Now Reading
ভাবা ও ভাবনা

ভাবা ও ভাবনা

Avatar photo
ভাবা ও ভাবনা

শীতের একাকীত্ব, ভাবনার বিলাসিতা, প্রকৃতির মায়াবি পরিবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলার এক গভীর উপলব্ধি। এক বাঙালির  ভাবা ও ভাবনা,  নির্জন সময়ের নান্দনিক অনুভূতি ও সমাজের অসাম্যের বাস্তব চিত্র।

ঠাণ্ডা পড়ার মুখে যে শীত শীত ভাবটা থাকে, সেটাকে চেটেপুটে উপভোগ করতে বেশ লাগে। অখণ্ড অবসর এখন। সব কাজ থেকে নিজেকে ছুটি দিয়েছি। না আছে কাজে যাবার তাগিত, না আছে অর্থ উপার্জনের কোন পথ। ওসবের দরজা জানলা বন্ধ করে অনেকটা ঝাড়া হাতপা গোছের একটা ব্যাপার। কতকিছু ভাবার, কতকিছু চিন্তা করার সময় – নাইবা থাকলো টাকা পয়সা লেনদেনের হিসাব। আমি ভাবছি, ভাবছি আর ভাবা প্র্যাক্টিস করছি।

আমাদের বাড়ী একটা কানা গলির শেষ মাথায়। রাস্তার ব্যস্ততার কোলাহল থেকে নিভৃতে। পুবদিকে রাস্তা — তারপর পাঁচিল ঘেরা অযত্নে বেড়ে উঠা আগাছা ভর্তি একটা জমি তারপর দাম্ভিক বাড়িদের সারি। সকালের সোনাঝরা রোদ বাড়ির পূবের বারান্দায় লুটিয়ে পড়ে। একটা চেয়ার-টেবিল পাতা। আমার দিন কাটে ওই চেয়ার টেবিল কে ঘিরে। ওখানে বসে পড়ি, লিখি – গুচ্ছের ছাইপাঁশ। রাতে ওটার দখল নেয় সাদাকালো একটা বিড়াল। সারাদিন পথের কুকুর, বিড়াল – বাড়ির চৌহুদ্দির মধ্যে ঘোরাফেরা করে। ওরাও বাড়ির সদস্যের মত। আমি এই চেয়ারে বসে সকালের মিঠে রোদ গায়ে মাখি। সামনের আগাছার মাঝে নবীন অশ্বত্থ গাছে একটা কোকিল রোজ এসে বসে। আমার সঙ্গে তার ভারী ভাব। রোদ ছায়ায় বসে ঠোঁট দিয়ে গা চুলকায়। গাছের ডালে চড়াই, শালিক, ফিঙে, ছাতারে — সবার আনাগোনা। কিচিরমিচির করে একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে। আমি কখনও মুচকি হেসে, কখনও মাথা নাড়িয়ে ভালো থাকার বার্তা দিই।

আজ আমাদের এক নতুন অতিথি এসেছে – “বসন্ত বউরি” । বাসন্তী রঙের ডানায় সকালের আলো সবটুকু শুষে নিয়ে অশ্বত্থ গাছের ডালে এসে বসলে। আমার বাষট্টির শরীরে ছাব্বিশ বছরের যুবক মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। চুপটি করে বসে, স্বার্থপরের মত একা সেই সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। পরম মমতায় উত্তরে বাতাস গাছের পাতা দুলিয়ে, খসখস শব্দে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সরিয়ে রাখলাম রোজদুনিয়ার হিংসা, বিদ্বেষ ভরা খবরের কাগজ। এখন আমি ও আমার একাকীত্ব মুখোমুখি।

কবে যেন লিখেছিলাম কোথাও একটা কাঁচা হাতের কবিতা…..

