কলকাতার দুর্গাপূজা: পৌরাণিক সূচনা, UNESCO স্বীকৃতি ও সার্বজনীনতা
 
						 
			 
		Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks…
২০২১ সালের ডিসেম্বরে, কলকাতার দুর্গাপূজা জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (UNESCO) কর্তৃক মানবতার আবহমান অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (Intangible Cultural Heritage of Humanity) হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই তকমা শুধু বাঙালি সমাজের নয়, গোটা দেশের জন্য এক বিশাল গর্বের বিষয়। এই স্বীকৃতি প্রমাণ করে যে দুর্গাপূজা কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি একটি সার্বজনীন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব—বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বা শারদোৎসব। কলমে স্বপন চৌধুরী
আবারো একটা দুর্গোৎসব এসে গেল, দুর্গাপুজো নয় দুর্গোৎসব বা শারদোৎসব। পুজোর মধ্যে একটা ধর্মীয় অনুষঙ্গ আছে। ধর্ম যার যার কিন্তু উৎসব সবার। শারদোৎসব নামে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। কলকাতার দুর্গাপুজো আপামর বাঙালীর উৎসব। বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব। মানবতার জন্য আবহমান অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এক মানব ঐশ্বর্য।
আমরা অকালবোধনের উল্লেখ পাই কৃত্তিবাস ওঝার বাংলা রামায়ণে যদিও আদিকবি বাল্মীকির রামায়ণে বা রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদসমূহ যেমন, তুলসীদাস রচিত হিন্দি রামচরিতমানস, তামিলভাষায় কাম্ব রামায়ণ, কন্নড় ভাষায় কুমুদেন্দু রামায়ণ, অসমীয়া ভাষায় কথা রামায়ণ, ওড়িয়া ভাষায় জগমোহন রামায়ণ, মারাঠি ভাষায় ভাবার্থ রামায়ণ, উর্দু ভাষায় পুথি রামায়ণ প্রভৃতিতে এমন ঘটনা উল্লেখিত হয় নি। এছাড়াও যোগবাশিষ্ট রামায়ণেও এমন ঘটনার উল্লেখ নেই। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণ তো মাত্রই পঞ্চদশ শতকের রচনা।
বাংলায় দুর্গাপুজো কিন্তু প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো। শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম্-এ দুর্গা ও দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কয়েকটা পৌরাণিক গল্প প্রচলিত আছে। দেবীমাহাত্ম্যম্ আসলে মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর একটি নির্বাচিত অংশ। শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে, সুরথ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরের বর্তমান “সুপুর” (স্বপুর) এর রাজা, মার্কণ্ডেয় পুরাণে এই স্থানটির উল্লেখ আছে। এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে, রাজ্য হারিয়ে রাজা সুরথ জঙ্গলে গিয়ে মেধা ঋষির আশ্রমে আশ্রয় নেন। সেখানেই সুরথের দেখা হয় সমাধি নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। সমাধিও আত্মীয় স্বজনের চক্রান্তে সর্বস্ব খুইয়ে মেধা ঋষির কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
মহামায়ার মাহাত্ম্য বোঝাতে মেধা ঋষি সুরথ ও সমাধিকে তিনটি গল্প বলেন, সেই গল্পগুলিই শ্রীশ্রীচণ্ডী-র মূল আলোচ্য বিষয়। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি মহিষাসুর মর্দ্দিনীর। এই গল্পটি হিন্দুরা এতটাই মান্য করে যে শ্রীশ্রীচণ্ডীর পাঠ দুর্গাপূজার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে।
