Now Reading
প্রেম সাধক

প্রেম সাধক

Avatar photo
পিশাচ-সাধক

পিশাচ-সাধনা, গ্রামের অদ্ভুত এক মানুষ মকবুল এবং তার বিশেষ কাককে নিয়ে এক রহস্যময় গল্প। বনগাঁতে এক চিত্রনাট্যকারের সঙ্গে মকবুলের সাক্ষাৎ এবং পিশাচ সাধনার রহস্য উদঘাটনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।

-স্যার, আমি পিশাচ-সাধক।
আমি কৌতূহল নিয়ে পিশাচ- সাধক -এর দিকে তাকালাম। মামুলি চেহারা। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় চুল নেই। শরীরের তুলনায় মাথা বেশ ছোট। সেই মাথা শারীরিক কোনো অসুবিধার কারণেই হয়তো সারাক্ষণ বামদিকে ঝুঁকে আছে। তার হাতে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা পাখির খাঁচা। খাঁচায় যে পাখিটা আছে সেটা খুব সম্ভব কাক। পা ছাড়া পাখিটার আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কাকের পা বলেই মনে হচ্ছে।
লোকটার বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। গ্রামের অভাবী মানুষের বয়স চট করে ধরা যায় না। দুঃখ ধান্দায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরেই তাদের মধ্যে বুড়োটে ভাব চলে আসে। আমার কাছে মনে হলো, লোকটার বয়স চল্লিশের বেশি হবে না। মাথার চুল অবশ্যি বেশির ভাগই পাকা। মুখের চামড়াও ঝুলে পড়েছে।

লোকটার পরনে টকটকে লাল রঙের নতুন লুঙ্গি। গলায় একই রঙের লাল চাদর উড়নির মতো ঝোলানো। এটাই সম্ভবত পিশাচ সাধক -দের পোশাক। সব ধরনের সাধক -দের জন্যে পোশাক আছে – ড্যানসিং দরবেশরা আলখাল্লা পরেন, সন্ন্যাসীরা গেরুয়া পরেন, নাগা সন্ন্যাসীরা নগ্ন থাকেন। পিশাচ-সাধকরা লাল লুঙ্গি এবং লাল চাদর কেন পরবে না! কারণ তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পে এরকম তো কতই পড়েছি। আমি পিশাচ-সাধক -এর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, – -তুমি তাহলে পিশাচের সাধনা করো?

পিশাচ-সাধক সব ক’টা দাঁত বের করে হাসল। আনন্দিত গলায় বলল-
– কথা সত্য।

লোকটার দাঁত ঝকঝকে সাদা। গ্রামের মানুষরা পান-সিগারেট খেয়ে দাঁত কুৎসিতভাবে নোংরা করে রাখে, এর বেলায় তা হয়নি।

নাম কী তোমার?

মকবুল। স্যার, আমি পিশাচ-সাধক মকবুল। যদি অনুমতি দেন আপনেরে একটা কদমবুসি করি।
কদমবুসি যে প্রণামেরই মতো একটা ব্যাপার সেটা আমি জানতাম কিন্তু আমি হতবাক হয়ে গেলাম এটা ভেবে যে সাধারণত এইসব সাধকরা নিজেরাই প্রণাম নিতে আগ্রহী হয় এর ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা অন্যরকম। এমনিতেই একটা সিনেমার চিত্রনাট্যের জন্য প্রেমের গল্পের তাগাদা পেয়েছিলাম বলে সেটাই লিখতে বসেছি কিন্তু প্লট কিছুই মাথায় আসছিল না তাই এইরকম একটি মানুষের উপদ্রবে প্রথমে বিরক্ত হলেও এখন আমার একটু ইন্টারেস্টিং লাগছে।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম,
-সে কি প্রণাম কেন? না না! প্রণাম করার দরকার নেই।
সে অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে বলল,
-পায়ে হাত দিবো না স্যার। ভয়ের কিছু নাই।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
-মানেটা ঠিক বুঝলাম না, পায়ে হাত দিলে ভয়ের কী?
সে বলল,
-পিশাচ-সাধনা যারা করে তারা কারোর শইল্যে হাত দিলে বিরাট ক্ষতি হয়।

-ক্ষতিটা কার হয় – তোমার, না তুমি যার গায়ে হাত দেবে তার?

