Now Reading
চাল-চিত্র: জাতীয়তাবাদ এবং চলচ্চিত্র

চাল-চিত্র: জাতীয়তাবাদ এবং চলচ্চিত্র

Avatar photo
চাল-চিত্র

প্রবন্ধটি চাল-চিত্র র মাধ্যমে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতবর্ষে ‘জাতীয়তাবাদ’-এর ধারা ও তার বিবর্তনের একটি বিশ্লেষণাত্মক চিত্র তুলে ধরে। ১৯৫০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বিভিন্ন দশকে হিন্দি চলচ্চিত্র কিভাবে জাতীয় চেতনা, সমাজব্যবস্থা ও মানুষের জীবনের প্রতিফলন ঘটিয়েছে, তা ধাপে ধাপে তুলে ধরা হয়েছে।

 

” জব তক সানিমা (সিনেমা) হ্যায়, লোগ তোহ্ …….”

থাক থাক। বাকি অংশটুকু না লেখাই থাক। সেটুকু লিখে ফেললে, আমার এই লেখা যে যৎসামান্য কিছু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও করতে পারতো, তারা নয় আমাকে দু চার অক্ষরের কিছু একটা….আর নয়তোবা এই প্রথম লাইনটি পড়ার পরেই বিরক্তির চোটে ওখানেই প্রবন্ধটা চোখ বোলানোয় ইতি টানবেন। আর যারা সিনেমাটির (গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর, ২; যারা দেখেননি, তারা চাইলে ইউটিউবে থাকা শর্টসে এই অংশটুকু দেখে নিতে পারেন, সেই কারণে উল্লেখ করা) এই অংশটা মনে করতে পারছেন, আমি আন্দাজ করতে পারছি, তাদের গালে ইতিমধ্যেই মুচকি হাসির ভাঁজ পড়ে গেছে। তা হঠাৎ একটা প্রবন্ধ বা প্রবন্ধ জাতীয় কিছু লিখতে গিয়ে এসব সিনেমার ডায়ালগ, আলতু ফালতু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ উল্লেখের কারণ! এই “প্রশ্ন গুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা।” হ্যাঁ, জানা তো নিশ্চয়ই, তবে সেগুলো যাতে ভাবনার অতলে না তলিয়ে যায়, তাদের সাথে গভীর সম্পর্কযুক্ত এবং মাঝেসাঝেই মনের মধ্যে জেগে ওঠা প্রশ্নগুলো যাতে ছাইচাপা পড়ে না যায়, সেই কারণে যৎসামান্য এই চেষ্টা। প্রবন্ধের এই বিষয়টার প্রতি টানের সাথে গভীর জ্ঞানের যথেষ্ট অভাবের সমানুপাতিক সম্পর্ক, অযাচিত শব্দসংখ্যা বৃদ্ধি না করতে চাওয়া এবং বেশ কিছু ভুল ও ভ্রান্তির হাত ধরেই এই উপস্থাপনার চেষ্টা, তা বলাই বাহুল্য।

****************************

(১)

“At the stroke of the midnight hour, when the world sleeps, India will awake to life and freedom…” – মাইকে নেহেরু বলছেন। আমরা যারা ৪৭ সালের আশেপাশে কেনো, তার ৫০ বছর পরেও জন্মাইনি, আমাদের চোখেও এই বিখ্যাত ছবিটি স্পষ্ট, আর যদি ছবিটি অচেনা হয়ে থাকে, তাহলে গুগলে গিয়ে একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। তা সে যাইহোক, “এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলা, আর যাতায়াত আজ পরাধীন। চক্রান্ত করে মানুষ মারার পরে আজকে আমরা স্বাধীন।” সে যেরকম স্বাধীনতাই হোক, স্বাধীনতা তো আসলো। স্বাধীনতার সেই স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা ইতিহাস নিয়ে এক্ষেত্রে বিস্তারিত বলার পরিসর নেই; বলতে গেলে বিষয় থেকে বিচ্যুতি ঘটার খানিক সম্ভবনা থেকে যাবে। এখন প্রশ্ন হলো, “What will happen after the day of revolution?” উত্তর একটাই। জাতি গঠন- ‘The time of Nation Building’। শুরু হলো, ভারতবর্ষকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা। সূচনা ঘটলো নতুন এক সমাজব্যবস্থার- ‘Neheruvian Socialism’ । এবং স্বাভাবিকভাবেই; জাতির চেতনা, চিন্তা উন্মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে আরো আরো গভীর হতে থাকলো ‘জাতীয়তাবাদ’ এর প্রসঙ্গ।

