Now Reading
ডুয়ার্স: সবুজ অরণ্যের আহ্বান

ডুয়ার্স: সবুজ অরণ্যের আহ্বান

Avatar photo
ডুয়ার্স

ডুয়ার্স ভ্রমণের এক অনন্য অভিজ্ঞতার গল্প—গরুমারা ফরেস্ট, ঝালং, বিন্দু, মূর্তি নদী, লাটপাঞ্চোর এবং সিতং-এর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জঙ্গল সাফারি এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ঘিরে এক মুগ্ধকর ভ্রমণকাহিনি।

বেশ কিছুদিন ঘরকুনো হয়ে বসে থাকলে আমার মনের ভিতর একটা বিষন্নতার নদী বয়ে যায়। অবসাদের পাড়ে বসে নদীর পাড়ে বিষণ্ণতার ঢেউ আছড়ে পড়া দেখতে থাকি। অপর পাড়ে বেঁচে থাকার রসদ। খুঁজতে শুরু করি সেই সেতুটাকে যাকে অবলম্বন করে ঝোলায় কটা জামা কাপড় পুরে বেরিয়ে পড়তে পারি। প্রকৃতির কোলে নিজেকে সঁপে দিয়ে আনন্দ পাই। মনে হয় এখনো আট আনা জীবনকে উপভোগ করা বাকি, এখনই চলে যাওয়াটা ভারী অন্যায় হবে।

এবার বেরিয়ে পড়লাম এগারোজন। স্ত্রীকে সঙ্গে ছাড়া কোথাও যাবার কথা কখনো ভাবি না, ভাবতেও পারি না। বাকি নয়জনের একজন তরুণ, অন্যরা প্রবীণ নাগরিকের দলে। আমাদের গন্তব্য ‘ডুয়ার্স’।

'অরণ্যকন্যা' রিসর্ট
‘অরণ্যকন্যা’ রিসর্ট

কলকাতায় গরম উঁকি দিলেও ডুয়ার্স কিন্তু এখনো শীতের ব্যাটিং চালিয়ে যাচ্ছে। ১৫ ই ফেব্রুয়ারি ‘কাঞ্চনকন্যা’ এক্সপ্রেস এর স্লিপার কোচে হই হই করে উঠে, পরের দিন সকাল নটা নাগাদ নিউ মাল জংশন স্টেশনে নামা। ‘অরণ্যকন্যা’ রিসর্ট আমাদের এগারো জনের জন্য একটা ঠাকুর দালান মার্কা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল স্টেশনে।

বাতাবাড়ি অঞ্চলে গরুমারা ফরেস্টের কাছে ফাঁকা নিরিবিলি প্রান্তরে আমাদের রিসর্ট। আতিথেয়তা চমৎকার। স্নান খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম ঝালং। ঝালং ভিউ পয়েন্ট থেকে মেঘ-কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা ভূটান পাহাড়, নিচে বয়ে চলা জলঢাকা নদী, নদীর পাশে ছোট ছোট জনপদ, মাটির রং এখানে ধূসর, মাঝে মাঝে সবুজ গাছ — জলরঙে আঁকা একটা আস্ত ক্যানভাস।

ঝালং
ঝালং

ঝালং থেকে একটু এগিয়ে ‘বিন্দু‘। জলঢাকাকে খুব কাছ থেকে দেখা। পাহাড়ি ঝরনার মত পাথরের ফাঁক দিয়ে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে জলঢাকা নদী। বিন্দু আমাদের দেশের শেষ গ্রাম। সামনে একটা ব্রীজ, সেটা পার হলেই ভুটান। সুভ্যেনির এর দোকানের ছড়াছড়ি। চাইলে কিছু একটা কিনে নেওয়া যেতেই পারে, দরদাম অবশ্যই করতে হবে।

জলঢাকা নদী
জলঢাকা নদী

এবার আস্তানায় ফেরার পালা, কাল আমাদের গন্তব্য সামসিং, সুনতালেখোলা। আপনি ভাববেন একরকম, হবে অন্যরকম। রিসর্ট থেকে জানানো হ’ল কাল আমাদের নির্ধারিত সূচি বদলাতে হবে, গাড়ি সিন্ডিকেট কাল কোন গাড়ি চালাবে না। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এখন সিন্ডিকেট রাজ। বালি, কয়লা, মাটি — এবার টুরিস্টদের সঙ্গেও অবভ্যতা করতে বাধা কোথায়? বাধ্য হলাম নিজেদের সূচি বদল করতে।

