পাসিঘাট -এ নোট বাতিলের ঝড়
Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks…
পাসিঘাট -এর উপর নোটবন্দির প্রভাব নিয়ে একটি বিশদ বর্ণনা, যেখানে ছোট শহরের অর্থনীতি, কৃষি, বাজার, এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের সংকটের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
তখন ছিলাম অরুনাচলের একটি ছোট্ট শহরে। পাসিঘাট, চারপাশে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট এক শহর। মাত্রই হাজার পঁচিশেক লোকের বাস। শহরের অর্থনীতির হাল বোঝা যায় ব্যাঙ্কের সংখ্যা দেখে। এখানে পাঁচ/ছটা সরকারী ও তিনটি বেসরকারী ব্যাঙ্কের শাখা আছে।
পাসিঘাট অরুনাচল প্রদেশের পূর্ব সিয়াং জেলার সদর দপ্তর। তিব্বতের মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে সাংপো নদ অরুনাচলে প্রবেশ করে এই সিয়াং নামে। সিয়াং নদকে ঘিরে আছে পাঁচটা জেলা। সিয়াং, পূর্ব সিয়াং, পশ্চিম সিয়াং, আপার সিয়াং ও লোয়ার সিয়াং। অরুনাচলে কিছুদুর যাবার পর সিয়াং এর নাম বদলে হয়ে যায় দিহাং। পাসিঘাটের কাছে দিহাং এ এসে মিলিত হয় দিবাং ও লোহিত নামে আরো দুটো বড় নদী। তারপর তিনটে নদী এক হয়ে আসামে ঢোকে ব্রহ্মপুত্র নামে। ঐ তিন নদীর সঙ্গমে তৈরী হয়েছে ১৯০ বর্গ কিলোমিটারের এক বিশাল জলাভূমি। সেই জলাভূমি জুড়ে গড়ে উঠেছে ডেইং এরিং অভয়ারণ্য। সেই অভয়ারণ্য ভ্রমণের একমাত্র ভরসা নৌকা। ঠান্ডা পড়তে শুরু হয়েছে, জলাভূমি ভরে উঠছে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পরিযায়ী পাখিতে।
চারিদিকের পাহাড়ের ওপর ছোটবড় বেশকিছু কমলালেবুর বাগান। পাকা কমলার মৃদু সুবাস ভেসে আসে শহরের কোনায় কোনায়। পাহাড়ের আনাচে কানাচে ছোট ছোট জমিতে টমাটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ক্যাপ্সিকাম ও অন্যান্য সব্জির চাষ। অফিসের সামনেই পাসিঘাটের মূল বাজার। বাজার নানা ধরনের স্থানীয় ও চালানী সব্জি, মাছ, মুরগী আর শুয়োরের মাংসে ভরা। আর পাওয়া যায় আগুনে পোড়ানো শুকনো মাছ ও সিল্কওয়ার্ম। সিল্কওয়ার্মের পকোড়া দারুন সুস্বাদু। এছাড়া আছে কমলালেবুর বাজার পাইকারী ও খুচরা। সকাল থেকে বেলা একটা অবধি বাজার সড়গরম থাকে আবার তিনটে থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত গমগম করে।
আট তারিখ সন্ধ্যায় নোট বাতিলের ঘোষনার পর আরও অসংখ্য সাধারন মানুষের সঙ্গে আমিও উৎফুল্ল হলাম। ভাবলাম ‘যাক, অবশেষে ভাল কিছু হতে চলেছে’। দু ঘন্টার মধ্যেই মমতা ব্যানার্জীর, হ্যাঁ একমাত্র মমতা ব্যানার্জীর, প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ল। বিরক্ত হলাম, সবকিছুতেই প্রতিবাদ।