এবার চলচ্চিত্রে এই জাতীয়তাবাদ কিভাবে আস্তে আস্তে নিজের বীজ বপন করলো, তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, প্রথমেই ১৯৪৭ এর পরবর্তী সময় থেকে আজ ২০২৪- এই এতোগুলো বছর কে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নিলে সুবিধে হবে। প্রথম ভাগ :- ১৯৫০-১৯৭০, দ্বিতীয় ভাগ:- ১৯৭১-১৯৮০ ; এইরকম ভাবেই ১৯৮০- ১৯৯০, ১৯৮০ এর পরবর্তী, ১৯৯০-২০০০ এর সময়কাল , এবং সর্বশেষে ২০১৪ র পরবর্তী সময়কে যথাক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ- এই ৬ ভাগে ভাগ করে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। যেহেতু হিন্দি চলচ্চিত্র বহুল প্রচলিত একটা মাধ্যম, তাই হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধতা থাকবে এই আলোচনার।

‘Do Bigha Zameen’ (১৯৫৩), ‘Shree 420’ (১৯৫৫) , ‘CID’ (১৯৫৬), ‘Mother India’ (১৯৫৭) , ‘Pyaasa’ (১৯৫৭), ‘Aanari’ (১৯৫৯) র মতো বহু বহু সিনেমা। সময়টা ১৯৫৫-১৯৭০। হিন্দি চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ- ‘Golden age of Hindi film Industry’। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন সিনেমা হলে তখন দেখানো হচ্ছে এসব সিনেমা। হিন্দি চলচ্চিত্র তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের মধ্যগগনে বিরাজ করছেন তারকারা। একাধারে তাঁরা অভিনেতা, অপরদিকে পরিচালক- রাজ কাপুর, গুরু দত্ত, দিলীপ কুমার, বলরাজ সাহানী। পর্দায় আসছেন, জনি ওয়াকারের মতো অসাধারণ দক্ষ অভিনেতা’রা। সাধারণ মানুষকে নিয়ে কাজ, সাধারণ মানুষের জন্য কাজ। যাঁরা সিনেমা তৈরি করছেন, অভিনয়ের মধ্যে ফুটিয়ে তুলছেন তৎকালীন ভারতবর্ষের অসংখ্য শিক্ষিত, বেকার, ভবঘুরে যুবকের চরিত্র কে। ফুটিয়ে তুলছেন তৎকালীন সমাজের প্রকৃত চিত্র কে।

“Ae dil hain mushkil jeena yahan, zara haatke, zara bachke yeh hain bombay meri jaan” (CID) অথবা “Kisiki muskuraahaton pe ho nisaar, Kisika dard mil sake to le udhaar, Kisike waaste ho tere dil mein pyaar,Jeena issika naam hai” (Anari) – জনি ওয়াকার, রাজ কাপুররা দেখাচ্ছেন শিক্ষিত বেকারের যন্ত্রণা, জীবনসংগ্রাম, তার মধ্যেই জড়িয়ে আছে বেঁচে থাকা, জীবনের আনন্দ। “Millions of Raj as a vagabond character”- ভারতীয় সমাজের অসংখ্য শিক্ষিত বেকার যুবককে চরিত্রায়ণ করেছেন রাজ। একটা জাতির চিত্র, সমাজের রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁরা সিনেমায়। “Mera joota hain japani…Phir bhi dil hain Hindustani”; ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। ‘Mother India’ (১৯৫৭) সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, মা তার সন্তানকে মেরে ফেলতেও পিছুপা হচ্ছেন না। সন্তানের অপরাধ- এক নারীকে অসম্মান। সিনেমার মধ্যে দেখানো হচ্ছে ভারতীয় নারীদের প্রকৃত রূপ। ভারতীয় নারীরা অপর নারীর অপমান হলে নিজের সন্তানকেও কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দিতে পারেন, অন্যায়ের সঠিক প্রতিবাদ করতে পারেন।

(২)

