তিয়াসা নদী



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
চল্লিশ বছর পর তিয়াসা আর বাবানের পুনর্মিলন, পুরনো স্মৃতির ভিড়, ভালোবাসার অপূর্ণ কাহিনি। শরতের বিকেলে শিউলি ফুল, লেকের ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছ, আর হৃদয়ে গোপনে থাকা ভালোবাসার গল্প।
বহু বছর পর পর্ণার বিয়ের আইবুড়োভাতে তিয়াসার সঙ্গে বাবানের দেখা। কত বছর হবে? নয় নয় করে চল্লিশ বছর তো বটেই।
বাবানের খুড়তুতো বোন ঋতজার সঙ্গে তিয়াসা খুব ছোট থেকে একই স্কুলে পড়তো। দুজনে খুব বন্ধু। বাবানদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। বাবান তখন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে, তিয়াসার ক্লাস এলেভেন।
সময় কত তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলে, মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। তিয়াসা কে বাবানের ভালো লাগতো। প্রেম ব্যাপারটা তখনও ঠিক মতন দানা বেঁধে ওঠেনি। উনিশের বাবান বা সতেরোর তিয়াসার পক্ষে প্রেমের নব্যতা বোঝার বয়স হয়নি তখনও।
ঋতজার মেয়ে পর্নার আইবুড়োভাতে আবার দেখা তিয়াসার সঙ্গে। তিয়াসা এখন অন্যের ঘরণী, দুই সন্তানের মা। বাবান সদ্য রিটায়ার করা প্রবীণ নাগরিক। স্ত্রী, পুত্র নিয়ে পাক্কা সংসারী। বিয়ে বাড়ির ভিড়ের মাঝে তিয়াসা, আড় চোখে বারে বারে বাবান কে দেখে, অচেনার ভান করে। বাবান বুঝতে পারে তিয়াসার নজর তার দিকে। খুব ইচ্ছে করে একবার গিয়ে তিয়াসার সামনে দাঁড়ায়, বলে “কেমন আছো তিয়াসা?”
জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে “চল্লিশ বছরে একদিনের জন্য কি মনে পড়েনি বাবান কে?”
বিয়ে বাড়ির হট্টগোলের মাঝে সে কথা বলা হয়নি। যেমন তিয়াসা কে সেদিন বলতে পারেনি ‘ছোট ডিঙি নৌকায় সংসার সমুদ্রে ভেসে পড়ার কথা।’
শরতের বিকেলে লেকের ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বেঞ্চে বসে তিয়াসার কোলে এক আঁজলা শিউলি ফুল ঢেলে দিয়ে বাবন বলেছিলো “আজ থেকে পৃথিবীর সব শিউলি ফুলের গন্ধ শুধু তোমার তিয়াসা।”
তিয়াসা কাজল টানা চোখে বাবানের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো “বাবান, তুমি আমায় এমন কিছু দিতে পারো, যা অন্য কেউ পারে না?”
বাবান নীল আকাশে এক টুকরো সাদা মেঘ দেখিয়ে বলেছিলো “আজ থেকে ওই মেঘটা তোমার। ওর নাম হোক তিয়াসা।”
গালে টোল ফেলে হেসে তিয়াসা বলেছিল “যখন ওই মেঘটা থাকবে না, তখন?”
উত্তরে বাবান বলেছিল “তুমি ওই মেঘ হয়ে, আমার মনে থাকবে। আমি যখন চাকরি করবো, তোমার জন্য এমন একটা জিনিস কিনবো, যা কেউ কখনো কেনে নি, কেনার কথা ভাবতেও পারে না।”
বাবান কোনদিন তার ভাবনার কথা প্রকাশ করে নি।
গোলপার্কের বাসস্টপে দাঁড়িয়ে তিয়াসা সেদিন বারে বারে বলেছিলো “বলো না, কি কিনে দেবে?”
বাবান বলে নি। ভেবেছে কিনে একবারে চমকে দেবে। তারপর তিয়াসা কে বলবে তার মনের কথা, ভালোবাসার কথা।
সেই শেষ দেখা তিয়াসার সাথে। সময় এগিয়েছে, ভালো চাকরি করেছে বাবান। টাকা জমিয়েছে বিস্তর। ছোটবেলার খুব কাছের মানুষ তিয়াসার জন্য একটি নদী কিনবে ভেবেছে বাবান! উঁচু পাহাড়ের পায়ে পায়ে ছোট ছোট নুড়ি পাথর দুহাতে ঠেলে সরিয়ে ধাবমান কাল হ’তে বয়ে চলা সরু একটি নদী। যে নদীকে পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যাবে, কাছে যাওয়া যাবে না, কেউ এখনও ছুঁয়ে দেখে নি — নদীর নাম রাখবে ‘তিয়াসা’। সে নদীর ঠান্ডা জলে তিয়াসার হাত ডুবিয়ে বলবে, “এই নদীটা আজ থেকে তোমার, শুধু তোমার তিয়াসা।
গতবছর অরুণাচলের ভালুকপঙে ‘জিও ভারিলী’ নদী দেখে বাবানের বড় আফসোস। এইরকম নদী সারা জীবন খুঁজে এসেছে — দেখা মেলে নি।
তিয়াসা, আমি নদী খুঁজে পেয়েছি। তোমাকে কিনে দিতে চাই। এই রকম উপহার এর আগে কেউ কখনো কাউকে দেয় নি। তুমি নেবে সে উপহার? যেমন নিয়েছিলে শরতের শিউলি ফুল, ভুবন ভোলানো হাসি ছড়িয়ে। আচ্ছা, হাসলে এখনো তোমার গালে টোল পড়ে?
এত বছর বাদে আজ তোমাকে আবার দেখতে পেলাম। পর্ণার বিয়েতে না আসলে, হয়তো জীবনে কোনদিন দেখাই হতো না। কি আশ্চর্য দেখো, একই শহরে আমরা দুজনে থাকি, তবু দেখা নেই প্রায় চল্লিশ বছর, বড্ড দীর্ঘ সময়। সেই যে তুমি বাই ওয়ান আসছে বলে বাসে উঠে গেলে……।
তিয়াসা, তোমাকে নদী কিনে দেওয়া হলো না। তুমি ভালো থেকো।
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.