পরদিন সকালে টোটো চড়ে এলাম মূর্তি নদীর ধারে। আজ থেকে দশ বছর আগে যেরকম মূর্তিকে দেখেছিলাম এখন যেন আরও বেশি ক্ষীনকায়। মূর্তির গোড়ালি ডোবানো জলে মা সরস্বতীকে বসিয়ে বিসর্জনের পালা সাঙ্গ করেছে। কবে বর্ষায় মূর্তির জল বাড়বে, তখন ঠাকুর জলে ভাসবেন। সরস্বতী আপাতত জলে দাঁড়িয়ে থাকুন। পড়ুয়াদের এহেন তাচ্ছিল্য আমার কাছে বড়ই দৃষ্টিকটু।

ঘরে ফিরে স্নান খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়া – জঙ্গল সাফারি। হুডখোলা দুটো জিপে চড়ে সবাই বেরিয়ে পড়লাম। গতবার বাইসন, হাতি, গন্ডার ইত্যাদির দেখা পেয়েছিলাম, এবারও আশা করেছিলাম দেখতে পাবো। শুধু কট কটা ময়ূর দেখেছি। আমাদের অন্য সঙ্গীরা অবশ্য হাতি দেখতে পেয়েছেন। তবে শুনেছি কাটঠোকরা, পিউ কাঁহা ছাড়াও বহু নাম না জানা পাখির মধুর ডাক। উপলব্ধি করেছি জঙ্গলের গাঢ় নিস্তব্ধতা। শহরের আওয়াজ ছাড়াও যে সুন্দর নিশ্চুপ একটা জীবন আছে, সেটা জঙ্গলে না আসলে বোঝা যায় না। জঙ্গলে কান পাতলে বোধহয় গাছের পাতা খসার শব্দও শোনা যায়।
বাইসন, হরিণ, গন্ডার, হাতি — এরা জঙ্গলে থাকে; আমরাও জঙ্গলে থাকি। ওদের জঙ্গল প্রকৃতির সৃষ্টি, আমাদের জঙ্গল আমরা নিজেরাই সৃষ্টিছাড়া ভাবে বানিয়েছি, ইট, কাঠ, পাথরের সঙ্গে দম্ভ, প্রলোভন ইত্যাদি মিশিয়ে।

ফেরার পথে উপরি পাওনা হিসেবে দেখলাম ধামসা মাদল বাজিয়ে সাঁওতাল মহিলাদের নাচ।

আজ বেড়ানোর তৃতীয় দিন। রিসর্ট থেকে সকালে প্রাতঃরাশ সেরে লাঞ্চ বেঁধে বেরিয়ে পড়া। যাকে বলে চিঁড়ে গুড় বেঁধে ঘুরতে যাওয়া। দুটো জিপে সবাই চড়ে বসলাম। গ্রামের পথ পেরিয়ে এসে জাতীয় সড়ক। চালসার মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে গাড়ি নিজের গতি বাড়িয়ে নিল। কালো পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তা, কোথাও এতটুকু গর্ত নেই। নেই স্পিড ব্রেকের ইতিউতি যথেচ্ছ ব্যবহার। একে একে পেরিয়ে এলাম সালবাড়ি, শুকিয়ে যাওয়া নেওড়া নদী, সোঙাচি চা বাগান, গরুবাথান উঠে যাবার পথ, মালবাজার, ওয়াশাবাড়ি, রাণীচেরা চা বাগান, ওদলাবাড়ি, আরো কত চা বাগান। কোথাও বাগানের রঙ ধূসর সবুজ, কোথাও বোতল সবুজ। রাস্তার এপারের চা বাগানের সব পাতা তোলা, ওপারে সবুজ গালিচা পাতা। অপরূপ শোভা। এসে পড়লাম ‘সেবক’; বিখ্যাত ‘করনেশন’ ব্রীজ। একটা অর্দ্ধ গোলাকৃতি খিলানের উপর ভর করে দুই পাহাড় হ্যান্ডশেক করছে। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে ফিরোজা রঙের ‘তিস্তা’। ‘ফিরোজা’ নীল ও সবুজ রঙের মিশ্রণ। ‘ফিরোজা’ রঙ বন্ধুত্বের, আনন্দের, প্রশান্তির প্রতীক।

তিস্তা কে বহুবার দেখলাম। তিস্তার সঙ্গে আমার গভীর সখ্যতা। যতবার তিস্তাকে দেখি, ততবারই নতুন লাগে — সদ্য যৌবনা, অষ্টাদশী। বারে বারে প্রেমে পড়ে যাই। আমার বাষট্টি পেরিয়ে যাওয়া শরীরে ছাব্বিশের তরুণ টুপ করে নিজের অজান্তে নেমে আসে।

