ফুলন দেবীর গল্প “কিসমত কো এহি মঞ্জুর থা”



Sandip Ghosh lives in Salt Lake City, Kolkata. He stays…
ফুলন দেবী সকলেরই চেনা নাম । জীবনের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে কিভাবে এক সাধারণ গ্রামীণ মেয়ে ফুলন দেবী হয়ে উঠলো, এই নিয়েই এবারের প্রতিবেদন “কিসমত কো এহি মঞ্জুর থা”। কলমে: সন্দীপ ঘোষ
উত্তর প্রদেশের জালাউন জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম ‘ঘুরা কা পুরওয়া’ বা ‘গোরহা কা পুরওয়া’- তে মাল্লা জাতি (যারা নৌকা চালায়)-তে জন্ম হয় ফুলনের । শ্রী দেবী দিন ও তার স্ত্রী শ্রীমতি মূলা দেবীর চার সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠা ফুলন। বড়দিদি ও সে ছাড়া বাকি দুজনেই অল্প বয়সে মারা যায়।
ফুলনের পরিবার প্রায় এক একর (০.৪ হেক্টর) জমি ও সেই জমিতে একটি বিশাল বড় নিমগাছের মালিক ছিল। ফুলনের বাবা আশা করেছিলেন এই গাছ বেচার টাকায় তিনি তার কন্যাদের বিয়ের পণ মেটাবেন। ফুলনের যখন মাত্র ১১ বছর বয়স তখন অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে তার ঠাকুর্দা ও ঠাকুমা মারা যান। ফুলনের কথায় জানা যায় যে তার জ্যাঠা তাকে আর তার দিদি ও মা কে মারত । কারণ পরিবারের মাথা হিসাবে সেই পরিবারের একমাত্র সম্পত্তি ওই জমির মালিক ছিল জ্যাঠা। তার জ্যাঠার ছেলে মায়া দিন ওই নিমগাছটি কেটে ফেলে কারণ সে চেয়েছিল ওই এক একর জমিতে অন্য লাভজনক শস্যাদির চাষ করবে। যদিও তার বাবা এই ব্যাপারে কিঞ্চিৎ প্রতিবাদ করেন তবে ১১ বছরের ফুলন কিন্তু তার থেকে অনেকটাই বড় জেঠতুতো দাদার বিরুদ্ধে ‘ যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব নিয়ে প্রতিবাদ জানায়। সে জনসমক্ষে তাকে অন্যায় ভাবে জমি জবর দখলের বিষয়ে দায়ী করে। সে তার বড় দিদির সঙ্গে জমিতে ধরনায় বসে এবং যখন সেই জেঠতুতো দাদা বলপ্রয়োগ করে তখনও সে জায়গা ছেড়ে নড়েনি। ফুলনের জ্যাঠা তার থেকে কুড়ি বছরের বড় একটা লোক, পুট্টিরাম-এর সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে। তাদের গ্রাম থেকে বেশ কয়েক শো মাইল দূরের এক গ্রামে থাকতো পুট্টিরাম। ফুলন তার জীবনীতে জানিয়েছে যে, তার স্বামী তার ওপর বল প্রয়োগ করেছিল শরীরের দখল নিতে।
ফুলন বহুবার তার শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে বাপের বাড়ি আসে কিন্তু তার অভিভাবকরা বারবারই তাকে যন্ত্রণা ভোগ করার জন্য শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়। পরিণাম স্বরূপ তার স্বামী তার মা-বাবাকে বলে ফুলনকে তাদের কাছেই রেখে দিতে। তিন বছর পর ১৯৭৭ সালে ফুলনের অভিভাবকরা পুট্টিরাম কে বলেন তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। শশুর বাড়ি পৌঁছে ফুলন আবারও প্রতিবাদ জানায় ও ফিরে আসে বাপের বাড়িতে। ভারতের গ্রামীণ অঞ্চলে স্ত্রীর স্বামীকে পরিত্যাগ করার বিষয়টা অলঙ্ঘনীয় ও নিষিদ্ধ বলে মানা হতো। এই কারণে ফুলন সামাজিক ভাবে জাতিচ্যুত হিসেবে চিহ্নিত হয়। অভিভাবকদের বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে ফুলন তার জেঠতুতো দাদা মায়া দিনের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। বেআইনিভাবে তার বাবার জমি দখল করার জন্য সে মায়া দিনকে আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় কিন্তু দুঃখের বিষয় ফুলন কেস হেরে যায়।