পুরাকালে মহিষাসুর দেবতাদের যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে, বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাঁকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের কাছে উপস্থিত হলেন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শ্রবণ করে তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। সেই ক্রোধে প্রথমে বিষ্ণু ও শিব ও পরে ব্রহ্মার মুখমণ্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হল। সেই সঙ্গে ইন্দ্রাদি অন্যন্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হল। সু-উচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। এক এক দেবতার তেজপ্রভাবে বহুবর্ণময়ী দেবীর এক এক অঙ্গ উৎপন্ন হল – শিবের তেজে মুখমণ্ডল, যমের তেজে কেশদাম, সন্ধ্যার তেজে ভ্রূযুগল, অগ্নিতেজে ত্রিনয়ন, । প্রত্যেক দেবতা তাঁদের আয়ুধ বা অস্ত্র দেবীকে দান করলেন। হিমালয় দেবীকে তাঁর বাহনরূপে সিংহ দান করলেন। কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়ায় এই দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হলেন। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে দেবী কাত্যায়নী আবির্ভূতা হয়েছিলেন; শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে ঋষি কাত্যায়ন দেবীকে পূজা করেন এবং দশমীতে এই মহাদেবীই অষ্টাদশভুজা জয়া মহালক্ষ্মী রূপে মহিষাসুরকে বধ করেন।
এরপর মেধার পরামর্শে দুজনে মিলে মেধা ঋষির আশ্রমে দুর্গাপুজো করেন। এটিই ছিল পৃথিবীর প্রথম দূর্গাপূজা। বর্তমানে ‘গড় জঙ্গল’ পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর ও আসানসোলের মধ্যে অবস্থিত আর সেখানে মেধা ঋষির আশ্রম আজও আছে। বোলপুরে সুরথ রাজার প্রতিষ্ঠিত সুরথেশ্বর শিব মন্দির ও রয়েছে। দেবী দুর্গার কৃপায় রাজ্য ফিরে পেয়ে সুরথ তার রাজধানী বলিপুরে (বর্তমানের বোলপুর) বাৎসরিক দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন।। সেই পুজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল বসন্তকালে, সেইজন্য একে বাসন্তী পুজো বলে। এই ঘটনা ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের।
এতো গেল পুরান কথা, কিন্তু ইতিহাস কি বলে? প্রচলিত মত হল, বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজা করেন নদীয়ার (এখন রাজশাহী জেলার) তাহেরপুরে রাজা কংস নারায়ণ রায় বাহাদুর। ১৫৮০ সালে পূজা শুরু হয়।
আর একটি মতে, তারও আগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬ – ১৫৩৪) প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে মাটির প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন।
অন্য আর একটি মতে কনৌজের পাঁচ কুলীন ব্রাহ্মণের এক ব্রাহ্মণ সুধানিধির বংশকে ‘ঘোষাল’ উপাধি দেন বাংলার শাসক লক্ষণ সেন। ১৪৫০ সালে সেই সুধানিধি বংশের আশুতোষ ঘোষাল কোন্নগরে আসেন। সেই ঘোষাল বংশের পারিবারিক নথি অনুসারে, কোন্নগরের বাড়িতে ১৪৫৪ সালে বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা হয়।
