Now Reading
মৃণাল সেন এবং মুভিং পার্সপেকটিভস ‘চালচিত্র’

মৃণাল সেন এবং মুভিং পার্সপেকটিভস ‘চালচিত্র’

Avatar photo
মৃণাল সেন

মৃণাল সেন -এর সিনেমার জগৎ মানবমুক্তির সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।সত্তরের রাজনৈতিক অস্থিরতা, নকশাল আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন এবং জরুরী অবস্থার প্রেক্ষাপটে নির্মিত তাঁর ছবি আমাদের সামনে ধরে মানুষের যন্ত্রণা, প্রতিবাদ, বেঁচে থাকার সংগ্রাম। তা নিয়ে এই প্রবন্ধ। কলমে – স্বাগতিকা সেন

“We shall all be free, we shall all be free, we shall all be free some day. Oh deep in my heart, I do believe. We shall overcome some day. “- ১৯৬৭, বার্লিন শহরে পিট সিগারের দৃপ্ত কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে মানবমুক্তির কথা। ঠিক সেই সুরে সুর মিলিয়ে, সেই আদর্শে দীক্ষিত হয়েই, ” পৃথিবীতে মহত্ত্বম কাজ হচ্ছে মানবমুক্তির জন্য সংগ্রাম করা। “- এই ভাবনাকে ধ্রুবতারা করেই ‘ইন্টারভিউ’র রঞ্জু, ‘কলকাতা ৭১’ এর গুলি খাওয়া ছেলেটা, ‘পদাতিক’এর সুমিত, ‘কোরাস’ এর রাগী বৃদ্ধটি, ‘মৃগয়া’র ঘিনুয়া, ‘ওকা উরি কথা’র ভেঙ্কাইয়া’কে রূপ দিয়েছেন মৃণাল সেন (উক্ত প্রতিটা ক্ষেত্রে সমানভাবে মুক্তির দাবি না থাকলেও, মূল লক্ষ্য তাই)। মানবমুক্তির সংগ্রামের নায়ক, যারা নীতিভ্রষ্ট সমাজের দর্শকের মগজাস্ত্রকে হ্যামার করবে। রাগ, ক্রোধের সমীকরণে মন্দকের কাজ করে হতাশ করবেনা, বরং অনুঘটক হিসেবে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিশোধের মিছিলে সামিল হতে চেষ্টা করাবে দর্শককে। সিনেমা দেখা শেষ করে হল থেকে বেরিয়ে নিজের মুখের সামনে একটা আয়না ধরতে দেবে, প্রশ্ন করতে বাধ্য করাবে। হয়তো সব উত্তর পাওয়া যাবেনা, পেতে হবে এমন কোনো বাধ্য বাধকতাও নেই। এইযে, নিজেকে নানা প্রশ্ন করা- এখানেই মৃণাল সেনের সিনেমার বিন্যাসে বাস্তবকে খোঁজার স্বার্থকতা।

