পুকুর পাড়ের নোয়ানো গাছ

Avatar photo
girl standing in front of a pond in a misty night

সমীরণ চাকরি হারানোর পর, লেখক  হওয়ার  আশা  নিয়ে বর্ধমানে আসে। ঐ গ্রামে তার ছোটবেলার প্রেমিকা অনামিকা থাকে। সমীরণ কি দেখা পাবে অনামিকার?

লেখক : সোমাশীস গুপ্ত

৩১ এ মার্চ,  সকল sales কর্মচারীরাই  দুঃস্বপ্ন দেখেন। কেন? কারণ  এই দিনে  ওপর মহলের কর্তারা ঠিক সুন্দরবনের বাঘের মতন দেখতে হয়ে জান। সমীরণের ক্ষেত্রে ও এর ব্যাতিক্রম হল না। সেদিন  ঘুম ভাঙার ইতিপূর্বে  সে  তিন  বার  দুঃস্বপ্ন দেখে ফেলেছে। কোনক্রমে ঘুমের ঘোর কাটিয়ে সে office যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তক্ষুনি এক বরকর্তার phone। সমিরনের হৃদকম্পন বেড়ে ১০০ ছুঁই ছুঁই, দুঃস্বপ্ন যে এইভাবে সত্যি হয়ে যাবে সেটা সে ভাবতেও পারে নি।

সমীরণ, গত ৩ বছর  ধরে এক private বিমা company তে  কর্মরত। কিন্তু তার মন টা এখনো ‘পথের পাঁচালী’ র আপু- দুর্গার মতো কাশবনে হারিয়ে থাকতে চায়। ছোটবেলার থেকেই সে লেখক হতে চেয়েছিল, কিন্তু পরিস্থির  চাপে  চাকরি কোরতে বাধ্য হয়। তারপর আর কি, বাসে  চড়া  সমীরণ  ট্যাক্সি  চরা শুরু করলো, তাঁর পর ফ্ল্যাট, air conditioning machine সবই সে কিনেছে, যাকে বলে consumerism এর দাসত্ব।

সেদিন যখন সে office পোঁছাল  তখন  ঘরির  কাঁটাতে  ঠিক  ৯ টা। চায়ের  কাপে  চুমুক দিতে না দিতে সমীরণের ডাক পড়লো।

“সমীরণ তোমার target shortfall কত জান?” Zonal manager বিবেক ব্যানার্জি হুঙ্কার দিলেন।

“আ…আ…আমি চেষ্টা করছি বিবেকদা, কিন্তু demonetarization এর পর…”

“ওই সব বলে লাভ নেই” সমীরণকে থামিয়ে বিবেক ব্যানার্জি বললেন, “আজ shortfall makeup না হলে office আসতে হবে না, resignation letter mail করে দিও ।”

সেইদিনের পর আজ ৪৫ দিন কেটে গেছে। সমীরণ এখন বাংলার লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকদের মধ্যে একজন। প্রচুর চেষ্টা করার পরও কোনও চাকরি জোটেনি। তার দুশ্চিন্তা  ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে কি করবে বুঝে উটতে পারছিল না সমীরণ । অবশেষে , অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে  এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে আর চাকরি নয়, আবার সে লেখক হবে ।

অবশ্য এর পেছনে এক কাকতালীয় ঘটনাও আছে। সমীরণের মাতুল মারা যাবার শময় তাকে বর্ধমানের মাহাতা  গ্রামের ১৫০ বছরের পুরোনো জমিদার বাড়িটা উপহার স্বরুপ দিয়ে গেছেন। এই বারিতে সমীরণ ছোটবেলায় অনেক সময় কাটিয়াছে। ঠাকুরমার ঝুলি, আবোল তাবোল, ফালুদা কত বইই না এখানে সে পড়েছে। অবশ্য আরও একটা কারণ ও আছে, এই গ্রামে অনামিকা ত্থাকে।

২ দিন পর সকাল বেলায় হাওড়া পৌঁছে সমীরণএর ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল । বাবার হাত ধরে পুরি-তরকারি খাওয়া, book stall থেকে বই কেনা, আরও কত কিছু । কিন্তু এখন কিরম যেনো সব পাল়্টে গেছে। পুরির দোকান গুল আর নেই, book stall গুল উধাও, শুধু আছে ঝাঁ চক়্চকে দোকান, যেগুলোতে  বিলিতি খাবারের বাহার। এটাই বোধহয় new Indiaর ‘achche din’। আর একটা জিনিষ সমীরণ লক্ষ কব়্লো,  লোকসংখ্যা  আগের চেয়ে ঢের গুন বেড়েছে, আর সাথে বেড়েছে ক্ষুধার্ত ভিকারিদের শঙ্কা।

