একটা ইচ্ছা, দুটো মৃত্যু আর কিছু খুচরো স্বপ্ন -পর্ব এক



Gunjon is a Kolkata-based writer whose journey has taken him…
একটি দমবন্ধ করা গল্প যেখানে অতীতের স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন ইচ্ছার তাগিদে জটিলভাবে জড়িয়ে আছে। বাণীব্রত নন্দীর জীবন সংগ্রাম এবং বোম্মার সাথে তার সম্পর্কের আবেগঘন পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে এই কাহিনী। সিনেমার প্রতি তার প্রেম, ইচ্ছা এবং পারিবারিক ইতিহাসের গভীর প্রভাব কিভাবে তার জীবন এবং পরিচয়কে পুনঃনির্মাণ করে, তা ধরা পড়েছে এই গল্পে। সম্পর্ক, আত্ম-অনুসন্ধান এবং সৃষ্টিশীলতার এই অমোঘ যাত্রা আপনাকে স্পর্শ করবে।
বানীব্রত’র একদম ইচ্ছা ছিল না বম্মা’র মুখাগ্নি ও করে। হোয়াই? নানা ওটা দাদাভাই ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। দাদাভাই একান্ত না পারলে কুট্টি করুক। ওর তো মা। আজকাল ছেলে মেয়ে বলে কিছু আলাদা করে হয় না। বানী দেখেছে মেয়েরা এখন ভাইদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখাগ্নি করছে, ১৩ দিনে কাজ করছে। হাজার হোক, মায়ের মত হোক বা মায়ের থেকেও বেশি হোক, কিন্তু বম্মা বানীর মা তো নয়। বাবা মায়ের মুখাগ্নি একমাত্র তাঁর সন্তানে’র করা উচিৎ। নিঃসন্তান হলে আলাদা। অবশ্য কেউ বানী’র কথা শুনল না। দাদাভাই শিকাগো থেকে অন্য কোথায় একটা গেছে অফিসের কাজে. এক্ষুনি আসার অবস্থায় নেই। বাড়ী ফিরে কোলকাতা পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় কাজের সময় হয়ে যাবে। কুট্টি খবর পেয়েই দিল্লী থেকে চলে এসেছে। দাদাভাই যখন ভিডিও কলে বলে দিল, ‘মায়ের মুখাগ্নি করার অধিকার যদি মা কাউকে দিয়ে যেত সে বানী। আমি না, কুট্টি না। বানী মায়ের মুখাগ্নি করবে’। দাদাভাই’র মুখের ওপর কথা? ৭/৩৮ এফ মুখার্জ্জীপাড়া লেন, এই নন্দীদের বাড়ীতে সেটা কারো সাধ্য নেই। ভিডিও কল হয়ে যাওয়ার পর বানীব্রত’র জেঠুমণি, সত্যব্রত নন্দী, তাঁর লম্বা, কালো, অশক্ত, বিরাশি বছরের শরীরটা প্রায় টলতে টলতে বানীর কাছে এনে, কাঁধে হাত রেখে ফ্যাঁসফেসে গলায় বলেছিলেন, ‘আমার ও এটাই ইচ্ছা বানী’।
ব্যস, বানীর কাছে ওই মুখাগ্নি চ্যাপ্টারের ওখানেই ‘দি এন্ড’।
বম্মা প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়েসে দেহ রাখলেন। সামান্য রোগে ভুগে। যে সকালে বানী বম্মা’কে মৃত অবস্থায় ওঁর নিজের বিছানায় আবিষ্কার করে, তার আগের রাতে পর্যন্ত খাবার টেবিলে সকালে বাজার কি হবে বানী’কে বলে রেখেছিলেন। বানীর হাতে করা বাজার ছাড়া কেউ মনে করতে পারে না বম্মা কোনদিন রান্না করেছেন। অন্তত বানীর বউ, রাখী, তো পারেই না। রাখী বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে পা দেওয়া ইস্তক তাই দেখে আসছে। পরের দিকে রান্নার লোক নিয়োগ হবার পরও বানী কি বাজার করবে সেটা বম্মাই বলে দেবেন। বানী খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে। উঠেই একবার বম্মা’র ঘরে গিয়ে ঠাকুর প্রণাম করে। তারপর চা খেয়ে হয় একতালায় নিজের লাইব্রেরীতে স্ক্রিপ্টের কাজ নিয়ে বসে বা বাজারে যায়। নয়ত বাজার নামিয়ে দিয়ে রেডি হয়ে গাড়ি এলেই শুটিং এ বেরিয়ে যায়।
