Now Reading
ভগবান কে মৃত্যু ছুঁয়ে গেল !!

ভগবান কে মৃত্যু ছুঁয়ে গেল !!

Avatar photo
ভগবান Ratan Tata

চিরজীবন যিনি মানুষের মঙ্গল চেয়েছেন, নিজের ঐশ্বর্য, সম্পদ কে মানুষের সেবা মূলক কাজে উৎসর্গ করতে চেয়েছেন। বিশিষ্ট শিল্পপতি হয়েও সাধারণ জীবনে বিশ্বাসী, কর্মসংস্থান করা যাঁর জীবনের লক্ষ্য, সেই মহান মানব Philanthropist SIR RATAN N TATA, সাধারণের চোখে ভগবান, তাঁকে নিয়ে আমাদের স্মৃতি চারণ – অনেকটা গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোর মতন।

আরব সাগর থেকে উঠে আসা ঝড়ো হাওয়া সঙ্গে বৃষ্টি। মহানগরী মুম্বাই বৃষ্টিস্নাত। ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি, বাইক, স্কুটার দাঁড়িয়ে। এক ব্যক্তি নিজের গাড়ির ড্রাইভার সিটে বসে দেখছেন, তাঁর গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে একটা স্কুটার। স্কুটারে এক দম্পতি, সঙ্গে তাদের সন্তান। ভদ্রলোকের খুব খারাপ লাগলো। ভাবলেন যদি স্কুটারের চাইতে অল্প কিছু বেশি নামে একটা ছোট গাড়ি বানানো যায়, তাহলে যারা স্কুটার বাইকে বৃষ্টিতে যাতায়াত করেন, তাদের কিছুটা উপকার হবে। নিজের হাতে আঁকলেন গাড়ির ছবি। কিছুতেই গাড়ির দাম এক লাখ টাকা করা সম্ভব হচ্ছে না, খরচ বেড়েই চলেছে। উপদেষ্টারা বললেন “গাড়ির দরজা না লাগিয়ে যদি অটো রিক্সার মতন করা যায় তাহলে কিন্তু খরচ অনেকটাই কমে যাবে” উনি বললেন “না না, বৃষ্টি থেকে তাহলে বাঁচবে কি করে? এটা হতে পারে না”। তাঁর উপদেষ্টারা আবার বললেন “গাড়ির চারটে নয়, দুটো দরজা হোক; খরচ কমবে।” উনি বললেন “ভারতীয় মহিলারা শাড়ি পরেন, সামনের সিটকে মুড়ে, শাড়ি পরে, পেছনের সিটে যাওয়া অসুবিধের – এটা করা ঠিক হবে না।” নানারকম মত বিনিময়ের পর উনি বললেন যদি গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরীর কারখানা একই জায়গায় করা যায় তাহলে খরচ অনেকটা কমে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে শুরু করতে চাইলেন তার স্বপ্নের গাড়ি বানানোর কারখানা। বলেছিলেন আমার বুকে বন্দুক চেপে ধরলেও আমি এই কারখানা করবো, কর্মসংস্থান হবে। যিনি অন্যের দুঃখ বোঝেন, তাঁকেই বোধহয় ভগবান বলা যায়।

তৎকালীন বিরোধী নেত্রী বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নিজের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে বন্ধ করে দিলেন সে প্রজেক্ট। কারখানা উঠে চলে গেল গুজরাটের সানন্দে। একলাখি গাড়ি বাজারে চলেনি তবে সেই কারখানায় এখন তৈরি হয় টিয়াগো, টিগর। কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় লোকেদের। উনি দুঃখ করে বলেছিলেন “বন্দুকের ট্রিগার টিপে দিলে আর কিছুই করার থাকে না”।

