নাহারলাগুন -এর নমিতা
Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks…
নমিতার জীবন সংগ্রামের কাহিনি। নাহারলাগুন -এর এক ছোটখাটো হোটেলের মালিক নমিতা, যিনি প্রতিদিনের লড়াই, জীবিকা এবং পরিবারের দায়িত্ব সামলে জীবনযুদ্ধে টিকে আছেন।
তখন ছিলাম নাহারলাগুন -এ, অফিসের কাজে। অরুনাচলের রাজধানী ইটানগরের পাশেই নাহারলাগুন। যেমন কোলকাতা আর দমদম। কোথায় শেষ আর কোথায় শুরু বোঝা যায় না।
অফিসের আশেপাশে কয়েকটা ছোটখাটো খাবার দোকান। এমনই এক খাবার দোকান চালায় মিনতি। কুড়ি বছর আগে, কুচবিহারের মোয়ামারীর পনেরো বছরের মিনতি ঘর ছেড়েছিল বছর পঁচিশের নিতাইয়ের হাত ধরে। তখন থেকেই তারা নাহারলাগুন -এ। আজ হৃদরোগে শয্যাশায়ী সেই নেতাই আর অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী, বছর পনেরোর মেয়ে মাধুরীকে নিয়ে মিনতির সংসার।
অরুণাচলে বাইরের লোকের ব্যবসা নিষিদ্ধ। ১৮৬৬ সালে আসামে প্রথম খনিজ তেল বা পেট্রোলের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। ১৮৭৩ সালে, ইংরেজ সরকার খনিজ তেল, চা ও হাতির দাঁতের বানিজ্যে একচেটিয়া অধিকার বজায় রাখতে সমগ্ৰ উত্তরপূর্বে “Bengal Eastern Frontier Regulations” নাম দিয়ে একটা আইন করে। যার ফলে যে কোন ভারতীয় ‘ব্রিটিশ প্রজা’কে উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে প্রবেশ করতে গেলে আভ্যন্তরীণ ভ্রমনের অনুমতিপত্র পত্র বা ইনার লাইন পারমিট (ILP) বাধ্যতামূলক করা হয়। স্বাধীনতার পরে ১৯৫০ সালে ঐ আইনে সামান্য পরিবর্তন করে ‘ব্রিটিশ প্রজা’ কথাটা শুধু তুলে দেওয়া হয়। ঐ আইনেই উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বহিরাগতদের ব্যবসার অনুমতি দেওয়া নিষিদ্ধ।
অরুণাচলের আয়তন প্রায় পশ্চিমবঙ্গের সমান কিন্তু জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের সত্তর ভাগের এক ভাগ মাত্র। সুতরাং সব পরিবারই প্রচুর জমির মালিক, সবাই জমিদার। মিনতির হোটেল তেমনি এক জমিদারের জমিতে। হোটেল ব্যবসার অনুমতিপত্রও জমির মালিকের নামে।
ছোট্ট সস্তার হোটেল মিনতির। গোটাচারেক নড়বড়ে টেবিল, সঙ্গে প্লাসটিকের চেয়ার। রোজই ভোররাতে উঠে পড়ে মিনতি। বাড়ির কাজকর্ম সামলিয়ে, চা বানিয়ে, মেয়ে আর বরের সঙ্গে চা বিস্কুট খেতে খেতেই এসে পড়ে প্রতিবেশী এক মধ্যবয়সী বিধবা আর আর এক নাবালক। এরাই মিনতির হোটেলের সাহায্যকারী। চা বিস্কুট তারাও খায়। এরপর মিনতি মধ্যবয়সী বিধবা ও নাবালকের সঙ্গে পাহাড় থেকে নেমে আসে নীচের দোকানে।