আবার আরো একটি মতে ১৫০৭ সালে চন্দননগরের খলিসানির বসু বাড়িতে করুণাময় বসু দুর্গাপূজার প্রবর্তন করে। সেই দুর্গাপূজারর বিস্তৃতি ছড়ায় সেই বংশের রামকমল বসুর আমলে। পর্তুগিজদের সঙ্গে ব্যবসা করতেন বলে তাঁকে বলা হতো ‘ফিরিঙ্গি কমল বসু’। রামকমল বসুর নামে আপার চিৎপুর রোডের (বর্তমানে রবীন্দ্র সরণি) বাড়িতে এখন বর্তমানে ‘মাতৃমঙ্গল প্রতিষ্ঠান’ নামে হাসপাতাল রয়েছে।
আরও একটি দাবী মতে, বাংলায় সবার আগে মাটির মূর্তিতে দুর্গাপূজা হয়েছে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরে। তখন মল্লভূমের রাজধানী প্রদ্যুম্ননগরে ছিল। রাজা জগৎমল্ল ছিলেন এই বংশের ১৯ তম রাজা। লোকশ্রুতি মতে তিনি প্রদ্যুম্ননগর থেকে রাজধানী বিষ্ণুপুরে সরিয়ে আনেন এবং ১৫৮৮ সালে মৃন্ময়ী দেবীর মূর্তি পূজা শুরু করেন।
মহিষাসুর মর্দিনীর প্রাণপুরুষ স্বর্গীয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পূর্বপুরুষ এর শেকড় বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী একটি গ্রাম উথলী (প্রাচীন বুড়ন দ্বীপ)।
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের পারিবারিক বংসপজ্ঞী খুজতে গিয়ে কিছু প্রাচীন কাগজ পত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই গ্রামে কোঠাবাড়ি নামক স্থানে ১০৮ টি ঘরের সমন্বয়ে এক বিশাল অট্টালিকা গড়ে ওঠে। সেখানেই প্রথমে শুরু হয় দুর্গাপুজা। একটা তালপাতায় ১০৭৬ বঙ্গাব্দের (১৬৬৯ খ্রীঃ)বাৎসরিক দুর্গাপুজার হিসাব আবিস্কৃত হয়। পুজার মোট খরচ ছিল আট আনা। এখন এটা ৩৫৬ বছরের পুরনো পুজো। এত বছর ধরে প্রতিপদ থেকে দেবী শৈলপুত্রি, দেবী মহাগৌরি, দেবী কাত্যয়নী, দেবী স্কন্দমাতা, দেবী চন্দ্রঘণ্টা, দেবী ব্রহ্মচারিণী, দেবী কালরাত্রি, দেবী সিদ্ধিদাত্রী ও দেবী কুষ্মাণ্ডা এই নয় রুপে নবদুর্গা পুজিত হয়ে আসছেন। কালের বিবর্তনে বড় বড় দালানকোঠা ,হাজার হাজার বিঘা সম্পত্তি হারিয়ে গেলেও এখনো কালের সাক্ষী হয়ে ভদ্রবংসের অস্তমিত শেষ প্রদীপ উথালীর দুর্গা পূজা অলৌকিক ভাবে মাত্র ১১ জন সদস্য এর হাতে টিকে রয়েছে। (তথ্যসুত্র: আবাপ – ১৪/১০/২০২৩)
ইংরাজী ১৬১০ সাল থেকে বড়িশার পারিবারিক বাড়িতে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি বাংলার প্রাচীনতম দুর্গোৎসবগুলির মধ্যে একটি এবং সম্ভবত কলকাতার প্রথম দুর্গাপূজা।
এই পুজো যখন শুরু হয় তখনও কলকাতায় জোব চার্নকের পদার্পণ ঘটেনি। ইংরেজদের প্রচার অনুযায়ী চার্নক ১৬৯০ সালের ২৪শে অগাষ্ট সুতানুটিতে পৌঁছে কলকাতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ইংরাজী সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারায় শিক্ষিত বহু ঐতিহাসিক ও গুণীজন এই মিথ্যাকেই সত্যি বলে মনে করেন। যদিও ২০০৩ সালে কলকাতার উচ্চ ন্যায়ালয়, তাদের নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ ক্রমে, এই মিথ্যাচার খন্ডন করে রায় দিয়েছেন। একটি সমৃদ্ধশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বানিজ্যকেন্দ্র হিসেবে কলকাতার উল্লেখ আছে আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি (১৫৯০ খ্রি.) গ্রন্থে। এছাড়া মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে হুগলি নদীর তীরবর্তী এক বর্ধিষ্ণু বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে কলিকাতা গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় কাব্য (১৪৯৫ খ্রি.), মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিকঙ্কণ চণ্ডী (১৫৯৪-১৬০৬ খ্রি.), সৈয়দ আলাওলের পদ্মাবতী (১৬৪৫–৫২ খ্রি.), কৃষ্ণরাম দাসের কালিকামঙ্গল (১৬৭৬–৭৭ খ্রি.) ও সনাতন ঘোষালের ভাষা-ভাগবত (১৬৭৯–৮০ খ্রি.)। এগুলো সবই ১৭৫৭র আগের।