-আমি যার শইল্যে হাত দিবো তার। আপনের শইল্যে হাত দিলে আপনার বিরাট ক্ষতি হইবো। যেখানে হাত দিবো সেখানে ঘা হইবো।

আমি এবার পুরোপুরি বিস্মিত হয়ে ভাবলাম, লোকটা পাগল। তাও একটু মজা দেখার জন্য বললাম,

See Also
Ghats of Varanasi

-পায়ে হাত দাও। দেখি ক্ষতি কী হয়! ঘা হয় কি-না।

-ছি-ছি! কন কী আপনে? আপনের ক্ষতি হবে এমন কাজ পিশাচ-সাধক মকবুল করব না।

সে আমার পা থেকে এক-দেড় হাত দূরে মাটিতে হাত দিয়ে ভক্তিভরে কদমবুসি করল। কদমবুসির পর সে আমার পা থেকে এক-দেড় হাত দূরে মাটিতে দুহাত জোড় করে চোখবন্ধ অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করল। কে জানে পিশাচ-সাধক -দের কদমবুসি করার এটাই হয়তো নিয়ম। বিপুল ভুলভ্রান্তি হলে বাঁচবার উপায় নাই।

বিশ্বের কতই বা আমরা জানি।
এতক্ষণ এই লোকটার সাথে কথাবার্তা বলে যেটা বুঝতে পেরেছি লোকটা এপার বাংলার নয় সম্ভবত ওপার বাংলার। যদিও বনগঁায় আমার এই মাসির বাড়িতে এলে এই ওপার বাংলার লোকেদের সঙ্গে আমার বেশি দেখা হয়। আমি আবার ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-তোমার খাঁচায় কী? কাক না-কি?
-জি স্যার কাক। আমরা বলি কাউয়া।
-তোমার কাকের ব্যাপারটা কী বলো তো?
-সাধনার জন্যে লাগে স্যার।
-ও আচ্ছা।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
– তা মকবুল তোমার দেশ কোথায়?
– পূর্ববঙ্গে বরিশালে স্যার, দেড় মাস হল এদেশে আসছি।
– দেড় মাস? কিভাবে এলে? এভাবে থাকছই বা কি করে? পাসপোর্ট- ভিসা!
– কি যে কন স্যার! আমাদের কি আর ওইসব জোগাড় করার সামর্থ্য আছে?!
– তাহলে?
– সাধক মানুষদের আর কি দেশ আর কি বর্ডার? আমরা ঠিকই চলে আসতে পারি।
ইলিগ্যাল ভাবে বর্ডার যে পারাপার করা যায় সে সম্বন্ধে আমার ধারণা ছিল, কিন্তু এখন জানার ইচ্ছাটা প্রবল হল, বললাম,
– কিভাবে গো?!
– কিভাবে তো তা কইতে পারব না স্যার। ওই যে আপনাকে বললাম না সাধক মানুষদের কিছু গুহ্যক্রিয়া করার ক্ষমতা থাকে। কিন্তু সেসব কিছু আপনাকে কইতে পারি না স্যার, আমাকে ক্ষমা করবেন। কিছু বললে গুহ্যক্রিয়ার আর পরবর্তীতে কাজ থাকে না..
আমি শুধু শুনলাম আর আমার মানসপটে ভেসে উঠলো – মকবুল পিশাচ-সাধক, তার পোষা পিশাচের পিঠে চেপে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে মানে বরিশাল থেকে বনগাঁয় ঢুকছে.. নিজের অলীক কল্পনায় নিজের মুখেই একটা হাসি খেলে গেল।
এবার মকবুল বলল –
– স্যার আপনার কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি স্যার!
এবার তার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু আন্দাজ করতে পারলাম না, কি চায় ও? কোন আর্থিক সাহায্য কি? গ্রামে বেড়াতে এলে এ-জাতীয় যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়। বনগাঁয় আমার মাসির বাড়ি, ছোটবেলায় আমার মা বাবা এক্সিডেন্টে মারা যান। তাই মাসি মেসোই আমাকে তাদের কাছে এনে রাখলেন। মেসোমশাই এর পরিবার বনগাঁর পূর্বতন জমিদার ছিলেন, তাদের বাড়িতে মেসো মাসির মেয়ে মানে আমার দিদিও ছিলো। তারপর মাসির বাড়িতেই আমি মানুষ। ক্লাস টেন অব্দি এখানেই পড়াশোনা করেছি। তারপর স্কুল কলেজ কলকাতায়। যদিও মাসি মেসোমশাই এখন কেউ বেঁচে নেই। মাসতুতো দিদিও থাকেন না, তিনি বিবাহ সূত্র থাকেন আমেরিকায়। কিন্তু মাতৃভূমির অমোঘ টানেই হয়তো দিদি বাড়িটি বিক্রি করেন নি। আমাকে তার সবথেকে নিকট আত্মীয় হিসেবেই বাড়িটি দেখা শোনার দায়িত্ব দিয়েছেন, বছরে যাতে এক দুবার আমি এই বাড়িটিতে আসি। আমার এই বাড়িটি ভালই লাগে, ছোটবেলার স্মৃতি আর এত সুন্দর প্রকৃতির সান্নিধ্য আমি খুব একটা পাইনা। এখন চিত্রনাট্যকার হিসেবে একটু নাম-ডাক হয়েছে এবং কলকাতার বাইরের ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার সুযোগ হওয়াতে কলকাতা ও