খিদে
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
পনেরো বছর আগে পুরুলিয়ায় বড়ন্তি লেকের ধারে জমি কিনে ফার্ম হাউস বানায় সতীশ। বাদল, স্থানীয় সাওতাল ছেলে সেই বাগান বাড়ির কেয়ার টেকার। দিন বদলের ফলে আজ ফার্ম হাউস হয়েছে রিসোর্ট। সতীশ মত্ত অবাস্থায় বাদলের কাছে বায়না ধরেছে আজ রাতে তার একটা গ্রামের যুবতী নারী চাই। বাদল কি পারবে বাবুর চাহিদার জোগান দিতে ? অভাবের সংসারে বাদল কি কাজটাই ছেড়ে দেবে?
লেখক : রাজ কুমার মুখার্জি
বাদল, অ্যাই বাদল, অ্যাই শালা বাদল, অ্যাই ঢ্যামনা, কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছিস?
তারস্বরে একটানা ডেকে চলেছে সতীশ। সতীশ ঘোষ। সতীশ – “ঐরাবত” রিসর্টের মালিক। রাঢ় বাংলায় পৌষের ঠাণ্ডা জম্পেশ হলেও সতীশের তা মালুম হচ্ছে না। হবেই বা কি করে, কাল মাঝরাতে মদে চুর হয়ে গাড়ি চালিয়ে এসে ঢুকেছে রিসর্টে। সকাল থেকেই ভদকার নেশায় মাতাল।
স্যান্ডো গেঞ্জি, বারমুডা প্যান্ট, হাওয়াই চপ্পল; সারা শরীর যেন সোনার দোকানের বিজ্ঞাপন। গলায় খান দুয়েক সোনার মোটা মোটা চেন, ডানহাতের কব্জিতে রিস্টলেট, হাতের দশ আঙুলে সোনা দিয়ে বাঁধানো নানারকম পাথরের গোটা চারেক আংটি — একতলার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সতীশ।
গতবার সতীশের মদের টালমাটাল অবস্থার শিকার হয়েছিল রিসর্টের ম্যানেজার পলাশ। সেবার তিন ইয়ার বন্ধু জুটিয়ে ফুর্তি করতে এসে রাত আটটার সময় মদের খেয়ালে বাবুর দেশী মুরগী আর স্কচ খাবার শখ চাপলো। গ্রামে রাত আটটায় কোন মুরগির দোকান খোলা নেই। পলাশ অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে একজনকে রাজি করিয়ে দেশী মুরগি জোগাড় করে সাইকেল নিয়ে পাঁচ মাইল দূরের গঞ্জ থেকে একটা হুইস্কির বোতল কিনে এনেছিল। পাতি হুইস্কি দেখে সতীশ রেগেই আগুন। বন্ধুদের সামনে সতীশের মান ইজ্জতে কালি ঢালা। প্রথমে পলাশকে ধমক ধামোক, তারপর সপাটে এক থাপ্পড়। পলাশ চুপ করে চলে যাচ্ছিল। সহ্য হল না। পলাশের মা বোন তুলে বিশ্রী গালাগাল দিতে দিতে পলাশকে হটাৎ এক লাথি কষিয়ে দিল। সেই রাতেই পলাশ নিজের গ্রামে ফিরে যায়, আর কাজে আসেনি, নিজের বকেয়া টাকা নিতেও আসে নি। দুসপ্তাহ পরে নতুন ম্যানেজার আসে — অতনু। বারো ক্লাস অবধি পড়াশুনা, অভাবের সংসার। বাড়িতে ছোট ভাই বছর চোদ্দ বয়স আর বিধবা মা।
সতীশ — উঠতি বড়োলোকের বকে যাওয়া ছেলে। সতীশের বাবা বলরাম ঘোষ, হাতিবাগান বাজারে মাছ বেচত। সেখান থেকে দুটো টাক্সি, একটা বাস, ইঁট – বালি – সিমেন্টের আড়ত। সতীশ কোনরকমে মাধ্যমিক থার্ড ডিভিশনে পাশ করে পড়াশুনার পাট তুলে দিয়ে বাপের ব্যবসায় বসে পড়েছে। বছর পনের আগে ফার্ম হাউস করবে মনে করে একলপ্তে প্রায় চুয়াল্লিশ কাঠা জমি জলের দরে কিনে নেয় পুরুলিয়ার মুরাদি গ্রামে বড়ন্তি লেকের ধারে। তখন বড়ন্তি ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে উঠে নি। পাঁচিল ঘিরে একটা ছোট একতলা বাড়ি বানিয়ে রেখেছিল। মাঝে মধ্যে আসা যাওয়া চলত, তখন থেকেই আঠারোর সদ্য যুবক বাদল এখানের কেয়ারটেকার।