এখানে হোটেলে থাকি। হোটেলের বিল কার্ডে পেমেন্ট হবে। তার বাইরে প্রতিদিন পাঁচ-সাতশো টাকা খরচ। প্রথম ধাক্কাটা খেলাম সিগারেট কিনতে গিয়ে। দোকানদার পাঁচশো টাকার নোট নেবে কিন্তু খুচরো দিতে পারবে না। সুতরাং পাঁচশো টাকার সিগারেট কিনতে হল। অবশ্য তাতেও লাভ হল। পাইকারী দামে পেলাম। এভাবে চলতে পারে না। পরদিন ব্যাঙ্কে গেলাম। আবারো ধাক্কা। সরকার বলেছে জনপ্রতি দশ হাজার টাকা পাওয়া যাবে, কিন্তু ব্যাঙ্ক দিচ্ছে মাত্র দুই হাজার। কারন নগদের জোগান নেই। বর্তমানে ব্যাঙ্কের নগদ জমার ৯০% থাকে ৫০০/১০০০ টাকার নোটে। সেগুলি বাতিল, নতুন নোট এসে পৌঁছয় নি। তবে সরকারের এমন অধ্যাদেশের অর্থ কি যা সরকারি ব্যাঙ্কই পালন করতে পারবে না। লোকজনের কিন্তু উৎসাহের অন্ত নেই। মনে হচ্ছে দেশসেবার পরব লেগেছে। ভাবখানা যেন ‘কে বা আগে প্রাণ করিবেক দান তারি লাগি কাড়াকাড়ি’।
আজ এক সপ্তাহ পরে বুঝতে পারছি নোট বাতিলের প্রভাব কি ভয়ঙ্কর হতে চলেছে।
পাসিঘাটের বাজারে ভিড় কমেছে। সাড়ে চারটের মধ্যে বাজার জনশূন্য। ক্রেতার অভাবে বিক্রেতারাও বাজার ছেড়েছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অন্যান্য দোকানও। একে খুচরোর অভাব উপরন্তু ক্রেতার অভাব।
এসময়ে প্রতিদিন প্রায় হাফ ডজন ট্রাক আসে পাসিঘাটে। তারা আসে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, যেমন আলু, পেঁয়াজ, ডাল, তেল, নুন, চিনি বা সাবান এবং গেরস্থালির নানান জিনিস, প্লাস্টিকের চায়ের ছাঁকনি থেকে রেফ্রিজারেটর নিয়ে, আর ফিরে যায় কমলালেবু নিয়ে। গত সাতদিন ধরে তারা আসছে না। গাছের কমলা ঝরে পড়ছে। কাজ হারাচ্ছে বাগিচা শ্রমিকরা। কাজ হারিয়েছে মাল ওঠানো-নামানোর কাজ করা শ্রমিকরাও। এক সপ্তাহ আগের ১০০ টাকা ডজনের কমলা এখন ৫০/৬০ টাকা।
প্রতিদিন ডজন খানেক ছোটহাতি গাড়ি সমতল থেকে পাসিঘাট আসে। তারা ছোট ছোট পাহাড়ী গ্রামে ঘুরে ঘুরে ক্ষেত থেকেই নগদ টাকায় সব্জি কিনে গাড়ী বোঝাই করে ফিরে যায়। নগদ টাকার অভাবে তারাও গত সাতদিন আসেনি। ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই পচছে।
এখানে সোমবার বাজার বন্ধ থাকে। ছোট ব্যবসায়ীরা রবিবার রাতের ট্রেনে গৌহাটি গিয়ে পরদিন ATM থেকে ২৫/৫০ হাজার টাকা তুলে কেনাকাটা করে আবার রাতের ট্রেন ধরে মঙ্গলবার সকালে ফিরে আসে। এখন ATMএ দুহাজার টাকার বেশী পাবেনা তাই গত সপ্তাহে তারাও যায়নি। বড় ব্যবসায়ীরা অবশ্য টাকা ইলেকট্রনিক ট্রান্সফার করে। কিন্তু তারাও ভরসা করে টাকা পাঠাচ্ছে না। কারন মাল নিয়ে ট্রাক কবে আসবে তার স্থিরতা নেই। ফলে ব্যাপারীর দোকানে মাল বাড়ন্ত।
টাকার ডিজিট্যাল ট্রান্সফার সম্ভব হলেও নুন, চিনি, তেলের ডিজিট্যাল ট্রান্সফার এখনও সম্ভব নয়।
