Now Reading
উঠলো বাই তো বিষ্ণুপুর যাই

উঠলো বাই তো বিষ্ণুপুর যাই

Avatar photo
বিষ্ণুপুর
+8
View Gallery

বিষ্ণুপুর ভ্রমণের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। রাসমঞ্চ, জোড়-বাংলা মন্দির, বালুচরী শাড়ির ইতিহাস, পোড়ামাটির হাট, এবং সাঁওতাল নৃত্যের সঙ্গে প্রকৃতির টান। জানতে পারবেন বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্য, মন্দির স্থাপত্য, এবং সংস্কৃতির বৈচিত্র্য। কলমে: রাজ কুমার মুখার্জী

উঠলো বাই তো………….না কটক নয়, বিষ্ণুপুর যাই। বেশ অনেকদিন বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে মন বড়ই চঞ্চল হয়ে গেছে। বাইরে যাবার হাতছানি কে উপেক্ষা করা খুবই কঠিন। রিটায়ার্ড, আয় বলতে ব্যাংকে জমানো সঞ্চয়ের সুদ। বেসরকারি অফিসে কেরানী ছিলাম, পেনশন কিছুই পাই না। পকেটে হাতড়ে মনে হল কাছে পিঠে দু-একদিনের জন্য ঘুরে আসা যেতেই পারে। শনিবারের রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস এর সেকেন্ড ক্লাসের দুটো টিকিট কেটে ফেললুম। সকাল সাড়ে ছটায় সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়বে, সকাল সাড়ে ন’টায় বিষ্ণুপুর।

স্টেশনে ট্রেনে উঠে বসে আছি, নির্দিষ্ট সময়ে পেরিয়ে গেল, তবুও ট্রেন নড়ে না। পরে জানলুম নলপুর স্টেশনে সেকেন্দ্রাবাদ-হাওড়া ডিরেল হয়েছে। ট্রেন ছাড়তে দেরি হবে। অনেকেই নেমে গেলেন, আমরা দুই বুড়ো বুড়ি বসে রইলাম। চার ঘন্টা দেরি করে ট্রেন ছাড়লো; বিষ্ণুপুর পৌঁছালো বেলা তিনটে, প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা লেট। বর্তমান সরকার বাহাদুর ‘বন্দেভারত’ নিয়ে এত বাহাদুরী দেখায় যে অন্য কোন ট্রেন আর সময়মতো চলে না। রেলের রক্ষণাবেক্ষণও তথইবচ। রোজ কোথাও কিছু একটা গোলমাল লেগেই থাকে।

যাক সে কথা। বিষ্ণুপুর নেমে বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা হোটেলে ঘর নিলাম। দু রাত থাকবো, আজকে তো কিছুই দেখা যাবে না। কাল সারাদিন টো টো কোম্পানি।

আমরা সাধারণত বেড়াতে গেলে হোটেল কেমন, খাবারের মেনু কি – এসব নিয়ে এত মাথা ঘামাই না। পরিষ্কার থালায় নিরামিষ ভাত, ডাল, সবজি পেলেই চলবে। হোটেলের ঘর নিয়েও খুব একটা খুঁতখুঁতুনি থাকে না। কারণ রাতে থাকার জন্য এবং সকালে বাথরুমের জন্য হোটেল লাগে, বাকি সময় তো ঘুরবো। ওই যে বলে না “ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দির” – কতকটা সেই রকম।

হোটেলের স্নান ছেড়ে চারটের সময় এক থালা ভাত খেয়ে একটা টোটো নিয়ে এসে পড়লাম পোড়ামাটির হাটে। শনিবার রবিবার, সপ্তাহে এই দুদিন হাট বসে। পোড়ামাটির ঘোড়া, সরস্বতী, গণেশ, কাপডিশ, জলের বোতল, ঘর সাজানোর সামগ্রী, বাঁকুড়ার গামছা থরে থরে সাজানো। পোড়ামাটির গহনা এবং তার উপর রং তুলির কাজ চোখে পড়ার মতো।
সূর্যের আলো নিভে গেছে, মাঠ জুড়ে অন্ধকার। যাঁরা মাটিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে পসরা নিয়ে বসে আছেন, তাঁদের মাথায় দড়িতে ঝোলানো ব্যাটারির আলো। আধো অন্ধকারে মাদলের আওয়াজ। সাঁওতাল ভাইরা ধামসা বাজাচ্ছেন, সঙ্গে নাচছে সাঁওতাল বোনেরা। মাটির টান বড় আপনার, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের নাচ দেখলাম। ইঁট, কাঠ, কংক্রিটের জঙ্গল থেকে প্রকৃতি স্বাদ কখনো পাই না। এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। বেশ অনেকক্ষণ বাজনা শোনা ও নাচ দেখা হল। একই ছন্দে, একই তালে বাজনা ও নাচ।