বড়ন্তির পরিচিতি বাড়তে সতীশ ফার্ম হাউসকে বানিয়ে ফেললো রিসর্টে। ছোট একতলা বাড়ী এখন দুতলা। সামনে কাঁচের দরজা – পেরিয়ে এলে রিসেপশন। পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। দোতলায় একটা গোল বারান্দা। ফাঁকা জমিতে ছটা কটেজ, একপাশে ফুলের বাগান, পলাশ গাছ, দেবদারু, ইউক্যালিপটাস। প্রতি ঘরে আধুনিক সরঞ্জাম। ম্যানেজার আর বাদলকে বাদ দিলে আরও তিনজন। তারমধ্যে একজন রাঁধুনি। শীতের চারমাস এখানে লোক আসে তখন বদলরা পুরো মাইনে পায় ছ হাজার টাকা। গরমের আটমাস লোক আসে না তখন মাইনে দেড় হাজার টাকা।
সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি পিছিয়ে পড়া জন জাতির বাস এখানে। রুক্ষ প্রকৃতি চাষের যোগ্য নয়। এক ফসলি জমি তাই কাজের চাইতে মজুর অনেক বেশী। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদহে এদের ঘরে খড়ের চাল শুকিয়ে যায়, বর্ষায় সেই শুকনো চালের ফাঁক দিয়ে জল পড়ে। দারিদ্র্য এখানে ছোট শিশুদের সঙ্গে খেলতে খেলতে ঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়ায় বারো মাস। দুবেলা ভাত জোটানো দায়। তবুও গরমকালে সাঁঝের বেলা অন্ধকারে দুলন্ডি, রাঙাবেলা, মুরাদ্দি গ্রামগুলো থেকে ধামসা মাদলের আওয়াজ ভেসে আসে। লাল পলাশের ঝাঁকড়া মাথায় মহুয়া ফুলের গন্ধ ভেসে যায়। শীতের সময়, আঘ্রাণ মাসের শেষের থেকে যখন কলকাতার বাবু বিবিরা এখানের রিসর্টে ভীড় জমায়, গ্রামের সর্দার, মারান বুড়ো থেকে ল্যাংটো শিশুটা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। বাবু বিবিদের কি সোন্দর পনা রঙ। বিবিগুলানের কি লাল ঠোঁট – যেন পাকা লঙ্কা। কি সব জামা, কাপড়, প্যান্টুল। সেই সময় ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কান মাথায় মোটা কাপড় জড়িয়ে শিবু, বুধো, গণেশ, খোকন কলসী করে খেজুর রস বিক্রি করতে আসে। রিসর্টের ভারী ভারী লোহার মস্ত ফটকের একপাশে অনাহুতের মত দাঁড়িয়ে থাকে। বাবু বিবিরা হাত নেড়ে ডাকলে তবে না ভিতরে যাবে। বাবুরা, বিবিরা, বেটা বিটিরা আহ্লাদ করে খায়, ইঞ্জিরিতে কি সব বলে — ফোটক তুলে মোবাইল।
বাদল — বাদল মাহাতো, দুলন্ডি গ্রামের মানুষ। খেটে খাওয়া, সৎ। সতীশের ঐরাবত রিসর্টে এখন কাজ করে। এখানে লোক এলে গাড়ি থেকে মাল নামানো, ফাই ফরমাশ খাটা, দুপুরে লাঞ্চ – দেশী মুরগীর ঝোল, রাতে চিলি চিকেন – সব সমস্যার সমাধান বাদল। লোক যখন চলে যাচ্ছে, তখনও বাদল। হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বিদায় জানাবে। “আবার আসবেন বাবু” একথাটা বলতে কখনও ভুল হয় না। সদা হাসিমুখ বাদলকে প্রায় সবাই পছন্দ করেন। দুচার জন উন্নাসিক মানুষ আছেন যাঁরা এসব সৌজন্যের ধার ধারেন না। কেউ কেউ যাবার সময় বাদলকে পঞ্চাশ একশ টাকা বখশিস করেন। বাদল সবাইকে ভাগ দিয়ে তবে নিজের ভাগ নেয়।
সতীশ গালাগালি দিতে দিতে রান্নাঘরের পিছনে এলো। বাদল এখানে বসে আলু ছাড়াচ্ছে। কটেজের বাবুরা ফিঙ্গার চিপস সহযোগে বেলা এগারোটায় বীয়ার খাবেন – এ তারই তোড়জোড়।
বাদলকে দেখে সতীশ বলে
— কি বে শালা, শুনতে পাস না, কখন থেকে ডাকছি।
— কাজ করছি তো খেয়াল করি নাই।
— যা বলেছি মনে আছে তো? আজ রাতে আমার চাই, সে তুই কোথা থেকে আনবি তুই জানিস।
— কত্তা আমি বলছিলেম কি নে…….
