“বন্যার ১০ ফুট পানিতে টিকে থাকা দেশি ধান হিজল দিঘা”
Bishwendu Nanda is a writer, researcher, and organizer focused on…
হিজল দিঘা নামের দেশি ধান প্রজাতি বন্যার ১০ ফুট গভীর পানিতে টিকে থাকে। দেলোয়ার জাহান এই প্রাচীন ধান চাষ পদ্ধতির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, যা আমাদের দেশীয় কৃষকদের উদ্ভাবনশীলতা ও টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। এই প্রজাতির ধান শুধু খাদ্যের যোগানই দেয় না, বরং বাংলাদেশের কৃষি ইতিহাসের ধারাকে জীবন্ত রাখে।
“বন্যার ১০ ফুট পানিতে টিকে থাকা দেশি ধান হিজল দিঘা”।
দেলোয়ার জাহান আমাদের মত সবুজবিপ্লবী প্রগতিশীলদের চোখে আঙুল রেখে দেখাচ্ছেন, কিভাবে আমাদের দেশের জ্ঞানী কৃষকেরা বন্যার বাড়তে থাকা জলের স্তরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লম্বা হতে থাকা ধান গাছ আবিষ্কার করেছিলেন। দেলোয়ার বন্যার জলে ডোবা ধান চাষের মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন। এই প্রজাতির নাম হিজলদীঘা। আজও জীবন্ত।
আমরা কারিগর হকার চাষী উৎপাদন ব্যবস্থার কথা বলি – যে ব্যবস্থা শয়ে শয়ে বছর দাঁড়িয়ে আছে নিজের পায়ে ভর্তুকি ছাড়াই। উপনিবেশি অত্যাচার, অনাচার, রাষ্ট্রের চোখ রাঙ্গানি, কর্পোরেটের বীজ সার পোকামারা বিষ বিক্রির চাপ, ক্রমশ গ্রামীন পরম্পরার উৎপাদকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে যেতে চাওয়া স্থানীয় বাজারের চাপ সহ্য করেও হিজল দিঘার মত অপার্থিব ধান আজও বেঁচে আছে এই বাংলার মাঠে। তাঁকে কৃতজ্ঞতা। চাষীদের প্রনাম, সালাম, জোহার।
মাথায় রাখুন ১৬৩০-৪০এ শাহজাহানের আমলে ডাচ আর ব্রিটিশ কর্পোরেট বাংলায় এসে ফসল আর পণ্যের বৈচিত্র, গুণমান দেখে অবাক। শুরু হল বাংলা নির্ভর ইওরোপে পণ্য রপ্তানির যুগ। কিছু কিছু পণ্য উৎপাদনে নতুন করে চাষের এলাকা বাড়াতে হল, কারিগরদের সংখ্যা বাড়াতে হল, তাদের দক্ষতায় শান দিতে হল, যন্ত্রের উতপাদকতা বাড়াতে হল, বাজার সামলাতে হল।
তো এই যে অকৃষিজ দ্রব্যের উৎপাদন বাড়ল, অকৃষিজ ক্ষেত্রে শ্রমিক কারিগরের সংখ্যা বাড়ল, বহু কৃষি জমিতে তুলো ইত্যাদি মত কাঁচামাল চাষ হল যে সব কৃষিজ দ্রব্য খাওয়া যায় না। একই সঙ্গে দক্ষিণে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বিপুল পরিমান চাল রপ্তানিতে ভাটা পড়ল না। ১৬৪০ থেকে ১৬৯০এর মধ্যে শুধু কাপড়ের রপ্তানি বাড়ল ১০০০%, অন্য সব রপ্তানি যেমন সোরা, কাঠ, আসবাব, নীল, রেশম, মশলা ইত্যাদির কথা ছেড়েই দিচ্ছি। বাংলার কৃষি-অকৃষি উতপাদকেরা এই বিপুল জটিল সমস্যা সামলে দিলেন কেমন করে, আমরা জানি না – আন্দাজ করতে পারি মাত্র। চাষীরা নতুন ব্যবস্থা সামলাতে মাঠে সময় দিলেন আর কারিগরেরা সময় দিলেন কারখানায়। বাংলা হয়ে উঠল নতুন করে সোনার বাংলা। আমরা ভুলতে চেয়েছি।