প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য মায়াদিন তার বিবিধ ছোটখাটো জিনিসপত্রাদি চুরির অভিযোগে স্থানীয় পুলিশ দ্বারা ফুলনকে আটক করায়। তিনদিনের জেল বাসের সময় ফুলনকে অকথ্য গালিগালাজ ও ধর্ষণ করে পুলিসরা। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার অভিভাবকরা ফুলনকে তার স্বামীর কাছে ফেরত পাঠায় কিন্তু স্বামী তা না মানায় সে তার পিতৃ গৃহে ফিরে আসে ১৯৭৯ সালে, তখন তার বয়স মাত্র ১৫-১৬।
ফুলন যে অঞ্চলে বাস করত তার নাম বুন্দেলখন্ড। আজও পর্যন্ত এটি অত্যন্ত গরিব, অনুর্বর একটি স্থান যেখানে কোন শিল্প গড়ে ওঠেনি। এখানকার বেশিরভাগ শক্ত সমর্থ জোয়ান মরদরা কঠিন পরিশ্রম করে রোজগারের আশায় শহরে চলে আসে। প্রাত্যহিক জীবন অত্যন্ত কঠোর কারণ এখানের খারাপ মাটির সুখা অঞ্চলে শুধুমাত্র নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর মত চাষ করা যেত। এই অঞ্চলে প্রধান ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য হলো গভীর ও সংকীর্ণ গিরিখাত এর পাশা পাশি চলা জমি যেখানে নিছক শ্রমদান করা, ডাকাত দল তৈরি করা ও গ্রামের ধনী প্রতিবেশীদের বা হাইওয়ে তে ধনবান পর্যটকদের লুট করার কাজ না করে শহরে পালিয়ে যাওয়া, যুবকদের পক্ষে অস্বাভাবিক ছিল না।
ফুলনের কারাবাসের কিছুদিন পরই অর্থাৎ ১৯৭৯ সালে সে একদল ডাকাতের পাল্লায় পড়ে। ঠিক কিভাবে তা ঘটেছিল তা পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলেন, তার ‘তেজস্বী মেজাজ’-এর জন্য সে আক্রান্ত হয়েছিল বা নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং তার থেকে বয়সে অনেক বড় স্বামীকে পছন্দ না হওয়ায় তাকে পরিত্যাগ করাই ডাকাতদের তার প্রতি আকর্ষিত করেছিল। আবার অন্যদের মতে সে তার জীবন থেকে পালাতে চেয়েছিল। আত্মজীবনীতে ফুলন জানায়, “কিসমত কো এহি মঞ্জুর থা”, “এটাই ছিল নিয়তির নির্দেশ” যে একদিন না একদিন সে ডাকাত দলের অভিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে। অপহরণ বা তার নিজের মুর্খামি, যাই হোক না কেন, খুব শীঘ্রই তাকে দুঃখ পেতে হলো, কারণ ডাকাত সর্দার বাবু গুজ্জর তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইল। এই সাংঘাতিক পরিস্থিতি থেকে ফুলনকে রক্ষা করে দলের দ্বিতীয় প্রধান বিক্রম মাল্লা, যে কিনা ফুলনের মাল্লা প্রজাতিরই লোক। এক রাতে বিক্রম মাল্লা, বাবু গুজ্জর কে খুন করে ও পরদিন সকালে দলের সরদার হয়ে যায়। বিক্রমের স্ত্রী ও ফুলনের স্বামী থাকা সত্ত্বেও তারা অশঙ্কিত চিত্তে দুজনে একসঙ্গে বসবাস করা শুরু করে। কয়েক সপ্তাহ পর তারা সেই গ্রাম আক্রমণ করে যেখানে ফুলনের স্বামী বাস করে। ফুলন নিজের হাতে তার বিচ্ছিন্ন হওয়া স্বামীকে খুন করে ও গ্রামবাসীর সামনে তাকে হিঁচড়ে নিয়ে আসে। ডাকাত দল তাকে রাস্তার ওপর ফেলে রেখে যাওয়ার আগে ঘোষণা করে যে কোন বৃদ্ধর যুবতীকে বিয়ে করা উচিত নয়।