ছেড়েছি প্রায় ছয় বছর। আর শেষ পাঁচ বছর মুম্বাইতে রয়েছি। শেষ দু’বছর এখানেও আসতে পারিনি। মুম্বাই থেকে কাজের সূত্রে কলকাতায় আসতাম ফ্লাইটে থাকতাম হোটেলে আর ফিরে যেতাম দু-তিন দিনের মধ্যেই মুম্বাইতে। তখন আর এখানে আসার সুযোগ হয়নি। এবছরের গোড়ার দিকে যখন আমার ডিভোর্স হল তখন কিছুটা সময়ের জন্য নিজেকে গুটিয়ে নিতে চেয়েছিলাম তাই মুম্বাইয়ে মন তখন আর লাগছিল না, জুহুর ১৩ তলার পেন্টহাউস এপার্টমেন্টটা আমাকে গিলে খেতে আসছিল। তাই আর কিছু না ভেবে হঠাৎ করেই একদিন সকালে চলে এসেছিলাম এখানে,ভারাক্রান্ত মনের কিছুটা ভার হয়তো লাঘব করতে পেরেছিল এই জায়গাটা। বহু মানুষ আমার সঙ্গে সেই সময় দেখা করতে এসেছিল ছোটবেলার বন্ধু, পুরনো স্কুলের শিক্ষক এবং পাড়ার লোকজন সবাই ছিল। এখানে আসার পর আমাকে রান্নাবান্না ও ঘর পরিষ্কার করার লোকের ব্যবস্থাও পাড়ার লোকে করে দিয়েছিল। ইন্টারনেট বিবর্তনের যুগে, যে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গেই চিত্রনাট্যকার হিসেবে যুক্ত থাকি না কেন সবাই আমার কাজ দেখেছিল, অগত্যা যা হবার তাই হল। যে শান্তির খোঁজে আমি মুম্বাই ছেড়ে এসেছিলাম সেই শান্তি আমি এখানে এসেও পেলাম না। কিন্তু ওই যে “ফিল্ম লাইন” সঙ্গে যুক্ত মানেই সাধারণ মানুষের চোখে সেটা বিস্ময়কর, রহস্যজনক ও সম্মানজনক স্থান। তাই সবার মনে বহু প্রশ্ন ছিল, যেমন- নায়ক নায়িকাদের নিয়ে গসিপের সত্যতা কিংবা ভালো স্ক্রিপ্ট রাইটারের অভাব বা আপকামিং কোন মুভির কাস্টিং থেকে কাস্টিং কাউচ অব্দি.. এছাড়াও পড়ার ছোট ছেলেমেয়েদের আবদার তাদেরকে ফিল্মে সুযোগ করে দেবার জন্য। তারপর তো আর্থিক সাহায্য চাওয়া তো রয়েছেই। প্রথম প্রথম এত মানুষের এত রকমের প্রশ্নে আমি বিরক্ত বোধ করতাম কিন্তু তারপর বুঝলাম এদের প্রশ্নগুলো আমার কাছে বিরক্তিকর হলেও এদের কাছে আমার উত্তরগুলো এবং ‘আমি’ খুবই মূল্যবান। আর আমরা যারা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত তাদের কাছে এই “ফেম” ব্যাপারটা খুব ইম্পর্টেন্ট। আর এখানে এসে আমি বুঝতে পেরেছিলাম মানুষের জীবনে কতইনা সমস্যা রয়েছে, সেখানে আমার প্রেমের বিয়ে ভেঙে যাওয়া এক তুচ্ছ ব্যাপার। তাই থেকে গিয়েছিলাম এক মাস। কথা দিয়েছিলাম এদেরকে যে এবারের দুর্গাপুজোয় গ্রামে আসবো, তারপর ফিরে গিয়েছিলাম নতুন কাজের রসদ নিয়ে।
এবার এসছি পঞ্চমীর দিন, থাকবো ওই কালীপুজো অব্দি। কালী পূজার পরের দিন আবার মুম্বাই চলে যাব। দুর্গাপুজো কেটে গেছে, কালীপুজোর আর দিন চার বাকি, নতুন একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করতে চাইলেও কাজ সেরকম কিছুই এগোয়নি। মাথায় কোন প্লটও আসছে না।
আমি এবার মকবুলকে প্রশ্ন করলাম,
– তা বলো মকবুল, আমার কাছে কি প্রয়োজন?
মকবুল কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে দুটো হাত ঘষতে লাগলো তারপর তার ইতস্তত ভাবটা যেন খানিকটা বেড়েই গেল। আমি এবার পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে তার আমার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন। এইসব ক্ষেত্রে আমি কোনো তর্কে যাই না। টাকা দিয়ে দিই। তেমন বেশি কিছু না, সামান্যই। তাতেই তারা খুশি হয়। তাদের প্রত্যাশাও হয়তো অল্পই থাকে। আমি ঠিক করলাম যে এই পিশাচ সাধক -কে পাঁচশ টাকা দেবো। পিশাচ-সাধক যে এই টাকা পেয়েই মহাখুশি হবে সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তার আনন্দ আরো বাড়বে যদি কিছুক্ষণ তার সঙ্গে গল্প করি। গ্রামাঞ্চলের মানুষের আনন্দ-বিলাস গল্পগুজব। হাসিমুখে কিছুক্ষণ গল্প করলেই তারা খুশি। আমি গল্প শুরু করলাম।
– কি হলো পিশাচ-সাধক? এত লজ্জা সংকোচ করছ কেন?! তুমি তো পিশাচ সাধনা করবে হে! এত লজ্জা সংকোচ থাকলে কি আর পিশাচ-সাধনা করা যায়?

