বাহামনি ও তার খাতা
Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks…
বাহামনি সোরেন, আসামের চা-শ্রমিক, সাহস করে প্রথমবার ব্যাঙ্কে এসেছে। জনধন যোজনার প্রেক্ষিতে চা-শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় কীভাবে পরিবর্তন এসেছে, তা ধরা হয়েছে বাস্তব সমস্যার গল্পে।
বাহামনি আজ অনেক সাহস করে ব্যাঙ্কে এসেছে। বাহামনি সোরেন, আসামের চা-শ্রমিক। আদতে সাঁওতাল কিন্তু আসাম সরকারের কাছে এরা হল টি-ট্রাইব বা চা জনগোষ্ঠী। এরা চা-বাগিচার সবচেয়ে দক্ষ শ্রমিক।
এই চা জনগোষ্ঠী কোন একটি জনগোষ্ঠী নয় বরং প্রায় একশো বহু ভাষাভাষী জাতি ও জনজাতীয় লোকের অসমসত্ত্ব মিশ্রণ। এরা মূলত আসামের এদিক থেকে সেদিকে বিক্ষিপ্ত প্রায় ৮০০ চা বাগিচার মধ্যের আবাসিক এলাকায় বসবাস করেন। আসামের চা জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬৫ লাখ। এর মধ্যে অধিকাংশ মানুষ চা বাগিচার মধ্যের পরিসরে অবস্থিত আবাসিক এলাকার অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর আবাসে বাস করেন। ভিন্ন ভিন্ন জাতি-জনগোষ্ঠীর হওয়ার জন্য তাঁদের ভাষা এবং সংস্কৃতির বৈচিত্রও দেখা যায়। তাঁরা ওড়িয়া, সাদ্রী, কুরমালি, বাংলা, সাঁওতালি এবং মুন্ডারী ভাষা ছাড়া আরো অনেক ভাষা ব্যবহার করে। বর্তমানে অনেকবছর একসাথে বসবাস করার জন্য তাঁদের এক সংমিশ্রিত উমৈহতীয়া ভাষা এবং সংস্কৃতি গড়ে নিয়ে উঠেছে। যদিও এক নির্দিষ্ট সীমায় জন-সমাজ থেকে দূরত্ব বজায় থাকার জন্য স্থান ভেদে তাঁদের উমৈহতীয়া ভাষা এবং সংস্কৃতিরও তারতম্য দেখা যায়।
আসামের বাইরে বসবাস করা এই চা জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের জাতি-জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েকটা নিজ নিজ অঞ্চলে ভারতীয় সংবিধান-এর তফসিলি উপজাতির মর্যাদা লাভ করেছে। তাঁরা নিজেদের আদিবাসী বলে অভিহিত করে। বর্তমান আসামেও চা জনগোষ্ঠীর লোকরাও নিজেদের আদিবাসী বলে, কিন্তু আসামে তারা তফসিলি উপজাতির মর্যাদা পায়নি।
আসামে চা বাগিচা স্থাপনের পরে ১৮৬০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে মূলতঃ ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ছত্তিশগঢ়, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার-এর জনজাতীয় এবং আদিবাসী লোকেদের ব্রিটিশরা পর্যায়ক্রমে আসামের চা উদ্যোগ এবং বাগিচাসমূহে কাজ করতে শ্রমিক হিসাবে আসামে নিয়ে আসে। আসামের চা জনগোষ্ঠীর লোকেদের ব্রিটিশরা তাঁদের কেবল শ্রমিক হিসাবেই আসামে আনেনি। অনেক উপজাতি যেমন সাঁওতাল, কুরুখ এবং মুন্ডাদের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অপরাধে বলপূর্বকভাবে ছোটোনাগপুর অঞ্চল থেকে আসামে নির্বাসিত করা হয়েছিল। সাঁওতালদের বেশির ভাগকে ১৮৫৫য় সিধো-কানহোর সাঁওতাল বিদ্রোহের পর এবং ১৮৯৯-১৯০০ সালের বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে সংঘটিত মুন্ডা বিদ্রোহে যোগদান করার শাস্তি স্বরূপে মুন্ডাদের নিম্ন আসামের অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলা এবং দরং জেলায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল।
