” জর্জ বিশ্বাস না দেবব্রত বিশ্বাস”
A devoted foodie with keen interest in wild life, music,…
Mud Cafe তে বসে দার্জিলিং চা খাওয়ার সময়ে বন্ধুর ফোনে দেবব্রত বিশ্বাসের জন্ম তিথির প্রবন্ধ লেখার অনুরোধ। লেখকের মনে পড়ে যায় পুরোনো একটি হাসির গল্প। এক বছর আগে মাড ক্যাফেতেই এই গল্পের সূত্রপাত হয়েছিল। দেবব্রত বিশ্বাস, যিনি ‘ জর্জ বিশ্বাস’ নামেও পরিচিত, তাকে নিয়ে সেই স্মৃতি।
” আরে জর্জ বিশ্বাস না দেবব্রত বিশ্বাস” সিদ্ধার্থর এই কথা শুনে আমাদের হাসি থামায় কে। সত্যি এই ঘটনাটা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। গতকাল যখন Mud Cafe তে বসে আমি দার্জিলিং চা খেতে খেতে দেবব্রত বিশ্বাসের জন্ম তিথি উপলক্ষে যে অনুষ্ঠানটা হচ্ছিল, সেটা শুনছি, ঠিক তখনই সিদ্ধার্থর ফোন। বললে “ওই দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মতিথি উপলক্ষে একটা প্রবন্ধ লিখ।” বিশ্বাস করুন অনুরোধটা পেয়ে আমি এই গল্পটা ছাড়া আর অন্য কোন গল্পের কথা ভাবতে পারিনি।
আসলে ঘটনাটার সূত্রপাত বছরখানেক আগে এই Mud Cafe তেই। তখন সিদ্ধার্থ এক বিয়ে বাড়ির উপলক্ষে, দিল্লি থেকে কলকাতা পাড়ি দেয়। বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান শেষ হলে বাল্য বন্ধুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসি। দুই বন্ধু মিলে ছোটবেলার কত মজার মজার গল্পের স্মৃতিচারণ করেছিলাম। একদিন বিকেলে সন্ধ্যা ভ্রমণে বেরিয়ে ভাবলাম রাসবিহারীর দিকে যাই। ভ্রমণটা যদিও পায়ে হেঁটে গেলে ভালোই হতো, কিন্তু রাসবিহারীর দূরত্ব আমার বাড়ি থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার, তাই নিজেদের অযান্ত্রিক বলের ওপর ভরসা না রেখে যান্ত্রিক পদ্ধতিতেই রাসবিহারীতে পৌছলাম।
এককালে গঙ্গার হাওয়া রাসবিহারীতে নির্মল আনন্দ দিত শুনেছি। কিন্তু এখন গাড়ি আর বাসের ধোঁয়া ছাড়া, কোন হাওয়াই চোখে পড়ে না। অগত্যা কোন উপায় না পেয়ে ভাবলাম কোন রেস্তোরাঁতে গিয়ে বন্ধুকে একটু ভালো চা খাওয়াই। Mud Cafe তে জমিয়ে বসলাম আর দার্জিলিং ফাস্ট ফ্লাস চায়ের অর্ডার দিলাম। কিন্তু ভাবতে পারেন সিদ্ধার্থ ওই চা মুখে দিয়ে বলল “ওই মসালাটি পাওয়া যায় না?” আমি অবাক, আসলে ব্যাপারটা কি জানেন দিল্লির লোকেরা চায়ের নামে যেটা খায় সেটা হলো পায়েস। দারচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, তেজপাতা, দুধ , খালি চালটা বাকি রাখে। তা সিদ্ধার্থর আর দোষ কি। কিন্তু এটা সত্যি যে ও কিমা ঘুগনি আর ফিশ রোল খেয়ে রেকাবিতে যে অল্প স্বল্প গুঁড়ো পড়েছিল সেটাও খেয়েছিল। মোটামুটি দুটো ফিশ রোল আর এক প্লেট কিমা ঘুগনি খেয়ে হঠাৎ সিদ্ধার্থ কণ্ঠস্বর জেগে উঠলো, বললে “খাবার দাবার বেশ ভালই …..গানটা কে গাইছে রে?”