বর্ধমান station-এ নেমে একটা টোটো  ভারা করল সমীরণ।মাহাতা পৌছতে মোটা মুটি ১ ঘণ্টা লাগবে। সমীরণ দেখল, রাস্তা ঘাট খুব একটা বদলায়নি,  কিন্তু গরমটা বেশ বেরেছে । বাইরে তাকিয়ে দ্যাখে রাস্তার গাছগুল আর নেই,  development এর বহরে কেটে ফেলা হয়েছে। ঘণ্টা খানেক পর যখন  গ্রামে পৌঁছল তখন  রামলছন বাইরে তার নতুন মনিবের অপেক্ষা করছিল। রামলছনের জন্ম এই  বাড়িতেই। তারা ৪ পুরুষ ধরে এই বাড়ির বিশ্বস্ত পরিচালক।

স্নান খাওয়া সেরে সমীরণ একটু হাওয়া খেতে বেরোল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে বাড়ির ঈশান কোনে অবস্থিত পুকুর পারে এসে বসে। দূরে গ্রামের বউ ঝিয়েরা বাসন মাজছিল। জলের শব্দের সাথে কোথায় একটা অজানা পাখির ডাক মিশে যাচ্ছে । এদিকে সূর্য তাঁর শেষ আলো পৃথিবীর বুকে ছুঁইয়ে দিচ্ছে। গ্রাম বাংলার তুলনা হয় না তাই সমীরণ ঠিক করল যে এটাই হবে তার গল্পের শুরু। কিন্তু আজ যে সে বড়ই ক্লান্ত, লেখা-লেখি আর করে কি করে, তাই প্রাকৃতিক বর্ণনা   গুলো সে তার voice recorder এ record কোরে রাখল ।

“আজ ২১ এ May। আমার নতুন জিবনের শুরু। গ্রামে এলাম, বিকেলে একটু বেরিয়ে পুকুর পারে এসে বসি, খুবই মনোরম পরিবেশ। গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য অতুলনীয়। তা ছাড়া আনামিকা এই গ্রমেই থাকে  তাই হয়তো আমার আরও বেশি ভাল  লাগছে । তাকে এখনো দেখতে পাই নি, আশা করি শিগগিরই দেখা পাব। আজ খুব ক্লান্ত , কাল থেকে লিখব।”

রাত ১২:৪৫, হটাৎ একটা আওয়াজে সমিরনের ঘুম ভাঙে । শব্দ টা বাইরে থেকে আসছে, জল তোলার শব্দ। কিন্তু এত রাতে…? সমীরণ উঠে জানালা দিয়া দ্যাখে একটি মে জল তুলছে। “ওই তো সে” বোলে সমীরণ তাড়াতাড়ি বাইরে গেল।

“আজ ২২ এ May গতকাল রাতে আমি অনামিকাকে দেখতে পাই । কিন্তু সে আমায় দ্যাখে নি, তাই কথা হোল না, বেরিয়ে যেতে যেতে সে চলে গেছিল। তবে এটা নিশ্চিত হোলাম যে, অনামিকা এই গ্রামেই থাকে। আঃ কি শান্তি। আজ না হয় কাল তো কথা হবেই। আজ লেখা শুরু করব।”

প্রাতঃরাশের পর সমীরণ লেখা-লেখি শুরু কব়্লো। কিন্তু কলম যেন ছলছে না। কত plot মাথায় ছিল সমীরণের, কিন্তু মন টা শুধু আনচান কোরে। অনামিকা দেখার পর, তার সাথে কথা বলার ইচ্ছেটা ক্রমশ বেড়ে চলেছে সমিরনের মণে । পুকুরপাড় টা যেন ওকে টানছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর থেকে রাত কিন্তু এক বর্ণও লেখা হল না সমীরণের।

“আজ লেখা হল না। অনামিকার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সে কি জানে আমি এসেছি? মণে হয়না, জানলে নিশ্চয়ই দেখা করত।”

পরের ঘটনা টা ঘটে  রাত ১২ টায়।

সমীরণের ঘুম ভাঙায় আবার সেই জলের  আওয়াজ  । এক লাফে সে জানালায় গিয়ে দেখে অনামিকা জল তুলচ্ছে। কিন্তু……