বাহামনির বাবা-মাও চা শ্রমিক। ওর জন্মও চা বাগানেই। বেড়ে উঠেছে চা বাগানেই। বিয়েও হয়েছে বাগানেরই শ্রমিকের সঙ্গে। বিয়ের পর হেমব্রম থেকে সোরেন হয়েছে। সাঁওতালরা একই জাতে বিয়ে করেনা। বাহামনির একটা ছেলেও আছে। বাহামনিরা খ্রীস্টান। প্রতি রবিবার চার্চে যায়। ছেলেও চার্চ লাগোয়া স্কুলেই পড়ে। বাহামনির আশা ছেলে পড়াশুনা করে, একদিন বাগানের বাবু হবে।
চা বাগানে মাইনে হত প্রতি শনিবার। শ্রমিকরা হাতে হাতে টাকা পেত। সেদিন বাগানের পাশেই বাজার বসত। সেই বাজারে মাছ, মাংস, সবজি ছাড়াও সস্তার জামাকাপড় ও ঘর-গেরস্থালির নানা জিনিসপত্র পাওয়া যেত। বাহামনি হাতে টাকা পেয়ে সারা সপ্তাহের বাজার করে বাড়ী ফিরত। চাল, ডাল, তেল, সবজি সব নিয়ে আসতো। সারা সপ্তাহ আর সময় পাবে না। আর ওর বর সেদিন খানিক হাঁড়িয়া গিলে পোয়া দুয়েক শুয়োর মাংস নিয়ে ঘরে ফিরত।
ছকে বাঁধা শান্ত জীবন একদিন হঠাৎই বদলে গেল। ঘোষণা হল মাইনে হবে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সবাইকে জনধন যোজনায় ব্যাঙ্কে একাউন্ট খুলতে হবে। নিকটবর্তী ব্যাঙ্কের শাখা হাইওয়ের ওপর সাত কিমি দূরে। ব্যাঙ্কের বাবুরা এসে একাউন্ট খুলে দেবে। তার জন্য ছবি চাই, ছবি চাই ভোটের কার্ডেরও। বাগানের অফিস থেকে পঁচিশ টাকা নিয়ে সেই সবও হয়ে গেল। কিন্তু গোল বাঁধল তার পরে। শ্রমিকরা ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে যাবে কি করে? প্রতি সপ্তাহে সাত কিমি দুরে ব্যাঙ্কে যেতে হলে, সেদিন কাজ বন্ধ। কাজ বন্ধ তো মাইনে বন্ধ। মাইনে বন্ধ তো খানা বন্ধ। তা হলে?
ব্যাঙ্ক বললো, সবাইকে টাকা তোলার কার্ড দেওয়া হবে। কিন্তু কার্ডে টাকা তুলবে কেমন করে? তাতেও তো ব্যাঙ্কেই যেতে হবে। এবারে অফিস সাহায্য করল। একজন লোক ঠিক হল। সে প্রত্যেকের কাছ থেকে কার্ড নিয়ে টাকা এনে দেবে। সে নেবে মাত্র কুড়ি টাকা। মাত্র? ৫০০ শ্রমিকের প্রত্যেকের থেকে সপ্তাহে ২০ টাকা নিলে, মাসে হয় ৪০০০০ টাকা। জনধনের উন্নয়ন। দেশের উন্নয়নে শ্রমিকরা তাও মেনে নিল।
এরপর জানা গেল, যারা নাম সই করতে পারবে না, তারা টাকা তোলার কার্ড পাবে না। তাদের প্রতিবার টাকা তোলার জন্য ব্যাঙ্কে যেতে হবে।
বাহামনি টিপ্পাছাপ, সে পড়ল বিপদে। । কিন্তু মনের জোরে অসম্ভব কে সম্ভব করল বাহামনি। স্কুলপড়ুয়া ছেলের সাহায্য নিয়ে কদিনেই সে নিজের নামের ছবি আঁকতে শিখে গেল। বাহামনি স্বাক্ষর হলো। আর এভাবেই ভারতের ‘সাক্ষরতা মিশন’ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল।
একাউন্ট খুলে গেল। বাহামনি টাকা তোলার কার্ড পেল। কিন্তু বিপদ হল অন্যভাবে। বাগানে শনিবার হিসাব করে টাকা দিত। এখনও শনিবার হিসাব হয়। কিন্তু সেই হিসাব ব্যাঙ্কে যায় সোমবার। টাকা পেতে পেতে মঙ্গলবার।