এসেই তিনজনে রান্নাবান্নায় লেগে পড়ে। সাড়ে ছটায় দুধ এসে যায়, সাতটা থেকেই শুরু হয়ে যায় সকালের চায়ের খদ্দের। সঙ্গে থাকে স্থানীয় বেকরির পাউরুটি ও আলুরদম বা ওমলেট। এছাড়া থাকে স্থানীয় বেকারির নানারকম সস্তার বিস্কুট, গুটকার প্যাকেট আর বিড়ি, সিগারেট। সেই সব সামলে, মিনতি ভাত, ডাল, সবজি, ডিমের কারি রান্না সেরে ফেলে সাড়ে আটটার মধ্যেই। একটা টিফিন ক্যারিয়ারে দুটো অমলেট সহ দুজনের খাবার নিয়ে নাবালক পৌঁছে দেয় পাহাড়ের ওপরে মিনতির ঘরে। মেয়ে বাবাকে খাইয়ে নিজে খেয়ে স্কুল যাবে, যাবার পথে নামিয়ে দিয়ে যাবে টিফিন ক্যারিয়ারটা। মিনতি বেরিয়ে যায় বাজারে। মাছ মাংসের বাজার, মিনতি, দিনেরটা দিনেই করে। ওর ঘরে ফ্রিজ নেই।
বাজার থেকে ফিরে, মাছ, মাংস নাবালকের হাতে দিয়ে চায়ের কেটলি আর খান দশেক কাগজের কাপ নিয়ে মিনতি আবার বেরিয়ে যায়। চলে যায় পাশের ব্যাঙ্কে। চা দিয়ে আগের দিনের টাকাগুলো গুছিয়ে হিসেব করে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে ফিরে আসে।
চায়ের কেটলিটা নামিয়ে দিয়েই বসে পড়ে ধুয়ে রাখা মাছ মাংস টুকরো করতে। নিপুণ হাতে সেগুলো টুকরো করে রান্না চাপিয়ে দেয়। এগারোটা থেকেই ভাতের খদ্দের আসতে থাকে। তার আগেই রান্না শেষ করে, মিনতি এসে বসে পড়ে কাউন্টারে। হেঁশেল সামলায় মধ্যবয়সী আর টেবিল সামলায় নাবালক। থালি সিস্টেম, সব্জী ভাত ৬০ টাকা, ডিম ভাত ৮০ টাকা, মাছ ভাত ১০০ টাকা আর মাংস ভাত ১২০ টাকা। ৭০/৭৫ থালি রোজের বিক্রি। সাড়ে তিনটে পর্যন্ত চলে। তারপর এক এক করে মধ্যবয়সী আর নাবালক দুপুরের খাওয়া সারে। এরপর মিনতি বরের ও নিজের খাবারটা গুছিয়ে নিয়ে উঠে যায় পিছনের পাহাড়ে নিজের বসতিতে, সঙ্গে নেয় ক্যাশ ব্যাগটা। বরকে খাইয়ে নিজে খেয়ে মিনতি হিসাবে বসে। ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজারেই আটকে থাকে রোজের হিসাব, যেদিন সাত হাজার ছাড়ায় সেদিন একটা মৃদু হাসি ঝুলে থাকে মিনতির মুখে।
মিনতি প্রথমেই চারশো টাকা সরিয়ে ক্যাশ ব্যাগের এক কোনে রাখে। মাঝবয়সীর ২৫০ আর নাবালকের ১৫০। মিনতি বকেয়া রাখেনা, ভয়ে, পাছে দিনে দিনে বেড়ে ওঠে দেনা। এরপর ১০০০ টাকা ফেলে দেয় মাসকাবারি বাক্সে। ওই দিয়েই চলবে সারা মাস, বাড়ী ভাড়া, হোটেল ভাড়া, বরের ওষুধ মায় মেয়ের স্কুলের খরচ। ৫০০ টাকা রাখে মেয়ের ভবিষ্যতের বাক্সে। মেয়ে বড় হচ্ছে।
বাকি টাকা কটা নিয়ে মিনতি আবার নেমে যায় হোটেলে। ইতোমধ্যে মাঝবয়সী আর নাবালক মিলে বাসনপত্র, টেবিল-চেয়ার পরিস্কার করে ফেলেছে। হোটেল বন্ধ করে তিনজনে যায় বাজারে। মিনতির পুঁজিপাটা নেতাইয়ের রোগের পেছনে গলে গেছে। তার এখন রোজকার কেনাবেচা।
