পরিবার



Gunjon is a Kolkata-based writer whose journey has taken him…
পরিবার, বন্ধুত্ব, স্বপ্ন আর সংগ্রামের গল্প। চিত্রনাট্যকার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে এক অজানা পথে যাত্রা। বন্ধুর সঙ্গে মুম্বাই-পার কলকাতা জীবনের টানাপোড়েন, কর্মজীবনের ওঠাপড়া আর পরিবারকে নিয়ে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার স্মৃতিকথা।
সুমিত সান্যালের সঙ্গে আমার পরিচয়, হ্যাঁ তা প্রায় বছর দশেক তো হবেই।
চল্লিশের ওপারে আমার বন্ধুরা, যারা কন্যাদায়গ্রস্ত, তারা যখন ফেসবুক একাউন্ট খুলে ‘গোপনে মদ ছাড়ান’ স্টাইলে হবু-জামাইকুলের প্রোফাইল দেখে বেড়াত আর পুত্রসন্তানের পিতা হলে তাকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করে তোলাবার দুশ্চিন্তায় মিউচুয়াল ফান্ড খায় না গায়ে মাখে গুগল করত, সেই বয়েসে আমি ড্যাং ড্যাং করে মোটা মাস মাইনের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চিত্রনাট্যকার হবার অবাধ্য, ডানপিটে ভূতের পিঠে চড়েছিলাম। সে ভূত যে, যে কোনদিন পিঠ থেকে ফেলে দিতে পারে সেটাও প্রথম ছ’মাসেই হাড়েহাড়ে বুঝে গেছিলাম। তবু হাল ছাড়িনি।
সুমিতের সঙ্গে আমার সেই নতুন ‘স্ট্রাগলার’ জীবনের একদম গোড়ার দিকে আলাপ।
আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট, ফর্সা, গোলগাল, চোখে চশমা, সুমিত’কে দেখে চিত্রপরিচালক কম প্রফেসর বেশি লাগত। সেটাও যে মন্দ ভাবিনি আলাপের কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম। সারা বিশ্বের সিনেমা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য যেন ওর মাথায় থাকথাক সাজানো। কোন সীন বা সিচুয়েশন বা প্রেমাইস, শুধু বললেই হল, সুমিত মিনিটের মধ্যে জাপান থেকে হলিউড, ভায়া ইরান, হাফ ডজন ছবির রেফারন্স দিয়ে দেবে। ও সিনেমাটা ভালবাসত। আর আমি? সদ্য পা রাখা এই দুনিয়ায় ওর এই প্যাশনে যেন নিজের মুক্তির একটা ছবি দেখতে পেতাম। কিসের মুক্তি না জেনেই। ১৮ বছর সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টার চাকরি যারা করেছেন বা করে চলেছেন একমাত্র তাঁরাই আমার এই কথার মানে ধরতে পারবেন।
সদ্য কলেজে ঢোকা যুবতীর পাড়ার পি এইচ ডি করা দাদা’কে দুর্গা পুজোর প্যান্ডেলে দেখে মুগ্ধ হওয়া আর তাকে ‘আমার সঙ্গে কফি খেতে যাবেন’ বলার মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান কাজ করে, সুমিতের সঙ্গে আমার তেমন হত। সুমিত তখন বাংলা টেলিভিশনের মধ্যগগনে হুহুংকার বিরাজিত। ওর এনে দেওয়া টি আর পি’র ঘাটে প্রোডাকশন হাউজের মালিক আর চ্যানেলের রিজিওনাল হেড তখন এক গেলাসে দারু খায়। সেখানে আমি কি করে বলি তোমার