এতদিন বাদে তিস্তার সঙ্গে দেখা, সহজে ছাড়তে চায় না। পাশে পাশে বয়ে চলেছে। আমার হাতের আঙুলে তার উষ্ণ স্পর্শ পাই। কলকল শব্দে কত কথা বলে চলেছে। সে শব্দের অর্থ কেবল আমি বুঝি, আর বোঝে সে — তিস্তা।

See Also
Sikkim Diary part 3

কালিঝোরা থেকে বাঁদিকে খাড়াই যে পথ চলে গেছে, ওটা ধরে চলতে লাগলো আমাদের জিপ। অনেকটা টিকটিকির ল্যাজ ধরে ওঠার মতন। দশ বছর আগে এই রাস্তায় এসেছিলাম – লাটপাঞ্চোর। এবারে গাড়ি পেরিয়ে এলো সেই লাটপাঞ্চোর জঙ্গল। এখানে ধনেশ পাখিদের আস্তানা। পৌঁছে গেলাম ‘অহলধারা’।

অহলধারা অনেকটা টেবিল টপের মতন। চা বাগানের মাঝে ছোট ছোট হোম স্টে। চাইলে এখানে রাত্রি বাস করা যেতে পারে, তবে আগে থেকে বুক করে আসতে হবে। ঠান্ডা হওয়ার ঝাপট। দূরের পাহাড়ের গায়ে পাতলা দুধের সরের মতন কুয়াশা, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বয়ে চলা তিস্তা, ছোট ছোট গ্রাম — এসব মনের ক্যামেরায় বন্দি করে নিলাম। দুচোখ ভরে দেখেছি। সময় হাওয়ার বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে বয়ে চলেছে। প্রকৃতি দুহাতে ঢেলে সাজিয়েছে। কোন কৃপণতা নেই, আমরা তা ধ্বংস করার জন্য কিভাবে উঠে পড়ে লেগেছি। পাহাড় কেটে চওড়া রাস্তা, টানেল, রেলপথ — এসবের কি খুব দরকার?

এলাম সিতং। কমলালেবুর বাগান। গাছে এখন আর কমলালেবু নেই, সিজিন শেষ। দেওদার গাছের সারি দিয়ে ঘেরা লেক দেখলাম। শীত লেক শুকনো। এবার রিসর্ট ফেলার পালা। সেবক করনেশন ব্রীজের উপরে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল। মন ভরে দেখলাম তিস্তাকে। জানি না আবার কবে দেখা হবে।

করনেশন ব্রীজ
করনেশন ব্রীজ

আজ বেড়ানোর শেষ দিন, দুপুর তিনটে পঁয়তাল্লিশে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে আমাদের ট্রেন – তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস। অতএব সময়ের অভাবে সুনতালেখোলা যাওয়া যাবে না। সিন্ডিকেটের বদান্যতায় যাওয়া হলো না।
সকালে ব্রেকফাস্ট করে চালসা ছাড়িয়ে সোজা উঠে এলাম সামসিঙ-একটা উপত্যাকা। এখান থেকে দূরের পাহাড়ের দৃশ্য খুব ভালো দেখা যায়। আসলে পাহাড়ের প্রতিটা বাঁকে লুকিয়ে থাকে অপরূপ সৌন্দর্য। একে অপরের থেকে আলাদা, অথচ একই রকম। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। নামার পথে পড়লো মেটলি টি এস্টেট। বেশ বড় বাগান। স্থানীয় একজন বললেন এই বাগানে হামেশাই চিতাবাঘ দেখা যায়।

সামসিং
সামসিং

একটু চা না হলে আর চলছে না। পথের ধারে দাঁড়ালাম এক চায়ের দোকানের পাশে। পাশে এক টুকরো ফালি জমি সেখানে দু-একটি বেঞ্চ বসানো রয়েছে। জায়গাটা দেখে মনে পড়ে গেল দশ বছর আগে এই দোকানের এই বেঞ্চেতে বসে চা খেয়েছিলাম। স্ত্রীকে জায়গাটা আবার দেখালাম। পুরনো জিনিসকে নতুন করে পাওয়ার মধ্যে যেরকম একটা আনন্দ থাকে সেই আনন্দ উপলব্ধি করলাম।

রিসর্টে এসে ভুরিভোজ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। পথে গজলডোবা ব্যারেজ হয়ে চলে যাব নিউ জলপাইগুড়ি। এবারের মতন বেড়ানো শেষ। আমি বলি বেঁচে থাকার রসদ। কাল থেকে আবার দিন গুনতে শুরু করবো। সুযোগ আর কিছু টাকা জোগাড় হলে ঝোলায় জামাকাপড় নিয়ে সস্ত্রীক আবার বেরিয়ে পড়বো। অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে।

What's Your Reaction?
Excited
1
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top