নীতিন গডকড়ি তখন কেন্দ্রীয় সড়ক মন্ত্রী। কোন এক কারণে মুম্বাই শহরে। ওনাকে ডেকে পাঠালেন। নীতিন গডকড়ির বাড়ির পথ হারিয়ে ফেলেছেন। ফোন করলেন মন্ত্রীমশাইকে। বললেন “তোমার বাড়ির লোকেশন টা একটু বলবে, আমি বোধহয় রাস্তা ঠিক করতে পারছি না”। নীতিন বললেন “আপনার ড্রাইভারকে ফোনটা দিন, বুঝিয়ে দিচ্ছি”। উনি বললেন “আমার তো ড্রাইভার নেই, আমি নিজেই গাড়ি চালাই।” মন্ত্রী মশাই অবাক, এত বড় মাপের মানুষ অথচ কি সাধারন। গাড়ি যথাস্থানে পৌঁছলো, গাড়ি থেকে নামলেন সঙ্গে একটা সাধারণ চামড়ার ফোলিও ব্যাগ। মন্ত্রীমশাই আর্ডালিকে বললেন ব্যাগটা নিয়ে যেতে। উনি বললেন “না না, আমার ব্যাগ আমি নিজেই বহন করতে পারবো, এইটুকু কাজের জন্য অন্যের সময় ও শ্রম কেন নষ্ট করব?” অসাধারণ রকমের সাধারণ – ভগবান বললে ভুল হবে না।

২০১৮ সাল, ব্রিটেনের রাজকুমার চার্লস শ্রেষ্ঠ মানবপ্রেমী পুরস্কার (Philanthropic Award) গ্রহণের জন্য ওনাকে ব্যাকিংহ্যাম প্যালেসে নিমন্ত্রণ জানালেন। সেই পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বরা থাকবেন। যেকোনো দেশের সাধারণ নাগরিকের কাছে এটা স্বপ্ন। যাবার আগের দিন ওনার আত্মসহায়ককে বললেন ‘রাজকুমার চার্লস কে খবর পাঠিয়ে বলো আমার পোষ্য (সারমেয়) খুব অসুস্থ, এই সময় তার কাছে থাকা আমার একান্ত জরুরী। রাজকুমার যেন আমায় মার্জনা করেন, আমি এই সময় আমার পোষ্যকে ছেড়ে কিছুতেই পুরস্কার নিতে যেতে পারবো না”। রাজকুমার চার্লস সেই খবর শুনে বলেছিলেন “That is the man”. শুধু মানুষ নয়, পশুদের কথাও ভাবেন। একমাত্র ভগবান সকল জীবের কথা ভাবতে পারেন।

বিশ্ববন্দিত ব্যবসায়ী ফোর্ড, একসময় ঠিক করলেন তার লোকসানে চলা প্রতিষ্ঠান ‘জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার’ বিক্রি করে দেবেন। উনি কিনতে চাইলেন। ওনার বন্ধুরা বললো “তুমি কি পাগল ? এইরকম লোকসানে চলা প্রতিষ্ঠান কে কেউ কেনে”? নিজের জেদ বজায় রাখলেন, কিনে ফেললেন ‘জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার’। বন্ধুরা এবার বললেন “তুমি এটাকে নিয়ে কি করবে? এর দেনা প্রচুর।” বন্ধু শুভানুধ্যায়ীরা একে একে পাশ থেকে সরে গেল। বিশাল দেনা নিজের কাঁধে নিয়েছেন, দেনার ভার সামলাতে না পেরে যদি সাহায্য চান !! ‘জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার’ কারখানায় শ্রমিকদের সঙ্গে মিটিং করলেন। মিটিং শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই একজন শ্রমিক উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো “What you will do with this JLR?”. প্রশ্ন শুনে এতটুকু বিচলিত হলেন না, চুপ করে এক মিনিট ভাবলেন। তারপরে খুব ঠান্ডা গলায় বললেন “আচ্ছা আমরা আবার একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারি না?” তারপর ইতিহাস। বিশ্ববাজারে ‘জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার’ এখন নিজের দাপট দেখিয়ে চলেছে। কোন কর্মী ছাঁটাই না করেও তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে তাদের খুশি রাখতে জানতেন।