ফুলন বন্দুক চালানো শেখে বিক্রমের কাছে এবং দলের কার্যাদিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকে বুন্দেলখন্ডে যেটি উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের সীমানার মাঝে অবস্থিত। যে সকল গ্রামে উঁচু জাতের লোকেরা বাস করত সেই সকল গ্রাম আক্রমণ করা ও লুট করা ছিল দলের কার্যাদির অন্তর্গত। তাছাড়া ধনী পরিবার থেকে মোটা অর্থ আদায়ের জন্য পরিবারের কোনো সদস্যকে অপহরণ এবং মাঝে মাঝেই ট্রেন ডাকাতিও ছিল। ডাকাত দলের একমাত্র মহিলা সদস্য ছিল ফুলন। প্রতিটি অপরাধমূলক কাজ সম্পন্ন করার পরই ফুলন দুর্গা মন্দির যেত, তাদের রক্ষা করার জন্য মাকে ধন্যবাদ জানাতে। চম্বল নদীর গভীর ও সংকীর্ণ গিরিখাতই প্রধানত ছিল ডাকাতদের লুকানোর জায়গা।
ঠাকুর বংশ অর্থাৎ উঁচু জাতের দুই ভাই শ্রীরাম ও লালা রাম দল ছেড়ে পরিবারে ফিরে আসে ও দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। তাদের প্রাক্তন দলনেতা বাবু গুজ্জরর হত্যাকাহিনী শুনে তারা এটি অত্যন্ত নীতি বিরদ্ধ কাজ বলে মনে করে এবং এই কাজের জন্য তারা ফুলনকে দায়ী করে। তারা ফুলনকে বিভেদ সৃষ্টিকারী পতিতা বলায় ফুলন ও তাদের গালিগালাজ করে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে । শ্রীরাম ফুলনের ঘেটি ধরে বিরাশি সিক্কার চড় কষায় তার ফলে তৎক্ষণাৎ প্রচন্ড মারামারি শুরু হয়। দলের নেতা হিসাবে বিক্রম মাল্লা একজন স্ত্রীলোককে আক্রমণ করার জন্য শ্রীরামকে তীব্র ভৎসনা করে এবং তাকে ফুলন এর কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। শ্রীরাম ও তার ভাই এই অবমাননায় প্রচন্ড ব্যথিত ও উত্ত্যক্ত হয় কারণ আসল সত্য হলো, বিক্রম ও ফুলন দুজনেই মাল্লা জাতের যারা জমি মালিক ঠাকুর জাতের চেয়ে অনেক নিচের স্তরের-যে ঠাকুর জাতের অন্তর্ভুক্ত এরা দুই ভাই । একটা কথা জানিয়ে রাখা দরকার, ডাকাত দলে মাল্লা ও ঠাকুর দুই জাতের লোকই থাকতো।
মাল্লা বংশ জাত বিক্রম যখন ঠাকুর বংশের শ্রীরাম ও লালা রামকে দিয়ে ফুলনের কাছে মাফ চাওয়ায় তখন থেকেই একটা চাপা বিদ্বেষ ডাকাতদলের দুই পক্ষের মধ্যে চলছিল। ওই ঘটনার পর ডাকাত দল যখন কোন গ্রাম তছনছ করত তখনই শ্রীরাম ও লালা রাম সেই গ্রামের মাল্লাদেরিই বেছে বেছে মারধর ও অপমান করত। ডাকাত দলের মাল্লা সদস্যদের ব্যাপারটি অখুশি করে তাই অনেকেই দলত্যাগ করে। অপর দিকে ডজন খানেক ঠাকুর সদস্যরা দলে যোগ দেয় শ্রীরাম ও লালা রামের ডাকে। এর ফলে দলে ঠাকুরদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দলে তাদেরই প্রতিপত্তি বাড়তে লাগলো। সেই সময় বিক্রম মাল্লা প্রস্তাব দেয় দল দু ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার, একটা ঠাকুরদের আর অন্যটি মাল্লাদের। শ্রীরাম এই প্রস্তাবে রাজি হলনা, তার বক্তব্য এই দল তৈরি হয়েছিল বাবু গুজ্জরর অনুগামীদের দ্বারা তাই দল ভাগ করা যাবেনা। এর মধ্যে আবার বেশ কিছু মাল্লা বিক্রমকে সহ্য করতে পারছিল না। কারণ দলের মধ্যে একমাত্র নারীর সঙ্গে বিক্রম থাকে যা তাদের ঈর্ষান্বিত করেছিল। অপর পক্ষে বেশ কয়েকজনের আবার বিক্রমের আসল স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল আর তারা কেউই ফুলনের শাণিত জিহ্বার জন্য তাকে