মকবুল কিন্তু তখনো হাতে হাত ঘষে মুখ নিচু করেই বসে আছে। অচেনা মানুষের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য চাওয়ার সংকোচ আমার চোখে মকবুলের দর বাড়ালো। আমি ওর লজ্জা কাটানোর জন্যই বললাম-
– আচ্ছা মকবুল আমি জ্বীন সাধনার কথা শুনেছি, পিশাচ সাধনার কথা শুনি নি।
এবার মকবুল তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল –
-পিশাচ-সাধনা আরো জটিল। পিশাচ নিয়া কারবার। এরা ভয়ংকর। সাধনাও কঠিন।
– তা এমন ভয়ংকর সাধনার দিকে গেলে কী জন্যে?
– মন ওইদিকে টানছে। মনের উপরে তো হাত নাই। এছাড়া উপায়ও নেই। কপালগুণে ভালো ওস্তাদও পেয়েছিলাম।
– আচ্ছা, ওস্তাদের নাম কী?
-উনার নাম কলিমুল্লাহ রব্বানী।
-নাম তো জবরদস্ত।
-উনি মানুষও জবরদস্ত ছিলেন। আলিশান শরীর। কথা যখন বলতেন মনে হইতো মেঘ ডাকতেছে। এক বৈঠকে দুইটা কাঁঠাল খাইতে পারতেন।
– পারতেন বলছো?! মারা গেছেন না-কি?!
-জি, উনার ইন্তেকাল হয়েছে। বড়ই দুঃখের মৃত্যু। ঘটনাটা বলব?
-বলো।
– উনি আমাদের গ্রামের সবথেকে বড় পিশাচ সাধক ছিলেন। উনি পিশাচদের পোষ মানাতে পারতেন, দুটো পিশাচ পোষ মানিয়ে রেখেও ছিলেন। কিন্তু স্যার, পিশাচ পোষ মানানো খুব ভয়ংকর ব্যাপার, সামান্য এদিক থেকে ওদিক হলেই মৃত্যু ঘনিয়ে আসতে পারে। এক মঙ্গলবার সন্ধ্যাকালে তিনি ঘর থাইক্যা বাইর হইছেন। মনের বেখেয়ালে শরীর বন্ধন দেন নাই। পিশাচ আইসা ধরল। মট কইরা একটা শব্দ হইল। মাথায় মোচড় দিয়া দিল ঘাড় ভাইঙ্গা।
– কেন কেন পিশাচ তো পোষ মানানো ছিল?!
– স্যার আপনাকে তো বললাম সে বড় ভয়ংকর ব্যাপার। ওরা কি আর কুকুর – বিড়াল দের মত পোষ মানে! ওদের পোষ মানানো মানে দেওয়া – নেওয়া। পিশাচ আপনাকে যেমন দিবে, আপনার কাছ থেকে নিবেও।
-পিশাচ সাধনা দেখি খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। তা তোমার পোষা পিশাচ আছে নাকি?!
– এখনো নাই স্যার। আমি এখনো পিশাচ সিদ্ধ হই নাই। তবে সামনের অমাবস্যার যোগে হয়ে যাব। এ তো কোন সহজ কাম নয় স্যার। বিপদের কাজ।
– তা তুমি এই বিপদজনক সিদ্ধি পেতে চাও কেন?
– পিশাচ-সাধনা থাকলে লোকজন সমীহ করে। একজন পিশাচ-সাধক-রে কেউ তুই তুকারি করে না। আপনে আপনে করবে। বিপদে-আপদে সবেই ছুইটা আসবে আমার কাছে। এরে বান মারতে হবে। তারে বশীকরণ মন্ত্র দিতে হবে। বান ছুটাইতে হবে। পিশাচ সাধকের কাজের কী শেষ আছে? ঠিক বলেছি না স্যার?
আমার এবার হাসি, মনে মনে ভাবি- বা: এও তো “ফেম-ক্রেজি”.. সমাজে গুরুত্ব পাওয়ার জন্য পিশাচ সাধক হতে চায়। বললাম-
– তা মকবুল, পিশাচ সাধক হয়ে কি কি কাজ করতে চাও? যেগুলো সাধারণভাবে করতে পারছ না.. নিশ্চয়ই প্রচুর টাকা-পয়সা ধন দৌলত করে ফেলবে পিশাচের কল্যাণে?
– আসলে স্যার পিশাচ সাধনা করলে খাওয়া-খাদ্য না পাইলেও আমরার চলে। পিশাচের সাধনা করি, আমরার স্বভাব-চরিত্রও পিশাচের মতো। তিন চাইর দিন না খাইলেও আমরার কিছু হয় না। তো বুঝতেই পারছেন স্যার খাবার প্রয়োজন নাই তাই টাকা পয়সারও বিশেষ প্রয়োজন নাই। টাকা পয়সা স্যার দরকার, কিন্তু এতটাও দরকার নয় তার জন্য পিশাচ সাধনা করতে হবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
– তাহলে এত কষ্ট করে এই সাধনা করছ কেন? সাধনা করে পিশাচ হবার দরকারইবা কী! আমাদের সমাজে পিশাচের তো অভাবও নেই। সাধনা ছাড়াই অনেক পিশাচ আছে।