আমি বললাম “দেবব্রত বিশ্বাস , আর যে বাড়িতে বসে তুই এতগুলো ফিশরোল পেঁদালি সেটা ওনারই বাড়ি।”
“ও তাই ? তা উনি কোথায়? এখানেই থাকেন?”
আমি একটু বিরক্তের সাথেই বললাম “উনি ১৮ই আগস্ট ১৯৮০ সালে মারা গেছেন।”
এরই মধ্যে আমাদের দুই বন্ধু, হর্ষ আর সুদীপ্তর আগমন। “কি হে, কি চলছে তোমাদের?” সুদীপ্তর প্রশ্ন।
আমি বললাম, “দেবব্রত বিশ্বাস সম্বন্ধে বলছিলাম।”
“ও জর্জ বিশ্বাস?”
“আরে জর্জ বিশ্বাস না দেবব্রত বিশ্বাস” সিদ্ধার্থ বলে উঠলো। আর তারপর হাসির বন্যা এতটাই ছিল যে পাশের টেবিলের ভদ্রমহিলা উঠে ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে এমন একটা মুখ করলেন যেন আমরা পাগল, তারপর আবার নিজ স্থানে বসে পড়লেন । শেষমেষ হাসি থামার পরে হর্ষ বলল “যা জল তাহাই পানি”, সাথে সুদীপ্ত যোগ দিয়ে বলল “কেষ্ট আর খ্রিস্টে কোন তফাৎ নাই রে ভাই।”
“মানে ? তোরা কি সব বলছিস কিছুই তো বুঝতে পারছিনা।”
“কিছুই না দেবব্রত বিশ্বাস আর জর্জ বিশ্বাস একই মানুষ।” শুধরে দিলাম ওকে।
“ও খ্রিস্টান ছিলেন নাকি?” সিদ্ধার্থের আবার প্রশ্ন।
“না উনি ব্রাহ্ম ছিলেন।” হর্ষর উত্তর।
“ব্রাহ্ম মানে ব্রাহ্মসমাজ? রাজা রামমোহন রায়?”
“হ্যাঁ বন্ধু।” বললাম আমি।
“তাহলে নাম জর্জ কেন?”
“আসলে রাজা পঞ্চম জর্জের আগমনের ঠিক আগে ওনার জন্ম হয়েছিল। তাই উনাকে বাড়িতে জর্জ নামে ডাকা হতো।”
“ও আচ্ছা এবার বুঝলাম ।”
“তুই জানিস, জর্জ বিশ্বাস হলেন ভারতীয় গণসংগীত এর এক প্রধান সৈনিক।”
“কিন্তু এই যে বললি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন?”
“ধীরে বন্ধু ধীরে সব বলছি…..ওনার জন্ম বরিশালে। জর্জ বিশ্বাসের দাদু কালী মোহন বিশ্বাস ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন। আর তার জন্য দেবব্রত বিশ্বাসকে স্কুলে ম্লেচ্ছ বলে ডাকা হতো। ”
“কোন স্কুল?” সিদ্ধার্থর আবার প্রশ্ন ।
“কিশোরগঞ্জ বিদ্যালয়”।
“ফালতু স্কুল , বাজে স্কুল।” সিদ্ধার্থ রেগে বলে উঠলো।
“ছোট্ট বয়স থেকেই মা বাবার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর ব্রম্মসঙ্গীত শেখা শুরু হয় দেবব্রতের, এই করতে করতে দেবব্রত যৌবনে পাড়ি দেন । ১৯২৭ সালের সিটি কলেজে ভর্তি হলেন। ”
“গান গাওয়া কবে শুরু করলেন?”
