমি চুপ করে বসে থাকি।
দুপুরে ভাত খেয়ে আমি খেলি-একা একা, সারা বাড়ি জুড়ে। কোন কোন দিন লিফটে চড়ে ছাদে চলে আসি। লিফটের সামনে একটা কাঁচের দরজা আছে, দাঁড়ালেই নিজে থেকে খুলে যায়-কি মজা। বাড়ির সব ফ্ল্যাটের দরজা তখন বন্ধ থাকে। সবাই ঘরে ঘুমায়। এই ফাঁকে ছাদে উঠে এলে আমায় কেউ দেখতে পাবে না। ছাদের পাঁচিল খুব উঁচু-পাশ দিয়ে কিছু দেখা যায় না। মাথার উপরে কত্তো বড় আকাশ-এই এত্তো বড়ো। এরোপেলেন উড়ে যায়। আমি তাকিয়ে থাকি; আমার পাখির মত উড়তে ইচ্ছে করে, দুপাশে ডানা ছড়িয়ে, আকাশে ভেসে যাব। ওই অত উঁচু থেকে কিরকম দেখতে লাগে। কি জানি!
এই বাড়িতে ছোটদের খেলার জন্য একটা মাঠ আছে-দোলনা, ঢেউ কুচকুচ। ওখানে ফ্ল্যাটের ছোটরা খেলে। আমি দুপুরবেলা খেলি, যখন কেউ থাকেনা। দোলনা চড়ি, সিলিপে চড়ি। আমার এরোপেলেন এরোপেলেন খেলার চাইতে কোন খেলা ভালো নয়। হাত দুটো দু’পাশে সোজা রেখে, ভোঁ করে ছুটে যাওয়া। আমি এক দৌড়ে নিচের বেসমেনে চলে যাই।ওখানে এক চক্কর লাগিয়ে উপরে উঠে চলে আসি। উপরে উঠে আসার সময় মনে হয় আমি নিজেই এরোপেলেন হয়ে অনেক উপরে উঠে যাচ্ছি। এইরকম একদিন খেলতে খেলতে দেখি, নিচের বেসমেনে, ব্লক বি, ফাইভ সি’র দাদাটা থি বি’র দিদিটার ঠোঁটে হামি খাচ্ছে। ওরা ওখানে দাঁড়িয়ে হামি খাচ্ছি কেন? আমি এক দৌড়ে ঘরে এসে মার পাশে শুয়ে পড়েছি। মার গায়ে একটা কিরকম মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। আমার খুব ভালো লাগে। মার ঘুম ভেঙে গেলো। মা আমাকে কাছে টেনে, জড়িয়ে ধরে, শুয়ে রইল। আমি মাকে বললাম
–মা, ওমা, মা!
–হুম।
–মা, জানোতো, নিচের বেসমেনে, ওই ফাইভ সির দাদাটা, থি বির দিদিটাকে হামি খাচ্ছে।
–আমিও তো তোমাকে আমি খাই, কি খাই না–
বলেই আমাকে একটা হামি খেয়ে নিল।
–না মা, এই হামিটা নয়, অন্যরকম হামি।
–তুমি এখন বুঝবে না সোনা, তুমি তো ছোট, বড় হও সব বুঝতে পারবে।
–কত বড় মা? ফাইভ সির দাদাটার মত?
কখন যে মার কোলের কাছে ঘুমিয়ে পড়লাম……।
এ বাড়িতে অনেক কাজের পিসিরা দিদিরা আসে। বাবার কাছে কাড দেখিয়ে ভেতরে আসে। যাবার সময় বনি মাসি, সবিতামাসি ওদের ব্যাগ, থলি সব ঘেঁটে দেখে। সবার নাম লিখতে হয়। যেদিন রবিবার, ফ্ল্যাটের সবাই থাকে, যেদিন দুপুরে কত গাড়ি থাকে। লাল, কালো, নীল, সাদা কত বড় বড় গাড়ি! কি চকচক করে, আয়নার মতো। আমি নিজেকে দেখতে পাই। কোন গাড়িতে নিজেকে লম্বা লাগে, কোনটাতে ছোট। আমি ওই গাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে একা একা লুকোচুরি খেলি। এইরকম এক রবিবার দুপুরে, আমি একা একা খেলছি, যমুনা দিদি, এ বাড়িতে তিনটে ঘরে কাজ করে, খুব সেজে আসে, আমায় খপ করে ধরেছে। আমার যমুনা দিদিকে খুব বিচ্ছিরি লাগে। জাপটে ধরে, চটকায়। আমাকে ধরেই বলে “বুকুনবাবু, আজ তোমার লঙ্কা টা দেখবো।” ওমা! আমার ইজের ধরে টানতে শুরু করে দিয়েছে। আমিও দিয়েছি হাতে কামড়ে। এক দৌড়ে মার কাছে চলে এসেছি। মাকে সব বলে দিয়েছি। তারপর মা আর যমুনা দিদির কি ঝগড়া!