“নকশাল আন্দোলনকে দেখেছি, তা নিয়ে ভেবেছি, জড়িয়ে পড়েছি। এ দেখার মধ্যে বেহিসেবিপনা ছিলো, এ ভাবনার মধ্যে কোনো হিসেব ছিলোনা। নির্লিপ্ত শীতল পর্যবেক্ষণ ছিলোনা। ছক কষার কোনো চেষ্টা ছিলোনা। নকশাল আন্দোলনকে সামনে রেখে অঙ্ক টঙ্ক কষে ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, কিংবা ‘পদাতিক’ বানাইনি। ঐ অস্থির সময়ের তাপ যখন যেভাবে মনের উপর ছাপ ফেলেছে, সেভাবেই একের পর এক ছবিগুলো করে গেছি। ” – সিনেমা তৈরীর জীবনের সবথেকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সময়ে দাঁড়িয়ে সৃষ্ট তাঁর ‘কলকাতা ট্রিলজি’ সম্পর্কে বিভিন্ন শিবিরের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন এভাবেই। কাহিনীর বাঁধনের অনুপস্থিতি, বরং টুকরো টুকরো কিছু ঘটনার কোলাজ, বিভিন্ন ইমেজ, প্রতীকি ব্যঞ্জনা, আলোর প্রতীকি ব্যবহার, পর্দায় লিখিত বক্তব্য এবং প্রশ্নের মাধ্যমে এক নতুন আঙ্গীক খুঁজেছেন এই সিনেমাগুলিতে। সত্তরের দশকের রাজনৈতিক উত্তাপ, সাধারণ মানুষের প্রতিদিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকা এবং বেঁচে থাকার লড়াই, নকশাল আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, জরুরী অবস্থা, সাধারণ মানুষের অসহায়তা, বেকারত্ব, সংগ্রাম, প্রতিবাদ, মিছিল এবং মানবমুক্তির লড়াইয়ের পথের দিশা দেখিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা এবং নকশালপন্থীদের ভাষায় ‘মুক্তির দশক’ এবং ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’ এর সমকালে শুধুমাত্র কলকাতা নয়, সমগ্র ভারতবর্ষ তথা আফ্রো-এশিয় রাজনীতি, সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর এবং সিগনিফিকেন্ট হয়ে ওঠার বাস্তবকে বাঁধতে চেয়েছেন ট্রিলজি’তে। ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭০) সিনেমায় হয় পরিচালক, নয় নায়ক নয় অন্য কারো দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র ছবির পরিকাঠামো তৈরী হয়েছিল। বাস্তব এবং ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে প্রচলিত সিনেমার ফিকশনকে ভেঙে তৈরী করতে চাওয়া ছবিটির মধ্যে দিয়ে মৃণাল তুলে ধরেছিলেন বিচ্ছিন্নতার দ্বারা আক্রান্ত মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক ভূমিকা; যার প্রতিনিধি বেকার , চাকরীপ্রার্থী যুবক রঞ্জিত। তৎকালীন যুবসমাজের হতাশা, ক্রোধ, বিপন্নতা, রাজনৈতিক অবস্থানকে তীব্র করে তুলতেই সিনেমার অংশে তিনি তীব্রভাবে দর্শকের সামনে হাজির করেন রঞ্জিতের; শো উইন্ডোর কাচ ভেঙে ফেলার দৃশ্যটি।

চলচ্চিত্র সমালোচক দীপেন্দু চক্রবর্তীর ভাষায় -” সত্তরের আবহাওয়ায় ‘কলকাতা ৭১’ ছিলো এক দু:সাহসিক এক্সপেরিমেন্ট। ” বছর কুড়ির ছেলেটি যেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়- “বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন”। মৃণাল সেন তাকে দিয়ে বলাচ্ছেন-” আজ সকালে আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি মরেছি, কেনোনা আমি রিঅ্যাক্ট করেছি। আমাদের এই শোষণভিত্তিক সমাজে রিঅ্যাক্ট করাটাও পাপ।” রিয়েলিটি এবং ফ্যান্টাসির মিশ্রণে তৈরি হওয়া চারটি গল্পের রাজনৈতিক মন্তাজ ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২) এ – “আমার বয়স কুড়ি…মৃত্যুর ভীড় ঠেলে… আমি পায়ে পায়ে চলেছি…হাজার বছর ধরে…দেখেছি ইতিহাস… দারিদ্র্যের ইতিহাস…শোষণের ইতিহাস…বঞ্চনার ইতিহাস”- বলে যাওয়া সেই কুড়ি বছরের যুবক মোটেই শুধু একজন যুবক নয়, সে হয়ে ওঠে একটা বিষয়। একটা কনসেপ্ট। এই সিস্টেমটাকে ঘৃণা করেছিলো যারা, ঘৃণা করে যারা- কারোর দাদা, কারোর সন্তান, হয়তো বা সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসা ঘামতে থাকা সেই ভদ্রলোক, যিনি মৃণাল সেনের হাত ধরে বলেছিলেন, একাত্তর সালের একখানা বুলেট তার শরীরে আছে, যেটা বের করা যায়নি। তিনি এই সিনেমা বোঝেন, উপলব্ধি করেন। সেই কুড়ি বছরের যুবক- এই এক একজন ইন্ডিভিজুয়ালের প্রতিরূপ।