“বলছি শোন , ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মসমাজের ভাদ্র উৎসবে দেবব্রত বিশ্বাস প্রথম বার দেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তারপর থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা আর ঠিক দশ বছর পরে ১৯৩৮ সালে কনক দাস এর সাথে দৈত্যকণ্ঠে তার প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডিং হয়।”
“ও আচ্ছা বুঝলাম।”
“তোকে একটা মজার ঘটনা বলি শোন, ‘ যুক্তি তক্ক আর গল্প’ ছবি করছেন ঋত্বিক ঘটক। উনি পরিচিত মহলে বললেন ছবিতে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকবে আর সেটা জর্জা -দা গাইবেন। ঘনিষ্ঠরা জিজ্ঞেস করেন ‘কোন গান ঋত্বিক দা?’ ঋত্বিক বাবু তো নিজেই জানেন না কি উত্তর দেবেন। রেকর্ডিং এর দিন ষ্টুডিও তে ঢুকলেন দেবব্রত বিশ্বাস। মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা কাঁধে ঝোলা, মুখে পান। বাঁদিকে হেলানো মাথা আর চশমার ফ্রেমের ভেতর গহন চাহনিতে অদ্ভুত এক মায়া রং আলো খেলা করে যেন প্রতিক্ষণে।”
“ওরে এত কমপ্লিকেটেড বাংলা বলিস না কিছুই বুঝতে পারছি না।” সিদ্ধার্থর প্রতিবাদ আর আমাদের আবার এক হাসির পর্ব।
” আচ্ছা ঠিক আছে সহজ বাংলাতেই বলি। আরো ভালো হয় যদি দেবব্রত বিশ্বাস যে রকম বলতেন সেই ভাষাতেই বলি। ফ্লোরে ঢুকে ঋত্বিকের পিঠ হাত চাপড়ে বললেন ‘দেখ ভভা, আমরা ঠিক আইয়া পড়ছি, কিন্তু আমি তোরে তো আগেই কইছি, আমি গাইমু না আমার গলা খারাফ।’ ঋত্বিকের মাথায় হাত বলে উঠলেন ‘সে কি? কে গাইবে এই গান?” তাতে জর্জ-দা বললেন ‘না আমি তো তোরে আগেই কইছি এইবারে আমারে ছাইরা দে আমার ছাত্র সুশীল গাইবো।’ এখানে বলে রাখা ভালো ঋত্বিক ঘটক কোনদিনও কাউকে রিকোয়েস্ট করতেন না। কিন্তু তার ব্যাতিক্রম ঘটে জর্জ -দার ক্ষেত্রে। যখন জর্জ দা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না তখন অনেক কাকুতি মিনতি শুরু করলেন ঋত্বিক বাবু। শেষমেষ একটা সমঝোতা হল , গানটি শুরু করবেন জর্জ দা আর ফলো করবে সুশীল। রেকর্ডিং হল গাইলেন জর্জ -দা সঙ্গে তার ছাত্র সুশীল মল্লিক। রবীন্দ্রনাথের ২৫ বছর বয়সে লেখা গান কাফি রাগের ‘কেন চেয়ে আছ গো মা’। ”
“আরেব্বাস। দারুন গান।” সিদ্ধার্থ বলে ওঠে।
আমি হেসে জিজ্ঞেস করি ” তুই শুনেছিস গানটা?”
“না মানে …. ওই আর কি।”
“নে শোন গানটা”, বলে গানটা চালিয়ে দিলাম।
এরই মধ্যে হঠাৎ বাইরে বৃষ্টি, তাতে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে গেয়ে উঠলাম, “নিল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায়…..” কিন্তু শেষ করতে পারলাম না, সুদীপ্ত আর হর্ষর রাঙা চোখ দেখে বুঝতে পারলাম খুবই বাজে গাইছি। পরিস্থিতি সামাল দিতে বললাম ” বর্ষার গান ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। এই বাড়িটা ১৭৪ ই রাসবিহারী এভিনিউ ছিল জর্জ বিশ্বাসের সাম্রাজ্য । ভেজানো কাঠের দরজা, ওপারে ছোট্ট গলি, গেট খুলেই বারান্দা। ঘরের ভেতরে ওনার প্রিয় মারফি রেডিও, পিক দান, গানের খাতা, ক্যাসেট আর গানের রেকর্ড।”
“জানিস তো সিদ্ধার্থ,” হর্ষ বলে ওঠে “ওনার ঘরের ভেতরে একটা কাঠের শেলফ ছিল গীতবিতান এবং আরো বিভিন্ন বই রাখা থাকতো। কাউকে হাত দিতে দিতেন না। যখন শরীর খারাপ হলো তখন ডাক্তারের উপদেশে জানলার জাল খুলে ফেলা হলো সারাক্ষণ আরাম কেদারায় বসে থাকতেন, ওখানেই ঘুমিয়ে পড়তেন। আর সামনে টুলের ওপরে থাকতো হারমোনিয়াম।”
“হর্ষ ওই মজার কথাটা বল”
“কোনটা?”