কোন প্রজেক্টে আমায় নাও। সেটা আর হয়ে ওঠে নি। কিন্তু বন্ধুত্ব হাল্কা থেকে ঈষৎ গাঢ় হয়েছে। যাতায়াত শুরু হয়েছে একে অন্যের বাড়ীতে। শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে নেমে বি কে পাল এভেনিউ – আহিরিটোলা’র দিকে যেতে ডানদিকে ওদের বিশাল পৈতৃক বাড়ি। রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে অবস্থা খুব জরাজীর্ণ। ওই বিশাল বাড়ীতে কয়েক ঘর ভাড়াটে, একতালায়। দোতলায় সুমিত আর ওর মা। ব্যস। সুমিত নিজে কোনদিন ওর আত্মীয়স্বজনের কথা বলেনি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। বরাবরের নিয়ম ছিল সুমিত বাড়ি ঢুকেই সোজা চলে যেত নিজের ঘরে। আমি পেছন পেছন। দেখেছি ওর মা, বসার ঘরে, যেটা পেরিয়ে সুমিতের ঘরে যেতে হয়, সেখানে বসে টিভি দেখছেন। এক দুবার এরম হওয়ার পর একদিন নিজে থেকেই ‘মাসিমা, আমি পরাগ’ বলে প্রণাম করেছি। মাসিমা হাত তুলে আশীর্বাদ করে আবার টিভিতে ফিরে গেছেন। চা বিস্কুট চলে আসত যথাসময়ে। ত্রুফো – গোদার – সত্যজিত – স্করসেসে হয়ে আড্ডা থামত ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গড়িয়াগামী লাস্ট মেট্রো ধরার মত সময়ে।
*
চিত্রনাট্য লেখা শুরু’র দু বছরের মধ্যে বুঝে গেলাম যদি লিখে কিছু করতে চাই আমাকে ভারতীয় সিনেমা’র মক্কায় যেতে হবে। কর্পোরেট সাপ লুডো একবার যিনি খেলে ফেলেছেন তিনিই জানেন এ খেলা কি বিষম বস্তু। পাক্কা নেশা। ‘আরও আরও প্রভু আরও আরও..’ অর্থাৎ আপনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হন অথবা সেই চাকরি ছেড়ে চিত্রনাট্যকার, এই খেলা আপনি যেখানে যাবেন সেখানেই যাবে আপনার ডি এন এ বাহিত হয়ে। ততদিনে অধিকাংশ সঞ্চয় ফুড়ুৎ এবং আয় আগের এক তৃতীয়াংশ হয়ে যাওয়ায় ছেলেকে শস্তায় হিস্ট্রি অথবা ইংরেজি পড়ার উপদেশ দিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বিপুল দেমাকে ‘এয়ারপোর্ট চলিয়ে’ বলেই জীভ কেটে তৎক্ষণাৎ বলতে হল ‘সরি ভাইয়া হাওড়া চলিয়ে’।
আমি মুম্বাইয়ে পাড়ি জমালাম। ট্রেনে। নন এসি থ্রি টিয়ার।
এরপর বাংলার চারাপোনা আরব সাগরের ঢেউ এর মাথায় দিবারাত্র নেত্ত করতে করতে আর ধোবিপাট খেতে খেতে আরো কয়েক বছর কাটিয়ে কোনমতে এক জায়গায় থিতু হল। তিমিমাছ হতে না পারলেও চারাপোনার গন্ধ গা থেকে মুছে গেল । কিন্তু মন খারাপ করা, মুম্বাইয়ের অবিরত বৃষ্টির কোন এক সকালে ফোনে আমার পুত্রের মায়ের বিরহাশ্রু মুছিয়ে, জলদি বাড়ি ফেরার মিথ্যে স্তোক দিয়েই সুমিত’কে নেক্সট ফোনটা করতাম। অদ্ভুত একটা ভাল লাগায় মন ভরে যেত। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে প্রত্যেকবার বলতাম ‘সুমিত আমি আর তুমি কিন্তু একসঙ্গে কাজ করবই, নো ম্যাটার হোয়াট’। অথচ ফোন ছেড়ে দিয়ে মনে হত আমার যত উৎসাহ ওর তার আদ্ধেক ও যেন নেই । পরক্ষনেই ভাবতাম আমি তো আলেজন্ডার দা গ্রেট বা টলেমী নই যে এরিস্টটল আমায় শেখানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠবেন। কিন্তু অনায়াসে মেনে নিতাম সুমিত এরিস্টটল। কথায় কথায় বুঝতাম সুমিত আমার সঙ্গে কাজ নয়, অন্য কিছু একটা বলতে চায় অথচ মন খুলে বলে উঠতে পারে না। আমার জোরাজোরি করার স্বভাব একদম না থাকায় সেই প্রাচীর হয়ত রয়ে গেল। কে জানে। উলটে প্রাচীর গাত্র ভরে উঠতে লাগল আমাদের অবান্তর আলোচনার বুনো লতাপাতায়।
কেটে গেল বেশ কয়েক বছর। কয়েকজন স্বনামধন্য প্রযোজকের সঙ্গে কাজের সুবাদে সামান্য নামডাক হল। গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থান হল সারা বছর ধরে কোন না কোন প্রজেক্টে লিখে; সঙ্গে বৃষ্টি রাতের পারানি – সামান্য সিঙ্গল মাল্টের। আমি আর দেরি না করে পরিবার’কে চটপট মুম্বাই আনিয়ে নিলাম। নিজের বউ’র চরিত্রে আমার অগাধ আস্থার ছিটেফোঁটাও যদি নিজের প্রতি থাকত। তাই একা থাকায় ভরসা না রেখে আমরা সবাই পাকাপাকি ভাবে মুম্বাইকার হয়ে গেলাম।
কিন্তু মাথা থেকে সুমিতের সঙ্গে কাজের ইচ্ছেটা একেবারে গেল না। ততদিনে সুমিত সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। খোঁজ পাই আজকাল টেলিভিশন আর করে না। প্রডিউসারের চাপে একটা দক্ষিনী ফিচার ফিল্মের বাংলা রিমেক করেছিল। ভেবেছিল সেটা দিয়ে বাকি শিঁকে ছিড়বে। কিন্তু না, হয়নি। খবর দেখলাম সুমিত ওয়েব সিরিজ করছে। খুব খুশী হলাম; মুম্বাইয়ে বসে বুঝতে পারছিলাম নেটফ্লিক্স আর অ্যামাজন ওরিজিনালস এর দৌলতে ওয়েব উইল বি দা নেক্সট বিগ থিং।
*
বাঙালী স্ত্রী’দের একটা অসম্ভব গুণ ওনারা যখন যেখানে থাকেন তার থেকে বহু দূরের জীবন মিস করতে শুরু করেন। আমার স্ত্রী যখন কোলকাতায় আর আমি মুম্বাই, তখন মুম্বাইয়ের জীবন ছিল শ্রেষ্ঠ। সেই এক উপপাদ্যে উনি এখন মনে করেন ওনার এই কেজো মুম্বাই মার্কা জীবনের কাছে কোলকাতার থেকে শ্রেষ্ঠ জীবন আর কিছু হতে পারে না। গড়িয়াহাটের থেকেও শ্রেষ্ঠ শপিং ডিস্ট্রিক্ট সৃষ্টি করতে মানুষ কোনদিন কোথাও পারবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। ততদিনে আমার লায়েক হয়ে যাওয়া, কলেজে পড়া ছেলে’কে একলা মুম্বাইতে রেখে মিয়া বিবি এসে কোলকাতার ফেলে যাওয়া তালাবন্ধ ফ্ল্যাটের দখিন খোলা জানালা খুলে দিলাম। অবশ্য বেশিক্ষনের জন্য নয়। আমাদের দক্ষিন খোলা জানালার অনতিদূরে সদ্য নির্মিত একটি ময়লার ভ্যাট আমাদের প্রাণবায়ুকে প্রায়ই শাসিয়ে যেতে লাগল এবং অচিরেই বোঝা গেল আমরা কোলকাতায় ফিরে এসেছি। বন্ধ হল আমার বহু সাধের দক্ষিন খোলা জানালা।