এই বাজার করাই বানীর সঙ্গে সংসারের একমাত্র যোগসূত্র। বাকি তার ছেলে, বউ, তাদের দৈনন্দিন জীবনের দায়িত্ব বম্মার আর জেঠুমণি’র। বানী মাসের শুরুতে একটা টাকা বম্মার হাতে এনে দিত। কি দিত, কত দিত, সংসারে ঐ দুজন ছাড়া কেউ জানত না। রাখী’ও না। তবে সন্দেহ হত সেটা সাঙ্ঘাতিক কিছু নয়। কারন মাসের শেষে বানী নিজের খরচের টাকাও কিছু কিছু বম্মা’র থেকে নিত। বাকি বানীর ছেলে মায়াব্রত’র স্কুলে ভর্তি, টিউশনের মাস্টার ঠিক করা, ডাক্তার দেখানো থেকে জামা কাপড় কেনা, সে পুজো হোক বা বাড়িতে কোন বিয়ে, সব দায়িত্ব বম্মার। প্রথম প্রথম রাখী’র এই বম্মা আর জেঠুমণি’র ওপর ওদের অর্থনৈতিক দায়িত্বের বহুলাংশ বর্তানো ব্যাপারটায় খুব অস্বস্তি হত। স্ত্রী’রা কি কোনদিন মেনে নিতে পারেন তাঁর স্বামী অর্থনৈতিক ভাবে তাঁর ভরন পোষণে অক্ষম? কিন্তু বানী’কে সে যত চিনেছে তত বুঝছে বানী অক্ষম নয়। বানী পাগল।
সিনেমা’টা ছিল বানীর পাগলামী।
বম্মা বলতেন স্কুলে পড়তে পড়তেই বানী বলত ও সিনেমা ছাড়া কিছু বোঝে না, ভাল ও লাগে না। খুব ছোটবেলায় জুতোর বাক্সের সামনে টেবিল ল্যাম্প ফোকাস করে ভেতরে পটের মত ছবি এঁকে রীলের মত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অসম্ভব ভালো গল্প বলত বানী। অথচ শান্তিব্রত, বানীর দাদাভাই, রাখী’কে বলেছে আই আই টি’তে বানীও যেতে পারত। কিন্তু বানী তো কোনদিন সে রাস্তায় হাঁটেই নি। আবার সবাই যখন বলেছে সিনেমাই যদি করবি তাহলে এফ টি আই আই কর, পুনে যা, তখন বানী বলেছে, ‘ধুর ওটা তো কারখানায়। ওখানে আবার সিনেমা হয় নাকি?’ তাহলে? ‘তাহলে আমি ইতিহাস নিয়ে প্রেসী’তে পড়ব’। ‘আচ্ছা তাই কর তাহলে’ জেঠুমণি মত দিয়ে বলেছেন। বানী ইতিহাসে মাস্টার্স করে কোলকাতা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি’তে পা রাখল। কিছুদিনের মধ্যেই বেশ ভাল কিছু পরিচালকের অ্যাসিটন্ট হয়ে নিজেই খুব খুশী । কিন্তু সেই ভাল লাগা বেশীদিন টিঁকল না। তারা সবাই খুব খারাপ ছবি বানায়, অশিক্ষিত, ইত্যাদি। বানী বলল, ‘আমায় নিজেই নিজের ছবি বানাতে হবে’। সেই শুরু।
আর এত বছর পরেও বাড়ীর লোকেরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না বানী এত স্ট্রাগল করেও কেন নিজের একটা ছবি, যেটা বানাতে ওর সর্বস্ব পণ রাখতেও রাজী, সেটার একজন প্রযোজক ও পেল না। একসময় জেঠুমণি আর শান্তি ঠিক করেছিল বানী’র ছবি ওঁরাই প্রডিউস করবেন। শান্তিব্রত বলেছিল, ‘আমার এমেরিকার বন্ধুদের বলব। ক্রাউড ফান্ডিং করে টাকা তুলে দেব তোর ছবির বানী, তুই চিন্তা করিস না’। সেই আইডিয়া নাকচ করতে বানী’কে দু সেকেন্ড ভাবতেও হয় নি।
