Now Reading
মোরীগাঁও থেকে অরুণাচল: আলোর পথে ৩২ ঘণ্টা

মোরীগাঁও থেকে অরুণাচল: আলোর পথে ৩২ ঘণ্টা

Avatar photo
মোরীগাঁও

এই লেখায় মোরীগাঁও থেকে গৌহাটী হয়ে অরুণাচলের উদ্দেশ্যে যাত্রার অভিজ্ঞতা শেয়ার করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের অনুমতি পত্র (ILP) পাওয়ার চক্র, গৌহাটি শহরের আন্তরাজ্য বাস পরিবহন, এবং যাত্রার পথে পাহাড়ি দৃশ্যের সৌন্দর্য বর্ণনা করা হয়েছে। লেখাটিতে স্থানীয় সংস্কৃতি, পর্যটন, এবং ভ্রমণের সময়কার নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে।

আমি তখন‌ও ছিলাম আসামের মোরীগাঁও -তে। আগের দিনেই শেষ হয়েছে এখানকার কাজ। জানতাম এবার যেতে হবে ত্রিপুরা, কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় শেষ মুহূর্তে গন্তব্য বদল হল। সকাল সাড়ে দশটার সময় আদেশ হল যেতে হবে অরুণাচলের আলো এবং অনতিবিলম্বে। অতএব আবারও বাঁধো গাঁঠরি উঠাও ঝোলা আবারও শুরু পথে চলা। এবার আলোর পথযাত্রী।

মোরীগাঁও থেকে গৌহাটীর পল্টন বাজারের দুরত্ব ৭৫ কিলোমিটার, সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। পল্টনবাজার পৌঁছলাম দুপুর তিনটের সময়। নেটওয়ার্ক ট্রাভেলসের অফিসের সামনেই বাস থেকে নামলাম। কাউন্টার থেকে জানলাম আন্তরাজ্য বাস আড্ডা (ISBT) থেকে পাসিঘাটের বাস ছাড়বে সাড়ে চারটের সময় কিন্তু পল্টনবাজার থেকে ISBTর জন্য সাটল বাস ছাড়বে সাড়ে তিনটেতে। তারপরে আর কোন গাড়ী নেই। এদিকে আমায়  অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের অনুমতি পত্র (ইনার লাইন পারমিট -ILP) নিতে হবে। হঠাৎ মনে পড়ল অল্প দুরে নেপালি মন্দিরের পাশেই আসাম পর্যটনের বাড়ীতেই অরুনাচল পর্যটনের অফিস আছে। কাউন্টারের ভদ্রলোককে বললাম “দয়া করে আমার জন্য একটা সিট রাখবেন আমি এখনই ILP করে আনছি”। ভদ্রলোক তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন “দেখুউন”। তাচ্ছিল্যটা গায়ে না মেখে বললাম, “আমার সুটকেসটা কি একটু রাখা যাবে”।

কাউন্টারের ভদ্রলোক বললেন, “গেটের সিকিউরিটিকে বলুন”।

গেটের সিকিউরিটির কাছে লাগেজ রেখে প্রায় দৌড়ে পৌঁছে গেলাম আসাম পর্যটনের অফিসে। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করতে বললে “অরুনাচল দোতলায়”।

লিফট ছিল চারতলায় তাই অপেক্ষা না করে দ্রুত সিড়ি ভেঙে উঠে গেলেম দোতলায়। ওদের অফিসে পৌঁছে দেখি তিন সুন্দরী তরুনী কর্মী, তাদের ILPর কথা বলতেই ওরা একটা ফর্ম এগিয়ে দিল। ফর্ম ভরে জমা করার পর যা হল তা অভাবনীয়।

একজন সুন্দরী বললো, “ছবি”।

আমি বললাম, “ছবি তো আনিনি”।

সুন্দরী বললো, “তাহলে নিয়ে আসুন”।

বললাম, “দেখুন, আমার যাওয়াটা খুবই জরুরী। সাড়ে তিনটেয় বাস। দয়া করে কিছু একটা করুন”।