কলকাতার অবস্থান সম্ভবত আরোও পুরানো। প্রায় তিন হাজার বছর আগে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমনের সময় বঙ্গোপসাগরের তীরে গঙ্গার মোহনায় এক অতি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল, গঙ্গাহৃদি। এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল কলকাতা থেকে মাত্র ৩০ মাইল দুরে, গঙ্গার দুই প্রধান স্রোত পদ্মা ও ভাগীরথীর মধ্যবর্তী, দ্বিগঙ্গা (বর্তমানে দেগঙ্গা)। নৌ বানিজ্যে পারদর্শী গঙ্গাহৃদির বণিকদের সমুদ্রযাত্রার একটি পথ, ভাগীরথীর নদীপথ, কোলকাতা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়তো। এই পথেই হয়তো ভগীরথ পৌঁছেছিল গঙ্গাসাগরে কপিলমুনির আশ্রমে। গঙ্গাহৃদির সাতশো হাতির ঠিকানা ছিল বর্তমানে নিউটাউনের অদুরে হাতিশালা। হ্যাঁ, কলকাতা এতটাই প্রাচীন।
সম্প্রতি ‘কলকাতার দুর্গাপূজা’ হেরিটেজ তকমা পেয়েছে। ১৫/১২/২০২১ এ প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) আবহমান বিশ্ব সংস্কৃতি রক্ষা সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি কমিটির ষোড়শ সম্মেলনে কলকাতার দুর্গোউৎসবকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ তথা ‘মানবতার জন্য আবহমান অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। সহজ কথায়, কলকাতার দুর্গাপূজা ‘হেরিটেজ’ উৎসবের তকমা পেয়েছে।
অধরা বা ইনট্যানজিবল (Intangible) মানে যা স্পর্শের অতীত। অর্থাৎ যার কোনও স্পর্শযোগ্য চেহারা নেই, যার শুধু প্রকাশ দেখা যায়। কোনও উৎসব, কোনও রীতি কিংবা লোককথা, সঙ্গীত কিংবা খাদ্য সংস্কৃতি– এ সবও ঠিক স্পর্শ করে দেখা যায় না, অনুভব উৎযাপন বা প্রকাশ করে তুলতে হয়। পৃথিবী জোড়া ছড়িয়ে থাকা এমন হাজারো মণিমুক্ত থেকেই ইউনেস্কো তাদের ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের তালিকা বানায়, বাড়ায়ও। অনন্য সাধারণ ঐহিত্যের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই এই কাজটি তারা করে থাকে। কারণ, তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী, এ সব হল হিউম্যান ট্রেজার– মানব-ঐশ্বর্য।
এ ছাড়াও রয়েছে ট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ-এর তালিকা। মানে কোনও পুরোন মূর্তি কিংবা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, যা গোদা ভাবে স্পর্শযোগ্য, তাকে ফেলা হয় এর মধ্যে। যেমন তাজমহল।
ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি তালিকায় ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৯২টি এন্ট্রি রয়েছে। এর মধ্যে ২০২১’এ যুক্ত হয়েছে ৩১টি। ইউনেস্কো জানিয়েছে, এর মধ্যে ১৩টি ভারতের। কলকাতার দুর্গাপূজা ছাড়া ওই তালিকায় এ দেশের আর যা রয়েছে, সেগুলি হলঃ
১) কেরলের কুটিয়াট্টম সংস্কৃত নাটক (২০০৮),
২) রামলীলা (২০০৮),
৩) বৈদিক মন্ত্র (২০০৮),
৪) গাড়োয়ালের রাম্মান উৎসব (২০০৯),
৫) পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ (২০১০),