বাজার সেরে তিনজনে ফিরে আসে হোটেলে। শাক-সবজি কেটে ধুয়ে প্যাকেটবন্দী করতে করতেই প্রায় আটটা বেজে যায়। সকালের বেঁচে যাওয়া সব্জীর সঙ্গে অল্প ভাত ফুটিয়ে নিয়ে তিনজনে ভাগাভাগি করে নেয়। তারপর রওনা দেয় অন্ধকার চড়াই পথে। যেতে যেতেই নমিতা মিটিয়ে দেয় মাঝবয়সী আর নাবালকের টাকা।
এখন আর ওরা নমিতার কর্মচারী নয়, সহকর্মীও নয়। ওরা এখন তিন সহযোদ্ধা। ওরা তিনজন একই আঁধার পথের পথিক। একসাথে পার হবে অনেকটা চড়াই। ওদের ডিঙ্গোতে হবে অনেক পাহাড়।
ঘরে পা দিয়ে নমিতা বাজারের পর বেঁচে যাওয়া শ-তিনেক টাকা রাখে জরুরী প্রয়োজনের বাক্সে। কুড়ি বছরের পথযাত্রা নমিতাকে অনেক হিসেবি করেছে। শেষ হয় নমিতার সে দিনের লড়াই। আর মেয়ে ও রুগ্ন স্বামীর দিকে চোখ পড়তেই সে সংগ্রহ করে নেয় পরের দিনের লড়াইয়ের রসদ।
নমিতার হিসাবের পর এবার আমরা একটু হিসাব করি।
মধ্যরাতে চালু হল পণ্য পরিষেবা কর। বাজার সরগরম। নীতিগত ভাবে কেউই এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নয়। প্রশ্ন করের হার, পদ্ধতি ও সময় নিয়ে।
সরকার বলছে ছোট ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। কত ছোট? যাদের বাৎসরিক ব্যবসার পরিমান ২০ লক্ষ টাকার কম। ২০ লক্ষ তো অনেক টাকা। তাই কি? হিসাব করা যাক।
নমিতার দৈনিক ব্যবসা গড়ে ৬০০০ টাকা।
মাসে ৬০০০×৩০=১,৮০,০০০ টাকা।
বছরে ১,৮০,০০০×১২=২১,৬০,০০০ টাকা।
তাহলে নমিতা তো ছোট ব্যবসায়ী নয়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছাড় ১০ লক্ষ টাকা। সেই হিসাবে নমিতা বেশ বড় ব্যবসায়ী। তাইতো, মন্ত্রীমশায়?
ধুউউস, অত ভাবলে মাথা খারাপ তার থেকে ভাল ইউটিউবে গান শোনা, বাংলাদেশের লীলার গান।
“রাজার পোষা বুদ্ধিজীবি সুশীলসমাজ নাম
রাজার বাণী জাবর কাটা এইডা তাগো কাম।
সুশীলসমাজ কয় কি, শুন জনগন
আমরা কিন্তু গরীব আছি, রাজা মেহেরবান।
রাজা দিব স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মান
দ্যাশের জন্য আমাদের কিবা অবদান।
এতকিছু দিব রাজা আমরা দিমু কি
কাছা খুইলা দিয়া রাখছি, কিছু কইরা যান,
রাজা, কিছু কইরা যান।
What's Your Reaction?
Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks trade analyst. In the course of his job, he had been posted all across the eastern and northeaster states. He has a great passion for writing. He has written many deeply touching stories about the common men and women he got to meet during his tenure. He is also a specialist contrarian amateur historian especially on issues like the history of Bengal and of the Bengal Renaissance.