তিনজনেই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। একজন ঘড়ি দেখল, আমিও, তিনটে আঠের।  মুচকি হেসে এক সুন্দরী বললো “আই ডি”।

প্যান কার্ডটা এগিয়ে দিলাম। সুন্দরী সেটা নিয়ে এগিয়ে দিল পাশের সুন্দরীকে। “এটা এখনি স্ক্যান করে প্রিন্ট দে, দুকপি”।

দ্বিতীয় সুন্দরী সঙ্গে সঙ্গেই স্ক্যান করে দুকপি প্রিন্ট করে তুলে দিলো প্রথম সুন্দরীর হাতে। প্রিন্ট হাতে নিয়েই সুন্দরী দ্রুত হাতে একটা কপি থেকে ছবিটা কেটে নিয়ে ILP সার্টিফিকেটে সাঁটিয়ে দিল। অন্য কপিটা ফর্মের সঙ্গে স্টেপল করতে করতে ঢুকে গেল ভিতরের কেবিনে আর বেরিয়েও এল দ্রুত।

সুন্দরী বললো, “দিন, সাড়ে চারশো”।

একটা পাঁচশোর নোট এগিয়ে দিলাম। সুন্দরী টাকাটা নিয়ে দেরাজে রেখে দ্রুত হাতে রসিদ তৈরী করল তারপর সেই রসিদ, পঞ্চাশ টাকা, আর ILPটা আমার হাতে দিয়ে আবার হাসলো, মিষ্টি হাসি। ঘড়ি দেখলাম। তিনটে বাইশ। অসম্ভব, মাত্র চার মিনিটে। সময় নেই হাতে, তাই একটা শুকনো ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে এলাম। নামার সময় রসিদটা দেখলাম। অরুনাচল সরকারের, সাড়ে চারশো টাকারই।

এই অবসরে, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের অনুমতি পত্র  বা ইনার লাইন পারমিট (ILP) এর ইতিহাসটা একটু দেখা যাক। ১৮৬৬ সালে আসামে প্রথম খনিজ তেল বা পেট্রোলের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। ১৮৭৩ সালে, ইংরেজ সরকার খনিজ তেল, চা ও হাতির দাঁতের বানিজ্যে একচেটিয়া অধিকার বজায় রাখতে সমগ্ৰ উত্তরপূর্বে “Bengal Eastern Frontier Regulations” নাম দিয়ে একটা আইন করে। যার ফলে যে কোন ভারতীয় ‘ব্রিটিশ প্রজা’কে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে প্রবেশ করতে গেলে আভ্যন্তরীণ ভ্রমনের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯৫০ সালে ঐ আইনে সামান্য পরিবর্তন করে ‘ব্রিটিশ প্রজা’ কথাটা শুধু তুলে দেওয়া হয়।

অনুমতিপত্র নিয়ে ফিরে এলাম নেটওয়ার্ক অফিসে। কাউন্টারে গিয়ে বললাম- “দিন, টিকিট দিন”।

কাউন্টারের ভদ্রলোক বললেন” ILP হয়ে গেছে”।

“হ্যাঁ” – সংক্ষিপ্ত উত্তর।

“না হলে কিন্তু গেটে আটকে দেবে”।

“জানি, টিকিট দিন”।

টিকিট দিল। ভাড়া ৬৬০ টাকা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রওয়ানা দিল সাটল বাস  ISBTর উদ্দেশে। সওয়া চারটেতে পৌঁছলাম ISBT। ২X১ বাস, বাসের বাঁদিকে চালকের পিছনে ডবল সিটার, অন্যদিকে একক আসন। আমার ১ নম্বর সিট। বাসে উঠেই ডানদিকের প্রথম একক আসনটাই আমার। বড় সুটকেসটা ঢুকিয়ে দিলাম বাসের পেটে। ব্যাকপ্যাকটা সঙ্গে‌ই র‌ইলো।  সকাল এগারোটায় খেয়ে বেরিয়েছি। এরপর হয়তো বাস দাড়াবে রাত নয়টায়। কিছু খেয়ে নিতে হবে।