‘পদাতিক'(১৯৭৩) এর বিপ্লবী, কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমার সুমিত, পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে পালিয়ে আশ্রয় পায় ভবানীপুরের এক পাঞ্জাবী মহিলার বাড়িতে। বাবার সাথে লড়াইয়ের কৌশল নিয়ে হতে থাকা ক্রমাগত দ্বন্দ্বের সংঘর্ষের মধ্যেই একদিন বাড়ি ছাড়া হয়েছিল সে। ভবানীপুরের আশ্রয়ে সুখী, লড়াইহীন জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আসতে আসতেই হঠাৎই একদিন মুমুর্ষু মায়ের খোঁজ নিতে গিয়ে বাড়ি ফিরলে সে দেখতে পায় কিছুক্ষণ আগে মা মারা গেছেন। পুলিশের প্রিজন ভ্যানের শব্দে পুনরায় সেখান থেকে পালাতে গিয়েই বাবার সাথে গভীর দৃষ্টি আদানপ্রদান হয় তার। বাবা তার মাটিতে পা রেখে লড়াই করা ‘পদাতিক’ ছেলের পলায়নে সাহায্য করার সময়ে বলেন- “বি ব্রেভ।” আমাদের সমাজকে বাসযোগ্য করে তুলতে শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন সাজিয়েছেন তিনি ‘পদাতিক’ এর মধ্য দিয়ে। মাও সে তুঙের একটি উদ্ধৃতি তুলে সিনেমায় বলেছেন- “Who are our enemies? Who are our friends? This is a question of the first importance for the revolution.”

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়- “সহযোদ্ধাদের প্রতি যে ভালোবাসা একদিন ছিলো, আবার তাকে ফিরিয়ে আনো। ” চলচ্চিত্র পরিচালক কোস্টা গাভরাসের মতো রাজনৈতিক থিসিস গড়ে তুলতে গিয়ে মৃণাল ও চেষ্টা করেছেন- ছবি দেখে হল থেকে বেরোনোর সময়ে দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগ্রত করতে। চলচ্চিত্র পরিচালক থেকে সমাজবিজ্ঞানী, অনুসন্ধিৎসু শিল্পী, নিজেকে আখ্যায়িত করা শব্দ ‘প্রাইভেট মার্ক্সিস্ট’ মৃণাল সেনের ভাবনায়-“বন্ধুদের জমায়েত করো। শত্রুদের চিহ্নিত করো। ” তাঁর সিনেমা মানে, হল থেকে বেরিয়ে নিজেকে সমানে প্রশ্নবিদ্ধ করা। অবশ্য তিনি কখনোই সরাসরি তাঁর বিশ্বাস করা মতাদর্শকে দর্শকের ওপর চাপিয়ে দেন নি। চলচ্চিত্র পরিচালক আইজেনস্টাইনের ভাষায় ‘Intellectual perception’ এর সুযোগ করিয়ে দিয়েছেন বরাবর। মৃণাল মনে করতেন, “We have nothing to hide. ” দৃঢ়ভাবে আজীবন মেনেছেন- সত্তরের দশক থেকে আজ অবধি চলতে থাকা অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মানুষকে একত্রিত করার লড়াইয়ে কোথাও কোনোকিছু লুকিয়ে দেখানোর নেই।