আমি আর বাবা একদিন একসঙ্গে দুপুরে ভাত খাচ্ছি। বাবা গল্প বলছে, মা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। অনিল কাকু বাবাকে ডেকে নিয়ে গেল। বাবা যে ঘরটায় বসে, ওখানে বনিমাসি একজন কাজের দিদিকে আটকে রেখেছে। কাজের দিদিটা কি সব যেন নিয়ে চলে যাচ্ছিল, খুব হই হই হচ্ছে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। মা বললো।
–বড়দের কথায় থাকে না সোনা, তুমি ঘরে এসো।
আমি ঘরে চলে এলাম। আমার দেখা হলো না।
ইস্কুলের বইতে একটা গল্প আছে-ধলেশ্বরী নদী, ইছামতি নদী, নৌকা, মাঝি, আরো কত কি। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি,”বাবা নদী কিরকম দেখতে?” বাবা আমাকে নদীর গল্প বলেছে, বাবাদের গ্রামে একটা মস্ত নদী আছে-‘কেলেঘাই’। কি মজার নাম! বাবা বলেছে একদিন বাবুঘাটে নিয়ে যাবে, আমাকে আর মাকে। আমাদের নদী দেখাবে, নৌকা চড়াবে। আমি ভাবি বাবুঘাট কি অনেক দূরে? আমরা কবে যাব? একদিন সন্টু দাদাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ওহ! তুমি তো সন্টু দাদাকে চেনোই না। আমাদের বাড়ির গেটের উল্টো দিকে ফুটপাতে, যেখানে আমার মতন আরও অনেকে বসে পড়ে, ওইখানে সন্টু দাদা, মলয় দাদা, মৌ দিদি, পড়ায়। মৌ দিদি কি ভালো গল্প বলে। টুনটুনির গল্প, ব্যঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প। কোনদিন মুড়কি মুড়ি, কোনদিন ছোলা ভাজা মুড়ি, কোনদিন বাদাম মুড়ি, কোনদিন চানাচুর মুড়ি, আমাদের খেতে দেয়। আমার বাদাম মুড়ি খেতে খুব ভালো লাগে। পড়া শেষ হয়ে গেলে বাবাকে ডাক দেয় ‘বিকাশ কাকু হয়ে গেছে, বুকুনকে নিয়ে যান।”
যে মাঠে ছোটরা বিকেলে খেলে, সেই মাঠে সন্ধ্যেবেলায় দাদুগুলো চেয়ার পেতে বসে গল্প করে। জোরে জোরে কিসব বলে, আমি বুঝতে পারিনা। সেভেন ই’র দাদু আসে, তবে কম। আমি ঘরে ঢুকে মার পাশে বসে পড়ি, ইস্কুলের পড়া। মা রুটি করে। আমরা রাতে রুটি খাই। আমার ঘুম পেয়ে যায়, মা রুটি ছিঁড়ে, তরকারি দিয়ে, জোর করে খাইয়ে দেয়। রোজ এক কথা বলে “খেয়ে নাও বুকুনসোনা, গায়ে গত্তি লাগবে, তোমাকে বড় হতে হবে।” আমি একটা নতুন কথা শিখি ‘গত্তি’। রোজ ভাবি মাকে জিজ্ঞেস করবো-‘গত্তি’ মানে কি? ঘুমিয়ে পড়ি, ভুলে যাই। সেদিন অনেক রাত্তিরে আমার ঘুম ভেঙে গেছে, মা পাশে নেই, আমার ভয় করছে। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। মার গলা পাচ্ছি। কি যেন বলছে বুঝতে পারলাম না ঘুমিয়ে পড়লাম পরের দিন মাকে বললাম “মা, কাল তোমার কি হয়েছিল?” মা হেসে বলল “কখন সোনা?” আমি বললাম ” রাত্তিরে, অনেক রাত্তিরে, তুমি আমার পাশে ছিলে না-তখন।”
মা একগাল হেসে, আমায় জড়িয়ে ধরে বলল “কিছু হয়নি সোনা তুমি স্বপন দেখেছো।” কি জানি, হবে হয়তো!
একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি গেটে খুব গন্ডগোল। যমুনা দিদি কয়েকজন লোক নিয়ে খুব চিৎকার করছে। আমি মার হাত ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। বাবা, অনিল কাকু, শ্যামল কাকু, গেটে তালা দিয়ে ভেতরে বসে আছে। লোকগুলো কেন চিৎকার করছে জানিনা। কোন কথা বোঝা যাচ্ছে না। আরো অনেকে দাঁড়িয়ে দেখছে। ওখানে একটা নতুন কথা শুনলাম ‘আশনাই’। অনেক বাদে সবাই চলে গেল। আমি, মা ঘরে এলাম। আজ আমার আর খেলা হবে না। রাত্তিরে খেতে বসে মাকে জিজ্ঞেস করলাম
–মা ‘আশনাই’ মানে কি?
মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি এসব কথা কোথায় শুনলে?
–কেন সকালে যে ওই লোকগুলো বলছিল?
মা আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললে
–বুকুন সোনা তো আমার ভালো ছেলে, সোনা ছেলে, ওগুলো খারাপ কথা বাবা, তোমায় জানতে হবে না।
বাবার যে কবে ছুটি থাকতো, আমি হিসেব করতে পারতাম না। কখনও সোমবার, কখনও বুধবার, কখনও রবিবার। বাবার ছুটির দিন যদি আমার ইস্কুল ছুটি থাকে, বেশ মজা হয়। আমি আর বাবা বাজারে যাই। মাংস, ডিম। মা খুব ভালো ডিম রান্না করে। ডিমটা সুতো দিয়ে দু টুকরো করে বাবা আর মা খায়। আমি একটা গোটা ডিম খাই। বিকেলে বাবা-মা আমি দূরে বল খেলার মাঠে যাই। বাবা মা ঘাসের উপর বসে থাকে, আমি এক ছুটে কতদূর চলে যাই। বাবা পেছন থেকে ডাকে, “বুকুন, আর না, আর না।” বাবা হাত তোলে, আমি সেই হাত দেখে আবার এক ছুটে বাবার কাছে চলে আসি। বাবা, মাকে আলুকাবলি কিনে দেয়, ঝালমুড়ি। আমি মার পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে, ঝালমুড়ি, আলুকাবলি খাই-বড্ড ঝাল। বাবাকে বলি
–বাবা, আমাদের নদী দেখাবে না? নৌকা চড়াবে না?
–নিয়ে যাব বাবা, ঠিক একদিন নদী দেখাতে নিয়ে যাবো।
এ বাড়িতে আমার একজনের সঙ্গে খুব ভাব, রাজু দাদা। রাজু দাদা ব্লক এ সেভেন সি’র গাড়ি চালায়। আমাকে একদিন অনেক দূর গাড়ি করে বেড়াতে নিয়ে গেছিল। গাড়িতে বসিয়ে, সিট বেল্ট লাগিয়ে দিলো। গাড়িতে গান বাজে, কি জোরে গাড়িটা যাচ্ছিল। আমার এরোপেলেনের চাইতেও জোরে। রাজু দাদা বলেছে আমি বড় হলে, আমায় গাড়ি চালানো শিখিয়ে দেবে। আমি তখন বাবা মাকে পেছনে বসিয়ে গান চালিয়ে সাঁই সাঁই করে গাড়ি চালাবো। আমাদের বাড়ির কাছে যে তেলের দোকানটা আছে, রাজু দাদা যখন একা ওখানে গাড়ি নিয়ে তেল ভরতে যায়, আমায় সঙ্গে নিয়ে যায়। বাবাকে বলে “বিকাশ কাকা, বুকুনকে নিয়ে গেলাম।” সেভেন সি’র বাবুরা এসব জানে না।
