Now Reading
সিকিম ডায়েরি পার্ট ২: দারাপ -এ প্রথম দিন

সিকিম ডায়েরি পার্ট ২: দারাপ -এ প্রথম দিন

Avatar photo
সিকিম ডায়েরি পার্ট ২: দারাপ

সিকিম ডায়েরির দ্বিতীয় পর্ব আপনাকে আবার নিয়ে চলে যাবে সিকিমের অতুলনীয় ল্যান্ডস্কেপে, এবং পরিচয় করাবে দারাপ -এ অবস্থিত লিম্বু সম্প্রদায়ের অনন্য ঐতিহ্যের সাথে ।

সুব্বাদের ইয়ুকসামের বাড়িতে পরশুরাম তার পরিবার নিয়ে বাস করে। পরিবারের বাকিরা বাস করে নিকটস্থ ‘দারাপ’ গ্ৰামে।
তিনটে বেজে গেছে, সন্ধ্যা এখানে আচমকা এসে পড়ে। খেচিপেড়ি দর্শন সেরে, এবার আমরা চললাম রামকুমারদের গ্ৰামের দিকে। পথের দুপাশে কমলালেবুর বাগান, আর তারই ফাঁকে ফাঁকে বড় এলাচের ক্ষেত।

কিছুদুর গিয়ে আবারও গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো। এবার সামনে রিম্বি জলপ্রপাত। অনেক ওপর থেকে ছোট ছোট লাফে ধাপে ধাপে নেমে আসছে জলধারা। এখানকার জলপ্রপাতগুলো বরফগলা জলে পুষ্ট। আজ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃষ্টির জল। ফলে এই জলপ্রপাতে এখন প্রচুর জল। এটাই শেষে গিয়ে রিম্বি নদীতে মিলেছে। এখানে একটা ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও রয়েছে। তবে তাতে স্থানীয় মানুষের কোন উপকার হয়নি। জলের ওপর দিয়ে গেছে একটি বাঁশের সাঁকো। সাঁকো দুলছে, জলের তোড়ে। তার ওপর দিয়ে গাড়ি যাওয়া অসম্ভব। এদিকে চারটে বেজে গেছে। যেকোনো সময় সন্ধ্যে নামবে। দেরি করে লাভ হবেনা, তাই গাড়ি সেখানে ছেড়ে আমরা সাঁকো পেরিয়ে পায়েচলা পথে চার কিলোমিটার দুরের দারাপ -এর দিকে এগোলাম। এখন এ রাস্তার উন্নতি হয়েছে নিশ্চয়ই, কারণ, এখন পেলিং থেকে এই পথেই লোকে কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত দর্শনে আসে।

দারাপ-রিম্বি জলপ্রপাত
দারাপ-রিম্বি জলপ্রপাত

বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান। সন্ধ্যা যায়… যেতে যেতে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে বিছিয়ে দিয়ে যায় তার সোনার আঁচল। সূর্যের রক্তিম আভায় কাঞ্চনজঙ্ঘার তিনটে শৃঙ্গের শৃঙ্গার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
অপূর্ব সুন্দর গ্ৰামটা। পুরো গ্ৰাম জুড়েই কমলার বাগান আর বড় এলাচের ক্ষেত। ফুল ফুটেছে প্রতিটা ঘরের উঠোনে। চারিদিকের পাহাড় থেকে নেমে আসছে অজস্র ছোটবড় জলধারা। বয়ে যাচ্ছে দারাপ -এর ওপর দিয়ে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় নাকি দেবদেবীদের বাস। আর দারাপ সেই স্বর্গের আগের স্টেশন।

কমলার বাগান
কমলার বাগান

কমলা বাগানের মধ্যে দিয়ে পায়ে পায়ে চলতে চলতে আমরা এসে পড়লাম একটা বাড়ির সামনে। দুইভাই হাঁক দিলো ‘আম্মী, আম্মী’ বলে। তাদের হাঁকডাকে খোলা দরজায় দেখা দিলেন তাদের মা, মধ্যবয়সিনী, পরনে সাদা ‘মেখলি-ব্লাউজ-তাগা’। তাগা হলো এক ধরনের মোটা কাপড়ের ওড়না। ঐ কাপড়ের নাম ‘ঢাকা’, লিম্বু মেয়েরা বাড়িতেই বানায়, বাঁশের তাঁতে। মায়ের পিছন পিছন ‘ভাইয়া’ বলে দৌড়ে এসেও, আমায় দেখে, আম্মীর পিছনেই দাঁড়িয়ে পড়ল এক অষ্টাদশী। পরনে তার নীলাম্বরী মেখলি আর সাদা ব্লাউজ, তাগা নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘার লালিমা ছায়া ফেলেছে তার নীলাম্বরীতে, মেখলি তখন ময়ুরকন্ঠী। আম্মীর পেছন থেকেই মুখ বাড়াল মেয়ে। আমায় দেখল কি না তা সেই জানে, আর জানি আমি। আমার একুশে হৃদয়ে তখন জীবনানন্দ,

“ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার রাঙা,
আপেলের মতো লাল যার গাল,
চুল যার শাঙনের মেঘ,
আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন”।

পরিচয় পর্ব শেষ করে ঘরে ঢুকলাম। অদ্ভুত নাম সেই মেয়ের, নুমা। কিন্তু নুমা শব্দের অর্থ জেনে বুঝলাম একদমই ঠিক নাম, নুমা’র মানে সুন্দরী।

বাড়ির কর্তা রাজকুমার ঘরেই বসে ছিলেন। প্রণাম করে বসতে না বসতেই সুন্দরী নুমা কয়েকটা ‘ধুংরো’ নিয়ে এলো, তাতে ‘পিপসিং’ দেওয়া। এখন সে একটা ‘টোগা’ চড়িয়েছে। সবাইয়ের হাতে হাতে ‘ধুংরো’ ধরিয়ে দিয়ে সুন্দরী আবারও উধাও। এবার সে এলো এক বিশাল পিতলের পাত্রে গরম জল নিয়ে। সবাইয়ের ধুংরোতে গরম জল ঢেলে দিল। ব্যস, ‘টোংবা’ তৈরী। পিপসিং এ মুখ লাগিয়ে সবাই টোংবা পানে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

সুন্দরীর হাতেও একটা ধুংরো। সে পিপসিং এ দুটো টান দিয়েই আবার উধাও। এবার ফিরলো হাতে দুটো বড় প্লেট ভরতি স্ন্যাকস নিয়ে। প্লেট দুটো টেবিলে নামিয়ে, পিপসিং এ দুটো টান দিয়ে আবারও বেরিয়ে গেল। এবার ফিরলো হাতে হ্যারিকেন নিয়ে। ঘরে অন্ধকার। ঘরের দুই কোনে দুটো হ্যারিকেন নামিয়ে, তৃতীয়টা নামালো টেবিলে। তারপর বসে পড়লো আমার উল্টোদিকেই। দারাপ তখন‌ও বিদ্যুৎহীন।

দারাপ

একটা স্ন্যাকস তুলে মুখে দিলাম, মনে হলো মাংস। রামকুমারকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি, এটা?” সে বললে, “সাখেক্যা”। এরপর আম্মী যা বললেন, তাতে বুঝলাম, ‘গরুর মাংস নানা রকম মশলায় জারিয়ে, রোদে শুকিয়ে, ‘সাখেক্যা’ তৈরি হয়। তারপর তেলে ভেজে খাওয়া হয়’। চমকে উঠলাম। রামও গরুর মাংস খাচ্ছে, আমার পাশে বসেই খাচ্ছে, আনন্দ করে খাচ্ছে, মা-বাবার সঙ্গে খাচ্ছে? রাম তো হিন্দু, রামের পুরো পরিবার হিন্দু, একেবারে সনাতনী হিন্দু, তা সত্বেও? নিজাম রেস্তোরাঁয় লুকিয়ে লুকিয়ে ‘বিফ রোল’ খাওয়ার গ্লানিবোধটা টুক করে খসে গেল। পরে জেনেছি ‘সাখেক্যা’ শুধু সিকিম নয়, নেপাল, ভূটান, লাদাখেও খায়। বিভিন্ন জায়গায় এর নাম বিভিন্ন। নেপালে এর নাম ‘সুকুতি’। আর সিকিমের বিখ্যাত ‘সা ফালে’ আসলে ‘বিফ স্যান্ডউইচ’। আরো পরে জেনেছি লিম্বুরা পুরোপুরি হিন্দু নয়। তারা এক প্রাচীন সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী।

আমার মুখের ভাব দেখে সুন্দরীর চোখে হাসির আভাস। সে চোখ দিয়ে হাসে। অপ্রস্তুত হয়ে আমি তড়িঘড়ি পিপসিং এ টান দিই। হাওয়া আসে শুধু। হাত সরিয়ে নিয়ে সামনে ঠেলে দিই ধুংরোটা। সুন্দরী টেনে নেয় ধুংরোটা। অবলীলায় পিপসিংএ মুখ লাগিয়ে টান দেয়, চোখে চোখ রেখে। মৃদু হাসি ঢেউ খেলিয়ে ওঠে ডালিম ফুলের মতো রাঙা ঠোঁটে। আমার ধুংরোটা সরিয়ে রেখে সে টেনে নেয় নিজেরটা। ডালিম ফুল নুয়ে আসে পিপসিংয়ে তারপর চোখে চোখ রেখে অল্প টান দিয়ে, ঠেলে দেয় আমার দিকে। আমি ইতস্তত করি। এবার কথা ফোটে তার গোধূলি রাঙা চোখে। ইশারায় বলে, “ছুঁয়ে দেখো”। আমার ঠোঁট নেমে আসে ডালিম ফুলের গন্ধেভরা পিপসিংয়ে। বাইরে আবার বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে, একুশের হৃদয়ে তখন বজ্রপাত হচ্ছে।