– কথাটা সত্য বলেছেন স্যার। কিন্তু স্যার পিশাচ সাধনা তে শুধু খারাপ কাজই নয় ভালো কাজও করা যায়, ভালো মানুষের ভালো করা যায়,খারাপ মানুষের খারাপ করা যায় আর মৃত্যু পথযাত্রী মানুষকে আরোগ্য দেওয়া যায়।
আমার গলা ছেড়ে হাসতে ইচ্ছা করলো, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে আরোগ্য দেওয়া যায় পিশাচ সাধনায়! লোকটার সত্যিই মাথা খারাপ। কিন্তু আমি হাসতে পারলাম না মকবুলের চোখের দৃষ্টি দেখে। এতক্ষণে ও আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়েছে তার চোখের দৃষ্টিতে এমন একটা কিছু ফুটে উঠেছে যা আমি এতক্ষণ খেয়াল করি নি।
মকবুলের চোখে যেটা ছিল সেটা এক আকুতি, এবার ও বলল –
– আসলে কি জানেন স্যার কোনো কারণ ছাড়া আমরা কোন কাজই করি না। অত কষ্ট কইরা সাধনা যে করতেছি বিনা কারণে তো করতেছি না। আমি তো বেকুব না। এই যে আপনার সঙ্গে এত গল্প করলাম, আপনার কি মনে হয়েছে আমি বেকুব?
– না না..
– পিশাচ সাধনায় পাস করতে পারলে আমি পিশাচের মাধ্যমে কোন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষকে আরোগ্য দিতে পারব। সম্পূর্ণ রোগ নিরাময়। যদিও তার বদলে আমাকেও কিছু দিতে হবে। সে দিতে হয় হোক..
এবার আমি একটু ধাক্কা খেলাম আমার যুক্তিবাদী মন যদিও তখন অটুট কিন্তু একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে উঁকি মারল, তাই প্রশ্নটা করেই ফেললাম,
– যেকোনো ‘মৃত্যু পথযাত্রীকে’ না কোন ‘বিশেষ মৃত্যু পথযাত্রীকে’ আরোগ্য দিতে চাও?
এবার মকবুল একেবারে ঘাড়কাত করে বসে রইল। আমার আর তর সইলো না আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
– বল মকবুল, পুরোটাই খুলে বলো।
মকবুলের চোখটা যেন চিকচিক করলো, আবার মাথা নামিয়ে একটু ধাতস্থ হয়েছে বলতে শুরু করলো –
– কইতারি আমাদের গ্রামের অবস্থাপণ্য মেয়ে, সেই ছেলেবেলা থেকে আমরা একসাথে বড় হয়েছি। একসাথে খেলাধুলা, গ্রামের একমাত্র ভিডিও হলে ছবি দেখা, নদীর ধারে বসে থাকা। কইতারি খুব প্রেমের ছবি ভালোবাসতো, আপনাদের দেশের হিরো শাহরুখ খানের ভক্ত ছিল। শাহরুখ খানের ডায়লগ ওর মুখস্থ থাকতো। শাহরুখ খানের যে সিনেমা টিভিতে দিতো বা ভিডিওতে হতো ওর সব দেখা ছিল, আর আমাকেও দেখতে হতো কারন আমি তো সর্বদা ওর সাথেই থাকার চেষ্টা করতাম। ছোটবেলায় যা হয় আর কি দুজনের মধ্যে মন দেওয়া নেওয়া হয় শাহরুখ খানের “দিলবালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে” – র মতো করেই, আমি কইতারিরে জবান দিয়েছিলাম যে ওকে আমি শাদি করবোই। কাঁচা বয়সের কথা, তাছাড়াও দুজন সমবয়স্ক। কিন্তু ওই বয়সে কি আর অত কিছু মাথায় থাকে। কইতারি যখন ১৫ বছর বয়স তখন তো ওর বাবা পাশের পাড়ার এক দোজবরের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিল। কইতারি খুব কাঁদলো আমি ভাবলাম আমার জন্য কাঁদছে, কিন্তু পরে জানলাম বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার দুঃখেই কাঁদছিল। কইতারির মা ছিল না। তাই আমারও কইতরীর মাকে সব কথা দিলওয়ালে দুলহানিয়ার মতো বলার সুযোগ ছিল না, এই সুযোগে ওর বাপ অমরিশ পুরির মত ওকে বিদায় করে দিল। আমি আর কি করবো বুঝতে পারলাম না মনের দুঃখে কয়েকদিন গুম হয়ে বসে রইলাম তারপরে খেতের কাজ কর্মে লেগে পড়লাম। পরে দুবছর কইতারি গ্রামে আসেনি। তারপরে যখন এলো তখন কইতারির বাচ্চা হয়ে গেছে, ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। কইতারির