আমাদের বাড়িতে খুব বড় দুর্গাপূজা হয়। কত বড় ঠাকুর, লাইট, প্যান্ডেল, গান, নাচ – কত মজা হয়। আমি দূর থেকে দেখি। ফ্ল্যাটের সবাই কি দারুন জামা প্যান্ট পরে, শাড়ি, ধুতি। আমার সব্বাইকে নতুন মনে হয়। বড় বড় কড়া আসে, চেয়ার, টেবিল, বামুন। কত বড় উনুন, কত রান্না হয়। আমাদের লিফট গুলোর পাশে যে বিরাট ঘরটা আছে, ওইখানে সবাই বসে খায়। কি হই হই। বাবা, আমার আর মার জন্য খাবার নিয়ে আসে বাক্স করে। লুচি, পোলাও, মাংস, রসগোল্লা, চপ। রাতে গান নাচ শেষ হয়ে যাবার পর, সবাই যখন ঘরে চলে যায়, কজন বাবু একসঙ্গে বসে গল্প করে। গেলাসে কি যেন ঢেলে ঢেলে খায়-সঙ্গে চানাচুর, মাংস। পরে জেনেছি ওটাকে মদ বলে। মা তখন আমাকে ঘরে ডেকে নেয়। এবার পুজোয় আমার দুটো জামা প্যান্ট হয়েছে। একটা বাবা দিয়েছে আর একটা সেভেন ই’র দিদা। এবার পুজোতে ঢাকি কাকুর সঙ্গে আমার মতো একটা ছেলে এসেছিল। ওর নাম সত্য। আমরা খুব বন্ধু। আমি সত্যকে লিফটে চড়িয়ে ছাদে নিয়ে গেছি। সত্য আগে কখনো লিফটে চড়েনি। ওদের গ্রামে এত উঁচু কোন বাড়ি নেই। সত্য আর আমি, আমাদের ঘরে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমাতাম। পুজোয় সত্যর নতুন জামা হয়নি। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম “মা সত্যর নতুন জামা হবে না?”
মা কোন কথা বলেনি। যেদিন সত্য চলে যাচ্ছিল, এইট ই’র বাবুরা সত্যকে একটা পুরনো প্যান্ট আর একটা গেঞ্জি দিল। আমি আর সত্য রোজ দুপুরে এরোপেলেন এরোপেলেন খেলতাম। এক দৌড়ে বেসমেনে গিয়ে আবার উপরে উঠে আসা। সত্য ওদের গাঁয়ে আমাকে যেতে বলেছে। এখন ওদের গাঁয়ে সাদা সাদা কাশফুল ফুটে আছে। সাদা বক মাঠে এসে বসে, পোড়ামাটির পুতুল তৈরি হয়-ঘোড়া, বর-বৌ আরো কত কি? গাঁয়ের পদ্দ দীঘিতে ফুলের মাথায় সাপ নাচে, জেলেপাড়ায় মাছের ঝাল বোনা, শিলাবতী নদীতে পালতোলা নৌকা-সব দেখাবে বলেছে। আমার খুব সত্যদের গ্রাম দেখতে ইচ্ছে করে। মাকে একদিন রাতে শুয়ে শুয়ে বললাম
–মা, সত্যদের গাঁয়ে যাবে? চলো না মা, আমরা বেড়াতে যাই। কাশফুল পালতোলা নৌকা…….।
মা যে কি বলে, মনে নেই। ঘুমিয়ে পড়লাম।
কালী পূজার পরে একদিন সকালে খুব হই হই আমাদের ঘরের সামনে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। ব্লক এ, সেভেন সি’র মোটা বাবুটা আর তার বউ খুব চেঁচাচ্ছে। বউটা মাকে খুব বকছে। হঠাৎ মা’র চুলের মুঠি ধরে মাকে এক চড় মারলো। আমি দৌড়ে গিয়ে বউটার পা জড়িয়ে ধরে বললাম
–আমার মাকে মেরো না!