কোন এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন ওনার বাবা ও মা দুজনেই দুরারোগ্য ক্যান্সারে মারা যান। দেখেছিলেন রুগী এবং তার আত্মীয়দের অসহায়তা। বানালেন ক্যান্সার হাসপাতাল। প্রথম হাসপাতাল বানালেন মুম্বাই শহরে, তারপর একে একে ছড়িয়ে পড়ল দেশের অন্যান্য শহরে। তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ; চেয়ার ছেড়ে পোডিয়াম অবধি হেঁটে আসতে অসুবিধা হয়। সেই সময় ডিব্রুগড়, আসামে ক্যান্সার হাসপাতালের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা শুরুতেই দর্শকদের কাছে মার্জনা চেয়ে বলেন “আমি হিন্দি বলতে পারি না, তবুও একবার চেষ্টা করবো বলতে”। হিন্দি বলতে শুরু করলেন, নিজের মনের ভাব ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারছেন না বুঝে চলে গেলেন প্রাঞ্জল সাদামাটা ইংরেজিতে। তাঁর নির্দেশ, কোন শিশুর ক্যান্সার ধরা পড়লে তাঁর যে কোনো হাসপাতালে যেন বিনা পয়সায় চিকিৎসা হয়, ওষুধের খরচ জোগাবে ‘ইন্ডিয়ান ক্যান্সার ইনস্টিটিউট’।

বেশ কিছু বছর আগের কথা, তাঁর কোন এক কারখানায় কিছু মাতব্বর স্ট্রাইক ডেকে বসলো। শ্রমিক কাজে আসতে চাইলে তাকে মারধর করা হ’ত। এইরকম প্রায় পাঁচশ’ শ্রমিকদের ভয় দেখানো হলো। উনি সব শুনে শ্রমিকদের বললেন “তোমরা কাজে এসো, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।” টানা তিন দিন, তিন রাত কারখানায় রইলেন শ্রমিকদের সাথে। মাতব্বর কে ডেকে বললেন ‘আমার লোকের বা তাদের পরিবারের গায়ে যদি এতটুকু আঁচড় লাগে, আমি তোমায় ছাড়বো না। আমার কর্মচারীদের আমার সন্তান মনে করি।” মাতব্বরের মাতব্বরি থেমে গেল।

সারা জীবন যত রোজগার করেছেন, তার সিংহভাগ দান করেছেন। ভারতের প্রথম দশ জন ধনী ব্যবসায়ীর মধ্যে তার নাম থাকে না কারণ নিজের সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। সারা জীবনে প্রায় ১৩০০ মিলিয়ন ডলার দান করেছেন। ভারতের যেকোনো ধনকুবের ব্যবসায়ীর মোট সম্পদের থেকে কোন অংশে কম নয়। এই দানের মধ্যে মসজিদ, গির্জা, মন্দির বা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান দান করে করের সুবিধা নেবার প্রয়াস একেবারে নেই। মানুষের কি করে ভালো হয়, সেই জন্য দান করেছেন। পথ চলতে বডিগার্ড, গাড়ির কনভয় – এসবের কখনো দরকার পড়ত না। জানতেন প্রতিটি ভারতীয়র মনে তিনি সবসময় পূজিত। বলতেন “তোমার ব্যাংকে কত টাকা আছে বা তুমি কত সম্পদ বানিয়েছো, সেগুলো কখনোই তোমার সম্পদ হতে পারে না। তুমি তোমার সারা জীবনে কত লোকের ভালো করার চেষ্টা করেছ বা কত লোককে সমৃদ্ধ করেছো, সেটাই তোমার সম্পদ হিসেবে গণ্য করা উচিত।”

See Also
Sitaram Yechuri

এইরকম অজস্র ঘটনা রয়েছে যা লিখতে গেলে একটা গোটা বই হয়ে যাবে। নুন থেকে শুরু করে গাড়ি, সব ক্ষেত্রেই নজির গড়েছেন।

যিনি এইভাবে সাধারণ মানুষের কথা ভাবেন, তাকেই তো আমরা ‘ভগবান’ বলি।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমি কার কথা বলছি। হ্যাঁ SIR RATAN N TATA, ভগবান বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই । গত ৯ অক্টোবর ২০২৪ ভগবানের জীবনাবসান হল। পার্সী ধর্মানুসারে মুম্বাইয়ের মালাবার হিলসে টাওয়ার অফ সাইলেন্সে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। ভগবান কে মৃত্যু রেহাই দিল না। মানুষের মনে শোকের ছায়া হয়তো একদিন ম্লান হয়ে যাবে, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি এক নতুন ইতিহাস তৈরি করে গেলেন “The Lighthouse of the India”.

What's Your Reaction?
Excited
1
Happy
2
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top