গৌহাটির এই আন্তরাজ্য আড্ডাটা খুবই সুন্দর।  পুরো উত্তর পূর্বাঞ্চলের রেলওয়ে নেটওয়ার্ক খুব দুর্বল। পুরো পরিবহন ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে এই আন্তরাজ্য বাস যোগাযোগের ওপরে। গৌহাটি থেকে মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল ও ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাস যোগাযোগের মূল কেন্দ্র এই ISBT। চত্বরের মাঝখানে বিশাল লাউঞ্জ। এক প্রান্তে সারি সারি নানা ট্রাভেল এজেন্সির কাউন্টার। বাকি লাউঞ্জের ধারে ধারে পরপর নানান দিকে যাবার বাসের লেন। মাঝবরাবর চা ও নানা শুকনো খাবারের দোকান। দোতলায় একটা রেস্তোরাঁও আছে।  মাঝের দোকান থেকেই চায়ের সঙ্গে অল্প কেক খেয়ে, খান চারেক বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে নিলাম। পাহাড়ী পথে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি সঙ্গে শুকনো খাবার রাখা আবশ্যিক। আবার বাসে এসে উঠলাম।

ISBT থেকে বাস ছাড়লো পাঁচটায়। গৌহাটি থেকে পাসিঘাটের দূরত্ব ৬০০ কিমি। বাস যায় নওগাঁ, তেজপুর, ধেমাজী, শিলাপাথার হয়ে। এই পথে বেশ কয়েকটি ট্রাভেল অপারেটর বাস চালায় তবে নেটওয়ার্ক ট্রাভেলস ই সবথেকে বিশ্বস্থ। এরা গাড়ী চালাবেই, অনেক সময় দেখেছি মাত্র গুটিকয়েক যাত্রী নিয়ে বাস চলতে। বাসগুলোর পেটের ভেতর ও মাথার ওপর মালপত্র বোঝাই। যাত্রাপথের অসংখ্য খুচরো ব্যবসায়ী এভাবেই গৌহাটি থেকে মাল আনে। মুদীর মাল, শাক-সব্জী থেকে শুরু করে স্টীলের আলমারীও এভাবে যেতে দেখেছি। ক্যুরিয়ারের চিঠিপত্রও এভাবেই যাতায়াত করে।

এপথে আমি গিয়েছি যে বারেবার। কিন্তু প্রতিবারই পথের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হই। গৌহাটি শহর প্রান্তে খানাপাড়ার পরই জাতীয় সড়ক আঁকাবাঁকা পথে পার হয় এক নাতি উচ্চ গিরিশ্রেনী। তারপর পাহাড় কখনও দুরে সরে যায় তো কখনও ঘাড়ে এসে পড়ে পথের। পথের দুপাশে কখনও ঘন জঙ্গল, কখনও দিগন্তবিস্তৃত কৃষিজমি কখনও বা চা-বাগান। একটু পরেই অবশ্য অন্ধকার নেমে এলো।

রাত সাড়ে আটটায় বাস দাঁড়ালে নগাঁও জেলার আমোনি তে, পথের পাশের ধাবায়। বাস দাঁড়াবে আধঘন্টা। রাতের খাবার এখানেই খেতে হবে। এরপর আর বাস দাঁড়াবে না কোথাও। ধাবায় ভাত-রুটি, মাছ-মাংস, সব্জি-মিষ্টি সবই পাওয়া যায়। তার পাশেই বিস্কুট-কেক, ফল ও নানা ধরনের শুকনো খাবারের দোকান। আমি খেলাম রুটি-সব্জী।‌ খাওয়া সেরে আবার ছুট। পরের গন্তব্য তেজপুর, বিখ্যাত কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের পাশ দিয়েই সেই পথ। দশটা নাগাদ এসে পৌঁছলাম ব্রহ্মপুত্রের ওপর তিন কিমি দীর্ঘ কোলিয়াভোমরা সেতুতে। এই কোলিয়াভোমরা ছিলেন আহোম রাজ্যের একজন সেনাপতি। তিনিই প্রথম ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড় থেকে অস্থায়ী সেতু তৈরি করে নদ পার হয়ে দক্ষিনের কামরূপ রাজ্য দখল করেন। তার নামেই সেতুর নামকরণ। সেতু পার হয়ে বাস ঢুকল তেজপুর শহরে।

ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর তীরে কামেং নদীর সংযোগস্থলে গড়ে উঠেছে তেজপুর শহর। এটা একটা অতি পৌরাণিক শহর, এই শহর নিয়ে বহু পৌরাণিক গল্প আছে। মহর্ষি কশ্যপের পুত্র দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু ছিলেন তেজপুরের রাজা। তার ভাই হিরণ্যাক্ষকে বিষ্ণু বধ করেন বরাহ অবতার রূপে। হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার। আবার হিরণ্যকশিপুর পুত্র বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদকে পুড়িয়ে মারতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা যায় হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা, সেই ঘটনা থেকেই হোলির আগের দিন উদযাপন হয় হোলিকা দহন। হিরণ্যকশিপুর ছেলে প্রহ্লাদের নাতি দৈত্যরাজ বলি কে বিষ্ণু দমন করেন বামন অবতার রূপে। বলির ছেলে বানাসুরের ঘটনা আরোও ‌‌। ঢ়ড়‌ ড়‌। ‌। ‌,‌। , আরও চমকপ্রদ। বানাসুরের মেয়ে উষা খুব সুন্দরী ছিল। উষা কৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধের প্রেমে পড়ে, গান্ধর্বমতে বিয়ে করে। বানাসুর শত্রুবংশে বিয়ে মানতে পারেন নি। তিনি অনিরুদ্ধ কে কারারুদ্ধ করলেন। তখন কৃষ্ণ এলেন নাতিকে উদ্ধার করতে। বানাসুরের না কি হাজার হাত ছিল। তিনি শিবের তাণ্ডব নৃত্যের সঙ্গে হাজার হাতে মৃদঙ্গ বাজিয়ে শিবকে তুষ্ট করেছিলেন। বানাসুরের বিপদ দেখে শিব এলেন তারপক্ষে যুদ্ধ করতে। মহাভারতে এই যুদ্ধ হরি-হরের যুদ্ধ হিসেবে বর্ণিত। ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পর ব্রহ্মার হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বন্ধ হয়। এই যুদ্ধে রণভূমির মাটি শোনিত অর্থাৎ রক্তে  ভিজে উঠেছিল তাই নাম হয় শোনিতপুর আর শোনিতপুরের রাজধানী তেজপুর। তেজ শব্দের‌ও একটা অর্থ‌ রক্ত। উষা ও অনিরুদ্ধের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল উষার সখি চিত্রলেখা। আশ্চর্যের যে, স্কুলপাঠ্য ভূগলে আমরা যে কালপুরুষ নক্ষত্র মন্ডলীর কথা পড়ি, ভারতীয় জ্যেতির্বিজ্ঞানে, সেই কালপুরুষের কোমরবন্ধের তিনটে নক্ষত্রের নাম উষা, চিত্রলেখা ও অনিরুদ্ধ। আমাদের পৌরাণিক কবিদের জ্ঞান ও রসবোধ অকল্পনীয়।