–যা ভাগ, সোয়াআইন।
এই বলে আমায় এক লাথি মারলো। বাবা দৌড়ে এসে আমায় কোলে তুলে নিল। ব্লক সি, টু এর দাদাটা বাবার জামা ধরে ঝাঁকাতে লাগলো। ইংরেজিতে কি সব বলছিল। আমি কাঁদছি। শ্যামল কাকু, অনিল কাকু, সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে। কেউ কিছু বলল না। অনেক ফ্ল্যাটের অনেক দাদা, বউ, দিদি, বাবু, সবাই অনেক দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। পুলিশ এলো, ছেলে পুলিশ, মেয়ে পুলিশ। আমার বাবা মাকে ধরে নিয়ে গেলো। আমি কতবার পুলিশ কাকুকে বললাম “ছেড়ে দাও, আমি রাতে একা থাকতে পারি না, ভয় পাই।” শুনলো না। সেভেন ই’র দাদু পুলিশটাকে ইংরেজিতে কী সব বলছিল। আমার মা বাবা নাকি ওদের ঘর থেকে কি সব নিয়েছে, কি জানি, হবে হয়তো! আমি একা বাড়িতে রইলাম। একটা নতুন কথা শুনলাম ‘সোয়াইন’।
পরদিন দুপুরে সেভেন ই’র দাদু, বাবা আর মাকে নিয়ে এলো। বনি মাসী আমাকে বাড়ি থেকে ভাত এনে খাইয়ে দিয়েছে। অনিল কাকু, চা পাউরুটি খাইয়েছে, সেভেন-ইর দিদা আমায় ওপরে নিয়ে গিয়ে টিভিতে কাটুন চালিয়ে দিত, খেতে দিত। রাতে আমার খুব ভয় করত। আমি তো রোজ মার পাশে শুই। বাবা-মা যেদিন ফিরে এলো সেদিন রাতে মা ট্রাঙ্কে কাপড় ভরছিলো। পরদিন সকালে আমি বাবা-মা বাসে করে এখানে চলে আসি, আরজিকরের ধারের বস্তিতে। আসার আগে আমি আর মা, সেভেন ইর দিদার কাছে গেছিলাম। মা বললো “দিদাকে প্রণাম করো”। আমি পায়ে হাত দিলাম। দিদা কাঁদছিল। দাদু মাকে বলল “ভালো থাকিস মা, কখনো দরকার পড়লে এই বুড়ো বাপটাকে বলিস”। মা কাঁদছিল। আমরা নেমে এলাম।
এই বস্তিটা একদম পচা, আমার ভাল্লাগে না। সকাল থেকে রাত্তির সবাই ঝগড়া করে। ভীষণ নোংরা। আমাদের ঘরটা খুব ছোট, এখানে কোন বাতরুম নেই। ‘অ্যা’ পেলে নর্দমার উপরে বাঁশের ঘরের মধ্যে যেতে হয়। বিচ্ছিরি গন্ধ। রাস্তার কলে গামছা পরে চান করতে হয়। জল নিয়ে রোজ ঝগড়া হয়। আমি আর স্কুল যাই না। মা এক বাড়িতে রান্না করে, দু বাড়িতে বাসন মাজে। বাবা কিছু করেনা, ঘরে বসে থাকে। মাঝে মাঝে কাজ করে, কি কাজ, আমি জানিনা। বাবা আর আগের মতন নেই। আমাকে মারে, মার সঙ্গে ঝগড়া করে। রাতে মদ খেয়ে ঘরে আসে। একদিন মদ খেয়ে এসে মাকে মারলো, আমাকেও মারলো। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমি বড় হয়ে বাবাকে খুব বকবো। বাবা রেগে গেলে মাকে বলে ‘ছেনালী মাগী’। ‘মাগী’ কথাটা আমি জানি, এখানে এসে শুনেছি। ‘ছেনালী’ মানে জানিনা।
এখন আমার চারজন বন্ধু হয়েছে-রতন, মলু, ছোটু, দীপা। ওরাও আমার মত কেউ ইস্কুলে যায় না। ছোটুর বাবা বাগবাজারে মাছের দোকানে কাজ করে, ওরা নাকি রোজ মাছ খায়। ছোটুর মা সবসময় চেঁচায়। আমাদের ঘরে ঢুকতে দেয় না। আমরা ছোটুকে বাইরে থেকে ডাকি। দীপার একটা দড়িলাফ আছে। আমরা চারজনে একসঙ্গে খেলি। কখনো দুজনে একসঙ্গে লাফাই, কখনো একা একা। মলু একদিন লুকিয়ে ওর বাবার ফেলে দেয়া বিড়ি টেনে দেখেছে। কি কাশি হয়। রতন খুব ভালো গুলি খেলতে পারে। আমি পারি না। রতনের খুব টিপ। একদিন রতনকে জিজ্ঞেস করলাম
–তুই ‘আশনাই’ মানে জানিস?
–‘আশনাই’ হল লুড়লুড়ি।
–সেটা কি?