কিন্তু স্থির করে ফেললাম যে করে হোক খুলে ফেলব সুমিতের মনের জানালা। এবার একসঙ্গে কাজ করব।
ফোনে ধরলাম। বললাম শহরে এসেছি। থাকব মাস ছয়েক। কাজ করব তোমার সঙ্গে, ইত্যাদি। সুমিত ধীর গলায় বলল ‘চল তাহলে দেখা করা যাক’। কোলকাতায় যে এত ভাল ভাল কফি শপে এত শস্তায় অ্যামেরিকানো পাওয়া যায় ধারনাই ছিল না। সঙ্গে বাড়তি পাওনা হল প্রতিবার সুমিতের কফি শপের যাবতীয় বিল মিটিয়ে দেওয়া। এই প্রথম সুমিত বলল ‘চল তাহলে কিছু প্রজেক্ট ডেভেলপ করা যাক’। হয়ত ভাবল আমি দশ বছর রাইটার হিসেবে টিঁকে গেছি মানে কত আর খারাপ হব। আমায় একটা সুযোগ হেলা ভরে ও দান করতেই পারে।
বন্ধ দক্ষিন খোলা জানালার দুঃখ ভুলে গেলাম ।
বহু গল্প নিয়ে আলোচনা হল। বুঝলাম সুমিতের আমার গল্প নিয়ে কাজ করার অত ইচ্ছে নেই। তাতে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ হল না। রাগ হল না। পাড়ার প্যান্ডেলের সেই দীর্ঘদেহি পি এইচ ডি দাদার প্রেমে পরা ষোড়শী অবশেষে আজ তার মুখোমুখি। এসব অভিমানের সময় কোথায়? ব্যস্ত হয়ে পরলাম ওর আইডিয়া থেকে নতুন গল্প সৃষ্টির জন্য। জানি সুমিত যা আইডিয়া দেবে সেই গল্প আমার চোদ্দ পুরুষেও ভাবতে পারবে না। সুমিত বলল, ‘একটা জাপানী ছবি আছে ‘শপলিফটার্স’, পরিচালক হিরোকাজু কোরি-এদা। এক বয়স্ক মহিলা তার স্বামী’র পেনসনের টাকায় পুরো পরিবারকে তার নিজের বাড়ীতে পালন পোষণ করেন। এই সামান্য পেনসনের টাকায় সংসার চলে না বলে পরিবারের বাকিরা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সুপার মার্কেট থেকে শপলিফটিং করে। অসাধারণ গল্প। ‘এই গল্পের ইন্সপিরিশনে আমরা একটা ওয়েব সিরিজ বানাব’। কমরেডের আজ্ঞায় লেখা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলাম।
তবে এবার যেন এক নতুন সুমিত’কে আবিষ্কার করলাম। যখন শহর ছেড়েছিলাম সুমিত অবিবাহিত ছিল। এবার কথায় কথায় বুঝতে পারলাম সুমিত বিয়ে শুধু করেনি, তিন বছরের একটা মেয়েও আছে। কান্ড দেখো! এর মাঝে এত বার কথা হয়েছে ফোনে, সুমিত ঘুণাক্ষরেও বলে নি এসব। আর যদি নাও বলে থাকে, বেশ করেছে, কিন্তু এরম পরিস্থিতিতে এতদিন বাদে কারো সঙ্গে দেখা হলে মানুষ তো প্রথমেই বলে ‘আরে জানো তো বিয়ে করে ফেলেছি, তোমায় আর বলা হয়ে ওঠেনি, মা এমন চাপাচাপি করল, ইত্যাদি’। ওটা তো সাধারণ মানুষের স্টাইল, কিন্তু সুমিতের স্টাইলই আলাদা। যেমন কফি শপে বসে আলোচনা করতে করতে হটাত একদিন বলল ‘আজ তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। বউ’কে নিয়ে খেতে যাব’। আমি তাজ্জব। সেই প্রথম শুনলাম ওর বউ আছে। কৌতূহলে পেট ফেটে গেলেও মুখে বললাম ‘আরে নিশ্চই। চল আজ প্যাক-আপ’।