৬) রাজস্থানের কালবেলিয়া নাচ (২০১০),
৭) কেরলের মুদিয়েট্টু নাচ (২০১০),
৮) লাদাখের বৌদ্ধ মন্ত্র (২০১২),
৯) মণিপুরের সংকীর্তন (২০১৩),
১০) পঞ্জাবের জান্দিয়ালা গুরু-র তামা-পিতলের বাসন নির্মাণ সংস্কৃতি (২০১৪),
১১) পার্শীদের নওরোজ (২০১৬) ও
১২) কুম্ভমেলা (২০১৭)
ইউনেস্কোর ঘোষণার পরপরই সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় পড়ে যায়। অনেকেই নানাজনকে এই প্রাপ্তির কৃতিত্ব দিতে উঠেপড়ে লাগে। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় শ্রীমতী তপতী গুহঠাকুরতার নাম।
একদা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপিকা তপতী দেবী Centre For Studies In Social Sciences -এর ডিরেক্টর। ২০০৩ সাল থেকেই তিনি দুর্গোৎসব নিয়ে গবেষণা করে আসছিলেন। ২০১২ সালেই তিনি দুর্গাপুজোর হেরিটেজ সম্মানের জন্য আবেদন করেছিলেন, কিন্তু তা গ্রাহ্য হয়নি।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা তথা ইউনেস্কোর (UNESCO) পুরো নাম United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization। United Nations বা জাতিসংঘ একটি আন্তরাষ্ট্রিক সংগঠন। সেই কারনেই, কোন ব্যক্তিবিশেষের আবেদন ওদের কাছে গ্রহনযোগ্য নয়। শুধুমাত্র কোন সদস্য রাষ্ট্রই এই আবেদন করতে পারে।
২০১৮ সালে রাজ্য সরকার নতুন করে উদ্যোগ নেয় কলকাতার দুর্গাপুজোর হেরিটেজ তকমা পেতে। যেহেতু ভারত সরকারই এই ব্যাপারে আবেদন করতে পারে সেইজন্যই কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করে। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর এই ব্যাপারে তথ্যপঞ্জী তৈরী করার বরাত দেয় তপতী গুহঠাকুরতাকে।
তপতী দেবী রাজ্য সরকারের পূর্ণ সহযোগিতায় কুড়িটি স্থিরচিত্র ও রেড রোডের কার্নিভালের একটি ভিডিও সহযোগে তথ্যপঞ্জী তৈরী করে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরে জমা দেন। এরপরেই কেন্দ্রীয় তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দূর্গাপূজার জন্য আবেদনপত্র জমা করে।
একদিকে যেমন দুর্গা পুজো বাঙালীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক, অন্যদিকে তেমনই পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে দুর্গা পুজোর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দুর্গাপুজোয় প্রায় ৮০০০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। ওই পরিমাণ ব্যবসা করতে লক্ষ কোটি খরচ করে বেশ কয়েকটি বড় শিল্প গড়তে হবে। ওই পরিমাণ ব্যবসার জন্যে GST বাবদ সরকারের আয় হয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। ঐ পুজোগুলোতে কাজ পায় প্রায় এক লক্ষ মৃৎশিল্পী, পাঁচ লক্ষ মন্ডপশিল্পী, দুই লক্ষ বিদ্যুৎশিল্পী, এক লক্ষ ঢাকি, ৫০০০০ পুরোহিত। এর বাইরেও আরো অসংখ্য মানুষ যারা উপকৃত হন যেমন চা বিক্রেতা, এগরোল বিক্রেতা, ফুচকা বিক্রেতা, ঘুগনি বিক্রেতা এমন সমস্ত অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এই বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের ব্যবসা বাড়ানোর লক্ষ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার কর্পোরেট ফান্ডিং হয়।