পছন্দ করতনা। এই দল ভাগের প্রস্তাব পেশ করার বেশ কয়েকদিন পর শ্রীরাম ও বিক্রমের মধ্যে প্রবল ঝগড়া বাঁধে। আপাতদৃষ্টিতে শ্রীরাম ফুলনের চরিত্র নিয়ে খারাপ মন্তব্য করায় বিক্রমও তার উত্তরে শ্রীরামের স্ত্রী সম্পর্কে কথা বলে। উভয়ের মধ্যে গালাগালি বিনিময় হয় এবং ফলস্বরূপ বিক্রম ও ফুলন একজনও সমর্থক না পাওয়ায় তাদের রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিতে হয়। যাই হোক, দিনের আলোয় তাদের খুঁজে বের করা হয় এবং বিক্রমকে গুলি করে মারা হয়। ফুলনকে নিয়ে যাওয়া হয় বেহমাই গ্রামে যেখানে ঠাকুরদের খবরদারি চলে। এই শ্রীরাম , লালা রাম ও অন্যান্য নতুন যোগদান করা দলের লোকেদের গ্রাম হল বেহমাই।
ফুলনকে বেহেমাই গ্রামের একটি বাড়ির একটি কক্ষে আটক করে রাখা হয়। প্রায় তিন সপ্তাহ ব্যাপী ফুলন প্রচন্ড মারধর ও ধর্ষণের শিকার হয়। কোনওক্রমে ফুলন তিন সপ্তাহের বন্দীদশা থেকে পালাতে সক্ষম হয়। তাকে পালাতে সাহায্য করে একজন নিচু জাতীর গ্রামবাসী ও বিক্রমের দলের দুই মাল্লা সদস্য যার মধ্যে একজন মান সিং মাল্লা। ফুলন ও মান সিং প্রেমে পড়ে ও শুধুমাত্র মাল্লাদের নিয়ে গড়ে তোলা একটি দলের যুগ্মনেতা হয়। এই দল বুন্দেলখণ্ডের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বেশ কয়েকটি ভয়ংকর ডাকাতি করে ধারাবাহিক ভাবে এবং সময় সময়ই তারা উঁচু জাতের লোকেদের নিশানা বানাত। কেউ কেউ বলে থাকেন ফুলনের লক্ষ্যই ছিল উঁচু জাতের লোকেদের আক্রমণ করা ও লুটের মাল নিচু জাতের মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা। কিন্তু ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা বলেন এটি অতিকথা মাত্র, এর কোন প্রমাণ নেই যে ফুলন বা তার সঙ্গীরা কারওকে টাকা-পয়সা দিয়েছে।
বেহেমাই থেকে মুক্তি পাওয়ার ১৭ মাস পর ফুলন তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ফিরে আসে গ্রামে। ১৯৮১ র ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যেবেলা ফুলন ও তার দলবল পুলিশের ছদ্মবেশে গ্রামে ঢোকে। সেই সময় একটি বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল গ্রামে। ফুলন দাবি করে গ্রামের সমস্ত মূল্যবান দ্রব্যাদি সমেত তার ওপর অত্যাচার করা ব্যক্তিদের হাজির করতে হবে। যাই হোক, যেহেতু সমস্ত জোয়ান মরদ রা কাজের খোঁজে শহরে চলে গিয়েছিল তাই অনেক খুঁজে শেষমেশ মাত্র দুজন ঠাকুর জাতের অত্যাচারীর সন্ধান পাওয়া গেল। এই দুই ব্যক্তি কিন্তু ফুলনের গণধর্ষণে জড়িয়ে ছিল না, তারা শুধুমাত্র ঠাকুরজাতির ছিল ওই দলে তবে তারা অবশ্যই বিক্রম মাল্লার বিরোধী ছিল।
সঠিক অপরাধীদের শনাক্ত করা গেল না বলে ফুলন বিষন্ন হয়ে পড়েছিল। তা সত্ত্বেও, সেই সময়ই গোটা ঠাকুর জাতির প্রতি ঘৃণা পোষণ করেছিল কারণ দলের কিছু সদস্য বাবু গুজ্জরর হত্যার প্রতিবাদ করেছিল এবং খুনি হিসেবে বিক্রম মাল্লার নেতৃত্বতে আপত্তি জানিয়েছিল এবং তাকে পদচ্যুত করে খুন করে ও ফুলনকে গণধর্ষণ করে। ফুলন তার দলের সদস্যদের আদেশ দেয় ঠাকুর জাতির সকল পুরুষ কে লাইনে দাঁড় করাতে। লাইনে শুধু ওই পরিবারের ঠাকুররাই নয় অন্যান্য গ্রাম ও শহর থেকে যে সকল ঠাকুররা বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিল, তাদেরকেও দাঁড় করায়। সমস্ত ঠাকুরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ফুলনের আদেশনুসার তার মাল্লাদল গুলি করে হত্যা করে। ২২ জন ঠাকুর কে হত্যা করা হয়। পরে আদালতে ফুলন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে জানায় যে সে নিজে একজনকেও হত্যা করেনি।