See Also

তেজপুরে বাস কিছুক্ষণ দাঁড়ালো, দু-চারজন যাত্রী ওঠানামা করলো, তারপর বাস আবার র‌ওনা দিলো সাড়ে দশটায়। শহর পার হতেই ঘন অন্ধকার গ্ৰাস করলো। আমি ডুব দিলাম তেজপুরের পৌরাণিক ইতিহাসে। আমার ধারণা এগুলো আসলে আর্য অনার্যদের লড়াই। আর্য কবিরা তার বর্ণনা দিয়েছেন ধর্মের মোড়কে। আর শিব কোন বৈদিক দেবতা নয়। শিব মূলত অনার্য দেবতা। বৈদিক সাহিত্যে শিবের প্রবেশ অনেক পরে।

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙলো লোকজনের চলা ফেরায়। ঘড়িতে দেখলাম রাত বারোটা বেজে গেছে। বাস দাড়িয়ে আছে অচেনা জায়গায় এক নাম না জানা ঘুমন্ত গ্রামের পাশে। দুপাশে বিস্তৃত চাষের ক্ষেত। মাথার ওপর মেঘলা আকাশ। “ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমোনা”।

বাসের গুটিকয় যাত্রী নীচে নেমে গেছে, আমিও নামলাম। আমরা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ কোত্থাও নেই। বাসে দুজন চালক ও খালাসি ছাড়া একজন মেকানিকও ছিল। নেমেছে তারাও। ইঞ্জিনে গড়বড়। মেকানিক ছেলেটি গাড়ীর নীচে ঢুকেছে। ওপর থেকে গাড়ীর বনেট তুলে চালক বড় একটা টর্চ ফেলেছে। মেকানিক বেরিয়ে এলো গাড়ির নীচ থেকে, তার হাতে একটা ভাঙা পার্টস। কিছু দুরে, হাইওয়ের ওপর একটা পেট্রোল পাম্প আছে। সেখান থেকেই পার্টসটা আনতে হবে। একটা লরি ধরে মেকানিক চলে গেল পার্টস আনতে।

চালককে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা এখন কোথায়। সে ববলো পাঁচ মিনিট আগে বালিজান পার হয়েছি। এর অর্থ আরোও তিনশো কিঃমিঃ যেতে হবে, তাতে আরো ছয় ঘন্টা লাগবে। পরদিন সকালে হয়তো পাসিঘাট থেকে আলোর গাড়ি ধরতে পারবো না।

চিন্তা ছেড়ে আশেপাশে নজর দিলাম। মাঝে মাঝে‌ই হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার ফালাফালা করে জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে দৈত্যাকৃতি বাস ও লরি। একবার এসে থামছে আমাদের সামনে। আমাদের চালকের কাছে সমস্যার কথা জেনে পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের, বহুদুর পর্যন্ত পিছনের লাল লাইটগুলো টিমটিম করতে করতে আবার চলে যাচ্ছে অন্ধকারের গর্ভে। আসামের এই অঞ্চল ব্রহ্মপুত্রের প্লাবনভূমি। ফলে প্রতিবছর বন্যা কিন্তু এক‌ই সঙ্গে ভীষণ উর্বর। এখন বর্ষাকাল। মেঘে ঢাকা আকাশ কালচে লাল। একটা অস্ফুট আলো ছড়িয়ে আছে আদিগন্ত জুড়ে। হাইওয়ের দুপাশের চাষের জমি ডুবে আছে জলে। যতদুর চোখ যায় শুধু জল, মাঝে মাঝে জেগে আছে বড় বড় গাছ। সেই জলের বুক চিরে বিছিয়ে রয়েছে সরু সিঁথির মতো রাজপথ।

মেকানিক ফিরলো পার্টস নিয়ে। বাস ঠিক হলো, আবার শুরু হলো পথচলা। তখন রাত তিনটে বাজে। কিছুক্ষণ পরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো, আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আবারও ঘুম ভাঙ্গলো।  বেশ আলো ফুটেছে। বাস থেমেছে, একজন যাত্রী নামবে। তাকে নামিয়ে বাস আবার চলতে শুরু করলো। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে চারটে। ভারতের পূর্ব সীমান্তের কাছাকাছি এসে গেছি। এখানে ভোর হয় বেশ তাড়াতাড়ি। রাতে বৃষ্টি হয়ে আকাশ অনেক পরিস্কার। ইতিউতি ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। উইন্ডস্ক্রীনের মধ্যে দিয়ে দেখলাম পূবের আকাশ লাল। মনের মধ্যে পীযূষ কান্তি অস্ফুটে গেয়ে উঠলে,