পরবর্তী পর্যায়ে এল ক্লাব গুলোকে আর্থিক অনুদান এবং বিভিন্ন ধরণের ছাড় দেওয়া। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে সব সময় ক্লাবগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর সরকারের এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে দুর্গা পুজোকে ঘিরে উন্মাদনা এবং প্রচার বৃদ্ধি পেয়েছে। যে ফর্মটি ইউনেস্কোকে জমা দেওয়া হয়েছিল সেখানে এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে এই ফর্মটি আজও বিদ্যমান।
২০১৬ তে রাজ্য সরকার শুরু করলেন রেড রোডে বিসর্জন শোভাযাত্রার আয়োজন। এর ফলে দুর্গা পুজোকে ঘিরে উন্মাদনা এবং প্রচার বৃদ্ধি পেল। এই বিষয়টিও আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুর্গা পুজোর ব্যাপ্তি যাতে বৃদ্ধি পায়ে তার জন্যে ২০১৮ সালেই লন্ডনের ন্যাশনাল থিয়েটারে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে যৌথভাবে কলকাতার দুর্গা পুজোর ওপর একটি এক্সিবিশনের আয়োজন করা হয়। এই বিষয়টিও আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
EXHIBITION FEATURING DURGA PUJA FESTIVAL IN LONDON
২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে যৌথভাবে একটি সমীক্ষা করে রাজ্যের অর্থনীতিতে দুর্গা পুজোর সঙ্গে যুক্ত সৃজনশীল শিল্পের (creative economy) অবদান বোঝার জন্য। এই রিপোর্টটি ব্রিটিশ কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে পেয়ে যাবেন।MAPPING THE CREATIVE ECONOMY AROUND DURGAPUJA- A REPORT BY THE BRITISH COUNCIL ইউনেস্কোতে জমা দেওয়া আবেদনপত্রে এই বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
ইউনেস্কোর Intangible Cultural Heritage of Humanity-এর স্বীকৃতি পেতে গেলে, যেই জিনিসটির জন্যে স্বীকৃতি দাবী করা হচ্ছে তাঁর সঙ্গে যুক্ত সমস্ত পক্ষের অনুমতি পত্র আবেদন পত্রের সঙ্গে জমা করতে হয়। কলকাতার দূর্গা পুজোর সমর্থনে এমন ১৭৯টি পত্র জমা দেওয়া হয়েছিল। ওই ১৭৯টি পত্রের মধ্যে প্রথম পত্রটি কিন্তু রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল।
দুর্গা পুজোর সময় শহরে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। সারা রাত ধরে ঠাকুর দেখা চলে। যাতে পুরো বিষয়টি সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয়, কোনো ধরণের বিপত্তি না ঘটে, সেই দিকে সতর্ক নজর রাখে পুলিশ ও প্রশাসন ভীড় নিয়ন্ত্রণ। এই বিষয়টিও আবেদন পত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল।
এই স্বীকৃতি লাভ অনেক মানুষ ও সংস্থার যৌথ উদ্যোগের ফল। কারুর অবদানকে ছোট করা উচিত না। তবে অবশই রাজ্য সরকার ও অধ্যাপিকা তপতী গুহ-ঠাকুরতার নাম সবথেকে উল্লেখযোগ্য। সেই কারণেই লাখো মানুষের চোখের সামনে, ইউনেস্কোর প্রতিনিধিদের সামনে, অসংখ্য বিশিষ্ট জনদের সমক্ষে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তপতী গুহঠাকুরতাকে ত্রিবর্ণরঞ্জিত উত্তরীয় পরিয়ে বরন করেছেন।