জাতি গঠন হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল। একদিকে চলছে জাতি গঠনের লড়াই, অপর পিঠে চলছে যুদ্ধ, মন্দা, দূর্নীতি। দারিদ্র গ্রাস করছে মানবজীবনকে। দেশের প্রতি, সদ্য গঠিত জাতির প্রতি ক্ষোভ উঠে আসছে মানুষের (Resentment over the nation) । সরল, সাদামাটা জীবনযাপনের যে কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা- মানুষ এক তুড়িতে উড়িয়ে দিতে চাইছে। ভয়ঙ্কর পরিবেশ। চারিদিকে চলছে সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা (Sociopolitical Restlessness)। ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশে, আইনকানুন সর্বনেশে’র চেহারা নিচ্ছে মানুষের মনে। উঠে যাচ্ছে আইনকানুনের ওপর বিশ্বাস। আগের অবস্থার মতো, দারিদ্রকে সঙ্গী করে, তাকেই আশ্রয় করে সবকিছু মেনে নিয়ে শান্তিতে বেঁচে থাকা নয়, বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম, আগামীর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার লড়াইয়ে সামিল হচ্ছে মানুষ। তা স্থান পাচ্ছে সিনেমাতেও। ‘Deewar’ (১৯৭৫) এ অমিতাভ বচ্চনের চেয়ারের ওপর পা তুলে, দু হাত ভাঁজ করে মাথার পিছনে রেখে সেই বিখ্যাত দামাল ছেলের ছবি, মনে করিয়ে দেয় সেই সময়ের দেশের পরিস্থিতির কথা। ১২ টা তথাকথিত ফ্লপ ছবির পর অমিতাভ বচ্চন পরপর নিয়ে এলেন ‘Zanjeer’ (১৯৭৩) , ‘Deewar’ (১৯৭৫), ‘Sholay'(১৯৭৫) র মতো হাউসফুল সিনেমা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের যুবসমাজ তখন নকল করছে অমিতাভের চুলের কাটিং, প্যান্টের স্টাইল। সূচনা হচ্ছে নতুন অধ্যায়- ‘Angry young man’ এর। আইনের রক্ষকের ভূমিকায় থাকা ঠাকুর (সঞ্জীব কুমার) , আইন ভঙ্গ করা দুটো ছেলের ভূমিকায় থাকা জয় (অমিতাভ), বীরুকে (ধর্মেন্দ্র) কাজে লাগাচ্ছে সমাজশোধন করার কাজে। নায়ক হয়ে উঠছে তারা’ই। চরিত্রের মধ্যে তথাকথিত ‘ভালো’, ‘মন্দ’ বলে কোনো মাপকাঠি নেই। ‘ঠিক’, ‘ভুল’ নামক কোনো বিচার নেই। ভালো ছেলেরাই সমাজের নায়ক হয়ে ওঠে, সিনেমাতেও তার থেকে আলাদা কিছু হয়না- এই ধারণার বালিঘড়ি উল্টে যেতে যেতে উঠে আসছে একটা ‘Shadow Character’। তথাকথিত খারাপ, দেশের আইন ভঙ্গ করা মানুষরা, তাদের চরিত্র গুলোই হয়ে উঠছে ‘Real Hero’ ।

সদ্য গঠিত হওয়া ভারতীয় জাতির মূল শ্রেণী- শ্রমিক এবং কৃষক। চাহিদা -” হাম মজদুরো কো এক হি মাঙ্গ- রোটি, কপড়া অউর মকান” লেখা ব্যানার দেখা যাচ্ছে ‘Deewaar’ (১৯৭৫) সিনেমাতেও। ভারতবর্ষের প্রতিটি শ্রমিক, কৃষকে্র শ্লোগান একটাই- “কউন বানায়া হিন্দুস্তান? ভারত কা মজদুর, কিষান”। তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে রূপোলি পর্দাতেও। ‘Deewaar’ (১৯৭৫) ‘Coolie’ (১৯৮৩) সিনেমার পোস্টারে অমিতাভের হাতে ধরে থাকা কাস্তে আর হাতুড়ির ছবিটা মাথায় আনলেই অঙ্কটা মিলে যাবে ঠিক। “Apni kahani chhod ja, kuchh to nishani chhod ja, kaun kahe is or, tu phir aaye na aaye, Mausam Beeta Jaaye”- ‘Do Bigha Zameen'(১৯৫৩)- গরীব সাধারণ কৃষক শোষিত, নিপীড়িত হচ্ছে গ্রামের জমিদারের অত্যাচারে। জমিদার ঠকাচ্ছে, স্বভাবসিদ্ধ ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। গ্রাম ছেড়ে, পরিবার পরিজনকে ছেড়ে গরীব কৃষক শহরে আসছে দু চোখে স্বপ্ন নিয়ে। বেঁচে থাকার আশায়, ভালো থাকার আশায় রিকশা টানছে, জীবনকে টানছে, যতোদূর টেনে িনয়ে যাওয়া যায়। প্রলেতারিয়েত শ্রেণীই এই ৮০ র দশক অবধি হয়ে উঠছে মানুষের নায়ক, জীবনের নায়ক, সমাজের নায়ক (Proletarian Hero in Silver Screen)। ‘Nation’ বলতে ভারতবর্ষ তখনও ‘Rural India’ই বোঝে। জাতির অর্থ, শ্রেণী চরিত্র তখনও ভুলে যায়নি মানুষ। তখনও গুলিয়ে ফেলেনি শ্রেণীসংগ্রামের কথা। জাতির নায়ক বলতে শুধুই শ্রমিক, কৃষক।

(৩)

” পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে, স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে,

ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী”- এই কথা তো পাওয়া গেছে ‘পুরোনো মহীনের গানে’। ৮০ এর দশকের রবিবারের সকাল। রাস্তাঘাট শুনশান। ঐ সময়টুকুতে বাজার হাট নেই, চায়ের দোকানে আড্ডা নেই্। এই প্রবন্ধের যে পাঠকরা সেই যুগের মানুষ, তাদের চোখের সামনে ইতিমধ্যেই ভেসে উঠছে সেই সময়গুলো। ঘরে ঘরে চলছে, ” অথ শ্রী মহাভারত কথা”। মানুষ বুঁদ হয়ে বসে গোগ্রাসে গিলছে ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বোকাবাক্স। নিজের বাড়িতে টেলিভিশন না থাকলেও, পাশের বাড়িতে গিয়ে সিনেমা দেখা, সিরিয়াল দেখার হুজুগ বেড়েছে। মানুষের মুঠোয় এসে গেছে গোটা পৃথিবী ; Cable TV এই হুজুগের সমীকরণে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। ঘরে ঘরে চলছে, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘জন্মভূমি’ র মতো ধারাবাহিক। স্বাধীনতার পরবর্তীতে তৈরি হওয়া জাতির চিত্র, জাতীয়তাবাদের রূপ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করছে। পাড়ার রকে, চায়ের দোকানের আড্ডাতেও আলাদা করে দেওয়া শুরু হয়ে গেছে মতিলাল আর মহম্মদ কে। সাধারণ দর্শককে বিন্দুমাত্র টের পেতে না দিয়ে ধর্মীয় সিরিয়াল গুলোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে বপন করা হচ্ছে ধর্মীয় উন্মাদনার বীজ। ‘জাতীয়তাবাদ’ এর সংজ্ঞা পাল্টাতে পাল্টাতে মানুষের মনের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’। দেশবাসীর মন থেকে ‘ভারতীয় জনতা’ (Indian citizen) র ধারণা মুছে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও গিয়ে খুব সুক্ষ ভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে একটা শব্দের ওপর- ‘হিন্দুস্তানি জনতা'(Hindustani Janta) ।

‘Zee Tv’, ‘Zee Cinema’, ‘Sony Max’, ‘Star Gold’, ‘Star one’, ‘Zoom’- হঠাৎ করেই এইরকম বিভিন্ন নামীদামী চ্যানেল এর পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে টেলিভিশনে। ১৯৯১ সালের ‘গ্যাট চুক্তি’। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির প্রভাবে বিদেশের বাজার থেকে সমানে টাকা ঢুকছে ভারতে। ভারতকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে প্রাণপণ – ভারতকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, ‘Global India’ নামে। ‘Rural culture’ বিলুপ্ত হওয়ার পথে জন্ম হচ্ছে ‘Urban Middle Class ‘ এর। সাধারণ মানুষের হাবভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ‘নব্য বাবু কালচার’।

(৪)

‘Hum aapke hain Kaun'(১৯৯৪) , ‘ Dilwale Dulhaniya le jayenge’ (১৯৯৫),’Hum Sath Sath Hain’ (১৯৯৭), ‘ Pardesh’ (১৯৯৭), ‘Mohabbatein'(২০০০),’Kabhi Khushi Kabhi Gum'(২০০১), ‘Chori Chori Chupke Chupke’ (২০০১), এর মতো অসংখ্য সুপারডুপার হিট সিনেমা। কলেজ বাঙ্ক করে, টিউশন কামাই করে, টিভিতে টেলিকাস্ট হলে, যতবার টেলিকাস্ট হচ্ছে, ততবারই সিনেমাগুলো কমবেশী দেখে ফেলা আছে সকলেরই। সাজিয়ে গুছিয়ে, যত্ন করে এই বিনোদনগুলি দর্শকদের উপহার দিচ্ছে ‘Yash Raj Production’, ‘Dharma Production’ এর মতো হঠাৎ উদ্ভব হওয়া Corporate Studio গুলি। শুটিং হচ্ছে বিদেশে গিয়ে। বিদেশ থেকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের আনা হচ্ছে হিন্দি সিনেমায় ব্যবহারের জন্য (‘ব্যবহার’ শব্দটি যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করেই প্রয়োগ করা হয়েছে) । সিনেমা তৈরির বাজেটের অঙ্ক গুলো দেখলে তো ‘চক্ষু ছানাবড়া’। এখানে টু দ্য পয়েন্ট তিনটে বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে বোঝা যাবে পরিবর্তিত, সম্পূর্ণ বিবর্তনের পথে অগ্রসর হওয়া জাতির চিত্রটি এবং জাতীয়তাবাদ ক্রমশ পরিবর্তন হওয়ার রূপরেখা টি।