মৃণাল সেনের সিনেমার বৈশিষ্ট্য হিসেবে নাটকীয়তার বদলে পরিলক্ষিত হয় টুকরো টুকরো কিছু ভাবনা। গল্প বলার প্রয়োজনে সিনেমাকে ব্যবহার না করে সর্বাঙ্গীন বাস্তবতার কাছে সিনেমাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার পদ্ধতিতে তিনি অনুসরণ করেছেন আন্দ্রে বাঁজাকে। সমকালীন, সম আদর্শের মিছিলে সামিল হওয়া এই পরিচালকরা ‘নিও রিঅ্যালিজম’ কে নির্দিষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করেননি। বাস্তবকে বিভিন্ন নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার এবং বাস্তবতার নতুন তাৎপর্য খুঁজে বের করতে চেয়ে কখনো পরিচালকদের কাছে এই ‘নিও রিয়েলিজম’ এর কনসেপ্ট হয়ে উঠেছে -‘নিউওয়েভ’। “The cinema…should accept, unconditionally, what is temporary. Today, today, today.”- জাভাত্তিনীর কথা অনুযায়ী বর্তমানের কথা, এই সময়ের কথা বরাবর মৃণাল নিয়ে এসেছেন ছবিতে। মেকি, আর্টিফিশিয়াল সেজে সিনেমায় কিছু বিপ্লবের ছোঁয়া দিয়ে সাংকেতিক বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন না বলেই শ্রেণীশত্রুদের চিহ্নিত করেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। সিনেমাকে নাটকীয় গঠনের ছাঁচে ফেলতে চাননি। চাননি সামাজিক অবস্থা থেকে সরে আসতে। জীবনের বহমান ধারায় কল্পনা হোক কিংবা বাস্তব; একটা ছাঁচ বেছে নিতেই হয়। বর্তমানের সাথে কোথাও কোথাও ইতিহাসের সন্ধানকে মেলাতে চেয়েছেন কোথাও। চেয়েছেন রূপোলী পর্দায় এই ধ্রুব সত্যগুলি ফুটিয়ে তুলতে। আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক সংকট বাস্তব ও বিন্যাসের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব, যা স্বাভাবিক। চলচ্চিত্র পরিচালক গোদার বলেছিলেন-“শিল্প, বিপ্লবের থেকে পিছিয়ে আছে। আমি মনে করি, শিল্প এক বিশেষ বন্দুক। চলচ্চিত্র এক তাত্ত্বিক বন্দুক এবং বন্দুক হলো এক কার্যকরী ছবি।”

‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯), ‘খন্ডহর'(১৯৮৩), ‘জেনেসিস’ (১৯৮৬) র মতো সিনেমার মধ্যে দিয়ে মৃণাল প্রমাণ করে দিয়েছেন গোদারের বাক্যগুলো। মানবমনের চিন্তা, বিকাশ, মননের আভ্যন্তরীণ ভাঙন, যন্ত্রণাকে বাস্তবের আড়ালে নিয়ে গিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। তাতে, সমস্ত আবরণ ছিঁড়ে ফেলে কঠোরভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল বাস্তব।

মানবজীবন যে কখনোই এক সুরে কথা বলেনা, তার চরমতম বাস্তবের রূপকে , বাইরে থেকে কমেডির ছাঁচে তুলে ধরেছিলেন ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫) এ। ফুটিয়ে তুলেছিলেন শহর কলকাতার দারিদ্র্যের স্বীকার বেকার যুবকের বেঁচে থাকা, বড় হওয়ার স্বপ্নের নিত্যদিনের লড়াইয়ে অবাস্তবতার অসম্ভব কল্পনায় ভেসে যাওয়া প্রেমকে।