উপর আমার খুব রাগ ছিল কিন্তু যেদিন কইতারির কোলে ওই ফুটফুটে বাচ্চাটাকে দেখলাম সেদিন আমার সমস্ত রাগ জলে ধুয়ে গেল। মনে মনে দুয়া করলাম – খুব ভালো থাক কইতারি, স্বামী সন্তান নিয়ে খুব ভালো থাক। এর দু’বছর পর ওর আবার একটি ছেলে সন্তান হয়েছিল। ততদিনে আমি কইতারির বিবাহিত জীবন মেনে নিয়েছি। ওর ছেলে মেয়েরা এখন আমাকে মুকু চাচা ডাকে। ঘটনাটা এক বছর আগের খবর পেলাম কইতারির খুব শরীর খারাপ। খোঁজ নিয়ে জানলাম বিগত ছয় মাস ধরে কইতারির বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা হচ্ছে, সমস্ত রকমের পরীক্ষা হয়েছে এবং ধরা পড়েছে ওর জরায়ুতে ক্যান্সার হয়েছে। আমাদের দেশে চিকিৎসা তো হয়েই ছিল তারপর কৈতারীর স্বামী ওকে নিয়ে আপনাদের দেশে আসে, সাথে কইতারির বাবা ও এসেছিলেন। ছেলেমেয়েগুলো আমার বাসায় ছিল আমার সাথে। আপনি যেখানে থাকেন স্যার সেই বোম্বেতে ওর চিকিৎসা হয়। বোম্বেতে হসপিটালে ভর্তি থাকাকালীন সঙ্গে কইতারির খোঁজখবর নিতে এবং বাচ্চাদের খোঁজ খবর দিতে কথা হতো কলে, এখানে কইতারি একদিন আমাকে বলে –
– জানিস মকবুল আমি যে শহরে হাসপাতালে ভর্তি আছি সেই শহরেই আমার স্বপ্নের রাজকুমার থাকে।। এখানেই তো শাহরুখ খানের বাড়ি আমি দেখেছি টিভিতে ইন্টারনেটে। আমি একবার সেখানে যেতে চাই মকবুল কিন্তু কেউ আমাকে এখানে নিয়ে যাচ্ছে না। আমি একবার শাহরুখ খানকে সামনে থেকে দেখতে চাই মকবুল অন্তত তার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চাই একবার। তুই একবার আমার জামাই কে বলে দেখ না।
আমি বললাম –
-তুই সুস্থ হয়ে যা কইতারি তারপর তো তুই যাবি আনন্দ করবি শাহরুখ খানের বাড়ির সামনে গিয়ে। তোর ব্যাটা আমাকে ফোনে দেখিয়েছে যে শাহরুখ খান নিজের জন্মদিনে বাড়ির বাইরেও আসে। তু সুস্থ হ তাড়াতাড়ি তারপর যাবি।
– আমি কি আর সুস্থ হব। মনে হয় না। এ যা যন্ত্রণা! “কাল হো না হো” দেখেছিলি মকবুল.. এখন আমার এই অবস্থা। খালি একবার আমার জামাইকে বলনা, আমি একবার শাহরুখ খানকে দেখতে চাই অন্তত মরার আগে।
এরপর তিন মাস হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর ডাক্তার কইতারিকে রিলিজ দিল, কিন্তু আশা দিলো না। কইতারির ক্যান্সার চতুর্থ স্টেজ পার করে গেছে। জরায়ু বাদ দিয়েও ক্যান্সারের গতি আটকানো যায়নি,সে মজ্জায় মজ্জায় প্রেমের মতই ছড়িয়ে গেছে। কইতারি যখন দেশে ফিরল আমি দেখি ওকে চিনতে পারিনি, মাথায় একটাও চুল নেই, শরীর কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। এ যেন আমার সেই কইতারি নয়, কিন্তু ওর চোখে আমি সেই কাতর মিনতি লক্ষ্য করেছি। সেই মিনতি শুধুমাত্র ওর স্বপ্নের নায়ক কে একবার সামনে থেকে দেখার। ওর স্বামী ওকে একবারও শাহরুখ খানের বাড়ির সামনেও নিয়ে যায়নি। টাকা-পয়সা সব শেষ। মেয়েটাকে চোখের সামনে এইরকম ভাবে শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে আমি আর দেখতে পারছিলাম না স্যার। ঈশ্বরে -আল্লাহ তে আমার ছোটবেলা থেকেই ভক্তি স্যার, বাড়িতে যেমন ঈদ পালন করেছি তেমন দুর্গাপূজারও জোগাড় দিয়েছি। এই সময় আমাদের বাড়ির কাছেই এক মৌলভী সাহেব আমাকে এই সাধকের কাছে নিয়ে যান। যার কাছে আমি পিশাচ সাধনা শুধু শিখতেই শুরু করেছিলাম কইতারি-কে অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্য। স্যার, সামনে আমার পিশাচ সাধনার দিন, যদি সফল হই পিশাচ, কইতারির সুস্থজীবন ফিরিয়ে দেবে, যদিও.. পিশাচ তার বদলে আমার জীবনটা নেবে। ওই যে স্যার আপনাকে বলছিলাম না যে পিশাচ বিনিময় প্রথায় কাজ করে। কিচ্ছু যায় আসেনা তাতে আমার। কইতারিকে চোখের সামনে এভাবে মরতে দেখার থেকে আমার মৃত্যু অনেক বেশি শ্রেয়। স্যার, কইতারি-র তো সুন্দর সংসার আছে, স্বামী আছে, দুটো ফুটফুটে সন্তান আছে।