— চুপ শালা। যদি না আনতে পারিস তো কাল লাথি মেরে দূর করে দেবো।
সতীশ টালমাটাল পায়ে ফিরে যায়। বাদল তাকিয়ে দেখে। মনটা বড় ভার লাগে। কাজটা বাদলের খুব দরকার। এগারো ক্লাসে পড়বার সময় বাপটা জ্বরে ভুগে ওষুধ না পেয়ে মরে গেল। এলাং গুনিন কত ঝাড় ফুঁক করলে – বাপটা বাঁচলো না। পড়া ছেড়ে কাজের ধান্ধায় ঘুরতে ঘুরতে শেষে সতীশের বাগান বাড়ির কেয়ারটেকার। এছাড়া দিনমজুর খেটে মাসান্তে শ’পাঁচেক রোজকার, তাই দিয়ে মা, বোন আর তার নিজের কোনমতে একবেলা চলে যাচ্ছিল। এখন বাদলের সংসার বেড়েছে – সুখে নয় সংখ্যায়। বাদলের বউ অতসী আর ছেলে সত্য। মুরাদ্দী উচ্চবিদ্যালয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে সত্য। সরকার থেকে ইস্কুলে যাবার সাইকেল দিয়েছে, জামা প্যান্ট দিয়েছে, পড়ার বই দিয়েছে, মিড ডে মিল দেয়। বাদলের খুব ইচ্ছে ছেলে লেখাপড়া শিখে বাবুদের মতন মস্ত কেউ একটা হোক। কষ্ট করে ছেলের লেখাপড়াটা চালিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটাও পড়ায় ভালো। মাস্টার গুলো বলে — বেটার নাকি মাথা আছে।
সতীশবাবুর নানারকম বায়না এর আগে বাদল বহুবার মিটিয়েছে। যতই হোক মনিব। ওনার দয়া আছে বলেই না আজ বাদলের পরিবার বেঁচে আছে। বাদল রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মারাং বুরুর উদ্দেশ্যে কপালে হাতজোড় করে প্রণাম করে। মারাং বুরু মুখ তুলে চেয়েছেন বলেই না সত্য কত ভালো লেখাপড়া করছে, গরমে যখন রিসর্টে লোক থাকে না তখন মারাং বুরুর কৃপায় বাদল কিছু না কিছু কাজ পায়। খাল কাটার কাজ কিংবা ইঁট বওয়ার কাজ নয়তো কারো বাড়ি দিন মজুরের কাজ। হোক না মাসে দশ দিন, তবুও তো পায়। হাজার দুয়েক আর সতীশ বাবুর দেড় হাজার, সব মিলিয়ে মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা তো হয়। মারাং বুরু চালিয়ে তো দেন বাদলের সংসার।
অঘ্রানের সংক্রান্তির দিনে যখন টুসু পরব শুরু হয়, বাদলের আনন্দ আর ধরে না। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে – মেয়েমরদেরা আমন ধানের আঁটি মাথায় করে এনে খামারে রাখে। মাটির সরায় চালের গুঁড়ো, তুষ, কাঁড়ুলি বাছুরের গোবর, দুব্বো, হলুদের টিপ দিয়ে সারাদিন ধরে সরাটাকে সাজানো হয়। সাঁঝের বেলা বিটি গুলান, মেয়েমরদ গুলান একসাথে টুসুর গান গাইতে গাইতে সরাখান কুলিঙ্গিতে রেখে বাতাসা, মুড়ি, চিঁড়ে, গুড় দিয়ে দেবতাকে ভোগ দেয়। গ্রামের ঘরে ঘরে মেয়েরা উলু দেয়। শীত তার আসার কথা যে টুসুকে দিয়ে বলে পাঠায়। আবার রিসর্টে লোক আসবে, “ঐরাবত” আলোর মালায় সেজে উঠবে। বাবু বিবিদের আসা যাওয়া লেগে থাকবে — কুন কুন দিন সন্ধ্যায় বাউল দল