“আরে রেসের মাঠের গল্পটা।”
“উনি রেস ও খেলতেন বুঝি?” সিদ্ধার্থ জিজ্ঞেস করল।
“এই….এই.. ঠিক এইভাবে অর্ঘ্য সেন, জর্জ বিশ্বাসের স্টুডেন্ট , জিজ্ঞেস করেছিল “আপনি রেস খেলেন কেন?” তাতে জর্জ দা রিপ্লাই কি দিয়ে ছিলেন জানিস?”
“কি?”
“তুমি বিয়া কর নাই কেন? তুমি যেরকম বিয়া কর নাই, তেমনি আমিও রেসের মাঠে যাই। বিয়া না করাটা যেরকম তোমার চয়েস, ঠিক রেসের মাঠে যাওয়াটাও আমার চয়েস।”
“শুধু তাই, ওনার সর্বক্ষণের একটি কাজের লোক ছিল। উনি তাকে ডাকতেন ‘বীতিকিশ্রী’ বলে। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, আমার মতন হত কুৎসিত লোকের সঙ্গে যে থাকে সে বীতিকিশ্রী ছাড়া কি?”
“শীলা বলে উনার একটা ছাত্রী ছিল, তা একদিন কি হলো গান শিখতে শিখতে বেশ রাত হয়ে গেল। এত রাতে তো ছাত্রীকে একা যেতে দিতে পারেন না, নিজের বাইকে করে ছেড়ে দিতে গেলেন। আর বললেন ‘ভয় পাইবা না তো? আমি কিন্তু জোরে সালাইমু’। শিলা হেসে বলে উঠলো না না। কিন্তু আসলে ভেতরে ভেতরে একটু ভয় পেয়েছিল। জর্জ দা বেশ জোরে বাইক চালাতেন। জর্জ ঘুরে বললেন ‘কি মনে হয় পঙ্খীরাযে চরছো?’ এই ছিল জর্জ বিশ্বাস। প্রচন্ড ডাইনামিক একজন মানুষ।”
গল্প করতে করতে ঘড়ির কাটা কখন যে দশটায় পাড়ি দিয়েছে তা বুঝতে পারিনি। সেদিন বাড়ি ফিরে আসতে হল, তবে সিদ্ধার্থর মনের ভেতর যে জর্জ বিশ্বাসের প্রতি এক অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জন্মেছে তা বুঝতে পারলাম। দিল্লি ফিরে গিয়েও প্রায়ই সে আমায় ফোনে জর্জ বিশ্বাসকে নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছে। তাই গতকাল যে তার ফোন আসবে সেটা আমি মনে মনে ভেবেই রেখেছিলাম। ও ফোনে আমায় যখন প্রবন্ধ লেখার অনুরোধ করলো তখন এই গল্প ছাড়া আর অন্য গল্প কিছু মাথায় আসলো না।
জর্জ বিশ্বাস নিয়ে আরো অনেক মজার মজার গল্প আছে । সে গল্প বরং আরেকদিন হবে ?
What's Your Reaction?
A devoted foodie with keen interest in wild life, music, cinema and travel Somashis has evolved over time . Being an enthusiastic reader he has recently started making occasional contribution to write-ups.