হাতে এখনো বেশ কিছুটা সময়। একটা টোটো ভাড়া করে চলে এলাম তাঁতিপাড়ায়। এখানে বালুচরী, স্বর্ণচরী শাড়ি বোনা হচ্ছে। অপূর্ব সুতোর কাজে ভরা বালুচরী শাড়ি, জরির সুতোর কাজ করা মিনেকারি স্বর্ণচরী শাড়ি। আমার স্ত্রী বলছিলেন যে বালুচরী স্বর্ণচরী শাড়িগুলো এখানে সাত হাজার টাকা দাম বলছে, কলকাতায় সেগুলো এগারো-বারো হাজারের নিচে পাওয়া যায় না। দেখলাম তসর, ঘিচা, কাতান, বিষ্ণুপুর সিল্ক।
এখানে বালুচরী শরীর শাড়ির একটা ইতিহাস না বললে বোধহয় সবটা বলা হয় না। প্রায় তিনশ’ বছর এর কিছু সময় আগে, তখনও ঢাকাই মসলিনের প্রসার ঘটে নি, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে বয়ন শিল্পকে নিয়ে আসেন। মুর্শিদাবাদ এর কাছে বালুচর গ্রামে এই শাড়ি বোনা হতো। সেই গ্রামের নাম অনুসারে বালুচরী শাড়ি। গঙ্গার বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গ্রামটি তলিয়ে যায়। পরবর্তীকালে বিষ্ণুপুর ও তার চারপাশের অঞ্চলে এর বিস্তার ঘটে। ব্রিটিশ রাজত্বকালে রাজনৈতিক কারণে এই শিল্প নষ্ট হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে শুভ ঠাকুরের উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় আবার এই শিল্পের পুনরুত্থান ঘটে।

আজ রবিবার, আমাদের বেড়ানোর দ্বিতীয় দিন। রাজু, আমাদের অটোচালক, সকাল আটটায় হোটেলে এসে হাজির। আমাদের সঙ্গে কথা হয়েছে বিষ্ণুপুর ঘুরিয়ে দেখাবে ঘন্টায় দুশো টাকা। এতে আমাদের ভালই হলো, আমরা বেশ অনেকটা সময় নিয়ে ভালো করে সব মন্দিরগুলো ঘুরে দেখতে পারবো।

প্রথমে এলাম রাসমঞ্চ। মল্লরাজ বংশের প্রথম রাজা আদি মল্ল। তাঁরই উত্তর পুরুষ দশম মল্লরাজ জগৎ মল্ল তার রাজ্য বিষ্ণুপুরের স্থানান্তরিত করেন। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা হাম্বির তৈরী করেন রাসমঞ্চ। এর গঠনশৈলটি অনেকটা পিরামিডের মতন। মূল মঞ্চের সঙ্গে চারদিক জুড়ে বারান্দা, অনেকটা লক্ষনৌয়ের ভুলভুলাইয়ার মতন। আর্চের পর আর্চ। প্রতিটি আর্চের গঠন তিন রকমের পোড়ামাটির ইঁট দিয়ে বানানো। পাতলা, অপেক্ষাকৃত মোটা এবং আরো মোটা ইঁট, সুড়কির গাঁথনি। গর্ভগৃহে কোন বিগ্রহ নেই। পুরো চত্বরটা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে। বিষ্ণুপুরের প্রায় সব মন্দির এরাই রক্ষণাবেক্ষণ করেন। রাজা হাম্বির এর কাছে বৈষ্ণব গুরু শ্রীনিবাস গোস্বামী এসেছিলেন। রাজা শ্রীনিবাস গোস্বামীর কাছে দীক্ষিত হন। রাসমঞ্চের গেটের বিপরীত দেয়ালে সে ছবি আঁকা আছে। আছে বৈষ্ণব পদকর্তার পদাবলীর অংশ বিশেষ।