“প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে যেই

নীড়বিরাগী হৃদয় আমার উধাও হল সেই ॥

একটু পরেই ছুটন্ত বাসে বসেই সূর্যোদয় দেখলাম। বাস ছুটে চলেছে ধেমাজির বিশাল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মধ্যে দিয়ে। সাড়ে আটটার সময় পৌঁছলাম জোনাই, বাংলায় জোনাকি, সুন্দর নাম। জোনাই বাজারে বাস থেকে নামানো হলো আলু পেঁয়াজ সবজি হাঁড়ি কলসি ঝাড়ু ঝাঁটা ইত্যাদি নানা সাংসারিক টুকিটাকি মালপত্র। সঙ্গে নামলো কিছু স্থানীয় ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে আসে প্রধানত গৌহাটি থেকে। এরপর বাস দাঁড়াল এক সরকারি অফিসের সামনে। মূর্তিমান রসভঙ্গের মতো এক পুলিশ কনস্টেবল উঠে এল বাসে -“যার যার পারমিট নেই নেমে আসুন, পারমিট বানিয়ে নিন, নয়তো অরুনাচলে ঢুকতে দেবে না”।

একজন নেমে গেল, ফিরে এল পাঁচ মিনিটেই। জিজ্ঞাসা করলাম ‘কত নিল’। ‘পাঁচশো’।

বাস আবারও এগিয়ে চলল। অরুনাচল সীমান্তে পারমিট চেক হলো। তারপর শুরু হল পাহাড় চড়া। অবশেষে পাহাড়ের কোলে কোলে বাস পৌঁছল পাসিঘাট। তখন সময় সাড়ে দশটা। গত ২৪ ঘন্টা বাসে বাসে ছুটে চলেছি। যাত্রা শুরু করেছিলাম মোরীগাঁও থেকে সকাল সাড়ে এগারোটায়। সফর এখনও শেষ হয়নি।

বাস থেকে নেমেই দৌড়লাম সুমো কাউন্টারে। টিকিট চাই। সকালের সব গাড়ী ছেড়ে গেছে। এরপরে যেসব গাড়ী ওপর থেকে নামবে তারা ফিরতি পথে যাবে দুপুর একটায়। টিকিট ৩৫০ টাকা। টিকিট কেটে একটা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলেম। তারপর একটার সময় বেরিয়ে চড়ে বসলেম সুমোতে।

আবার শুরু হল যাত্রা, আলোর পথে। রাস্তা অত্যন্ত সংকীর্ণ, অবস্থাও বেশ খারাপ। বোঝা যায় এপথে ধ্বস নামে ঘনঘন। কিন্তু আলোর পথ যাত্রা তো কখনোই বকুল বিছানো হয়না। পথ চলেছে সিয়াং এর ধারে ধারে। ব্রহ্মপুত্রকে অরুনাচলে সিয়াং নামেই ডাকে। পাহাড় থেকে নেমে সিয়াং পাসিঘাটের কাছে দিবাং আর লোহিতের সঙ্গে মিলে তৈরী করেছে ব্রহ্মপুত্র। বড় সুন্দরী সিয়াং। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সুন্দরীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই সন্ধ্যা নামলো। হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরে গাড়ী দাড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার বলল ‘আ গিয়া’। প্রায় সাতটা বাজে। গাড়ী থেকে নেমে দেখি চারিদিকে পাহাড়ের গায়ে গায়ে টিমটিম করছে ছোট ছোট  আলোর বিন্দু। ৩২ ঘন্টা সফর করে আলোর পথ যাত্রা শেষ হল।

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top