• উদাহরণস্বরূপ ধরে নেওয়া যাক- ‘Dilwale Dulhaniya Le Jayenge’ র অমব্রীশ পুরী’র চরিত্রটি। NRI, বাড়ি ফেরার জন্য তাঁর উদগ্রীব টান। মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র কতটা ভারতীয় সুলভ (Indianness), সেই পরীক্ষা করে মেয়ের বিয়ে দেবেন। এইভাবেই সিনেমার মধ্যে দিয়ে বোঝানো হচ্ছে প্রবাসীদের তাঁর দেশের প্রতি প্রেম (Patriotism), তাঁর জাতীয়তাবাদের (Nationalism) তীব্রতা। “Main ek hindustani hoon, Main janta hoon, ek hindustani ladki ka ijjat kya hota hain”- সিনেমাটা আশা করি অধিকাংশ পাঠকের হাজার হাজার বার দেখা এবং আমি মনে করানোর আগেই হয়তো অনেকের মনে পড়ে গেছে সিনটির কথা। হোটেল রুমের সেই পরিচিত সিন। রাজ (শাহরুখ) , সিমরান (কাজল) এর সাথে গতরাতে যে কোনো অশালীন আচরণ করেনি, তার প্রমাণ দিচ্ছে এই একটি কথার মাধ্যমে। অর্থাৎ, সিনেমার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ‘হিন্দুস্তানি'( ‘ভারতীয়’ নয়) জাতির ছেলেরা মেয়েদের সম্মান করতে জানে। একটা শব্দের ওপর সত্যিই “বারেবারে তবু আসতেই হবে ফিরে।” ‘ভারতবর্ষ’, ‘ভারতীয়’ শব্দগুলো বালি চাপা পড়ে গিয়ে ঠিক কিভাবে যেনো প্রকোপ বাড়ছে ‘হিন্দুস্তান’, ‘হিন্দুস্তানী’ – এই জাতীয় শব্দগুলোর।

•ধরা যাক ‘Chori Chori Chupke Chupke’ র মতো সিনেমা। ‘দাদাজী’, ‘মামাজী’, ‘মামীজী’, ‘পাপ্পু ভাইয়া’ থেকে শুরু করে বাড়ির কুকুর, বিড়াল, তাদের আলাদা আলাদা করে নাম কিম্বা ‘Hum Sath Sath Hain’ তে বাবা, মা, তিন ভাই, তাদের বউ, প্রেমিকা, তাদের পরিবার, এক বোন সমেত তার পরিবার, মামাবাড়ির লোকজন, মায়ের বন্ধুরা। কি দেখা যাচ্ছে! এই এতো মানুষ, সব্বাই নাকি একটাই পরিবারের সদস্য। সিনেমায় প্রকাশিত হচ্ছে ‘Large Indian Parivaar’।

• অথবা ধরা যাক, ‘দিওয়ালি’, ‘মেহেন্দী’, ‘সঙ্গীত’, ‘করভা চথ’ এর মতো বিভিন্ন উপাচার। এই ৯০ এর যেসব সিনেমা নিয়ে এখন কথা হচ্ছে, সেগুলোর প্রতিটিতে ব্যবহার করা হয়েছে এই সমস্ত উপাচার গুলোকে। আর যেখানেই হোক, অন্তত বাঙালীর ঘরে এইসব উৎসব আগে কখনোই পালিত হতোনা। এদিকে সাধারণ দর্শক কোথাও এগুলোর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে না, এগুলোকে মানাতে পারছেনা। তবুও এই সংস্কৃতি গুলোকে সাদরে গ্রহণ করছে। নিজেদের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিচ্ছে। এগুলোর সাথে জোরজবরদস্তি বেঁচে থাকতে চেষ্টা করছে। বাস্তবের সাথে কোনো মিল না পেলেও সিনেমার এই কায়দা গুলো অনুকরণ করতে করতে এই উপাচার গুলোই হয়ে উঠেছে সমাজের ধারক ও বাহক। ভাবতে শুরু করলে সত্যিই অদ্ভুত মজা লাগে। আগে বাঙালীর ‘দীপাবলি’ ছিলো, এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘দিওয়ালি’। এইতো আমাদের ছোটোবেলায় মা, বাবা, বাড়ির বড়োরা ‘দীপাবলি’ তে বাজি ফাটানোর সময়ে সিন্থেটিক জামা পড়তে দিতেন না। এখন ঘরে ঘরে মানুষ ‘রঙ্গোলী’ বানাচ্ছে, প্রদীপ নিয়ে ছবি তুলছে, বাজি ফাটাচ্ছে ল্যাহেঙ্গা পড়ে। নাহলে বিশ্ব প্রতিযোগীতায় স্থান হবেনা তার। ‘আইবুড়োভাত’ থেকে শুরু করে ‘গাত্র হরিদ্রা’, ‘বাসি বিয়ে’র মতো বিভিন্ন আচার তো বিয়ের অঙ্গ। সকলেরই জানা। কিন্তু এই ‘মেহেন্দী’, ‘সঙ্গীত’, ‘হলদি’ যে কখন টুকটুক করে বিয়ের অনুষ্ঠানে চুপিসারে সিঁধ কেটে ঢুকে পড়লো, টের পাওয়া গেলোনা। সাধারণ মানুষের বিয়ে থেকে নায়ক, নায়িকা, তারা, জ্বলজ্বলে তারা-যাদেরই বিয়ে হচ্ছে, যেনো স্বয়ম্বর সভা, বিশাল আয়োজন। কনে মালা নিয়ে এগিয়ে আসছে, আশেপাশের মানুষ ফুল ছুঁড়ছে। সকালে গায়ে হলুদের সময়ে বালতি বালতি হলুদের জল ছোঁড়া হচ্ছে, আকাশ থেকে যেনো পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ, সামর্থ্য থাকুক না থাকুক, সাধ্যের বাইরে গিয়েও এই সংস্কৃতি গুলিকে নিজেদের মধ্যে প্রবেশ করাচ্ছে।