গল্প এগোতে লাগল। সুমিত দু একবার আমার লেখার হাল্কা প্রশংসাও করল। এর মধ্যে এমন একটা পরিস্থিতি হল যে দুজনের কারো একটা বাড়ি বসে কাজটা করতে হবে। কফি শপে বসে আর হবে না। এখন মনে নেই, তবে কি একটা কারনে আমার বাড়ীতে বসাটা আর হয়ে উঠল না। এদিকে সময় চলে যায়। একদিন ওই বলল ‘আমার বাড়িতেই হোক’।
প্রায় দশ বছর বাদে ওর বাড়িতে এলাম। চারপাশে বহুতল উঠে ওদের বাড়িটাকে আরো একঘরে করে ফেলেছে। ভেতরে অনেক জায়গায় পলেস্তরা খসে লোহার কড়িবরগা বেরিয়ে এসেছে। আগে দেখেছিলাম ভাড়াটেদের ছেলেমেয়েদের দাপটে একতলা সব সময় জমজমাট থাকত। এবার সেই উৎসাহ খুব স্তিমিত।
দোতালায় নিজের চাবি দিয়ে লক খুলে সুমিত আমায় ডাকল, ‘এসো’। আমি বাইরে জুতো খুলে ভেতরে গিয়ে দেখি মাসিমা আমাদের দিকে পেছন ফিরে একটা চেস্ট অফ ড্রয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে কি করছিলেন। দরজার আওয়াজে ঘুরে দাঁড়ালেন। আমি দু পা এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করার আগে মাথায় টেনে রাখা কাপড় সামান্য সরে গেল মাসিমার। কেমন যেন কালো হয়ে গেছে মুখটা। বয়েস বাড়লে অনেক সময় এরম হয়। কিন্তু মাসিমার তো অত বয়েস নয়। হাইটেও একটু খাটো লাগল। নিজেই নিজেকে বললাম ‘ধুস.. বাজারী টেলিভিশন ক্রাইম লিখে লিখে এখন সব কিছুই সন্দেহের চোখে দেখার অভ্যাস হয়ে গেছে’। হাসিই পেল। আমি প্রণাম করে ‘চিনতে পারছেন? আমি পরাগ’ বলাতে উনি যেন একটু অপ্রস্তুত হলেন। তাকিয়ে দেখি সুমিত ঢুকে গেছে নিজের ঘরে। পুরনো অভ্যাসের কোন বদল হয় নি।
ধীরে ধীরে গল্প অনেকটা দাঁড়িয়ে গেল। সুমিত বলল একটা ফ্রেশ ড্রাফট কাল ওকে মেইল করে দিতে। ঠিক হল আগামী সপ্তাহে গল্প লক করে আমরা চ্যানেল থেকে ন্যারেশনের জন্য সময় চাইব।
পরদিন সকালে মেইল করে রাতে ফোন করলাম ফিডব্যাকের জন্য। সুমিত বলল বউ আর মেয়েকে নিয়ে মলে এসেছে ডিনার করতে। কল ব্যাক করবে।
রাত এগারো’টা নাগাদ ফোন করল সুমিত। বুঝতে পারলাম পেছনে একটা বাচ্চার খিলখিল হাসি’তে ঘর ভেসে যাচ্ছে। সুমিত বলল ‘মহা বিচ্ছু মেয়ে.. এখন ও কিছুতেই শোবে না.. আমাকে খেলতে হবে’। আমি মহা ব্যস্ত হয়ে বললাম ‘নানা তাহলে থাক.. কাল সকালে কথা বলব’। সুমিত বলল ‘কাজ আগে.. ওর মা ওকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে যাক.. দু মিনিট হোল্ড কর..’ শুনলাম সুমিত রাগারাগি করল; কাকে একটা বলল বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে। এক সময় সব কোলাহল মিটে গেল; এরপর সুমিতের ঈষৎ বিরক্ত গলা ‘হ্যাঁ বলো..’ ।
*