আমার আর কে আছে, তিন কুলে কেউ নাই। এক আছে ওই কইতারি, এবার যদি সেও চলে যায়..
স্যার একটু পানি দিবেন, গলাটা শুকায়ে গেছে।
আমি ঘর থেকে তাড়াতাড়ি জল এনে দিলাম মকবুলকে মকবুল এক গ্লাস জল খেয়ে আরো জল চাইলো, আরো একগ্লাস খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে বলল-
– কি স্যার আমাকে পাগল বলে মনে হচ্ছে না?!
আমি জবাব দিলাম না। মানুষটার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কাকের খাঁচা নিয়ে আমার সামনে যে উবু হয়ে বসে আছে, সে কোনো সাধারণ মানুষ না। পিশাচ-সাধনা করুক বা না করুক, সে বিরাট প্রেমিক পুরুষ।
– স্যার, তাই আপনাকে আমাকে সাহায্য করতে হবে স্যার।
আমি একটু অবাক হলাম ভাবলাম এখানে কি সাহায্য আমি করতে পারি, মকবুল কিন্তু বলে চলল –
– অনেক কষ্ট করে আপনি যে এখানে এসেছেন, ফিল্ম লাইনে কাজ করেন, সে সম্বন্ধে আমি তথ্য জোগাড় করেছি। স্যার আমার কয়তারির ইচ্ছা যে শাহরুখ খানের বাড়ির সামনে যেতে চায়, জন্মদিনে সে শাহরুখ খানকে বাইরে থেকে দেখতে চায়। স্যার আপনি তো ফিল লাইনের লোক বোম্বেতে থাকেন হিন্দি সিনেমা ও কাজ করেন, শাহরুখ খানকে তো নিশ্চয়ই চেনেন, এইটা আপনাকে করে দিতেই হবে। আমার কইতারির কথা একটু বলবেন স্যার, আমি জানি উনি কইতারির সঙ্গে দেখা করবেন-ই।একমাত্র পৈতৃক বসতবাড়িটা বিক্রি করে, টাকা পয়সা নিয়ে, বর্ডার টপকে, দেড় মাস ধরে চেষ্টা করছি স্যার, বোম্বেতেও গেছি। শাহরুখ খানের বাড়ির সামনে গিয়ে গার্ডদেরকেও কিছু বুঝাতে পারিনি, আসলে ভাষা-র সমস্যা তো, গলা ধাক্কাও খেয়েছি। স্যার ওখান থেকেই এক বাঙালিবাবুর দোকানে বাংলায় কথা বলে জানলাম এখানে এভাবে কিছু হতে পারবেনা। তিনি আপনার কথা বললেন যেহেতু আপনি ওখানে খাওয়া-দাওয়া করেন, সেখান থেকে জানলাম যে আপনি এখানে আছেন। স্যার আপনি আমাকে যা খুশি করেন কিন্তু আমাকে ফেরাবেন না স্যার। আপনাকে আমার কইতারির জন্য এটুকু করতেই হবে।
বলেই লোকটা আগের মতই প্রণামের ভঙ্গিতে কদমবুসি করল। আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে আছি। কি বলবো আর কি করবো তার কোন জ্ঞান আমার নেই তখন। একজন “পরদেশ”- ঈ, আমার “স্বদেশ” – ঈ সুপারস্টার এর সঙ্গে তার মৃত্যু পথযাত্রী প্রেমিকার দেখা করাতে চায়, আর তার সাথে পিশাচ সাধনা করে বিসর্জন দিতে চায় তার নিজের জীবন। এই লোকটা জানেই না সে তার প্রেমিকার সঙ্গে যার দেখা করাতে চায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুপার-স্টার, তার দেখা পাওয়া কোনভাবেই সহজ নয়। অবশ্য ওর জন্য তো এটা স্বাভাবিকই, ওতো আর রিল লাইফে প্রেম বিলোয়নি ওর প্রেমটা অ্যাবসুলেট রিয়েল।। হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়লো, মুম্বাইতে এত বছর থাকার সুবাদে এটা জানি যে শাহরুখ খানের একটি ফাউন্ডেশন আছে তাঁর বাবার নামে মীর ফাউন্ডেশন, যারা ক্যান্সার রোগীদেরকে চিকিৎসায় সাহায্য করে এবং শাহরুখ খান তাঁর সঙ্গে সর্বতোভাবে যুক্ত থাকেন । আমি এবার মোবাইলটা তুলে নিলাম, মুম্বাইতে আমার কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধব কে ফোন করতে হবে, যদি ঐ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কৈতারির যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া যায়.. হয়তো হয়তো মেয়েটা মীর ফাউন্ডেশনের রিকভারি ওয়ার্ডে শুয়ে শাহরুখ খানের স্নেহ স্পর্শ উপভোগ করলেও করতে পারে।
