সিকিম ডায়েরি: ১৯৮০ সালের একটি ভ্রমণ কাহিনী
Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks…
সিকিম দেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক পটভূমির মধ্যে দিয়ে, পরিবর্তিত ল্যান্ডস্কেপ এবং অনন্য সাংস্কৃতিক এনকাউন্টারের প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়ে ফুটে উঠেছে এই গল্প ।
সালটা ১৯৮০। আমি তখন সদ্য স্নাতক। যোগ দিয়েছি বাবার ব্যবসায়। গালভারী পদ ‘Director, Commercial Operations’। জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন নিগমের অধীনে সিকিমের গ্যাংটক ও জোরথাং এ দুটো দুগ্ধ খামার তৈরি হচ্ছিল। আমাদের কোম্পানি সেখানে কিছু কাজের বরাত পেয়েছে। কাজ শুরু হয়ে গেছে। এমন সময় তৈরী হলো সিকিম দুগ্ধ সমবায় সমিতি আর নির্মাণ চলাকালীনই ঐ দুটি খামার হাতবদল হয়ে সমবায়ের অধীনে চলে এল।
আমার ওপর দায়িত্ব পড়লো ঐ পরিবর্তন সংক্রান্ত কাগজপত্র সম্পাদন করার। কিন্তু বাবা সদ্য স্নাতক পুত্রের উপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারলেন না। সর্বঘটে কাঁঠালী কলা শ্যামকাকুকে আগে পাঠিয়ে দিলেন জমি তৈরির জন্য আর আমার সঙ্গে জুড়ে দিলেন আমার দ্বিগুন বয়সী এক ইঞ্জিনিয়ার প্রবীর ঘোষকে। শেষ অগাস্টের এক সন্ধ্যায় বৃষ্টি মাথায় কাকুর সঙ্গে চড়ে বসলেম দার্জিলিং মেল’এ।
পরদিন সকালে নামলেম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। বৃষ্টি আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি একবারের জন্যও। শুনলেম সিকিমে যেতে হলে শিলিগুড়ি থেকে এসএনটি’র গাড়ি ধরতে হবে। সিকিমে বাইরের বানিজ্যিক যানবাহন তখনও নিষিদ্ধ। প্রাতরাশ সেরে শিলিগুড়ি এসএনটি বাস আড্ডায় পৌঁছতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। টিকিট কাটতে গিয়ে জানা গেল শেষ বাস একটায়, তার আগে কোন বাসেই টিকিট নেই।
এখন শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক পৌঁছতে সাড়ে তিন/চার ঘণ্টা লাগে, তখন পাঁচ ঘণ্টার বেশি লাগতো। একটায় রওনা দিলে গ্যাংটক পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে যাবে, এমন বাদল দিনের সন্ধ্যায় ভাড়ার গাড়ী পাওয়ার সম্ভাবনা সেখানে কম, ফলে হোটেলে পৌঁছতে সমস্যা হবে।
প্রথমে ঘোষকাকু, তার ইঞ্জিনিয়ারিং মদগর্বে টিকিট কাউন্টারে খানিক হম্বিতম্বি করে ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরলেন। এবার হাল ধরলেম আমি।
আমি, সোজা চলে গেলাম বাসআড্ডার প্রবন্ধকের কামরায়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞানপত্রটি তার হাতে দিয়ে আমি বললেম, “আমি সরকারি কাজে গ্যাংটক যাচ্ছি। গ্যাংটক ও জোরথাং এ নির্মীয়মান দুটি দুগ্ধ খামার পরিদর্শনের জন্য আজই আমায় গ্যাংটক পৌঁছতে হবে”। মধ্যবয়সী প্রবন্ধক মহোদয় অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখলেন। তারপর ইংরেজি অভিজ্ঞানপত্রটি দেখলেন। সম্ভবত এতো কমবয়সী কোন পরিদর্শক তিনি আগে দেখেননি। কিন্তু ‘ডাইরেক্টর’ শব্দটি তার পরিচিত। তাতে কাজ হলো ম্যাজিকের মতো। সমস্ত সরকারি দুরপাল্লার বাসে খানকয়েক আসন সংরক্ষিত থাকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’দের জন্য, তারই দুটো আসন বরাদ্দ হলো আমাদের জন্য। আমরা রওনা দিলেম ১১ টায়। এরপর সারা রাস্তা ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’র খাতিরদারি পেতে পেতে চারটে নাগাদ পৌঁছে গেলেম গ্যাংটক।
আজ থেকে ৪৪ বছর আগে সিকিম ভ্রমণ এতো সহজ ছিল না। তার মাত্র পাঁচ বছর আগে ১৯৭৫ সালে সিকিমের রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পর ভারতভুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। তখনও সেখানকার পরিকাঠামো অনুন্নত। রাস্তা ঘাট নেই। প্রশাসন দুর্বল। সমগ্ৰ সিকিম সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। পদে পদে সেনাবাহিনীর নাকাবন্দী, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ। স্থানীয় মানুষ না হলে আরো বেশী হয়রানি।