আলোচক ইভস থোরাবল বলেছিলেন- “As Ghatak is obsessed with Partition, Mrinal is obsessed with Famine. ” মৃণালের গুণমুগ্ধ চলচ্চিত্র সমালোচক জন ডাব্লিউ উডের মতে- “The famine, his main enemy is to be understood in a literal and metaphorical sense, for it can manifest in a dimension as much spiritual, as intellectual and economic. “- এর উদাহরণস্বরূপ, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মাথা চাগাড় দেয় ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) এবং ‘আবার বছর কুড়ি পর’ ফিরে আসা ‘আকালের সন্ধানে'(১৯৮০)। ‘বাইশে শ্রাবণ’ নির্মাণের আগের বছরেই কলকাতার রাজপথে ঘটে গেছে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। “ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও। ” – শ্লোগান মুখরিত খাদ্যের দাবীতে সংগঠিত মিছিল। বর্তমানের শহীদ মিনার থেকে মহাকরণের দিকে মিছিলমুখী আশিজন সাধারণ মানুষকে তৎকালীন সরকারের পুলিশ লাঠিপেটা করে খুন করেছে। মৃণাল সেন যন্ত্রণা থেকে তৈরী করেছেন ট্রেনের কামরায় আলতা বিক্রি করা নায়কের চরিত্র এবং তার রূপসী ঘরনীর চরিত্রটির জীবনের কঠোর কাহিনীকে। বিবাহের পরে, আলতা বিক্রি করতে গিয়ে নায়কের রোমান্টিক মন বাঁধ মানেনা। আলতার ব্যবসায় ভাঁটা পড়ার সাথে সাথে দূর্ঘটনায় পা হারান তিনি। ” অদ্য আমাদের বিবাহের এক বৎসর পূর্ণ হইলো”- র মাধুর্যের রেশ কাটতে না কাটতেই জীবনের আকাশে দুর্ভিক্ষের কালো মেঘ ঘনীভূত হলো। আর্থ সামাজিক সংকট শেষ করে দিলো সম্পর্কের টান। ‘আকালের সন্ধানে'(১৯৮০) তে সেন, নিজের এবং স্বশ্রেণীর দিকে আঙুল তুলে একাকার করে দিয়েছেন অতীত এবং বর্তমানের ক্ষুধার পৃথিবীকে। ” ও নদীরে , একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে। বলো কোথায় তোমার দেশ, তোমার নেই কি চলার শেষ?” হলিউডের কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ভর গল্পবলার সাবেকী চলচ্চিত্রীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে ধরে ধরে তৈরি করেছিলেন মহাদেবী ভার্মা’র কাহিনী অবলম্বনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রযোজিত ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৯)। পরে চীনদেশের প্রতিনিধিরা ভারতবর্ষে এলে স্পেশাল ফ্লাইটে করে যে সিনেমা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিয়ে গেছিলেন চীন-ভারত মৈত্রী প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। চীনদেশের সামন্ততান্ত্রিক শাসনে সর্বস্ব খুইয়ে ফেলা চীনা ফেরিওয়ালার উপাখ্যান। ফেরিওয়ালাকে চোখের জলে বিদায়ে দেওয়া তার ‘সিস্টার’ হিসেবে কাছে টেনে নেওয়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানকারী গৃহবধূ। মর্মস্পর্শী সিনেমা।

See Also
Early indians

“বুলু, তোরা কি সব মিথ্যে হয়ে গেলি”- ‘মহাপৃথিবী'( ১৯৯১) সিনেমায় সুক্ষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, বার্লিন পাঁচিল ভাঙার শব্দে উত্তর কলকাতায় সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ হারানো যুবকের মায়ের আত্মহত্যার পর তার ডায়েরীতে পাওয়া সমাজ বদলের আশায় প্রাণত্যাগ করা তরুণদের আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যাওয়ার সংশয়ের প্রশ্ন। সত্তরের দশককে মুক্তির দশক হিসেবে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় তরুণ অরুণদের অস্তাচলে যাওয়া কি সম্পূর্ণরূপে বৃথা হয়ে যাবে এভাবেই! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে গেছেন তিনি সিনেমার মধ্যেও।