আশেপাশের গোটা দশেক বাগানের প্রায় হাজার ছয়েক টাকা তোলার কার্ড নিয়ে জনাপনেরো প্রতিনিধি প্রতি মঙ্গলবার শহরের গুটি পাঁচেক এটিএমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে হাতাহাতির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ওদিকে এটিএমে একশো টাকার কমে তোলা যায় না। ফলে শ্রমিকরা পুরো মাইনে তুলতে পারে না। মাঝে মাঝেই মেশিনের টাকা শেষ হয়ে যায়। আবার ব্যাঙ্ক থেকে এসে টাকা ভরে দেয়। তাতেও দেরী হয়। ফলে সবাইয়ের টাকা তুলে প্রতিনিধির ফিরতে রাত হয়ে যায়। সুতরাং পরদিন, বুধবার, সেই তুলে আনা টাকা আবারও হিসেব করে পাঁচশো জনের হাতে তুলে দিতে হয়, দিনের শেষে। যে টাকা শ্রমিকরা বাগানের অফিস থেকে শনিবার পেত, সেই টাকা সেই বাগানের অফিস থেকেই শ্রমিকদের হাতে আসে বুধবার, তাও কাটছাঁট করে। অথচ বুধবার বাজার বসে না। সুতরাং কেনাকাটা সেই পরের শনিবার। প্রতিটা বাগানে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। উন্নয়নের ফল।
এত ঝামেলা এড়াতে আজ বাহামনি সাহস করে নিজেই ব্যাঙ্কে এসেছে। সকালেই চলে এসেছে। আজ বাহামনির ছেলের জন্মদিন। এই একদিন বাহামনি কাজ থেকে ছুটি নেয়। সারা বছর সে সপ্তাহের বাড়তি টাকাটা জমায়। এদিন শহরের বাজার থেকে ছেলের জন্য একটা জামা কেনে, মিষ্টি কেনে। সে আজ নিজে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলবে।
এই প্রথম বাহামনি ব্যাঙ্কে এসেছে। ছোট ব্রাঞ্চ। ম্যানেজার বিহারের লোক। ব্যাঙ্কের ভেতরে কাঁচের ঘেরাটোপ দেখে বাহামনি প্রথমে ঘাবড়ে গেল। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। শেষে সাহস সঞ্চয় করে বাহামনি ম্যানেজারের সামনে গেল।
“টকা লাগব।”
“খাতা হ্যায়, খাতা, খাতা আছে?”
“হয়, হয় আসসে।”
“নাম্বার ক্যায়া হ্যায়, নাম্বার।”
বাহামনি অবাক হয়। খাতার ও নম্বর হয়।
“খাতা কোথ আছে? ” ম্যানেজার অহমিয়া বলার চেষ্টা করে।
“ঘরত আসসে “।
“লে কে আও “।
বাহামনি দৌড়ল। যেতে আসতে, সাত সাত চোদ্দ কিমি। আজ তার ছেলের জন্মদিন, টাকা তার চাইই।
প্রায় ঘন্টা দুই পরে বাহামনি আবার ম্যানেজারের সামনে, হাঁপাচ্ছে।
“লায়া হ্যায়? কোথ খাতা? ”
সন্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বাহামনি ম্যানেজারের টেবিলে ঢেলে দেয় ডজন খানেক খাতা। তার ছেলের যে কটা স্কুলের খাতা সে পেয়েছে, নিয়ে এসেছে।
বাহামনি আজ ডিজিট্যাল।
What's Your Reaction?
Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks trade analyst. In the course of his job, he had been posted all across the eastern and northeaster states. He has a great passion for writing. He has written many deeply touching stories about the common men and women he got to meet during his tenure. He is also a specialist contrarian amateur historian especially on issues like the history of Bengal and of the Bengal Renaissance.