অফিসের পাশে, মাস পাঁচেক আগে পুড়ে যাওয়া বাজারের অংশটার পূননির্মান শুরু হয়েছে। সপ্তাহান্তে ঠিকাদার শ্রমিকদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে বাতিল ৫০০/১০০০ এর নোট। এই ঠিকাশ্রমিকরা সমতল থেকে আসা, এখানে তাদের না আছে ব্যাঙ্কের খাতা না আছে সচিত্র পরিচয় পত্র। টাকা ভাঙাতে না পেরে তারা দলবেঁধে ফিরে গেছে। কাজ বন্ধ।
এখানে বাজারের পাশে ছোটখাটো খাবারের দোকানগুলো সবই বাঙালী বা বিহারীরা চালায়। তেমনই একটা বাঙালীর হোটেলে দুপুরের খাবার খাই। দুটোর পর অনেক সময়ই বসার জায়গা পাওয়া যেত না। এখন ফাঁকাই থাকে। বাজারে লোকের আনাগোনা কমেছে তাই হোটেলের খদ্দেরও কম। আগে ঐ দোকানে মাটন, চিকেন সহ দু-তিন রকম মাছের পদ পাওয়া যেত। এখন শুধুই চিকেন আর লোকাল মাছ। কাল রুটির সঙ্গে আলুগোবি চাইতে বর্মনবাবু বললেন “স্যার, আলুগোবির বদলে গোবি-টমেটো টেস্ট করুন, ভাল লাগবে”। আসলে আলু আসে বাইরে থেকে। সরবরাহের অভাবে তার দাম বাড়ছে। আর গোবি, টমেটো দুটোই স্থানীয়, ক্রেতার অভাবে তার দাম কমছে।
পাসিঘাট জেলা সদর। নানা কাজে লোকজন এখানে আসে। পাহাড়ী পথে পরিবহন বলতে সুমো-বোলেরো জাতীয় গাড়ীই ভরসা। বাজারের পাশ থেকেই গাড়ীগুলো যাতায়াত করে। আগে সেখানে হাঁকডাক লেগেই থাকতো, এখন কেমন চুপচাপ। গাড়ী কমেছে, যাত্রীও কম তাই দশ জনের বদলে ছয়/সাত জনকে নিয়েই গাড়ী রওনা দিচ্ছে।
অফিসে যাওয়ার পথটুকু পার হই অটোতে। রোজই মিনিট দশেক দাঁড়াতে হয়। ভরতি অটোগুলো সামনে দিয়ে চলে যায়, হাত দেখালেও থামে না। এখনও দাঁড়াতে হয় গাড়ীর দেখা পেতে। অটোওয়ালা আমায় দেখে গাড়ী থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে ‘যাবেন নাকি?’। কথা বলে জানলাম, আগে অটোওয়ালারা দিনে ছয়/সাতশো টাকা আয় করতো, এখন হচ্ছে তিনশোরও কম। অটো মালিকের পাওনা দিনে চারশো, এরফলে যাদের নিজস্ব গাড়ী নেই তারা চালানো বন্ধ করেছে।
মাত্রই সাতদিন অতিক্রান্ত হয়েছে নোট বাতিলের পর। এরমধ্যেই কৃষি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। সাত সপ্তাহ পরে এদের কি হবে? কে দায়িত্ব নেবে শ্রমদিবসের এই বিপুল অপচয়ের? দেশ কি এক স্বরোপিত বিপুল মন্দার সন্মুখিন?
What's Your Reaction?
Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks trade analyst. In the course of his job, he had been posted all across the eastern and northeaster states. He has a great passion for writing. He has written many deeply touching stories about the common men and women he got to meet during his tenure. He is also a specialist contrarian amateur historian especially on issues like the history of Bengal and of the Bengal Renaissance.