বেহমাই গণহত্যাকাণ্ড দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বেহমাই হত্যাকাণ্ডের দায়স্বরূপ তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ভি. পি. সিং পদত্যাগ করেন। বিশাল পুলিশ বাহিনী নিযুক্ত করা হলেও, ফুলনকে খুঁজে বার করতে তারা ব্যর্থ হয়। নির্দিষ্ট ব্যক্তির অনুসন্ধান সাফল্য লাভ না করার কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে ওই অঞ্চলের গরিব মানুষ দের সহায়তা পেয়েছিল ফুলন। সংবাদমাধ্যমে সেই থেকেই ‘রবিন হুড’-এর কাহিনী চালু হয়। ফুলনকে ‘দস্যু রানী’ হিসাবে অভিহিত করা হয়। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের একটি অংশ তাকে এই ভাবেই গৌরব দীপ্ত করতে থাকে যে সে একজন নির্ভীক, নিঃশঙ্কচিত্ত, অসম সাহসী এক নারী, যে লাঞ্ছিত, অবহেলিত হয়েও পৃথিবীতে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তার চরিত্রের একান্ত আবেগের প্রবল প্রকাশ ও ব্যক্তিত্বকে ব্যাখ্যা করা হয়, যন্ত্রণার ইশতেহার হিসাবে, যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়েছিল। অবশ্য এই চালু কাহিনীগুলির ভিত্তি কতটা দৃঢ় তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে কারণ একটাও নিশ্চিত উদাহরণের ওপর আলোকপাত হয়নি, যেখানে ফুলন বদান্যতা প্রদর্শন করতে টাকা পয়সা দান করেছে।
বেহেমাই গণহত্যার বছর দুই পড়ও ফুলনকে ধরা যায়নি। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার আত্মসমর্পণের সমঝোতায় আসতে চেয়েছিল। সেই সময়টায় ফুলনের শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না এবং তার দলের অধিকাংশ সদস্যই মারা গিয়েছিল। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফুলন আত্মসমর্পনে রাজি হয় কর্তৃপক্ষের কাছে। যাইহোক, সে জানিয়েছিল, উত্তরপ্রদেশের পুলিশকে সে বিশ্বাস করে না, সে মধ্যপ্রদেশের পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে। ফুলন ভীষণভাবে চেয়েছিল যে শুধুমাত্র মহাত্মা গান্ধীর ছবি এবং হিন্দু দেবী মা দুর্গার সামনেই তার অস্ত্র নামিয়ে রাখবে, পুলিশের কাছে নয়। চারটে শর্ত সে দিয়েছিল: (১) মৃত্যুর জন্য জরিমানা মুকুবের নিশ্চিত করণ, (২) দলের অন্যান্য সদস্যদের জেল খাটার মেয়াদ ৮ বছরের বেশি হবে না, (৩) বন্ধুত্ব স্থাপনের জন্য একখণ্ড জমি, (৪) তার গোটা পরিবারের সদস্যদের পুলিশি পাহারায় তার আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে নিয়ে আসা।
নিরস্ত্র অবস্থায় পুলিশের একজন বড়কর্তা চম্বলের সংকীর্ণ গিরিখাত অঞ্চলের গোপন স্থানে ফুলনের সঙ্গে দেখা করেন। তার ভিন্দ-এ আসেন ও ফুলন তার রাইফেল গান্ধীর ছবি ও দুর্গা মূর্তির সামনে নামিয়ে রাখে। সেখানে প্র ায় হাজার দশেক দর্শনার্থী ও ৩০০ পুলিশ এবং মধ্যপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিং হাজির ছিলেন। ফুলন ও তার অন্যান্য সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করার জন্য সক্রিয় ছিল পুলিশের দল।
