Now Reading
আজিনোমোটো -র ইতিকথা। 

আজিনোমোটো -র ইতিকথা। 

Avatar photo
আজিনোমোটো

মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (MSG) ও আজিনোমোটো সম্পর্কে বিশদ আলোচনা, এর রাসায়নিক গঠন, স্বাদ বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্য, স্বাস্থ্যগত প্রভাব ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য।

মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেট আর আজিনোমোটো এই দুটো শব্দের সাথেই প্রথম পরিচয় ক্লাস 11 এ। আমরা সবাই-ই মাঝে মধ্যে এদের নাম শুনে থাকি, তাইনা? তাহলে দেরি না করে, খুব সংক্ষেপে হলেও শুরু করা যাক ‘আজিনোমোটোর ইতিকথা’।
ছোটো থেকেই বাড়ির বাইরের খাবার খাইনি খুব একটা, তাছাড়া আমারা যখন বড় হচ্ছি তখন আমাদের গ্রামের দিকে রেস্টুরেন্ট ছিলনা বললেই চলে। রেস্টুরেন্ট যেমন ছিলনা, তেমনিই তখনও কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দৌলতে ফাস্ট ফুড খাওয়ার এই জোয়ার আছড়ে পড়েনি সাধারণ বা নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে।
তারপর আমরাও আস্তে আস্তে বড় হলাম, বিগত কয়েকবছরে ফুড ব্লগিং এর মত বিশ্ব মানের একটা শিল্পকে নেহাৎ নোংরামিতে নামিয়ে আনা হলো, এবং তার দরুন আরো যে একটা ব্যাপার ঘটলো তা হলো, সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের ভিতরে ফাস্ট ফুডের প্রতি একটা তীব্র আকর্ষন তৈরি হলো।
যাক সেসব আলোচনা করা যাবে অন্যদিন। হ্যাঁ তো যেটা বলছিলাম, কলকাতায় গিয়ে স্ট্রিট ফুডের দুই মহারথীর একটি ; ইয়ে মানে চাউমিন খেয়েছি অজস্র বার(বলাই বাহুল্য, আরেক মহারথী নান আদার দ্যান এগ রোল)। এই দোকান গুলোতে ফুড সেফটি বলে কী আছে, এই হাস্যকর তর্কে না যাওয়াই শ্রেয়, কিন্তু এই দোকান গুলোতে রাইট টু ইনফরমেশন যে আছে সেইটা বেশ গর্ব করে বলতে পারা যায়। রেস্তোরাঁয় রান্না ঘরে ঢু মারতে আমরা পারিনা, কিন্তু রাস্তার ধারের এই দোকানে চাউমিন বানানোর উপকরণ গুলো আমরা বেশ দেখতে পাই।
ঠিক এই রাইট টু ইনফরমেশনের দরুন, আমি দেখতাম তেল, বিভিন্ন সব্জি, মসলা, ভিনিগার, সোয়া সস, নুন ছাড়াও ঠিক নুন বা চিনির মতো কী যেন একটা দু চিমটে দেওয়া হচ্ছে। মাথায় একটু চাপ দিতেই ব্যাপারটা বেশ বোধগম্য হলো। মনে মনে বললাম, ” উঁ,‌ ধরে ফেলেছি। কাকু এই জন্য এত স্বাদ তোমাদের চাউমিনে। MSG; মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট।”
হ্যাঁ, মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট। মানুষ চেনে আজিনোমোটো হিসেবে। আসলে MSG হলো একপ্রকারের ফুড অ্যাডেটিভ, আরো ভেঙে বললে ফ্লেভার এনহ্যান্সার। আর আজিনোমোটো হলো MSG এর সবথেকে প্রচলিত ব্র্যান্ড।বেশিরভাগ চাইনিজ খাবারে অন্যান্য ইনগ্রিডিয়েন্টের স্বাদ আরো বাড়িয়ে দেওয়ার পিছনে রয়েছে যার অবদান। একদম হিডেন জিনিয়াস বা ফিল্মি স্টাইলে যাকে বলে ছুপা রুস্তম।
কিন্তু কেনো MSG এতো বিখ্যাত? কেনো এতো ওয়াডলি উজ্ড? উত্তর টা আগেই বলা হয়েছে। টেস্ট। যে কোনো পদের স্বাদ কয়েক গুণে বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সাদা দানাদার এই উপকরণটি।
রান্নাবাটি নিয়ে কথা হলো। এবার একটু রসায়নটা দেখা যাক। MSG আসলে গ্লুটামিক অ্যাসিডের সোডিয়াম সল্ট। MSG তে কিন্তু গ্লুটামিক অ্যাসিড থাকে গ্লুটামেট আয়ন হিসেবে। এই গ্লুটামিক অ্যাসিড হল অন-অপরিহার্য বা নন এসেনশিয়াল একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড। তবে একে শুধুমাত্র একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড বলে ছেড়ে দিলে এর নিয়ে আসল কথাটাই বলা হয়না। গ্লুটামিক অ্যাসিড মানব মস্তিষ্কের সর্বাধিক প্রচূর্যপূর্ণ (The most abundant) উত্তেজক বা এক্সসাইটেটোরি নিউরোট্রান্সমিটার। সহজ ভাষায় বললে, এটি আমাদের মস্তিষ্কের কাজ কে উদ্দীপিত করে।
MSG – র থার্মাল স্টেবিলিটি ভালোই, অমরা সাধারণত যে তাপে রান্না করে থাকি সেটায় এর কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটেনা। এটি খুব ভালোভাবে জলে গুলে যায়, কিন্তু অন্য জৈব দ্রাবকে এর দ্রাব্যতা কম। এইবার সবথেকে ইন্টারেস্টিং যে বিষয়টি হলো, অতিরিক্ত অম্লিক মাধ্যমে MSG এর গ্লুটামেট প্রোটোনেটেড হয়ে রূপান্তরিত হয় গ্লুটামিক অ্যাসিডে। এবং তখনই কিন্তু তার কার্যক্ষমতা যায় কমে। এই ব্যাপারটা কিন্তু ওই ফ্রেঞ্চ ফ্রাই থেকে আলু ভাজা বা ফ্রায়েড চিকেন থেকে মুরগি ভাজায় অবনমন এর মত নয়। এর প্রভাব যথেষ্ট।