–ধুসস, তুই কিস্যু জানিস না। বড় হলে সব জানবি।
রতন আমার বন্ধু, রতন জানে, আমি জানি না। কেন? কি জানি? আমি তো অনেক কিছুই জানি না। আমি জানি না, আমাদের কেন রাজারহাট এর বাড়ি ছেড়ে এই বিচ্ছিরি জায়গায় চলে আসতে হলো?
একদিন মলুকে জিজ্ঞাসা করলাম
–তুই সোয়াইন মানে জানিস?
মলু খুব গম্ভীর হয়ে বললো
–ওটা ইংরেজি। খুব খারাপ গালাগাল।
আমিও তাই জানলাম।
এ ঘরের উঠোন ও ঘরের টাঙানো শাড়ির পাশ দিয়ে ছুটোছুটি করে আমাদের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা চলত। এমনি করেই সকাল থেকে রাত কেটে যেত। মা কি রকম হয়ে যাচ্ছিল। মা আর আগের মত সুন্দর নয়। তবুও মা যখন রাতের বেলা মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, আমার খুব ভালো লাগতো। মা কোন কথা বলতো না আমার দিকে শুধু তাকিয়ে দেখতো।
এবারে আমাদের বস্তিতে সরস্বতী পুজো হলো। ঠাকুর, লাইট, প্যান্ডেল, মাইক-রাজারহাট এর বাড়ির মতন নয়। ওখানে আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতাম, এখানে মাইকে গান বাজছে “চুরাকে দিল তেরা গুড়িয়া চলে”। আমরা চারজন খুব নাচছি। ঠাকুর মশাই হাতে ফুল দিল। কি শক্ত মন্তর। দুপুরে সবাই মাটিতে বসে শালপাতায় খিচুড়ি, বাঁধাকপি, চাটনি। রাতে বস্তির দাদারা সবাই একসঙ্গে মদ খেলো। বাবা ছিল না। বাবা অন্য কোথাও মদ খেয়ে, লাইন পার হতে গিয়ে মালগাড়িতে কাটা পড়লো। অনেক রাতে ঘরে এসে কে যেন বলে গেলো। বস্তির দাদারা সবাই বাবাকে আনতে গেলো। পরদিন দুপুরে দড়ির খাটে শুয়ে বাবা ঘরে এলো, মা খুব কাঁদছিলো। আমারও খুব কষ্ট হচ্ছিল। ভালোই হলো — আর বাবার কাছে মার খেতে হবে না। বস্তির দাদারা বাবাকে কাঁধে করে নিয়ে চলেছে, পেছনে পেছনে আমি, রতন, মলু। ওরা বাবাকে শ্মশানে নিয়ে এলো। আমি আগে কখনো শ্মশান দেখিনি, কত লোক। পাশ দিয়ে একটা বিশাল নদী। আমার ক্লাস ফোরের বইতে পড়ার মতো – ধলেশ্বরী নদী। বাবা বলেছিল নদী দেখাবে।
সুবলদা ডেকে নিয়ে গেল, বাবাকে মাটিতে শুইয়ে রেখেছে। আমাকে অনেকগুলো কাঠি হাতে দিলো, অন্যদিকে আগুন ধরানো। ঠাকুর মশাই মন্তর বলছে, আমি কাঠিগুলো নিয়ে বাবার পাশ দিয়ে ঘুরছি। ঠাকুর মশাই বললে বাবার মুখে আগুন ঠেকাও। আমি ঠেকালাম। বাবার ছেঁকা লাগবে না? আমার হাতে একবার গরম মোম পড়ে গেছিলো, কি জ্বালা করে। বাবার জ্বালা করবে না? কি জানি? হয়তো করবে! বাবাকে ওরা একটা লোহার বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল–ওটাকে চুল্লী বলে। আমি, মলু, রতন নদীর ধারে বসে বিস্কুট খাচ্ছি; সুবলদা দিয়ে গেলো। অনেক বাদে সুবলদা এসে আমার হাতে একটা মাটির বাটি দিলো। বাটির উপরে মাটি চাপা দেওয়া। কি গরম। আমায় হাত ধরে জলের কাছে নিয়ে এলো।
–অক্কো, জলে নাম, ভয় নেই আমি আছি।
আমি জলে নামলাম। কি ঠান্ডা জল। আমাদের টিপকলের জলের চেয়ে ঠান্ডা।
–নে, এবার সরাটা জলে ভাসিয়ে দে।
আমি বাটিটা জলে ভাসিয়ে দিলাম। আকাশ লাল করে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
–আমার হাতটা শক্ত করে ধর। আচ্ছা দাঁড়া, আমি তোর হাতটা ধরছি। নে, এবার ডুব দে। কি করে ডুব দেয় জানিস তো?