মকবুল এবার আমায় প্রশ্ন করে –
– স্যার সাহায্য টা করবেন তো।।
মকবুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার খুব কষ্ট হল, মুখে খালি বললাম –
– হুঁ করব।
মকবুলের মুখটা আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। আমি প্রসঙ্গান্তরে যেতেই বললাম,
-তুমি সাধনার কোন পর্যায়ে আছ?
-শেষ পর্যায়ে স্যার। পানিতে চুবাইয়া এই কাউয়াটা মারণ লাগব। এইটা এখনো পারি নাই। এই কাউয়াটা সাথে নিয়া আসছি গ্রাম থেকে । দুইবার পুসকুনিতে নামছি এরে চুবাইয়া মারার জন্যে, দুইবারই উইঠা আসছি। জীবন্ত একটা প্রাণী পানিতে চুবাইয়া মারা তো সহজ কথা না। একবার পানিতে ডুবাইয়াই টান দিয়া তুললাম। কাউয়া কিছু বুঝে নাই। হে ভাবছে আমি তারে গোসল দিছি। পশুপাখির বুদ্ধি তো আমরার মতো না। তারার বুদ্ধি কম।
-কাকটা ছেড়ে দিচ্ছ না কেন? সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরার দরকার কী?
-কাউয়ার উপরে মুহব্বত জন্মাইছে। ছাইড়া দিতে মন চায় না। ছাড়লেও হে যায় না। মুহব্বতের মর্ম পশুপাখিও বুঝে। এই দেখেন ছাড়তাছি। সে যাবে না।
মকবুল খাঁচার দরজা খুলে দিল। কাকটা বের হয়ে এসে মকবুলের চারপাশে গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবারো খাঁচায় ঢুকে গেল।
-স্যার, আমার জন্যে খাস দিলে দোয়া কইরেন, যেন পিশাচ-সাধনা শেষ করতে পারি।
আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করলো, কাক মারতে পারবে? করলাম না।
খাঁচার ভেতর থেকে কাক আবারো কা-কা করে দুবার ডাকল। মকবুল বিরক্ত গলায় বলল,
-খাওন তো দিবোরে বাপ। তরে খাওন না দিয়া আমি খাব? তুই আমারে ভাবস কী! চুপ কইরা থাক, স্যারের সাথে মূল্যবান আলাপ করতেছি।
কাক চুপ করে গেল।
আমি তাকিয়ে আছি। অবাক হয়ে এমন এক রিয়েল লাইফের নায়ককে দেখছি যে হৃদয়ে ভালোবাসার সমুদ্র ধারণ করে পিশাচ হবার সাধনা করে যাচ্ছে। কিন্ত স্টেজ ফোরে থাকা কর্কট রোগ কি এই ভালোবাসার মর্ম বুঝবে?! সুযোগ দেবে?! কে জানে! অবশ্য ওদের প্রিয় নায়ক তো বলেইছেন – “যদি কোন কিছুই মন থেকে চাও আর আপ্রাণ চেষ্টা করো, তবে পৃথিবীর প্রতিটা শক্তি তোমাকে সেটা পেতে সাহায্য করবে”.. ভারাক্রান্ত মনেও এবার একটু যেন জোর পেলাম, তাড়াতাড়ি ফোনটা বার করলাম, মকবুলকে দাওয়ায় বসতে বলে ঘরে গেলাম। মীর ফাউন্ডেশনে ফোনটা তাড়াতাড়ি করতে হবে, নইলে “ক্যায়া পাতা, কাল হো না “।।

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
1
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comment (1)
  • It’s an excellent story. Once more it proves that, a man,who loved someone, can do everything for his loving personal..
    Thanks to the writer and expect more such creation should come out through his pen.

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top