আবারও উঠে বাইরে যায় সুন্দরী। ফিরে আসে গরম জলের পাত্র নিয়ে। আবারও গরম জল ঢেলে দেয় সবার ধুংরোতে। আমার ধুংরোতেও। সুন্দরীর ধুংরোটা তখনও আমার হাতে ধরা। সুন্দরী গরম জল ঢালে তাতেও। তারপর আমার হাতের ওপর হাত দিয়ে ধরল আর টেনে নিলো নিজের দিকে। একুশের আঙ্গুলে বিদ্যুৎস্রোত বয়ে গেল।

See Also
Kaziranga National Park and Tiger Reserve

টোংবা শেষ করে আম্মী কিছু বললো মেয়েকে। সুন্দরী এবার রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে উঠে গেল। একজন সহকারীর সাহায্যে সে খাবার পাত্রগুলো টেবিলে নিয়ে এলো। খাবার পরিবেশন করলো কাঁসার থালায়। থালার ওপর চীনামাটির বাটিতে থুকপা, একটা গরম ফুলকো খোরেং (বাজরার রুটি), কাঁসার বাটিতে এক বাটি ঢাল (মুসুর ডাল), একটু মুলোর আচার, একটা বাটিতে ফানোকিক সুম্বক (কচি বাঁশের তরকারি) আর একটা বাটিতে ইয়াংবেন ফাকসা (লাইকেন দিয়ে শুয়োরের মাংস)।
খাবার পর রামকুমার আমায় নিয়ে গেল একটা ঘরে, আমার শোবার ব্যবস্থা দেখাতে। পিছন পিছন সুন্দরী এলো আমার ছোট্ট সুটকেস টা নিয়ে। সারা ঘরে মেয়েলি গন্ধ। হয়তো এটা সুন্দরীর ঘর, আজ আমার জন্যই সে ঘরছাড়া। এই ঘরে সংলগ্ন বাথরুম রয়েছে, সে কারণেই হয়তো এই ঘরে আমার ঠাঁই হলো। ভাইবোনে ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলাম, জল প্রচন্ড ঠান্ডা। ঘড়িতে দেখলাম মাত্র দশটা বাজে। চোখে ঘুম নেই। বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। বৃষ্টি বেড়েছে। বাইরে ঠান্ডা আরও বেশি। একটা শাল দিয়ে কান, মাথা, গলা ঢেকে জ্যাকেটের চেনটা পুরো টেনে নিলাম। কোথাও জনমানব নেই। নেই কোন আলোর রেখা। নেই কোন শব্দ। শুধু অবিরাম জল ঝরার আওয়াজ। মনে হলো জগৎসংসারে শুধু আমিই জেগে আছি, একা।

একটা সিগারেট ধরালাম। কয়েকটা টান দিয়ে আর ভালো লাগলো না। ফেলে দিলাম। মন ভীষণ অস্থির। বাইরে বর্ষনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একুশের হৃদয়ে তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবিঠাকুর হয়ে ঝরছে। গুনগুনিয়ে উঠলাম,

এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার॥

গান শেষ হলে একটা হাত আলতো করে আমার কাঁধ ছুলো। চমকে ঘুরে তাকালাম। আম্মী। বললেন, “ইতনা দুখ কিঁউ হ্যায়, বেটা”। চুপ করে রইলাম। কেমন করে বলি, এতো ভালোবাসার গান, আর সে তো কেবলি যাতনাময়। বারান্দার কোন থেকে এগিয়ে এলো রামকুমার, বললে, “আপ, বহুত আচ্ছা গাতে হ্যায়, সাব”। দাদার পিছন পিছন এগিয়ে এলো বোন। মুখে সে বললে না কিছুই, চোখে চোখে চেয়ে রইলে, সে চোখে চিকচিক করছে সপ্রশংস ভালোলাগা। আম্মী বললেন, “অন্দর যাও বেটা, তুমহারা আদত নেহি, সর্দি লাগ জায়েগা”।

পৃথিবীর সব মা একই রকম। কথা না বাড়িয়ে, ঘরে ঢুকে, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে, জ্যাকেটটা খুলে, সোজা কম্বলের তলায়। সারা রাত ঘুম হলো ছেঁড়া ছেঁড়া, ঘুমপথে বারেবারেই সুন্দরীর নড়াচড়া।

ক্রমশঃ

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
1
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top