দেখলাম জোর শ্রেণি মন্দির। পোড়ামাটির হাটের পিছনে একই প্রাঙ্গণে তিনটি মন্দির। মহারাজ কৃষ্ণ সিংহ ১৭২৩ সালে এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করেছিলেন। একই স্থাপত্য কলার নিদর্শন বহন করে, তবে তাদের প্রত্যেকে একে অপরের থেকে আলাদা। মন্দিরগুলির গায়ে পোড়ামাটির কাজ মুগ্ধ করে। বেশিরভাগ কাজই রোদ জলে নষ্ট হয়ে গেছে, যেটুকু বর্তমান-সেটাই অনেক।

চলতে চলতে পথে পড়ল ছিন্নমস্তার মন্দির। পুজোর জন্য ডালার দোকানি ডাকাডাকি করছিলো। দেব ও দ্বিজে আমার ভক্তি কম তাই ও পথে না হেঁটে চলে এলাম ‘দলমাদল’ কামান দেখতে। ‘দলমাদল’ শব্দের অর্থ ‘শত্রু ধ্বংস’। ইতিহাস বলে ১৭০০ শতকে রাজা গোপাল সিংহের রাজত্বকালে ভাস্কর রাওয়ের নেতৃত্বে মারাঠারা বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে। সেই সময় গোপাল সিংহের ছেলে এই কামানটি ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু গোপাল সিংহের ছেলে সে কথা অস্বীকার করেন। প্রচলিত আছে স্বয়ং মদন মোহন দেব বিষ্ণুপুর কে রক্ষা করতে এই কামান দাগেন। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার এই কামানটিকে লালবাঁধের ধারে অর্ধেক পোঁতা অবস্থায় পায়। সেখান থেকে তুলে এনে শহরের মধ্যে স্থাপন করে। ঢালাই লোহার কামানটির গায়ে কোথাও মরচে ধরে নি। ফার্সী ভাষায় কামানটির গায়ে কিছু লেখা আছে।

জোড়-বাংলা মন্দির বিষ্ণুপুরের এক ঐতিহ্য বহন করে। দুচালার এক জায়গায় মিলন। ১৬৫৬ সালে রঘুনাথ সিংহ এই মন্দির নির্মাণ করেন। গায়ে পোড়ামাটির কাজ। রামের হরধনুভঙ্গ, লক্ষণের সুর্পনাখার নাক কেটে দেওয়া, শ্রীকৃষ্ণের লীলা ইত্যাদি কাজ নজর কাড়বেই।

কলকাতায় শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো বা হাটখোলার দত্ত বাড়ি দুর্গাপুজোকে প্রাচীন দুর্গাপুজো বলে ধরা হয়। এখানে দেখলাম মৃন্ময়ী মন্দির, স্থাপিত ৪০৪ বঙ্গাব্দে। এখন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১০২৭ বছরের পুরনো দুর্গাপুজো। মন্দিরে একটা ছোট কামান রাখা আছে। প্রতিবছর সন্ধিপুজোর আগে এই কামান রাজবাড়ির টিলার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে এই কামানে তোপ দাগা হয়।

দেখলাম বিরাট জলাশয় লালবাঁধ, রামকৃষ্ণ মিশন। এক সময় এই জলাশয় বিষ্ণুপুরের একমাত্র জলের উৎস ছিল।

এবার এলাম গড় দরজা দেখতে। গড় দরজা, রাজবাড়ি প্রবেশের মূল ফটক। এক সময় রাজবাড়ির চারপাশে পরিখা কাটা থাকতো। পরিখা কে ঘিরে থাকতো বিশাল উঁচু মাটির দেওয়াল। রাজবাড়ির দরজায় পৌঁছাতে গেলে বেরিয়ে আসতে হতো কাঠের পাঠাতন। সেই পাঠাতন তুলে রেখে রাজবাড়িকে সুরক্ষার বলয় মুড়ে রাখত সৈন্যদল। গড় দরজার দেওয়ালে তির্যক গর্ত, সেখান দিয়ে নজর রাখা হতো কে বা কারা ওই পথে আসছে। সরু পথের দুদিকের দেওয়ালে চোরা খোপ। শত্রু কোনক্রমে প্রবেশ করলে খোপ থেকে বল্লমের খোঁচায় প্রাণ দিতে হতো। খোপের নিচে সুড়ঙ্গ পথ।

আমাদের সারথী রাজু, খুব যত্ন করে প্রতিটি মন্দির ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল। বলেই বসল “সবাই আসে, দেড় দু ঘন্টার মধ্যে সব দেখে, সেলফি তুলে চলে যায়। আপনাদের মতন এত খুঁটিয়ে কেউ দেখেনা।” বুঝলাম না, ও আমাদের প্রশংসা করছে, না প্যাঁক দিচ্ছে!