না, অকৃষি দ্রব্য উৎপাদন করতে ১০০ বছর পর ইওরোপ যে কাজটা করবে, আমরা তাদের মত করে কেন্দ্রিভূত কারখানা বানালাম না। কারিগর তার বাড়ির কারখানায় আর আড়ংএ সময় দিলেন এবং চাষীরা মাঠে নেমে পড়লেন অঞ্চলের সামনে উদ্ভুত নতুন সমস্যার সমাধানে। মাথায় রাখুন ইওরোপে যেত মোট উৎপাদনের মাত্র ১০% – দেশিয় ব্যবসায়ীয়া সারা বিশ্বে, ইওরোপিয়দের তুলনায় দেড় থেকে দুগুণ বেশি পণ্য রপ্তানি করে – তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বাজার তো আছেই – বাংলায় মোটা কাপড় বিক্রি হয় ৬ কোটি টাকায়। সমস্যার সমাধানে নজর দেওয়া চাষী হকার কারিগরদের মাথায় আছে, শুধুই ইওরোপিয় কর্পোরেটদের চাহিদা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে গিয়ে, যে দেশিয় ব্যবসায়ীরা তাদের বছরের পর বছর ব্যবসা দিয়েছেন, তাদের বিশ্ব বাজার যেন নষ্ট না হয়। দূরে সোনার টোপর দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু চাষী কারিগরদের ভাবনা হল, ইওরোপের বাজার ধরতে গিয়ে যেন হাতের পাঁচ, দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়া, আফ্রিকার এত দিনের বাজার নষ্ট না হয়ে যায়।
আমার ধারণা কারিগর চাষী হকার জোট যে সমাধান সূত্র তৈরি করলেন, তার একটা আঙটা হল হিজল দীঘা। এই রকম হাজারো ধান উদ্ভাবিত হল। হিজল দিঘার মত ধানের কল্যাণে একটা বিষয় নিশ্চিত হল – বিপুল বন্যায় গোটা দেশ ডুবেগেলেও, বন্যার শেষে দেশের মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাবেন না, তেমনি ব্যবসাও থেমে যাবে না।
দেলোয়ারকে কৃতজ্ঞতা। তার মত মানুষ নিজের জীবন উতসর্গ করে দিয়েছেন দেশের ভদ্রবিত্তের গালি খাওয়া চাষীদের জ্ঞান দক্ষতা আবিষ্কার তাদের দর্শনকে আমার মত অবুঝ মানুষের সামনে জলের মত সহজ করে বোঝাতে।
হে ইওরোপিয় কর্পোরেটপন্থী শাসক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপক ভদ্রবিত্ত – দেশ বুঝুন, নিন্দিত দেশের উৎপাদকদের তাত্ত্বিক অবস্থান বুঝুন, বুঝুন আমরা ঠিকঠাক মাঠ পেলে কর্পোরেটকে গুণে গুণে ১০০ গোলে হারাতে পারি। আমরাই একদা বিশ্ববাজারের সরতাজ ছিলাম। আমরাই পারি বাংলাকে নতুন করে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে।
শুধু রাষ্ট্রকে বলব, ভিক্ষে চাই না মা, কুকুর সামলাও
What's Your Reaction?
Bishwendu Nanda is a writer, researcher, and organizer focused on the history of artisans in pre-colonial Bengal. He has been active in hawker and artisan organizations for nearly three decades, authored several books, and translated key historical works. Nanda also edits Param magazine and researches colonial state systems.