রসায়ন তো হলো। কিন্তু আসল প্রশ্নটা থেকেই যায় — কীভাবে MSG খাদ্যের স্বাদ বাড়ায়? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য এবার দেখা একটু যাক শরীরবৃত্তি বা ফিজিওলজি। আমাদের জিহ্বায় বিভিন্ন ধরনের স্বাদ গ্রহণ করবার জন্য আলাদা আলাদা স্বাদ কোরক রয়েছে। তেতো, মিষ্টি, নোনতা, টক…. আর একটা? আর একটা হল উমামি। এই স্বাদের বাংলা অর্থ আমি পাইনি। তবুও অনেক জায়গায়, মোটামুটি ভাবে এই উমামির যে ভাবানুবাদ করা হয়েছে তা হলে — মাংসল। যাই হোক, এই উমামি টেস্টের জন্যও আমাদের জিভের প্রায় সর্বত্রই আছে রিসেপ্টর। মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট ঠিক এই রিসেপ্টারের সাথেই বাইন্ড করে। গ্লুটামেট বাইন্ডিং এর দরুন রিসেপ্টর mGluR1 & mGluR4 একটিভেটেড হয়, এবং একে একে কয়েক ধাপ জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় আমাদের মস্তিষ্ক উদ্দীপিত হয়। আমাদের ব্রেন অনুভব করে একটা দারুন মাংসল স্বাদ, ইংরিজিতে a Rich, Meaty, Savory taste.
ব্যাস কেল্লা ফতে। আমাদের মনে হয়, উফ কী দারুণই না বানিয়েছে কাকু চাউমিন টা। জিও, কাকা।
আমরা রাঁধুনি নই, খাবারের স্বাদ বাড়ানো আমদের কাজ নয়। আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট নই যে MSG – র রাসায়নিক চরিত্র টুকুই আমাদের জানতে হবে তার বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য। আবার আমরা ফিজিওলজিস্ট ও নই, রিসেপ্টর বাইন্ডিং, নিউরোট্রান্সমিশন এবং তার ফিজিওলজিক্যাল ইফেক্ট জেনেই আমাদের নিস্তার নেই। আমরা এদিকেরও না আমরা ওদিকেরও না — অমরা নিউট্রিশনিষ্ট।
আমাদের দেখতে হবে, এই আজিনোমোটো বা যে কোনো ব্র্যান্ডের MSG কি খাওয়া চলে? আর খেলেও, এটা খাওয়া কি সেফ? যদি সেফ হয়, ঠিক কতটা? প্রশ্ন গুলো খুব ভালো, এবং খুব গুরুত্বপূর্নও বটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (FDA ) মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট কে GRAS এর অন্তর্ভুক্ত করেছে, GRAS অর্থাৎ Generally  Recognised As Safe। সহজ ভাবে বললে, MSG  তার নির্দিষ্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরাপদ হিসেবে স্বীকৃত। Gen Z এর ভাষায় গ্রীন ফ্ল্যাগ।
  মনে একটা প্রশ্ন  জগতেই পারে যে, FDA কি এই সংক্রান্ত কোনো গবেষণা করে দেখেছিল? উত্তরটা না এবং হ্যাঁ। FDA নিজে কোনো রিসার্চ প্রজেক্ট করেনি এই বিষয়ে। তাহলে? আরে বলছি বলছি,  ১৯৯০ এর দশকে FDA, ফেডারেশন অফ  আমেরিকান স্যোসাইটিস ফর এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজি (Federation of American Societies for Experimental Biology, FASEB) কে বলে MSG-র স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে একটি গবেষণা করতে। গবেষনার শেষে এই সংস্থা FDA কে রিপোর্ট জমা দেয়, জানায় —  Monosodium Glutamate is safe.
তাহলে প্রথম প্রশ্নের উত্তরে স্বয়ং FDA বললো, “হ্যাঁ বাপু MSG সেফ।” সেফ তো বুঝলুম, কিন্তু কতটা ? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে চলুন মার্কিন মুলুক থেকে  উড়ে আসি ইউরোপে। ২০১৭ সালে,  European Food Safety Authority (EFSA ) বললো, MSG এর এক্সেপ্টেবল ডেইলি ইনটেক (ADI ) হলো ৩০ মিলিগ্রাম প্রতি কিলোগ্রাম দৈহিক ওজনে ( 30mg/Kg Body Weight)। ব্যাস মিটে গেল তাহলে। মিটে গেলো কি?
না ঠিক পুরোপুরি মিটলো না। MSG তে তো শুধু গ্লুটামিক অ্যাসিডই নেই, আছে সোডিয়াম ও। অল্প মাত্রায় থাকলেও, যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের একটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন বৈকি। তবে নিশ্চই বুঝতে পারলেন, MSG এড়িয়ে চলতে পারেন কিন্তু অনাবশ্যক ভয় খাওয়ার কোনো দরকার নেই।
 আজ এই টুকুই। আজিনোমোটোর, থুরি মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেটের ইতিকথা শেষ হলো এখানেই।
What's Your Reaction?
Excited
2
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top