এবারে দেখতে গেলাম নন্দলাল, কালাচাঁদ মন্দির। কালাচাঁদ মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর নগরকীর্তনের মূর্তি দেয়ালের গায়। সবই পোড়ামাটির কাজ।

শ্যামরায় মন্দির। ১৬৪৩ সালে রাজা রঘুনাথ সিংহ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির, অনেকটা এরই আদলে তৈরি। এই মন্দিরের গায়ের কাজ বেশ পরিষ্কার। বিষ্ণুপুরে বালুচরী শাড়ির কাজের মতনই সুক্ষ। মন্দিরের গায়ে কোথাও অর্জুনের লক্ষ্য ভেদ, হরধনুভঙ্গ, শৃঙ্গাররত নারী, মৃগয়া ইত্যাদি বহু কাজ দেখার মতন। ধাপে ধাপে কাজগুলি করা। কোনার্কের সূর্যমন্দির এর কাজ বা খাজুরাহের মন্দিরে কাজ পাথর কেটে করা, এখানে মাটির মূর্তি গড়ে আগুনে পুড়িয়ে করা। এই মন্দিরের ওপরে ওঠা যায় না, শিকল দিয়ে চারিপাশে ব্যারিকেড করা, বাইরে থেকে দেখতে হয়।

দুপুর সাড়ে বারোটা বেজে গেছে, অটোর সারথি রাজুকে বললাম জয়পুর জঙ্গলে নিয়ে যাবে? পথে কোথাও না হয় চা খেয়ে নেব। রাজু এক কথায় রাজি। চললাম জয়পুর জঙ্গল দেখতে। বিষ্ণুপুর শহর ছাড়িয়ে ১০ কিলোমিটার দূরে জঙ্গল। রাজু বলছিল জঙ্গল ছাড়িয়ে গেলে বনলতা রিসোর্ট, সবাই সেখানে বেড়াতে যায়, ওখানে লাঞ্চ করে। আমরা বললাম না না রিসোর্ট নয়, জঙ্গলে চলো। হাইওয়ে ছেড়ে ডানদিকে সরু পথ ধরে কিছুটা গিয়ে জঙ্গলের লাল মাটির পথ ধরে ধুলো উড়িয়ে ছুটতে লাগলো আমাদের অটো। রাস্তা মোটেই ভালো নয়, ঝাঁকুনি খেতে খেতে চললাম। মাঝে মাঝে দু চার ঘর সাঁওতাল বাড়ি। বেশ অনেকটা যাবার পর দেখলাম ইলেকট্রিক তার দিয়ে জঙ্গল ঘেরা। কারেন্টের তারের ভিতর সাঁওতাল গ্রাম। এরা ভূমিপুত্র, সত্যিকারের ভূমিপুত্র। জঙ্গল নির্ভর জীবন। এরা জঙ্গল ছেড়ে যাবে না। জঙ্গলের হাতির আক্রমণ থেকে গ্রামকে বাঁচাতে এই পন্থা। এসে পৌছালাম গভীর জঙ্গলে। একটা কংক্রিটের রানওয়ে, পরিত্যাক্ত। ব্রিটিশরা বানিয়েছিল। একসময় এখানে যুদ্ধবিমান নামতো, সেটা সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।

আমাদের মতন ঊনপাঁজুড়ে আটজন বাইক আরোহী সেখানে আগেই এসেছে। তারাও সকাল থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজু আর এগোতে নারাজ। হাতির দল এই জঙ্গলের আরো ভিতরে রয়েছে। রাজু খবর নিয়ে জেনেছে সঙ্গে সদ্যজাত বাচ্চা আছে। হাতির সামনে পড়ে গেলে প্রাণ নিয়ে পালানো মুশকিল। এইখানে দাঁড়িয়েই জঙ্গলের নিস্তব্ধতা উপভোগ করছি। সোনাঝুরি, সেগুন, শাল, মহানিম, বহেড়া, শিরিষের ফিসফিসানি কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি।