দশমীর দুপুরে আমি আর আমার বউ আর মুম্বাই থেকে আগত পুত্র বাগবাজারে সিঁদুর খেলা দেখে আহিরিটোলা সার্বজনীন দেখব বলে বি কে পাল এভিনিউ’র মুখে এসে দেখি বিরাট জ্যাম। গাড়ির সারথী পরামর্শ দিলেন উনি গাড়ি আশেপাশে পার্ক করে দেবেন, আমরা হেঁটে আহিরিটোলা সার্বজনীন দেখে আসতে পারি। নানান টাল বাহানার পর তিনজন নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। ভাবছিলাম সুমিত’কে গিয়ে একটা সারপ্রাইজ দেব কিনা। এই রাস্তার ওপরেই তো ওর বাড়ি। আহিরিটোলা দেখে ওই পথেই আবার গাড়ির কাছে ফিরে আসার আগে মিষ্টি কিনলাম। বউ’কে রাজি করালাম সুমিতের বাড়ীতে গিয়ে ওকে চমকে দেবার প্ল্যানে।
বাইরের খর রোদ, বিপুল জনস্রোত আর কোলাহল পেরিয়ে সুমিতের ওই স্যাঁতসেঁতে বাড়ীতে ঢুকে সেদিন বাড়িটা যেন আরো নির্বান্ধব, আরও নিঃসঙ্গ লাগল। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে সামান্য কিন্তু কিন্তু করছি এর মধ্যে এক ভাড়াটেদের ঘর থেকে একজন লুঙ্গী আর গেঞ্জি পরা পুরুষ মানুষ বেরিয়ে বোধহয় বাথরুমে যাওয়ার মুখে আমাদের সামনে পরে গেলেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন। ‘কাউকে চাইছেন?’ আমি বললাম ‘সুমিত সান্যাল, আমার বন্ধু। ওর মা, মাসিমার সঙ্গে বিজয়া করতে এসেছি’। ভদ্রলোক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা বুঝি কোলকাতায় থাকেন না? সুমিতবাবুর মা তো প্রায় পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন’। আমার হতবাক অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে আমার স্ত্রী ওনাকে বললেন, ‘তা কি করে হয়? উনি তো এই মাস খানেক আগেও এই বাড়িতে এসেছেন..’ । ভদ্রলোক আমার বিস্ময়াবিষ্ট মুখের দিকে বললেন ‘আপনি যাকে দেখেছেন তিনি সুমিতবাবু’র সব সময়ের কাজের মাসি..’ । এবার আমার প্রচন্ড রাগ হয়ে গেল। আমি বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে ওনাকে বললাম ‘কি যাতা বলছেন। মাসিমা এখনো বেঁচে আছেন। সুমিত বিয়ে করেছে, ওর একটা তিন বছরের মেয়ে আছে। ওর মা’র কাছে রেখে ওঁর স্ত্রী রোজ স্কুলে যান পড়াতে’ । ভদ্রলোক একটু রাগ না করে হেসে বললেন,’ আপনি কি দেখেছেন তাদের কোনদিন নিজের চোখে?’ বলতে বাধ্য হলাম না।
এরপর ভদ্রলোক যা বললেন বিশ্বাস করব নাকি গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেব বুঝে উঠতে পারলাম না। ভদ্রলোকের বয়ানে সুমিতের সঙ্গে সুমিতের মায়ের একটা অপার্থিব যোগ ছিল। সেই মা চলে যাওয়ার পর সুমিত এরকম পাগল হয়ে গেছিল। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে সুমিতের অবস্থার সামান্য উন্নতি হলেও মায়ের অভাব কিছুতেই যেন ও আর ভুলতে পারে নি । নিজেই সেন্টার থেকে মায়ের মত দেখতে একজন আয়া এনে তাকে মা বলা শুরু করে। তারপর ওনাদের কানে আসে সুমিত বলে বেরাচ্ছে ও বিয়ে করেছে, একটা বাচ্চা আছে। এই বাড়ীতে মেইন গেট ভেঙ্গে পরার পর এক বিহারি চৌকিদার রাখা হয়। তার একটা তিন বছরের বাচ্চা মেয়েকে সুমিত মেয়ে বলে ডাকতে শুরু করে। বাচ্চার মায়ের হাজার অনিচ্ছা সত্বেও সুমিত বাচ্চাটাকে নিজের কাছে এনে মাঝে মাঝে রাখে, জামা কাপড়, গিফটের বন্যা বইয়ে দেয়।