বিয়ের পর সংসার চালাতে বানী শুরু করল টেলিভিশনের কাজ। রাখী দেখল টেলিভিশনের কাজ শুরু করার পর কিভাবে বানীর আত্মা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকল মৃত্যু’র দিকে। তাই এখন যখন একতালার একটা ঘরে শ’য়ে শ’য়ে সিনেমার বই’য়ের মধ্যে বসে মগ্ন হয়ে বানী নিজের ছবির স্ক্রিপ্টের কাজ করে রাখী জানে ওই স্ক্রিপ্টের প্রতিটি লাইনের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সংলাপ বানীর মুখস্থ। কিন্তু তবু সময় পেলেই ওটা নিয়ে বসে টেলিভিশনের কাছে বন্ধক রাখা আত্মাটা বানী অল্প অল্প করে ছাড়িয়ে আনে।
ভাবে হয়ত, একদিন একটা ছবি করে বানী সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারবে নিজেকে।
*
বানীর বাবা তখনকার দিনের নামকরা ক্যামেরাম্যান ছিলেন। ওর বছর দশ বয়েসে উনি হটাৎ মারা যান। বানীর মা ছিলেন অসামান্য সুন্দরী। আর বানীর থেকে পাঁচ বছরের ছোট বানীর এক আপন ভাই ছিল। মাত্র ৩২ বছর বয়েসে স্বামী হারিয়ে বানীর মা ছোটছেলে’কে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। পরে এদিক ওদিক থেকে খবর আসে উনি বানীর বাবার কোন পরিচালক বন্ধু’কে নাকি বিয়ে করেছেন। সত্যব্রত সেদিন সবাইকে বলে দিয়েছিলেন এই বাড়িতে তাঁর ভাতৃবধূর নাম আর কোন দিন উচ্চারিত হবে না। আর খুব তাড়াতাড়ি তাঁর আপন দুই সন্তান, শান্তিব্রত আর লোপামুদ্রা, বুঝতে শিখে গেল বানীব্রত তাদের আপন ভাই বৈকি নয়। আর সত্যব্রত’র স্ত্রী, বানীর বড়মা, বম্মা, তাঁর সমস্ত স্নেহটুকু যেন, যেন নয়, মনে প্রাণে ঢেলে দিলেন তাঁর অকাল প্রয়াত দেওরের এই মা পরিত্যক্ত শিশুটির প্রতি। সত্যব্রত এই নিয়ে নিজের সন্তানদের খুচখাচ অভিযোগের মধ্যেও তাঁর স্ত্রী’র বানীর প্রতি অসম্ভব পক্ষপাতিত্বে কোনদিন নাক গলান নি বা নিজের সন্তানদের ওই অভিযোগে কোনদিন কর্ণপাতও করেন নি। নন্দীদের পরিবারে জীবন বয়ে গেছে একরকম বানী’কে আর ওর চাওয়া পাওয়াকেই কেন্দ্র করে।
কাজের দিন; কাজ শেষ করে বানী সবে উঠে দাঁড়িয়েছে, রাখী এসে ওর ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখোতো কে। বলছে বালাজী টকিজ থেকে’।
বালাজী টকিজ, কলকাতার এক নামি প্রযোজনা সংস্থা । বালাজী টকিজের ব্যানারে বানী নিজের গল্পে আর চিত্রনাট্যে ছবিটা করল। বানীর সেই স্বপ্নের প্রথম ছবি। চলল মন্দ না। নামী কাগজের চিত্র সমালোচকরা বানীর ছবির মধ্যে গৎ ভাঙ্গা এক ভবিষ্যৎ উঁকি দিচ্ছে দেখতে পেলেন। সাধারণ দর্শক, তাদের কারো কারো মতে কোথায় গিয়ে যেন গল্পটা থই হারিয়ে ফেলেছে । আবার আরেকদল বললেন গল্প খুব ভাল চরিত্র’রা ভাল করে ফুটে ওঠেনি, ইত্যাদি।