ফুলনের বিরুদ্ধে আটচল্লিশটি অপরাধমূলক কাজের মধ্যে ত্রিশটি ছিল ডাকাতি ও অপহরণমূলক কাজ। তার বিচার ব্যবস্থা গ্রহণে সময় লাগে ১১ বছর আর সেই সময়টা তাকে কারাবাসে থাকতে হয়। সেই সময়ই ‘তার ওভারিয়ান সিস্ট’-এর অস্ত্রোপচার করা হয় এবং অপ্রয়োজনীয় হিস্টেকটমিও করা হয়। কারণস্বরূপ ডাক্তাররা জানান যে তারা চাননি, ফুলন আর কোন ফুলনের জন্ম দেয়। ১৯৯৪ সালে প্যারোলে ছাড়া পায় ফুলন, ‘ নিষাদ জেলে ‘ সম্প্রদায়ের নেতা, বিশ্বম্ভর প্রসাদ নিষাদের প্ররোচনায়। মুলায়ম সিং যাদবের নেতৃত্বে থাকা উত্তর প্রদেশ সরকার তার বিরুদ্ধে থাকা সব রকম মামলা তুলে নেয়।
গরিব ও নির্যাতিত দের সাহায্যার্থে, ১৯৯৬ সালে একাদশতম লোকসভা নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টির হয়ে ভোটে দাঁড়ায় ফুলন দেবী। উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর থেকে সে জয়ী হয় নির্বাচনে। ১৯৯৮ সালে পরাজিত হলেও ১৯৯৯ তে আবার নির্বাচিত হয়।
দুর্বল শ্রেণীর সুরক্ষায় নিয়োজিত জাতীয় জনতা পার্টির নেতা গঙ্গাচরণ রাজপুতের নেতৃত্বাধীন ‘একলব্য সেনা’- র সভাপতি পদে কাজ করে ফুলন ১৯৯০ সালে। নিচু জাতের মানুষদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণের প্রতি নজর দেয় ফুলনের নেতৃত্বে দলটি। সেই সময়ই ফুলন তার দিদির স্বামী নতুন দিল্লির ঠিকাদার উম্মেদ সিং কে বিয়ে করে।
১৯৯৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে ফুলন জানায় তার রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্তর্গত বিষয়বস্তু হল গরিবদের জন্য পানীয় জল বিদ্যুৎ সরবরাহ স্কুল ও হাসপাতাল নির্মাণ। পুরুষের সমতুল্য নারীর সম্মান, শিক্ষা এবং চাকরির ওপর সে জোর দেয়।
ফুলন দেবীর রাজনৈতিক উন্নতি ছিল বিতর্কিত। তার ভোটপ্রচার-এর সময় সেই বেহমাই হত্যাকাণ্ডের ফলে যেসব মহিলারা বিধবা হয়েছিল, তারা ফুলনের তীব্র সমালোচনা করে। ক্ষত্রিয় (উচ্চজাত) সংস্থা, ক্ষত্রিয় স্বাভিমান আন্দোলন সমবায় কমিটি (KSASC) রাজ্যজুড়ে ফুলন দেবীর বিরুদ্ধে প্রচার চালায়। ভারতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে ফুলন অনির্ধারিত স্টেশনে ট্রেন থামায়, উত্তরপ্রদেশে তার আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তৎকালীন রেলমন্ত্রী রাম-বিলাস পাশওয়ান রেলের এই ঘটনাটিকে অত্যন্ত লঘু করে দেখে ছিলেন এবং সামান্য অনুসন্ধানের আদেশ দিয়েছিলেন। একবার সে গোয়ালিয়ার জেল পরিদর্শনে যায়, যেখানে একসময় সে বন্দিনী ছিল, তার আগেকার সঙ্গীদের সঙ্গে দেখা করতে। সাক্ষাৎকারের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না হওয়ায় জেলের অফিসাররা তাকে ঢুকতে দিতে না চাওয়ায় ফুলন তাদের গালাগালি করে। পরে এই ঘটনায় জড়িত অফিসারদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় কোনরকম কারণ না দর্শিয়েই।