গাইতে আসবে, কুন কুন দিন তার গ্রাম থেকে পরামনি, আশা, কাইন্দি, হিরিঝিরি, তুরসি এরা সবাই সেজেগুজে বাবু বিবিদের নাচ দেখাতে আসবে। শিবু, বুধো, গণেশ, খোকন যারা সকালে রস বেচতে আসে, তারা মাদল ধামসা নিয়ে আসবে, বাজাবে। নিজের মাটির নাচ, মাটির গান বাবু বিবিরা শুনে আনন্দ পাবে। বাদলের ঘরে আবার একটু টাকা আসবে,। মোটা চালের ভাতের পাতে কোন কোন দিন এক টুকরো ছোট মাছ – সত্য বেটা খেতে খুব ভালোবাসে।
বেলা গড়িয়ে যায়। দুপুর হতে চললো। লাঞ্চের হুড়োহুড়ি লেগে যাবে। সতীশ এখন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। একটু বাদে উঠেই আবার মদ আর বাদলকে গালমন্দ – আবার সেই আবদার। এবারে বাবুর বাদলদের গ্রামের একটা যুবতী মেয়ে আজ রাতে চাই। বাবুর এ বায়না রাখা কি করে যাবে, বাদল ভেবে পায় না। এ তো অধর্ম, পাপ। বাদলের ঘরে নিজের ছোট বোন আছে। গ্রামের মেয়েরা তার বোনের মত। এ কাজ করলে মারাং বুরু ক্ষমা করবেন না। বউ এর সঙ্গে একবার আলোচনা করা দরকার।
এতো বছরের মধ্যে সতীশ বাবু মাত্র চারবার নিজের বউকে সঙ্গে করে এনেছিল। একবার তো ওনার বেটিও এসেছিল। কি সোন্দর দেখতে, যেন লক্ষী প্রতিমা। তখন সতীশ বাবু অন্য মানুষ। কম কথা বলেন, চেয়ার পেতে বাগানে বসে থাকেন, মাঝে মাঝে ফোন করেন, বিকেলে বরন্তির লেকের ধারে হাঁটতে যান বউকে নিয়ে। কোন দিন সকালে গাড়ি নিয়ে বউকে সঙ্গে করে কোথায় চলে যান, বিকেল গড়িয়ে ফিরে আসেন।
দুপুরে বাবু বিবিদের খাওয়ার পাট চুকল। বাদল গুটি গুটি পায়ে সতীশের ঘরে গেল।
— বাবু, অ বাবু, কিছু খেয়ে লিবেন চলেন।
— হুম
— বাবু, দুপুর গড়িয়ে সাঁঝ হতে চললো যে, আপনি চলেন, কিছু খেয়ে লিবেন চলেন।
সতীশ ধড়মড় করে উঠে বসে গেলাসে রাখা বাকি মদটুকু গলায় ঢেলে দেয়।
— কি রে মেয়েছেলে কই? কখন আসবে? তুই এখানে কি করছিস হতভাগা? যা গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে আয়। একরাতে হাজার টাকা দেবো। এতো টাকা একসঙ্গে কখনও দেখেছে তোদের মেয়েছেলে গুলো। যা ভাগ।
বাদল সাইকেল নিয়ে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে। ঘরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। হ্যারিকেনের আলোয় সত্য ইস্কুলের পড়া করবে। দাওয়ায় বুড়ি মা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে সদর পানে তাকিয়ে থাকবে। অতসী গলায় আঁচল পেঁচিয়ে তুলসী তলায় প্রদীপ দিয়ে উলু দেবে। অতসীর একটা শাঁখের খুব ইচ্ছে। ভালো শাঁখের বিস্তর দাম — বাদল কিনে দিতে পারে না। বাদলের বোন কাঠ জোগাড় করে উনুন ধরানোর ব্যবস্থা করবে — চোখের সামনে ছবির মত সব ভেসে ওঠে।