বাস থেকে নামতেই এগিয়ে এলো সেনা জওয়ানরা। আমি আবারও এগিয়ে দিলেম আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞান পত্র। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হতেই এগিয়ে এলেন করিৎকর্মা শ্যাম কাকু। তিনি মাত্র দিন দশেকেই আলাপ জমিয়ে নিয়েছেন সেনা জওয়ানদের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে ছিল চারটে স্যুটকেস, একটাতে আমার জামাকাপড় ও টুকিটাকি, আরেকটাতে ঘোষকাকুর। অন্যদুটোয় প্রকল্পের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। শ্যামকাকু চারটে স্যুটকেস খুলে জওয়ানদের দেখিয়ে দিয়ে সহজেই ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেললো। শ্যাম কাকু সঙ্গে আসা চারজনের হাতে চারটে স্যুটকেস তুলে দিয়ে আমাদের নিয়ে একটা ভাড়ার গাড়ীতে এমজি মার্গের হোটেলে তুলে দিলো।
এক সপ্তাহের মধ্যেই আমার কাজ শেষ হয়ে গেল, ঘোষ কাকু দুটো প্রকল্পেরই দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। আমি কয়েকদিন থেকে একটু ঘোরাঘুরি করে নিলেম। তখন ঘোরাঘুরি করা বেশ ঝামেলার ছিল। প্রায় সবজায়গাতেই সেনার অনুমতি প্রয়োজন হতো। রুমটেক মঠ, এনচে মঠ, রাঙ্কা মঠ, চোরতেন স্তুপ, নামগিয়াল জাদুঘর, চোগিয়ালের রাজবাড়ী, ঠাকুরবাড়ি, হনুমান টোক, গনেশ টোক এগুলো ঘুরতে আলাদা অনুমতির প্রয়োজন ছিল না। দুই দিনে সেগুলো দেখা হয়ে গেল। নাথু লা আর জেলেপ লা তখন বন্ধ, যাওয়ার অনুমতিও দেয়া হতো না। শ্যামকাকু করিৎকর্মা লোক। ছাঙ্গু লেক দর্শনের অনুমতি নিয়ে সেটাও দেখিয়ে আনলেন। কিন্তু এতো কমে আমার মন ভরলো না। তরুণ বয়সের স্বাভাবিক চঞ্চলতা আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়।
জোরথাং প্রকল্পের কর্মী রামকুমার সুব্বা। বাড়ি তার পশ্চিম সিকিম জেলার ইয়ুকসাম, সিকিমের প্রথম রাজধানী। নেপাল সংলগ্ন জেলা হওয়ায় এই জেলায় নেপালীর সংখ্যা প্রচুর, ফলে জেলাটি হিন্দু প্রধান। রামকুমার নেপালী হিন্দু, জাতিতে লিম্বু, কিন্তু গ্ৰামের মোড়ল পরিবারের লোক হিসেবে ‘সুব্বা’ পদবি ব্যবহার করে।
রামকুমার বললে, “চলিয়ে সাব, মেরা গাঁও, আসলি সিকিম দেখিয়েগা”। একবাক্যে রাজী হয়ে গেলেম।
রামকুমার, করিৎকর্মা শ্যাম কাকুর সাহায্যে পরদিনই সেনার অনুমতি জোগাড় করে ফেললো।
হাতে সময় কম, তাই পরদিনই সকাল ছটায় রওনা দিলেম, ইয়ুকসামের উদ্দেশ্যে, রামকুমারের ভাই পরশুরাম সুব্বার ভাড়ার গাড়ীতে।
শুরুতে শুধুই চড়াই। রাস্তার দুই পাশে প্রকৃতির অপার বৈভব, অনাঘ্রাতা সুন্দরীর মতো, এলিয়ে শুয়ে আছে, শুধুমাত্র আমার জন্য। চড়তে চড়তে ন টা নাগাদ পৌঁছলেম ৮০০০ ফিট উচ্চতায় রাভাংলা। আজকের রাভাংলা নয় চুয়াল্লিশ বছর আগের রাভাংলা। ছোট্ট জনপদ। পথের পাশে খান কয়েক টুকিটাকি জিনিসপত্রের দোকান। তারই একটাতে চা খেলেম। সঙ্গে মোমো। শুয়োরের মাংসের। এই কদিন সিকিমে থেকেও মোমো ছুঁয়ে দেখিনি। অচেনা বিজাতীয় খাবার, কেমন হবে জানিনে। সেদিন প্রথম আমার মোমোর সঙ্গে ‘মুখোমুখি’। আর প্রথম আস্বাদনেই প্রেম, সে প্রেম আজোও অটুট।
আবার যাত্রা হলো শুরু। এবার শুধুই উৎরাই। প্রকৃতির রূপসুধা পান করতে করতে ইয়ুকসাম পৌঁছলেম ঠিক দুপুর বারোটায়।
আমাদের আপ্যায়ন করা হলো ‘টোংবা’ আর ‘ফাকসা দোমকে’ দিয়ে। টোংবা হলো বাজরা থেকে তৈরি এক ধরনের বিয়ার। এটা দেওয়া হয় একটা বাঁশের পাত্র, ‘ধুংরো’তে। আর খেতে হয় ‘পিপসিং’ নামে বিশেষ এক ধরনের বাঁশের নল দিয়ে। লিম্বু সংস্কৃতিতে টোংবা অতি পবিত্র। সমস্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ও অতিথি আপ্যায়নে এর ব্যবহার আবশ্যিক। ফাকসা হলো শুয়োরের মাংস আর দোমকে এক ধরনের কাবাব।