পুজো উদ্যোক্তাদের সরকার থেকে আর্থিক অনুদান দেওয়ার অনেকেই বিরোধী। তারা মনে করেন সরকারের দেওয়া অনুদানের টাকায় ক্লাবের ছেলেরা মোচ্ছব(?) করবে। আসলে তারা জানেন না ঐ টাকায় কারা উপকৃত হন। তারা জানেন না সেইসব মৃৎশিল্পীদের কথা, যারা অমানুষিক পরিশ্রমে ও অনায়াস দক্ষতায় মৃন্ময়ী মূর্তির মধ্যে ফুটিয়ে তোলেন অনবদ্য শৈল্পিক সুষমা। জানেন না গ্রামের সেইসব মন্ডপশিল্পীদের কথা, শুধু সূচিকর্মের সাহায্যে, যারা সৃষ্টি করেন অসামান্য সব মন্ডপ। জানেন না সেইসব বিদ্যুৎশিল্পীদের কথাও, পারম্পরিক জ্ঞানের সাহায্যে, যারা সারাবছর ধরে তৈরী করেন তাদের শিল্পকর্ম, মন্ডপে মন্ডপে আলোর খেলা দেখাবার জন্য। তারা চেনেন না সেইসব দরিদ্র ঢাকিদের, যারা নাবালক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পাঁচদিন ধরে ঢাকের বোলে মাতিয়ে রাখেন পূজামন্ডপগুলো। কারণ ঢাকি জানে পুজোর শেষে দানের শাড়িটা নিয়ে ঘরে ফিরলে তার গাঁয়ের বধুর গায়ে উঠবে একটা নতুন কাপড়। বিরোধীরা জানেন না সেই গরীব ব্রাহ্মণদের, যরা পাঁচদিন ধরে শুধু ফল, মূল আর মিষ্টি খেয়ে স্বাত্ত্বিকভাবে পুজো করে আমাদের জন্য কামনা করেন,
“নমঃ আয়ুর্দ্দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতি দেহি মে | পুত্রান্ দেহি ধনং দেহি সর্ব্বান্ কামাশ্চ দেহি মে ।।”
তাঁরা আরও কামনা করেন,
“হর পাপং হর ক্লেশং হর শোকং হরাসুখম্ | হর রোগং হর ক্ষোভং হর মারীং হরপ্রিয়ে ।। “
এতকিছু কি ঐটুকু অনুদানের টাকায় হয়?
অনেকেই বলেন, “দূর্গাপূজোকে উৎসবে রূপান্তরিত করা হয়েছে, আড়ম্বড়ের দিকটা বেশী করে দেখা হয়, দেখানো হয় । কিন্তু আসলে তো দূর্গাপূজো হিন্দুদের ঐতিহ্য”। তারা ঠিকই বলেন, আমরা বাঙালিরা বলি দুর্গোৎসব, বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব। এটা শুধু হিন্দুদের নয়, বাঙালীর দুর্গোৎসব সার্বজনীন। ইউনেস্কো কলকাতার দুর্গাপূজা উৎসবকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ তথা ‘মানবতার জন্য আবহমান অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ বলেছে। তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী, এ হল হিউম্যান ট্রেজার– মানব-ঐশ্বর্য। মানবতার এই ঐতিহ্যকে শুধুমাত্র ‘হিন্দুর ঐতিহ্য’ বলে সংকুচিত করা উচিত নয়। এই উৎসব ইনট্যানজিবল (Intangible) মানে যা স্পর্শের অতীত, এ শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। হেরিটেজ তকমা পাওয়ার পর, রেড রোডে ‘ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন’ অনুষ্ঠানে, মহমেডান ক্লাবের মুসলমান সম্পাদক যখন ইউনেস্কোর খ্রীস্টান প্রতিনিধিদের দুর্গামূর্তি উপহার দিয়ে সম্বর্ধনা জানান তখন তা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে, গর্বে ভরে ওঠে আমাদের বুক, আমাদের দুর্গাপুজো তখনই হয়ে ওঠে মানবতার সার্বজনীন দুর্গোৎসব । রবিঠাকুর, আমার প্রাণের ঠাকুর, বলেছেন, “সংসারে প্রতিদিন আমরা যে সত্যকে স্বার্থের বিক্ষিপ্ততায় ভুলিয়া থাকি উৎসবের বিশেষ দিনে সেই অখণ্ড সত্যকে স্বীকার করিবার দিন – এইজন্য উৎসবের মধ্যে মিলন চাই। একলার উৎসব হইলে চলে না।”
What's Your Reaction?
 
	Swapan Chowdhury is a retired senior banker and a stocks trade analyst. In the course of his job, he had been posted all across the eastern and northeaster states. He has a great passion for writing. He has written many deeply touching stories about the common men and women he got to meet during his tenure. He is also a specialist contrarian amateur historian especially on issues like the history of Bengal and of the Bengal Renaissance.
 
		