আর শোনার সাহস আমার হয়নি। ওই মিষ্টির বাক্স ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বারবার অনুরোধ করে এলাম আমাদের আসার কথা কাউকে বলার কোন দরকার নেই।
*
আমরা যথাসময়ে মুম্বাই ফিরে এসেছি।
একদিন আমার প্রডিউসার বিনতা কাপুর’কে সুমিতের গল্প’টা শোনালাম। বললাম, ‘সচ্চি কাহানি হ্যায়..’ । বিনতা সামান্য চুপ করে থেকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দাদা আপনে ওহ জাপানি পিকচার দেখি হ্যায়? শপলিফটার্স?’
কি করে ভুলি ছবিটার কথা। ওখান থেকেই তো সব শুরু।
এক বয়স্ক মহিলা তার স্বামী’র পেনসনের টাকায় পুরো পরিবারকে তার নিজের বাড়ীতে পালন পোষণ করেন আর ওই সামান্য পেনসনের টাকায় সংসার চলে না বলে পরিবারের বাকিরা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সুপার মার্কেট থেকে শপলিফটিং করে। এদের একটা ‘ক্লোজ নিট’ পরিবার ভেবে দর্শক যে এতক্ষণ ছবিটা দেখলেন, আবেগাপ্লুত হলেন, শেষে বুঝলেন আসলে এরা কেউ কারো ছিল না। কেউ কারো মা, কেউ কারো স্ত্রী, সন্তান, কিচ্ছু নয়। এমনকি স্বামী স্ত্রী ভেবে যাদের মিলন দৃশ্য দেখলেন তারাও স্বামী স্ত্রী নন। কতগুলো প্রান্তিক মানুষ একাকিত্ব আর দারিদ্র থেকে বাঁচতে একটা পরিবার সৃষ্টি করেছিল।
সিনেমা আর জীবন এক করে ফেলা; সুমিতের মতো এমন কাউকে আর কোনদিন দেখিনি।
চটক ভাঙ্গল বিনতার কথায়, ‘দাদা চলিয়ে আপকা ইয়ে স্টোরি ঔর শপলিফটার্স মিলাকে এক ওয়েব সিরিজ বানাতে হ্যায়.. ফটাফট লিখনা চালু কিজিয়ে। আই নো আপনি ফাটিয়ে দেবেন।’ নিজের বাংলায় নিজেই হেসে ফেলে বিনতা।
*
১৮ই জুন, ২০১৯ জগন্নাথদেবের স্নান যাত্রা; পূর্ণিমা ।
What's Your Reaction?

Gunjon is a Kolkata-based writer whose journey has taken him from Bollywood to Southeast Asia, working as a screenwriter for a major production house in Jakarta. His debut Bengali thriller introduces a groundbreaking mother-son duo as investigators, adding a fresh twist to the genre. An avid reader with interests ranging from Astronomy to Zymurgy, Gunjon is equally passionate about fermented foods and beverages from Bengal and the Far East. He delights in spicy Shutki Machh paired with a glass of home-brewed Chhang.