চিত্রপরিচালক শেখর কাপুর ১৯ ৯৪ সালে “ব্যান্ডিট কুইন” নামে একটি ছবি নির্মাণ করেন ফুলন দেবীর জীবনী ভিত্তিক যা শেষ হয় ১৯৮৩ তে তার সমর্পণের ঘটনায়। ছবির বিষয়বস্তু ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত মালা সেনের “ইন্ডিয়াস ব্যান্ডিট কুইন” : দা ট্রু স্টোরি অফ ফুলন দেবী” থেকে নেওয়া। যদিও ছবির নায়িকা ফুলন তবু সে ভয়ংকর ভাবে কাহিনীর সত্যতার ওপর সন্দেহ প্রকাশ করে এবং ভারতে ছবিটির প্রদর্শনী বন্ধ করার প্রচেষ্টা করে।
প্রেক্ষাগৃহ থেকে ছবিটি তুলে না ফেলা হলে ফুলন প্রেক্ষাগৃহ বাইরে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে বলেও হুমকি দেয়। ফুলন তার অভিযোগ তুলে নেয় যখন প্রযোজক চ্যানেল ফোর তাকে ৪০ হাজার পাউন্ড দেয়। এই ছবি তাকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দেয়। সমাজসেবী লেখিকা অরুন্ধতী রায়, “দা গ্রেট ইন্ডিয়ান রেপ ট্রিক” নামে ছবিটির সমালোচনায় প্রশ্ন তোলেন, জীবিত নারীর অনুমতিব্যতীত তার ধর্ষণের পুনরাভিনয় কি সঙ্গত? পরিচালক শেখর কাপুরকে দায়ী করেছেন ফুলন দেবীকে শোষণ করা ও তার জীবনও জীবনের অর্থকে ভুল উপস্থাপনা করার জন্য।
যদিও ফুলনদেবী অশিক্ষিত তবুও আন্তর্জাতিক লখলদ্বয়, মেরি থেরেস কিউনি এবং পল রেমবালির সহযোগিতায় আত্মজীবনী ‘ দা ব্যান্ডিট কুইন অফ ইন্ডিয়া: এন ইন্ডিয়ান উওমেন’স অ্যামেজিং জার্নি ফ্রম পেজেন্ট টু ইন্টারন্যাশনাল লেজেন্ড” লেখেন।
২০০৯ সালের ২৫ জুলাই, তার দিল্লির বাংলোর বাইরে, মুখোসাবৃত তিন বন্দুকধারীর গুলিতে মারা যান ফুলন দেবী। তার শরীরে পাঁচটি গুলি লাগে, মাথায় তিনটে ও গায়ে দুটো। কাজ সেরে বন্দুকধারীরা মারুতি গাড়ি চেপে পালায়। তাকে কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এই হত্যাকাহিনীর মুখ্য ব্যক্তি শের সিং রানা ওরফে পঙ্কজ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। রানা জানায় যে সে ফুলন দেবীকে হত্যা করে বেহমাই গণহত্যার জন্য।
এই খুনের জন্য পুলিশের অকর্মণ্যতাকে দায়ী করা হয়। অভিযোগ করা হয় যে একজন পার্টি-কর্মী, আততায়ীদের ফেলে যাওয়া রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে লুকিয়ে ফেলে। ফুলন দেবীর বাড়িতে বাস করা আরো তিনজনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে যে তারা রিভলভারের বিষয়ে জানতো। পুলিশ যাতে রিভলবারের ফরেন্সিক পরীক্ষা করতে না পারে তাই রিভলবারটিকে অদৃশ্য করা হয়।
সামান্য গ্রাম্য সহজ সরল বালিকা জীবন থেকে পরিস্থিতি পরিবেশের চাপে ‘ডাকাত রানী’-র শিরোপা অর্জন করা থেকে ভারতীয় লোকসভার সংসদ পদ-প্রাপ্তির নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে মাত্র ৩৭/৩৮ বছরের জীবনে যবনিকা পতন ঘটে ফুলন দেবীর।
What's Your Reaction?

Sandip Ghosh lives in Salt Lake City, Kolkata. He stays clear of politics, sports or regular curricular studies, but loves learning varied issues. His personal romance is theatre. Now 61, he has worked in various embassies and private organisations, but ploughs himself back into acting whenever he can. His latest book is titled “Theatre in the Districts and Suburbs”