আমি মাথা নাড়লাম – না, আমি জানি না।
–চোক বন্দ করে, বসেই উঠে পরবি।
আমার খুব ভয় করছিল।
–কি রে ডুব দে! আমি তোর হাত ধরে আছি। ভয় নেই।
আমি চোখ বন্ধ করে জলের মধ্যে বসে পড়লাম। পা দুটো ভেসে উঠছে। নিজেকে কি রকম একটা লাগছে লিফটে নামার মতো। উঠে দাঁড়ালাম, সুবলদা আমার জামা প্যান্ট ছাড়িয়ে, একটা সাদা কাপড় পরিয়ে দিল। গলায় একটা চাবি। সুবলদার হাত ধরে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরে এলাম।
সবাই চাঁদা তুলে বাবার ছাদ্দো করলো। আমাদের ঘরের সামনে ঠাকুর মশাই কত জিনিস এনে পূজো করলে। আমি ন্যাড়া মাথায়, সাদা কাপড় পরে, মার পাশে বসে সব দেখছি। মা যাদের বাড়ি কাজ করে, সেখানে দিদারা সবাই এসেছিল। মাকে টাকা দিলো, আমার জন্য জামা প্যান্ট। আমার নতুন জামা প্যান্ট হলো। কি মজা। মা এখনো কাঁদে, আঁচলে চোখ মোছে।
মা আবার সকালে কাজে যায়। আমি আর ঘুরে বেড়াই না। ঘরে থাকি। ছোটু, মলু, দীপা, রতন আমায় ডাকতে আসে। আমার খেলতে যেতে ইচ্ছে করে না। আমি ঘরের সামনে উবু হয়ে বসে থাকি। আমাদের ঘরে, বাবার একটা ফটো আছে-বুক অবধি। নীল জামা কালো টুপি। ফটো থেকে মনে হয় বাবা আমাকে রোজ দ্যাখে। আমি শুনতে পাই বাবা আমাকে বলছে “কি রে বুকুন, তোকে বলেছিলাম না নদী দেখাবো — কি নদী দেখলি তো?”
মা সকালে কাজে যায় সন্ধ্যে হলে ফেরে, মা কোথাও আরো কাজ করে। মা রাত্তিরে খুব কাশে, আমি পাশে শুয়ে শুনতে পাই। মার গায়ে এখন আর ওই রকম মিষ্টি গন্ধ পাই না। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আমার খুব ইচ্ছে করে ইনকাম করতে। রতন, গলির মোড়ে চায়ের দোকানে কাজ শুরু করেছে। আমি যদি ওই রকম একটা কাজ পেতাম! মলু সামনের মাস থেকে একটা বাইকের দোকানে কাজ করবে। ছোটুর বাবা ছোটু কে টু বি বাসের ওখানে, একটা ভাতের হোটেলে কাজে লাগিয়ে দেবে বলেছে।
মা রাতে এসে রুটি করে, আলুর তরকারি। আমি এখন আর ঘুমিয়ে পড়ি না, নিজে নিজেই খাই। রাতে শুয়ে মা আমাকে বললো
–বাবা বুকুন, তোর বাবা তো আর নেই, তুই কিছু কাজ কর এবার।
–কি কাজ মা? বলো, আমি করবো।
–শোন আমি সুবলকে বলেছি। ও তোকে শিকিয়ে দেবে। ও ধম্মতলায় জুতো পালিশের বাক্স নিয়ে বসে, তুই পারবি না?
–আমি পারবো মা। আমার এখানে ভাল্লাগে না।
নতুন জায়গায় যাব আমার অন্যরকম লাগে — ঠিক আনন্দ নয়। অন্যরকম। মা আরো কি সব বলছিল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
কাল রাতে মা কাজ থেকে ফিরে ডিমের ঝোল আর রুটি করছিলো। রাতে আমি, মা একসঙ্গে খেলাম। মা একটা বাটিতে একটু ঝোল, রুটি চাপা দিয়ে আমায় বললো
–বুকুন, এটা রইল। কাল সকালে খেয়ে নিস। কাল আর ভাত করবো না। শরীরটা ভালো নেই রে।
আমি আর মা শুয়ে শুয়ে গল্প করছিলাম।
–বুকুন, কটা দিন পরেই কাজের বাড়ি থেকে মাইনে পাবো, তোকে জুতো পালিশের বাক্স কিনে দেবো, তুই ঠিকমতো পারবি তো বাবা?