ঐ যে, শুরুতেই বলেছি, “জব তক সিনেমা হ্যায়”… নায়কের চুল, প্যান্টের স্টাইল থেকে শুরু করে নায়িকার এঙ্গেজমেন্টের ল্যাহেঙ্গা- সিনেমার সবকিছুই অনুকরণ করি আমরা। সোজা ভাষায়, চলতি কথায় কপি অ্যান্ড পেস্ট। আসলে সিনেমা আমাদের মনকে একটা আকৃতি দেয়। এবং সিনেমা একটা সহজতর মাধ্যম, যে মাধ্যম দিয়ে সহজেই কোনো চিন্তা, চেতনা, নীতি, আদর্শ, বলতে চাওয়া কঠিন কথা সহজ থেকে সহজতর উপায়ে মানুষের মধ্যে গেঁথে দেওয়া যায়। জাতীয়তাবাদ হোক, অথবা জাতীয়তাবাদ পাল্টে যাওয়ার রূপরেখা- সবটাই তাই প্রকাশিত হতে থাকে চলচ্চিত্রে, নিপুণভাবে। ‘হিন্দি সিনেমা’ নামটা কিরকম ধীরে ধীরে মেঘের আড়ালে চলে গিয়ে, হঠাৎই উদ্ভব হলো একটি শব্দের। তারপর জ্বলজ্বল করতে শুরু করলো আচমকাই উদ্ভুত- ‘বলিউড’

(৫)

‘ গুজরাট দাঙ্গা’, ‘কারগিল যুদ্ধ’, ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস’, ‘শবরমতী এক্সপ্রেস পুড়িয়ে দেওয়া’র মতো বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, ভারতবর্ষে ঘটতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তৈরী হওয়া সেই ‘ভারতীয় জাতি’ ধ্বংসের পথে। এক একটা Serial Blast এর মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেলো ‘জাতির মেরুকরণ’। প্রচন্ড দ্রুত গতিতে পরিবর্তন হতে লাগলো সমাজ। রাজনীতিতে একটা শব্দের প্রচলন বাড়তে শুরু করলো- ‘আমরা-ওরা’। তিনটি সিনেমার নাম এখানে ভীষণ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন- ‘Roja’ (১৯৯২),’Bombay’ (১৯৯৫), ‘Dil Se’ (১৯৯৭) [Maniratnam’s Trilogy]। কতো কতো ভাষায় যে রিমেক হয়েছে এই বহুল চর্চিত সিনেমাগুলি; তার ইয়ত্তা নেই। প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসের দিন এই সিনেমা গুলির গান চলতো মাইকে। টিভিতে কোনো না কোনো চ্যানেলে দেখানো হতো এই ‘Nationally Successful’ সিনেমা তিনটি। এখানেও কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে টু দ্য পয়েন্ট কয়েকটা বিষয় কাটাছেঁড়া করলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।

• একটু চোখ বন্ধ করে ‘Roja’ সিনেমার একটি অংশ ভাবা যাক। ঋষি ( অরবিন্দ স্বামী) কে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই ডেরার হদিশ যখন দেওয়া হচ্ছে দর্শকদের, আবহ তে ‘মিলে যাওয়া দূরের আজান’। আজানের সুর এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে সন্ত্রাসের চিহ্ন (Sign of Terrorism) হিসেবে। নায়ক ঋষির কাছে হুমকির ফোন আসার পর তার মুখে উচ্চারিত হচ্ছে একটাই শব্দ- ‘জয় হিন্দ’।

• ‘Bombay’ সিনেমাটি পুরোটা দেখলেই আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে ধর্মনিরপেক্ষ একটি সিনেমা। সেই বিখ্যাত গান- ‘Tu hi re, tu hi re.. Tere bina main kaise jiyun’ – গানটার ৪ মিনিট ৩০-৩২ সেকেন্ডের দিকে আমরা দেখতে পাই শায়লার (মনীষা কৈরালা) বোরখা আটকে যাচ্ছে পাহাড়ের একটা ত্রিশূলের খাঁজে। সেই বোরখা ছিঁড়ে সে চলে আসছে নায়ক, শেখর (অরবিন্দ স্বামী) এর কাছে। সারা সিনেমার প্রতিটি খাঁজে খাঁজে ধর্মনিরপেক্ষতাকে কাপড়ে জড়িয়ে চিত্রায়ণ করা হলেও, হিমবাহের ১/৩ অংশের সমুদ্রের তলায় থাকা অংশটা একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, পরোক্ষ ভাবে হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মৌলবাদের উলঙ্গ রূপ টা। দেখানো হচ্ছে, মুসলিমরা হিন্দুদের কাছে আসেই আশ্রয় নিতে। আর উদার হিন্দুরা সাদরে গ্রহণ করে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের। ঠিক সেই সময় থেকেই এইভাবেই ধীরে ধীরে শুরু হতে থাকলো, ‘আমরা-ওরা’ রাজনীতির ‘বলিউডি মেরুকরণ’।