ওরা বেঁচে থাকে

শহরের ভিতর আর এক শহর
শীত এখানে ছেঁড়া কাঁথায় নামে
ভোরের পাতলা কুয়াশা চাদর
ঘর সংসার ট্রেন লাইনের বামে।

উঁচু প্ল্যাটফর্মের নিচে ভাঙাচোরা সংসার
হামা দেয় শিশু লাইনের স্লিপারে
পাশের লাইনে ট্রেন ছোটে দুরদার
কেউ তাকে তুলে এনে রাখে ঘরে।

বাপ করে কাজ এটাওটা টুকটাক
মাস মাইনের কাজ জোটে নি কভু
দিনের ক্লান্তি ঘোচায় চোলাই ঠেক
কেবল হাহুতাশ, মুখ তুলে চাইলো না প্রভু।

মা, তিন বাড়ির ঠিকে কাজের লোক
তার রোজগারে সংসার চলে খুঁড়িয়ে
তিনটে ইঁটের উনুনে রান্না যা হোক
বড় মেয়েটা ভাতের পানে লোলুপ চোখে তাকিয়ে।

আটের মেয়ে এখনও ডাগর হয় নি
অভ্যেস মতো জানলার কাঁচে দেয় ঠোক্কর
ঠান্ডা গাড়ির নরম গদিতে সবে চোখে ঢুলুনি
খিঁচিয়ে বলি “যা ভাগ, যত্তোসব জোচ্চোর।”

মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দি
ভাগ্যিস ওরা ভিখিরি, ওরা গরীব
কখনও ভাবিনি আসল সত্যি
আরও ধনীর কাছে আমিও ভিখারি, গরীব।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। অলস দিন কাটাই। বসে থাকি চুপচাপ আর ভাবী, ভাবা অভ্যেস করি। শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা থেকে দু চার লাইন ধার করে লিখি  —

“মানুষ যতই ভাবুক, করুক চেষ্টা,
মেলে না জীবনে এমন কোন মুহূর্ত
মানতে যখন না হয় — দারুণ ধূর্ত
এই অসহ্য সর্পই উপদেষ্টা।”

নিস্তব্ধ দুপুরে ঘুঘু এসে বসে বাড়ির পাঁচিল। কর্মহীন আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি। ভিটে তে ঘুঘু চরে বেড়ানো। এটা কি শান্তির প্রতীক নাকি ঘর ছাড়ার — কিছু একটা হবে। ঘুঘুর ঘু ঘু শব্দে মাঝে মাঝে ডেকে উঠার মধ্যে একটা প্রাণের সঞ্চার পাই।

শীতের দুপুর খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। এরই ফাঁক ফোঁকরে নিজের মনের মাঝে লতাপাতার মত বেড়ে ওঠা ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নগুলোকে সাজাতে বসি। কোন অতলে চলে যাই। গহীন সাগর থেকে রত্ন তুলে আনার মতন মস্ত ডুব। গভীর, গভীর আরো গভীরে। অলস ভাবনার ভাবনায় আমি মশগুল। আলোয়ান মুড়ি দিয়ে ভাবনার বিলাসিতা করা শুধু আমারই সাজে। আমি যে “রাজকুমার”। ভাসতে ভাসতে চলে যাই ডাকঘরের ঠাকুরদার মুখে শোনা সেই অজানা দ্বীপে — যেখানে তির তির করে নদী ছোট ছোট লাল নীল নুড়ি পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে বয়ে চলে। পাখিরা সব নানা সুরে গান গায় …….. ।

See Also
Badal Sircar

দিন শেষ হয়ে রাত নামে। আকাশে চাঁদ তার সভা উজ্জ্বল করে আমার উঠোনে আলো ছড়িয়ে নেমে আসে — আমি তখনও একা ভাবী, ভাবী এবং ভাবা প্র্যাক্টিস করি। ভাবনা আর ভাবা, একে অপরের পরিপূরক।

“হৃদয়ের মধ্যে বাঁধো ঘর
অবরোধ, বরফ, কুয়াশা,
স্তব্ধমন, শব্দহীন ভাষা,
অগ্নিকুন্ড, দীর্ঘ অবসর
আর দুই মুগ্ধ অন্তর্যামী —
আমি আর মুখোমুখি আমি।”

— বুদ্ধদেব বসু।।

 

 

 

 

What's Your Reaction?
Excited
1
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top