–হ্যাঁ মা, আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। আমি সুবলদার থেকে সব দেকে নেবো। দেকবে আমি সুবলদার মত ইনকাম করবো।
–হলেই ভালো বাবা।
–মা, ওমা, মা; শোনো না। তুমি আমি একদিন গলির মোড়ে রোলের দোকান থেকে এগরোল খাবো।
মা আমাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে, সেই আগের মতন।
–তোর খুব এগরোল খেতে ইচ্ছে করে, তাই না?
–হ্যাঁ মা, বেশি করে সস্ দিয়ে খাবো।
–ঠিক আছে, আমি তোকে একদিন খাওয়াবো — মাইনেটা পাই তারপর। কেমন?
–মা, আমরা আর এখানে থাকবো না।
–সে কিরে পাগল, কোথায় যাবি?
মা আমাকে আদর করে, হামি খায়। কতদিন বাদে হামি খেলো।
–আমরা ওই বাড়িটার মতো কোথাও থাকবো। আমি নীল জামা পরে গেটে কাজ করবো। তুমি গুঁজিয়া দিয়ে লখ্খী পুজো করবে। আমরা বল খেলার মাঠে বেড়াতে যাব। তুমি শুধু একটা দিদার বাড়ী রান্না করবে।
মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আমি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভেঙে গেল মার জোরে জোরে ডাক আর ঠেলানি তে।
–বুকুন, বুকুন, শীগ্গিরি ওঠ্। ঘরে আগুন লেগেছে। বাইরে পালা বাবা, বুকুন, বুকুন।
আমার ঘুম ভেঙে গেলো। কি গরম লাগছে! মা আমাকে ঠেলে ঘর থেকে বার করে দিয়ে চৌকির নিচে ঢুকে ট্রাঙ্কের ভিতর কি একটা খুঁজছে। আমি এক দৌড়ে রাস্তার এপারে এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের ঘরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। ঘরের চালটা ভেঙে পড়লো। পুরো বস্তিটা জ্বলছে। আমার মা, বাবা, নতুন জামা, জুতো পালিশের বাক্স-সব জ্বলছে। আমি হাত কাটা গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট পরে রাস্তার এপাশে দাঁড়িয়ে। মা আমায় বলেছিল এগরোল খাওয়াবে। আমি বাবার মতন নীল জামা, নীল প্যান্ট, কালো টুপি পরে গেটে কাজ করবো — মা’র লখ্খী পুজো, লখ্খীর থালায় গুঁজিয়া……..।
সবাই খুব দৌড়াদৌড়ি করছে। পুলিশ, দমকল, কত লোক আমাদের বস্তির সামনে। আমি একা, বড্ড একা হয়ে গেলাম। খুব কান্না পাচ্ছে। একটা দিদি, হাতে মাইক নিয়ে আমার কাছে এসে বললো
–তুমি এই বস্তিতে থাকতে? কি নাম তোমার?
আমি মাথা নেড়ে বললাম “হ্যাঁ, আমি বুকুন।”
দিদিটা সঙ্গের লোকটা কে বললো
–অনিদা এই বাচ্চাটাকে পেয়েছি। ভিকটিম। বাইট নেবো। রেডি।
সকাল হয়ে গেছে, চারিদিক আলো। দিদিটা মাইকটা আমার সামনে নিয়ে এসে বললো
–তুমি এই বস্তিতে থাকতে? সঙ্গে কে কে থাকতো? বাবা-মা ভাই বোন? কোনখানে ছিল তোমাদের ঘর? তোমরা ক’ ভাই, ক’ বোন? বাকিরা সবাই কোথায়? আরো কত কি।
আমি দেখছিলাম রাস্তার ধারে হলুদ দোতলা বাড়ির ছাদে অনেকে দাঁড়িয়ে। বাড়িটার গায়ে সকালের রোদ এসে পড়েছে। বাড়ির পাশের তারে দুটো কালো ছোট পাখি বসে দোল খাচ্ছে, আমার দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছে। আমি জানি ওদের একটা আমার মা, অন্যটা বাবা।
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.