See Also
Train Ticket

ফিরে এলাম হোটেলে, প্রায় আড়াইটে বাজে। রাজু চলে গেল খেতে। আমরা স্নান সেরে বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক ভাতের হোটেলে ডাল, ভাত, পোস্তর বড়া, মাছ খেয়ে ফিরে দেখি রাজু হাজির। এবার যাবো গনগনি।

বিষ্ণুপুর থেকে গড়বেতা প্রায় ২৮ কিলোমিটার, সেখান থেকে আরও ২ কিলোমিটার গেলে গনগনি। ইচ্ছে আছে শিলাবতীর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখবো।

এক ঘণ্টার মধ্যে চলে এলাম গনগনি-বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। আমেরিকাতে কলরাডো নদীর ধারে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, সেটা দেখেনি। বাংলার গ্রান্ড ক্যানিয়ন আমার কাছে খারাপ লাগেনি। তুলনা করা মুর্খামি। দু দেশের জলবায়ু আলাদা, ভূপ্রকৃতি আলাদা-দুটো আলাদা রকমের হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

বেশ অনেকগুলো সিঁড়ির ধাপ নেমে, ঝুরঝুরে কাঁকড়ের উপর দিয়ে উঁচু-নিচু পথে চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থামলাম। আমার স্ত্রীর পায়ে অসুবিধে, আর যেতে পারবেন না। এখান থেকে একা চড়াই-উৎরাই পথে চলতে শুরু করলাম। কয়েক কোটি বছর ধরে হওয়ার ঘর্ষণে লাল মাটির গায়ে গুহা, গিরিখাদ তৈরি হয়েছে। কথিত আছে মহাভারতে পঞ্চপান্ডবের বনবাস কালে ভীম বকাসুরকে এখানে বধ করেন। এটাই নাকি ছিল বকাসুরের বাসস্থান।

ফিরে এসে দুজনে হেঁটে এলাম শিলাবতী নদীর ধারে। নদী সোজা এসে এখান থেকে ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। নদীর পাড়ে জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে সূর্য সারা আকাশে ফাগের রং ছড়িয়ে ডুব দিল। ক্ষনিকের এইটুকু দেখার জন্য এতদূর ছুটে আসা। স্বার্থক হ’ল আসা।

দুজনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম। ওপরে একটা ছোট পার্ক আছে, সেখানের ওয়াচ টাওয়ারে উঠে গনগনি ও শিলাবতীর এরিয়াল ভিউ পাওয়া যায়। বেশ সুন্দর লাগে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে, পার্কের ভিতরে আলো জ্বলে উঠলো। শহুরে সভ্যতার দাম্ভিকতা। পার্কে একটা বাদাম গাছের তলায় একটা বেদিতে দুটো বড় হাড় রাখা। এগুলো নাকি বকাসুরের হাড়। দেখে খুব আশ্চর্য লাগলো।

যতদূর জানি ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষিণ প্রজাপতির দুই কন্যা দিতি ও অদিতি। এঁদের দুজনেরই বিয়ে হয় ঋষি কাশ্যপের সঙ্গে। দিতি ছিলেন হিংসুটে প্রকৃতির, তাই দিতির গর্ভে জন্ম হয় অসুর ও দৈত্যদের। অদিথির গর্ভে ৩৩ পুত্র জন্ম নেন, এঁর মধ্যে ছিলেন অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং একাদশ রুদ্র। এঁদেরই দেবতা বলে বর্ণনা করা আছে উপনিষদে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে দিতি এবং অদিতির পুত্রদের শারীরিক গঠন এক হওয়া উচিত।

এই অঞ্চলের আশেপাশে হাতি পাওয়া যায়। যদি কোন পূর্ণবয়স্ক হাতির হাড় এনে বকাসুরের হাড় বলে চালায় — কিছুই বিচিত্র নয়।

পার্ক থেকে বেরিয়ে কফি খেয়ে অন্ধকারের বুক চিরে হোটেলে ফেরা। কাল সকালে ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরবো। অটোতে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম আবার কোথাও, অন্য কোনখানে, অন্য কোন সময়।

What's Your Reaction?
Excited
2
Happy
1
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top