এই প্রবহমান ধারাকে অক্ষুন্ন রেখেই পরবর্তীতে উঠে আসছে ‘ Border’ (১৯৯৭),’Mission Kashmir‘ (২০০০), ‘Gadar ek prem katha'(২০০১), ‘Veer Zara‘(২০০৪), ‘Fana'(২০০৬), ‘Kurbaan'(২০০৯) এর মতো সিনেমার উদাহরণ। সবকটি সিনেমাই এক একটি মাইলস্টোন। আগেও বলেছি, Corporate studio যেসব সিনেমা আমাদের উপহার দেওয়া শুরু করেছিলো, তাদের বাজেটের পরিমাণ দেখলে সত্যিই চোখ কপালে উঠে যাওয়ার জোগাড়। সেরকমই একটি সিনেমা ‘Hum aapke hain kaun'(১৯৯৪) সেই সময়ের সবচেয়ে বাজেট পূর্ণ সিনেমা। তাকেও ছাপিয়ে গেলো ‘Gadar ek prem katha’ । ‘Border’ থেকে ‘Kurbaan’- উক্ত প্রতিটি সিনেমাকেই কয়েকটা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একটা ছাঁচে ফেলা যায়। ‘বর্ডারের রাজনীতি'(Border Politics), ‘ ‘পাকিস্তান বিরোধিতা/মুসলিম বিদ্বেষ ‘(Anti Pakistan/Anti Muslim)। সাধারণকে ভাবতে বাধ্য করা হলো, মুসলিম মানেই পাকিস্তান, মুসলিম মানেই খারাপ।পার্টিশান, দেশভাগের জন্য একমাত্র পাকিস্তানই দায়ী।এই ৯০ থেকে একটু সামান্য পিছনে হাঁটলে ‘Kasmir ki Kali'(১৯৬৪), ‘Betaab’ ্(১৯৮৩)এর মতো সিনেমার কথা বলা যায়, যেখানে কাশ্মীরকে আমরা দেখতে পাই ‘ভূস্বর্গ’ রূপে, ‘বিশ্বসুন্দরী’ রূপে। ‘ Gadar’ থেকে শুরু করে ‘Kurban’; উপরোক্ত এই প্রতিটি সিনেমাতেই কোনো না কোনো প্রকারে কাশ্মীরকে দেখানো হয়েছে ভয়াবহ রূপে। ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে। সিনেমাগুলোর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে- ‘Kashmir Issue’। প্রচেষ্টা চলেছে সাধারণ মানুষের কাছে কাশ্মীরকে একটা ‘সন্ত্রাসের নাম’ এ রূপান্তর করার। প্রতিটি সিনেমাতেই এমন একটি চরিত্র রাখা হয়েছে, যে চরিত্র মুসলিম হয়েও মুসলিম বিরোধী। সিনেমার পরিভাষায় তাকে নামাঙ্কিত করা হয়েছে- ‘Good Muslim’। সিনেমার গল্পগুলিতে কোনো না কোনো ভাবে দেখানো হচ্ছে, মুসলিমদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হিন্দুরা এবং সেই ‘Good Muslim’ চরিত্রটি প্রাণপণ চেষ্টা করছে হিন্দুদের সাহায্য করতে। জাতীয়তাবাদকে মনোরঞ্জনের মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরা শুরু হলো- ‘Nationalism-Package of Entertainment’। এই ধারাটিকেই ধীরে ধীরে, খুব সুক্ষ ভাবে অতিরঞ্জিত করে তোলা হলো ‘Uri:The Surgical Strike'(২০১৯), ‘Kashmir Files'(২০২২) প্রভৃতি সিনেমায়। গান্ধীর ভারতবর্ষ, নেহেরুর জাতীয়তাবাদকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে নতুন ভাবে সাজাতে চাওয়া দেশের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য দেওয়া হলো এই সিনেমাগুলির মাধ্যমে (Tribute to ‘Naya Hindustan’)।

(৬)