“আবার অনামিকা পুকুর পারে এসেছিল। সে আজও আমায় দেখল না? আমি চিৎকার করে ওকে ডাকলাম, কিন্তু সে শুনল না। কথা আমায় বোলতেই হবে। কাল সকালে গ্রামে গিয়ে খোঁজ ওর নেব।”

পরদিন সমীরণ সকাল সকাল অনামিকার খোঁজে বেরোল। কিন্তু এ তো কলকাতা না, হঠাৎ  একটা মেয়ের খোঁজ নিতে গেলে হিতে-বিপরীত হতে পারে। তাই বাকি দিনটা পুকুর পাড়ে বশে কাঁটালো সমীরণ। কিন্তু অনামিকা এলো না।

“আজ রাতে জেগে থাকব, আমার অনামিকার সাথে কথা বলতেই হবে। আজও লিখতে পারিনি , সারা দিন পুকুর পারে ওর অপেক্ষা করলাম কিন্তু সে এলো না।“

“এখন রাত ১২ টা । আমি জেগে আছি অনামিকার অপেক্ষায়।“

“আজ ভর রাতে অনামিকা এসেছিল। আমায় দেখে মুচকি হেঁসে চলে গেল। কথা বলল না। হয়তো লজ্জা পায়।তবে আমার যে আর তর সইছে না।আজ অনামিকা এলে কথা বলব সে যাই হয়ে যাক।”

“এখন ১২টা বাজে, এখন ……সকাল না রাত জানি না, মণে হয় দুদিন কেটে গাছে, আজ কত তারিক কি জানি? আনামিকার দেখা আর পাইনি।  ও আসছেনা কেন?”

“অনামিকা আসে নি, ওর কি শরীর খারাপ হোল?আমি কি ওর বাড়ি যাব?”

“ওর বাড়ি যেতে পারিনি, শরীর টা খারাপ লাগছে। কিন্তু কথা যে আমায় বলতেই হবে। আমি তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারছিনা। তুমি কি বোঝ না? আজ আসবে তো?”

“আমি জানি আজ তুমি আসবে, আজ না এলে আমি আর কোন দিন অপেক্ষা করব না। “

“কালও এলে না তুমি?আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। তোমার সাথে কথা না বলার যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। আচ্ছা ……আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?…‌আমি ……আমি … আরে …পুকুর পারে ওটা কে? ওটা কি অনামিকা? না ওটা গাছের ছায়া? না ঐ তো … ঐ তো  অনামিকা । সে জল তুলচ্ছে, জ্যোৎস্নার  আলোতে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। আজ কথা বলতেই হবে। অনামিকা আমায় দেখেছে, ঐ তো ও হাসছে, তুমি দাঁড়াও আমি আসছি অনামিকা, অনামিকা……”

See Also
Hilsa and the Ghost

“এটাই  last recording Sir, আর কিছু বলতে পারে নি”

“হম bodyটা post-mortem করতে পাঠাও, মণে তো হয় suicide…। আচ্ছা  বাড়ির কাজের লকটাকে  ডাকো  …কথা বলি।”

রামলছন তখন মর্মাহত, যাকে ছোটবেলার থেকে কোলে-পিঠে মানুষ করেছে, তাকে মৃত দেখতে হবে সে কোনদিনও ভাবতেই পারেনি।

“তুমি কতদিন ধরে এই বাড়িতে কাজ কর?” Inspector Bagchi জিজ্ঞেস করলেন।

“আজ্ঞে আমার জন্ম এই বারিতেই।”

“তোমার দাদাবাবু কলকাতায় থাকতেন না?”

“হাঁ সাহেব। বরবাবু মারা যাওয়ার সময় দাদাবাবু কে বারিটা লিখে দিয়ে গালেন, তাই দাদাবাবু কলকাতা ছেরে এখানে এলেন।”

“হুম্  আমি খবর নিয়েছি চাকরি যাবার পড় সমীরণ বাবু একটু ভেঙে পরেছিলেন, তাই বোধহয় suicide করেছেন। তুমি এখন য়াও……আচ্ছা শোন এই অনামিকা টা কে?”

“অনামিকা? সে তহ বাবুর ছোটবেলার বন্ধু ছিল।“

“ছিল মানে? এখন কোথায়?”

“অনামিকা দিদিমনি এখন অনেক দূরে সাহেব।“

“দূরে মানে?কোথায়? এই গ্রামেই থাকে তো?”

“আজ ৩ বছর হোল অনামিকা দিদিমনি এই পুকুরে ডুবে মারা যায়।”

What's Your Reaction?
Excited
5
Happy
7
In Love
8
Not Sure
1
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top