ফরিদপুরে স্কুল শিক্ষা শেষ করে ১৯৪০ এ, কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পদার্থবিজ্ঞান অধ্যয়নের সময় থেকেই দেশের টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাম ছাত্র ফেডারেশনের আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই, ১৯৪১ সালে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ রাখার দায়ে কারাবাস হয় মৃণাল সেনের। ঠিক সেই সময়েই বন্ধু বংশীচরণ গুপ্তর সাহচর্যে সিনেমার প্রতি আকর্ষণ, ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীতে নিয়মিত পড়াশোনা এবং গণনাট্য সংঘে প্রবেশ। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই পরবর্তীতে বলেছেন- ” The legacy left by IPTA of the forties found deep roots in our minds. I came later but I was taken in. I continued to line with this legacy to sleep with it. দক্ষিণ কলকাতার ‘প্যারাডাইস’ ক্যাফেতে সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেন, হৃষিকেশ মুখার্জীদের সাথে আড্ডা প্রসঙ্গে বলেছেন-” আমাদের দিনরাত্তির এই আড্ডায় কি ছিলোনা! লেনিন, স্ট্যালিন, গণসঙ্গীত, চ্যাপলিন, আইজেনস্টাইন, রাজশেখর বসু, কমিউনিস্ট পার্টি, পাবলো নেরুদা, পুদভকিন, অরসন ওয়েলস, ফিল্ম সোসাইটি, প্যাসন অফ জোয়ান অফ আর্ক, সমর সেন, ধর্মঘট, ডিসিকা, রোজেলিনি, পিকাসো, সাইট অ্যান্ড সাউন্ড, নিও রিয়েলিজম, নবজীবনের গান, ফেড ইন আর ফেড আউট’।” নিজের জীবনের সাফল্যের অংশীদার হিসেবে অকপট স্বীকার করেছেন প্রেমিকা এবং সেখান থেকে পরবর্তীকালে স্ত্রী গীতার কথা। সাক্ষাৎকারে বলেছেন-” এক সোম দিয়েছে জীবন (স্ত্রী গীতা সোম) অন্য সোম (ভুবন সোম) প্রতিষ্ঠা। ”

মৃণাল সেন লিখিত ‘দুধারা’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য গীতা সোমের সাথে একটি দলের মাধ্যমে তার যোগাযোগ শুরু। অভিভাবকহীন, অভাবের সংসার থেকে উঠে আসা একটি মেয়ে। রিহার্সাল শেষে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে বিবাহের আগে থেকেই নিজের বেকবাগানের বাড়ির অভাবের সংসার এবং যুবতীর বাড়ির আর্থিক অনটন সামলানোর মাঝেই শুরু হয় প্রেমালাপ। ভবানীপুরে্র একটি বাড়িতে ‘মরা চাঁদ’, ‘নীলদর্পণ’,’জ্বালা’, ‘বিসর্জন’- প্রমুখ নাটকের রিহার্সাল থেকে আরো চেনাজানা হয় উভয়ের। অশ্বিনী দত্ত রোডের বাড়িতে অভাবের সংসার পেতে সামান্য টাকা রোজগারের চেষ্টায় পাড়ি দিয়েছিলেন লক্ষৌ, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে। সিনেমা তৈরীর ইচ্ছেয় বরাবর সেখান থেকে স্ত্রী’কে চিঠি দিতেন। স্ত্রী গীতার সমর্থনেই সেখান থেকে ফিরে এসে প্রথম সিনেমা তৈরী করলেন ‘রাতভোর'(১৯৫৫)। পরের সিনেমা ‘নীল আকাশের নীচে'(১৯৫৯) । পছন্দ হয়নি নিজের। ‘রাতভোর’ এর উদ্দেশ্যে ভেবেছেন-” সাংঘাতিক খারাপ ছবি। ছবি করতে আমি জানিনা। ” মারাত্মক আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে কখনো ভেবেছেন আত্মহত্যার কথা। এখানেও সামলে নিয়েছেন সঙ্গীনি। তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ এর পর আস্থা পেলেন নিজের ওপর। ‘ভুবন সোম’ তৈরীর সুবাদে জীবনের মোড় এবং অশ্বিনী দত্ত রোডের বাড়ির মোড় ও ঘুরে গেলো। উঠে এলেন মতিলাল নেহেরু রোডের বাড়িতে। ছবির সেটে রান্নাঘর সাজানো থেকে শুরু করে সিনেমার মধ্যে সুক্ষ্ম মেয়েলি বিষয়গুলোর সম্পূর্ণ ভার দিতেন স্ত্রীয়ের ওপর। এবং মৃণালের পরিচালকের দৃষ্টিতে ‘কলকাতা ৭১’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘চালচিত্র’, ‘খারিজ’ এর মতো সিনেমাগুলিতে মায়ের চরিত্রে সঠিক অভিনেত্রী হিসেবেও খুঁজে পেয়েছেন, পরিচিত করেছেন গীতাকে। নতুন স্ক্রিপ্ট লেখা নিয়ে বরাবর আলোচনা করেছেন স্ত্রী গীতার সাথে। ছবির স্ক্রিপ্ট পছন্দ না হলে, অভিমানের ধমক ও দিয়েছেন স্ত্রী, তা স্বীকারও করেছেন অকপট। তৈরী করেছেন ‘পুনশ্চ'(১৯৬১), ‘অবশেষে’ (১৯৬৩), ‘প্রতিনিধি'(১৯৬৪), ‘ইচ্ছাপূরণ’ (১৯৭০), ‘পরশুরাম'(১৯৭৮), ‘অন্তরীণ'(১৯৯৩), ‘আমার ভুবন'(২০০২) এর মতো কালজয়ী সিনেমা। ‘মাটির মনিষ'(১৯৬৬), ‘এক আধুরি কাহানী'( ১৯৭১), ‘মৃগয়া'(১৯৭৬), ‘ওকা উরি কথা'(১৯৭৭), ‘একদিন আচানক'( ১৯৮৯) এর মতো সিনেমার মাধ্যমেও অন্যান্য ভাষার মাধ্যমে নিজের বক্তব্য হাজির করেছেন দর্শকের সামনে। সিনেমার জন্য গল্প সংগ্রহ করেছেন মহাদেবী বর্মা, কানাই বসু, আশীষ বর্মন, বনফুল, সমরেশ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুবোধ ঘোষ, প্রেমচাঁদ, মান্টোর লেখা থেকে। সিনেমা তৈরির সাথে সাথেই কলম চালিয়ে সিনেমা জগতকে উপহার দিয়ে গেছেন ‘চার্লি চ্যাপলিন’ (প্রচ্ছদ তৈরি করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়), ‘আমি এবং চলচ্চিত্র’, ‘চলচ্চিত্র: ভূত বর্তমান ভবিষ্যৎ’, ‘Views on cinema’ র মতো গ্রন্থ ।