“Yeh Naya Hindustan hain, yeh ghar mein ghusega bhi, aur marega bhi”- ‘Mera Bharat Mahan’ এর প্রাচীন ধারণাকে মাটিতে মিশিয়ে, নতুন ভারতবর্ষ, থুড়ি নতুন ‘হিন্দুস্তান’ এর আসল রূপ প্রকাশিত হতে থাকলো সিনেমার সংলাপে। “Unhe Kashmir chahiye, aur humein unka sar”। “How’s the Josh”- এর মতো সিনেমার সংলাপগুলো শোনা যেতে লাগলো রাজনীতির মঞ্চে। সংলাপগুলি ব্যবহৃত হতে লাগলো রাজনৈতিক শ্লোগান হিসেবে। ্

‘Lagan'(২০০১), ‘The legend of Bhagat Singh’ (২০০২), ‘Rang de basanti’ (২০০৬), ‘Chak de India’ (২০০৭) এর মতো কালজয়ী সিনেমাগুলোর মূল বিষয়বস্তু ছিলো- ব্রিটিশরা ভারতের শত্রু, খেলাধূলার মাধ্যমে ইংল্যান্ড বা অন্যান্য দেশকে হারাচ্ছে ভারতবর্ষ। অথবা কোনো দূর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতার বিরোধিতার মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ। সেই দেশপ্রেমের ছবিকে ছাপিয়ে গিয়ে ‘Kesari'(২০১৯), ‘Bhuj:The pride of India’ (২০২১), ‘Shershah'(২০২১) র মতো সিনেমায় দেখানো হচ্ছে, ব্রিটিশ নয় ; পাকিস্তান, আফগানিস্তান ভারতবর্ষের মূল শত্রু। দেশপ্রেম কোথাও একটা গিয়ে পরিণত হতে শুরু করলো উগ্র জাতীয়তাবাদে। সিনেমার চরিত্রগুলোর মধ্যে ফুটে উঠতে লাগলো একটা অস্বাভাবিক ‘Boldness’ ।

See Also
Shah Rukh Khan

‘Bajirao Mastani'(২০১৫), ‘Padmavat’ (২০১৮), ‘Panipat'(২০১৯), ‘Manikarnika:The queen of Jhansi’ (২০১৯) সিনেমাগুলির পোস্টারে কোনো একটা রঙের ছাপ ফুটে উঠতে দেখা যাচ্ছে। হিন্দুদের একটা প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাস (Hindu Glorious Culture) কে স্থাপন করা হচ্ছে দর্শকের মননে্। পরিলক্ষিত হচ্ছে গৈরিকিকরণের চেষ্টা। সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বারেবারে তুলে ধরা হচ্ছে সিনেমায়।

ধীরে ধীরে আরো ভয়ানক হয়ে উঠছে মৌলবাদের চেহারা। প্রকাশিত হচ্ছে দৃঢ় ভাবে। “যে গেরুয়াবাদী ঠিক করেছে, পরধর্মের শিশুর রক্ত গড়াবে মাটিতে, চাটবে কুকুরে”- তার নৃশংস চেহারা সিনেমার পোস্টারে স্থান পাচ্ছে শৌখিনতার ছাঁচে। ‘Bajirao Mastani'(২০১৫), ‘Padmavat’ (২০১৮), ‘Panipat'(২০১৯), ‘Manikarnika:The queen of Jhansi’ (২০১৯) এই নির্দিষ্ট সিনেমাগুলির পোস্টারে কোনো একটা রঙের ছাপ যেনো জ্বলজ্বল করছে। হিন্দুদের একটা প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাস (Hindu Glorious Culture) কে স্থাপন করার চেষ্টা হচ্ছে দর্শকের মননে্। পরিলক্ষিত হচ্ছে সমাজকে সম্পূর্ণ রূপে গৈরিকিকরণের চেষ্টা। সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বারেবারে তুলে ধরা হচ্ছে সিনেমায়।

এবং এভাবেই জাতীয়তাবাদ বিবর্তিত হতে হতে ‘অশোকস্তম্ভ’ এর সিংহ আগ্রাস

রূপ নিয়েছে। পড়াশোনার সিলেবাসের  বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কমে কাদের নামগান, গুণগান পাঠ্যপুস্তক গুলোতে স্থান পাচ্ছে।মানুষের ফোনের ওয়ালপেপারে, বাইকের সামনে লাগানো স্টিকারে একটা হোমড়াচোমড়া খেঁকি হনুমান স্থান পাচ্ছে। অ্যাডভার্টাইজড হচ্ছে।

এবং, “অ্যালসেশিয়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে

আমরা তিন মাস বক্‌লস পরিয়ে মাংস খাওয়ালাম

ক্রমশ তার খেঁকিভাব প্রকট হয়ে উঠছে।

আমরা টের পাইনি।

আমাদের ঝরণা কলম কবে ডট্‌ পেন হয়ে গেছে

আমাদের বড়বাবু কবে হেড অ্যসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন

আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন।

আমরা বুঝতে পারিনি

আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

Here, I rest my case। বাকিটা পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলাম, তারা বুঝবেন। বিচার করবেন। পক্ষ নেবেন।

What's Your Reaction?
Excited
2
Happy
2
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top