ইয়ুকসাম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান শুরুও হয় ইয়ুকসাম থেকেই। ইয়ুকসাম থেকেই শুরু হয় কাঞ্চনজঙ্ঘা বেস ক্যাম্প ট্রেক। এগারো দিনের এই ট্রেকিং রুট বিশ্বের অন্যতম কঠিন ট্রেকিং রুট। সেই কারণেই এখানে প্রচুর বিদেশিদের আনাগোনা। এখন অবশ্য বর্ষাকাল, ট্রেকিং বন্ধ, ইয়ুকসামও বিদেশি শূন্য।
সত্তর দশকে বলিউডের সফল চরিত্রাভিনেতা ড্যানি ডেনজংপা ইয়ুকসামের ছেলে। ১৯৮০ তে সে খ্যাতির মধ্যগগনে। গর্বিত রামকুমার দেখালে, তাদের দুটো বাড়ীর পরেই ড্যানির বাড়ি। পরের বার যখন আসি, তখন দেখেছি সেই বাড়িতে পাঁচতারা হোটেল হয়েছে, বিদেশীদের খাতিরদারির জন্য।
বৃষ্টি একটু ধরেছে। তাই আমরা, ড্যানির বাড়ির অদূরেই, সিকিমে নামগিয়াল বংশের প্রথম রাজা প্রথম চোগিয়ালের অভিষেক স্থল নরবু ঘ্যাঙ, দেখে নিলেম।
এখানে একটু ইতিহাস ছুঁয়ে যাই। নামগিয়ালরা আসলে তিব্বতি। সপ্তদশ শতকে তিব্বতে রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে নামগিয়ালরা দক্ষিণ দিকে পালিয়ে আসে। এদের একটা শাখা লাদাখে নামগিয়াল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। আরেকটা শাখা ভূটানে রিনপোচে রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। আর তৃতীয় একটা শাখা সিকিমে চোগিয়াল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে।
আবারও শুরু হলো চলা। আধঘন্টা পরে গাড়ি হঠাৎ গেল থামি। পরশুরাম ইঞ্জিন বন্ধ করলে। চারিদিকে যেন জলতরঙ্গ বাজছে। রামকুমার বললে, “চলিয়ে সাব”। দুই রাম কুকরি হাতে জঙ্গল সাফ করতে করতে পাহাড়ে চড়তে লাগলো, আমিও পিছু নিলেম। একটু এগিয়ে একটা চওড়া পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে গেল দুই ভাই। আমিও উঠে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেম। পাহাড়ের মাথা থেকে বিপুল জলরাশি ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রায় ১০০ ফুট নিচের ছোট্ট জলাশয়ে। তারই অভিঘাতে সৃষ্টি হচ্ছে এক প্রাকৃতিক ঐকতান। রাম বললে, এই জল কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ গলা জল, বৃষ্টির জন্য জল আরও বেড়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত, তখনও পর্যন্ত সে ছিল সাধারণ পর্যটকদের অজানা। ১৯৯০ সাল নাগাদ এক পর্যটন সংস্থা এটাকে সাধারণ পর্যটকদের সামনে নিয়ে আসে।
আবারও চলা শুরু। প্রায় জনমানবশূন্য জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ গিয়ে থামলো চারিদিকে পাহাড়ের মাঝে বিশাল এক জলাশয়ের পাশে। রাম বললে ‘খেচিপেড়ি লেক’। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জল। জলে খেলে বেড়ানো মাছগুলোও দেখা যাচ্ছে। ধর্মীয় কারণে জলে নামা নিষেধ। আয়তন প্রায় ১০০ বিঘে। (২০১৫ সালে গিয়ে দেখেছি জলাশয়ের আয়তন অর্ধেক হয়ে গেছে।)
ক্রমশঃ
What's Your Reaction?
Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks trade analyst. In the course of his job, he had been posted all across the eastern and northeaster states. He has a great passion for writing. He has written many deeply touching stories about the common men and women he got to meet during his tenure. He is also a specialist contrarian amateur historian especially on issues like the history of Bengal and of the Bengal Renaissance.
I am excited to read the memoirs of Sikkim by Swapan Chowdhury. He has written in a very interesting style in lucid language ! As I also resided in Gangtok for three years from 2009 , I am eagerly waiting to know how the place was 44 years back . I have visited most of the places Swapan has mentioned , and our Doordarshan studio is situated bang opposite to Enchey monastery… can’t forget the beautiful state , very courteous behaviour of the local people and the nature !