‘পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউট’ থেকে ঐ “টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম” ছেলেটাকে খুঁজে পেয়েছিলেন ‘মৃগয়া’ র জন্য। পুত্র কুনালের মতোই স্নেহ দিয়ে তৈরি করেছিলেন অভিনেতা অঞ্জন দত্ত থেকে পরিচালক অঞ্জন দত্তকে। অঞ্জন দত্তও পিতার মতো শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তাঁর প্রতি, যার প্রমাণ ‘Dutt vs Dutt’ (২০১২) । অর্জন করেছেন ‘পদ্মভূষণ'(১৯৮১), ‘দাদাসাহেব ফালকে'(২০০৫), ফ্রান্স সরকারের ‘কম্যান্ডার অফ দ্য অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস’ এর মতো পুরস্কার, সম্মান। শারীরিক কারণে নিজে অনুপস্থিত থাকলে পুরষ্কার গ্রহণ করতে পাঠিয়েছেন মানসপুত্র অঞ্জনকে।কালের নিয়মে ২০১৮র ৩০ শে ডিসেম্বর আসলেও; মানবমুক্তির লড়াইয়ে সামিল হওয়া, ‘আকালের সন্ধান’ করা, ‘প্রাইভেট মার্কসিস্ট’ যেনো আজও শিখিয়ে যান- “পৃথিবী ভাঙছে, পুড়ছে, ছিন্নভিন্ন হচ্ছে। তবুও মানুষ বেঁচে বর্তে থাকে মহত্বের, ভালোবাসায়, সহমর্মিতায়। “

What's Your Reaction?
Excited
2
Happy
0
In Love
4
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top