Now Reading
প্রীতিলতা: দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান।

প্রীতিলতা: দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান।

Avatar photo
প্রীতিলতা

বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মৃত্যু বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি দেশকে ভালোবেসে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ কাহিনী নতুন প্রজন্মের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।

দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে শুধুমাত্র বাঙালি পুরুষ নয়, মহিলারাও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন — সে কথা ইতিহাস বলে। বাঙালি হয়ে সেই জন্য শ্লাঘা বোধ করি। মাতঙ্গিনী হাজরা, কল্পনা দত্ত, বীনা দাস, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, কমলা দাশগুপ্ত, বেগম রোকেয়া, সুহাসিনী গাঙ্গুলী — কত নাম বলবো! আজ বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সম্বন্ধে দু চার কথা বলি।

১৯৩২ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী।

চলুন একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক। ইতিহাসের পাতা উল্টে চলে যাই ১০০ বছরের আগে। ১৯১১ সাল, ৫ই মে, চট্টগ্রাম (অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত) বলঘাট গ্রামে প্রীতিলতার জন্ম। ছয় ভাই বোনের মধ্যে বড় হওয়া। প্রীতিলতাদের আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত। কোন এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে ওয়াহেদদার উপাধি পান। ওয়াহেদদার থেকে ওয়াদ্দেদার।

১৯১৮ সালে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে ডক্টর খাস্তগীর সরকারি স্কুলে ভর্তি হন। অত্যন্ত লাজুক, নম্র স্বভাবের মেয়ে প্রীতিলতা। স্কুলের দিদিমনির কাছ থেকে ঝাঁসি রানী লক্ষীবাঈ এর যুদ্ধের বর্ণনা শুনে প্রথম উদ্দীপিত হন।

১৯২৩ সাল সরকারি কর্মচারীদের বেতনের টাকা লুট করার অভিযোগে মাস্টারদা সূর্যসেন গ্রেপ্তার হলেন। এই ঘটনা প্রীতিলতার মনে গভীর দাগ ফেলে দেয়। ১৯২৪ সাল — ব্রিটিশ সরকার “বেঙ্গল অডিন্যান্স” নামে এক আইন জারি করে বিনা বিচারে বিপ্লবীদের আটক করতে শুরু করল। চট্টগ্রামের বহু বিপ্লবী সেই সময় ধরা পড়েন। সরকার বিপ্লবীদের সমস্ত প্রকাশনা বাজায়াপ্ত করে। বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার বেশ কিছু বই ইস্তেহার প্রভৃতি প্রীতিলতার জিম্মায় লুকিয়ে রাখেন। প্রীতিলতা তখন কিশোরী। সেই সময় প্রীতিলতা পড়ে ফেলেন একে একে ‘বাঘাযতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’, ‘দেশের কথা’ ইত্যাদি বই। বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেন, ইচ্ছা প্রকাশ করলেন বিপ্লবী সংগঠনের কাজে যোগদান করবেন। তখন মহিলাদের বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করা হতো না।

১৯২৮ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করে ঢাকার ইডেন কলেজে আইএ পড়তে ভর্তি হলেন। মাসিক ১০ টাকা বৃত্তি।

ইডেন কলেজে পড়বার সময় কলেজের শিক্ষিকা নীলিমাদের মাধ্যমে আলাপ হলো লীলা রায় সঙ্গে। লীলা রায়ের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় গড়ে উঠেছে দিপালী সংঘ — মেয়েদের অনুশীলন কেন্দ্র। সেখানে শিখলেন লাঠি খেলা, ছোরা খেলা, বন্দুক ছোঁড়া ইত্যাদি।

১৯৩০ সালে আইএ পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে ফিরে আসার সময় খবর পান আগের রাতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস, রেল স্টেশন সব ধ্বংস হয়েছে। বিপ্লবীদের এই বিদ্রোহকে তখন ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ নামকরণ করা হয়।

আই এ পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো, প্রীতিলতা মেয়েদের মধ্যে হলেন প্রথম। এবার আর ঢাকায় নয়, চলে এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন বেথুন কলেজে। প্রিয় বিষয় দর্শন। থাকতেন বারানসী ঘোষ স্ট্রিটের হোস্টেলে। প্রীতিলতার ব্যাডমিন্টনের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল; এছাড়াও পারতেন খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতে। হোস্টেলের ছাদে, সন্ধ্যার অবসরে বাঁশির আসর বসতো। অন্য ছাত্রীরা শুনতেন আগ্রহ নিয়ে।

বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার সেই সময় যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের একজন বিপ্লবী চিহ্নিত করে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায় তখন নারী বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ করছেন। প্রীতিলতা ও তাঁর বান্ধবী কল্পনা দত্তর দৃঢ়চেতা মনোভাব দেখে মনোরঞ্জন বুঝেছিলেন দেশের জন্য প্রাণ দিতে এঁরা দুবার ভাববেন না। একে একে সব বিপ্লবীরা সেই সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ছেন। মাস্টারদা বুঝেছিলেন নারী সংগঠন বেশ জরুরী। বিপ্লবের দীক্ষা নিলেন প্রীতিলতা ও কল্পনা। মাস্টারদার প্রেরিত ইস্তেহার সাইক্লোস্টাইলে ছেপে প্রীতিলতা ও কল্পনা ও কলকাতায় বিলি করতেন।

চট্টগ্রামে মাস্টারদাকে বোমা পৌঁছে ফেরার পথে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন মনোরঞ্জন রায়। এদিকে পুলিশের এসডিও তারিনী মুখার্জিকে হত্যা করার কারণে বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির সাজা হয়েছে। ফাঁসির অপেক্ষায় রামকৃষ্ণ বিশ্বাস তখন আলিপুর জেলে। চট্টগ্রাম থেকে কলকাতার আলিপুর জেলে কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেন না। প্রীতিলতা ‘অনিমা দাস’ ছদ্মনামে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ‘কাজিন’ এই সুবাদে সাক্ষাতের জন্য দরখাস্ত করেন। দরখাস্ত মঞ্জুর হয়। এই ভাবেই প্রীতিলতা আলিপুর জেলে বহুবার রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

১৯৩২ সাল, প্রীতিলতা বিএ পাস করলেন। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রীতিলতাকে স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করলেন না। দীর্ঘ ৮০ বছর পর ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করা হয়।

See Also
Sister Nivedita

বিএ পাস করে প্রীতিলতা চট্টগ্রাম নন্দনকানন গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হন। সেই সময় প্রীতিলতার পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। চাকরিটা তাঁর খুব দরকার, তবুও দেশের কাজের জন্য কখনো কোন কিছু তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।

মাস্টারদা খবর পেলেন প্রীতিলতা জেলে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে বহুবার সাক্ষাৎ করেছেন। মাস্টারদা নিজেই ইচ্ছা প্রকাশ করলেন প্রীতিলতার সঙ্গে দেখা করার। সেই দিনটা ছিল ১২ই জুন ১৯৩২, মাস্টারদার সঙ্গে প্রীতিলতার প্রথম সাক্ষাৎ।

এরপর সাবিত্রীদির বাড়িতে গোপন আস্তানায় মাস্টারদা সঙ্গে প্রীতিলতার আবার সাক্ষাৎ। সেদিন গোপন ডেরায় হাজির ছিলেন বিপ্লবী অপূর্ব সেন, নির্মল সেন প্রমুখেরা। অতর্কিতে পুলিশের আক্রমণ। পুলিশের গুলিতে নির্মল সেন ও অপূর্ব সেনের মৃত্যু হয়। মাস্টারদা ও প্রীতিলতা কোনক্রমে পালিয়ে গেলেন। কচুরিপানা ভর্তি পুকুর সাঁতরে, কাদা রাস্তায় হেঁটে, কাশিয়াইশ গ্রামে আশ্রয় নিলেন। মাস্টারদার নির্দেশে প্রীতিলতা ফিরে গেলেন নিজের কর্মস্থলে।

সেই বছর সেপ্টেম্বর মাস, প্রীতিলতার আবার ডাক পড়লো। এবার অভিযান পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব। নেতৃত্বে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। মালকোচা ধুতি পাঞ্জাবি পরে প্রীতিলতা; সঙ্গে কালীকিঙ্কর দে, বীরেশ্বর রায় প্রমূখ। পুলিশের গুলিতে আহত হলেন প্রীতিলতা। আগেই ঠিক ছিল কিছুতেই পুলিশের হাতে ধরা দেবেন না। আহত অবস্থায় পটাশিয়াম সাইনাইড খেয়ে মৃত্যুকে বরণ করেন প্রীতিলতা।

প্রীতিলতার মৃত্যুর খবর পেয়ে, প্রীতিলতার মা এক বুক দুঃখ সহ্য করেও গর্ব করে বলতেন “আমার মেয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে”।

বাঙালি স্ত্রী পুরুষ — স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে কখনো কুন্ঠা বোধ করেন নি, আজও আন্দোলনের পুরোধায় বাঙালি। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম বাঙালি নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মৃতি তর্পণ করে আমরা, ইস্ট ইন্ডিয়া স্টোরি, নিজেদের ধন্য মনে করি।

What's Your Reaction?
Excited
1
Happy
1
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll To Top