পৌষ মাস শেষ হতে চললো। আর কদিন পরেই টুসু পরবের শেষ — চৌনড়ি, বাউঁড়ি, মকর, আখান। ঘরে উঠি পিঠে হবে। বাউঁড়ি রাতে টুসু কে জাগানোর উৎসব হবে সারারাত ধরে। পরবের গান হবে, বেটাছেলেরা মাদল বাজাবে, ধামসা বাজাবে, বেটিরা সব মাথায় ফুল লাগিয়ে নাচবে, রাতে টুসু ঠাকুরের ভোগ হবে – মুড়ি, জিলিপি, ছোলাভাজা, চিঁড়ে। পরদিন সকালে মুরাদী পাহাড়ের পাশে বড়ন্তি নদীতে ডুব দিয়ে নতুন কাপড় পরবে। দু এক দিনের মধ্যে দুপুরের দিকে যখন রিসর্টে লোক গাড়ি করে গড় পঞ্চকোট বেড়াতে যায়, তখন রঘুনাথপুর বাজার যেতে হবে। মোটে সাত মাইল রাস্তা, ও ঠিক সাইকেল চালিয়ে চলে যাবে। অতসী আর বোনের জন্য দুটো শাড়ি কিনতে হবে, মায়ের জন্য থান, সত্য এবারে বলেছে বাবুদের মত জিন্স লাগবে।
এতো কিছু ভাবতে ভাবতে ঘরে পৌঁছায় বাদল। অতসী কে ঘরে ডাকে। সত্য ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে পড়া করছিল। সত্যকে বলে ” বাবা তু এট্টু দাওয়া পানে যা দিকিন, তুয়ার মার সাথে দুখান কতা আছে।” অতসী ঘুরে ঢুকে চোখ পাকিয়ে বলে ” তুমার কি সাঁঝের বেলা ঢঙ হল না কি?”
বাদল সব কথা অতসী কে বলে, সব গুছিয়ে বলতে পারে না। অতসী জানে সতীশ বাবুর বায়নার কথা। চুপ করে শোনে তারপর বলে
— তুমি এট্টু জিরেন নাও দীকিন। মারাং বুরু আছেন, সব ঠিক হই যাবেক।
দুজনে বেশ কিছুক্ষণ পরামর্শ করে।
রাত প্রায় আটটা, শীতের দিনে রাত আটটা, মনে হয় যেন মধ্য রাত্রি। অতসী খুব সুন্দর সেজেছে। চোখে কাজল, মাথার খোঁপায় পালক, কপালে লাল টিপ – মধ্য যৌবনের রূপ ফুটে উঠেছে। অতসী কে দেখে বাদলের বুকে ড্রিমী ড্রিমী ঢাক বাজতে শুরু করে। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। নিজের বউয়ের ইজ্জত তার মনিবের কাছে বিকিয়ে দিতে হচ্ছে শুধুমাত্র পেটের দায়। অতসী বাদল কে বুঝিয়েছে — গ্রামের মেয়ে বউদের দিয়ে এ কাজ করানো পাপ। টুসু পরবের সময় পাপ কাজ করলে মস্ত ক্ষতি হবে। স্বামীর বিপদের দিনে বউ যদি পাশে না থাকে, তবে কে থাকবে। সত্যর লেখাপড়ার খরচ, সেটার কথা ভাবতে হবে। রাতের আঁধারে যাবে আবার আঁধারে ফিরে আসবে, কেউ জানতে পারবে না। বাদল যেন তাকে ভুল না বোঝে।
বাদল অতসী কে সাইকেলের সামনের রডে বসিয়ে প্যাডেলে চাপ দেয়। বাদলের নিশ্বাস অতসীর ঘাড়ে এসে পড়ছে। কতদিন দুজনা একসাথে মেলায় যায় না। অতসীর খুব ইচ্ছে করে বাদলকে আদর করতে। দূরে ঐরাবত আলোর মালায় সেজে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণিমার আলোয় ভেসে যাওয়া চরাচরের মাঝে সাইকেলে পৃথিবীর দুই আদিম মানব – মানবী,আদম আর ইভ, সংসারের গহীন সাগরে ঝাঁপ দিতে চলেছে।
What's Your Reaction?
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.