বানী নিজে খুব উৎসাহিত হয়ে ওর দ্বিতীয় গল্প নিয়ে প্রডিউসারদের কাছে দৌড়োদৌড়ি করল কিন্তু একবারেই সারা পেল না।
এক বছরের মধ্যে বানী’র জীবন আবার যে কে সেই। বাধ্য হয়ে বানী ফিরে গেল সেই টেলিভিশনের ‘রোজ কুড়ি মিনিট ফুটেজ ছেপে দিতেই হবে’র দুনিয়ায়।
এই করতে করতে কেটে গেল আরো বছর চারেক। মায়াব্রত উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে প্রেসীডেন্সী’তে ভর্তি হল। আর রাখী’কে হতাশ করে বানী’র মত সিনেমা’র নেশা ওর ছেলেকেও পেয়ে বসল। মায়াব্রত ক্লাসের পরে সন্ধ্যেবেলায় একটা অ্যানিমেশন আর স্পেশাল এফেক্ট শেখার স্কুলে ভর্তি হল। কোর্স শেষে প্রজেক্ট হিসেবে করা দুটো অ্যানিমেশন শর্ট ফিল্ম দেখে বানী’ও মুগ্ধ। কোন ফেস্টিভ্যালে পাঠানো যায় কিনা বলতে মায়া বাবাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এত কিছুই না বাবা। দেখো না আগে আগে হোতা হ্যায় কেয়া!’
এর মধ্যে একদিন উমেশ ভাটের অফিস থেকে ফোন। উমেশ মুম্বাইয়ের এক বিখ্যাত পরিচালক, প্রযোজক। ওঁরা বানীর বাংলা ছবিটার হিন্দি ভার্সান করতে চায়। তবে সেটা করতে গেলে ওকে দু বছর মুম্বাই এসে থাকতে হবে। থাকার জায়গা ওঁরাই দেবেন। বানী না বলে দিল।
এই খবর রাখী থেকে কুট্টি মারফৎ শান্তিব্রত’র কাছে শিকাগো’তে পৌঁছতে দেরী হল না। শান্তিব্রত ফোন করে বলল, ‘তুই মুম্বাই চলে যা বানী; কুট্টি’র সঙ্গে আমার কথা হয়েছে; বাবা’কে ও নিয়ে রাখবে। কোন অসুবিধা হবে না। তুই এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করিস না’। এই প্রথম বানী ওর দাদাভাই’র ওপর সামান্য উষ্মা দেখিয়ে মুখের ওপর বলেছিল, ‘প্লিজ দাদাভাই.. ওটা আমি পারব না.. আর জেঠুমনি এই ৮৬ বছর বয়েসে নিজের বাড়ী ছেড়ে তোমার ওখানে বা কুট্টি, কারো কাছেই যাবে না। আবার জিজ্ঞেস করলে না’টাও তোমাদের মুখের ওপর বলতে পারবে না। আমি জানি। তুমি ছেড়ে দাও দাদাভাই’।
ঠিক তার তিন দিনের মাথায় রাতে ঘুমের মধ্যে সত্যব্রত চলে গেলেন।
শ্মশান থেকে ফিরেই বানী কল হিস্ট্রি দেখে মনে করার চেষ্টা করল কোন নাম্বারটা উমেশের হতে পারে।
*
What's Your Reaction?

Gunjon is a Kolkata-based writer whose journey has taken him from Bollywood to Southeast Asia, working as a screenwriter for a major production house in Jakarta. His debut Bengali thriller introduces a groundbreaking mother-son duo as investigators, adding a fresh twist to the genre. An avid reader with interests ranging from Astronomy to Zymurgy, Gunjon is equally passionate about fermented foods and beverages from Bengal and the Far East. He delights in spicy Shutki Machh paired with a glass of home-brewed Chhang.