কৈলাসে কথপোকথন



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
বর্তমান সময় এবং সামাজিক আবহাওয়া কে অবলম্বন করে একটি মজার গল্প – কৈলাসে কথপোকথন। একে গল্প হিসেবে দেখার বা পড়ার অনুরোধ রইল। কলমে: রাজ কুমার মুখার্জী
কৈলাসে শিব দূর্গার মন কষাকষির পালা চলছে। এক বছর বাদে দূর্গা বাপের বাড়ি আসবে, শিবের এতোটুকু ইচ্ছে নেই। শিবের এক কথা “পারো এবার না হয় নাইবা গেলে বাপের বাড়ি”। দুর্গা অভিমান করে বসে আছে, শিব সে অভিমান কিছুতেই ভাঙাতে পারে না। চলুন একটু কান পেতে শুনি কিসের এত আলোচনা।
শিব: দেখো পারো মর্তে চারিদিকে যুদ্ধ। গাজা ভূখণ্ডে মিসাইল অ্যাটাক। ইউক্রেন-রাশিয়া কবে থেকে লড়াই! এমনকি বাংলাদেশও কি সব হচ্ছে। কি দরকার যাবার, এবার না হয় বাদ দাও।
দূর্গা: আমি তো বছরে একবার যাই, এভাবে বলো না। মানুষগুলো সারা বছর আমার পথ চেয়ে বসে আছে। তাছাড়া আমার পুষ্পকরথ ওসব কায়দা করে ঠিক পৌঁছে যাবে। যারা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে ওরা তো খেস্টান না হয় ইহুদি। আমাদের লোক তো নয়, অত ভাবছো কেন।
শিব: ধরো যদি একটা মিসাইল তোমার রথে এসে লাগে! এখন তো আবার দূরপাল্লার রকেট। ফুস করে উঠলো আর ধুম করে ফেটে যাবে, তা নয়। এ তো আর ‘মারবো এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’ নয়। এ হলো গিয়ে ‘রকেট ছুঁড়বো মস্কোয়, ফাটবে আলাস্কায়’।
দূর্গা: দ্যাখো আমি যদি না যাই, তোমার সারা বছরের গাঁজার স্টক আনবো কোথা থেকে? মনিপুরি গাঁজা বিশ্ববিখ্যাত। একবার মনিপুর ঘুরে তো যেতেই হবে।
শিব: একি অলক্ষুণে কথা পারো! খবর্দার ভুলেও মণিপুর যেও না। ওখানে কি গন্ডগোল, ওখানের খবর তো আবার সব দেখানো হয় না। সেন্সর, সেন্সর।
হঠাৎ লক্ষ্মী কানে হেডফোন গুজে সামনে এসে দাঁড়ালো।
শিব: তোদের এই এক ঢং হয়েছে। সব সময় কানে ছিপি গুঁজে থাকা। আমার একদম না পসন্দ।
লক্ষী: কুল, ড্যাডি কুল। আমায় হাজার দশেক ক্যাশ ছাড়ো তো, ইন্ডিয়ান রুপি। নো ডলার, নো ইউরো।
শিব: মা তুমি ধন দৌলতে দেবী হয়ে আমার কাছে টাকা চাইছো?
লক্ষী: কি করব? আজকাল তো কেউ ক্যাশ ছাড়ে না। গুগল পে, ফোন পে, কার্ড। তোমায় কত করে বললাম কৈলাসে এবার ব্যাংকিং সিস্টেমটা চালু করো — শুনলে আমার কথা!?
শিব: আমাদের এখানে যে কেউ ওই ব্যাপারটা বোঝে না মা। শিল্পপতিও তো কেউ নেই, যে টাকা ধার নেবে আবার শোধ না করে কেটে পড়বে। সে যাক্ তোমার দশ হাজার টাকা কেন লাগবে, সেটা তো বললে না।
লক্ষী: আমি সেলোঁ যাবো। চুলে স্পা করাতে হবে, বোটক্স, ফেসিয়াল, পেডিকিওর, ম্যানিকিউর — সে তুমি বুঝবে না।
দূর্গা: সেলোঁ!! সেটা আবার কি লো? তুমি দিন দিন বড্ড অসভ্য হয়ে যাচ্ছ। তোমার ওই রকম শ্রাবণের মেঘের মতন এক ঢাল কালো কোঁকড়া চুল, সেই চুলে তুমি পা করাবে!!??
লক্ষী: পা নয়, পা নয়, স্পা। এমন অশিক্ষিতের মতন কথা বলো, কি বলবো? এসব না করালে স্ট্যাটাস বজায় থাকে!!
শিব গাঁজার কল্কিতে এক টান মেরে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে বললেন
শিব: লক্ষ্মী, মা আমার। এখন একটু কড়কি চলছে। তুমি পাঁচ নিয়ে ম্যানেজ করো মা।
লক্ষী: ওসব হবে না। সবে শ্রাবণ গেছে, বাবা ধাম, বাবা ধাম করে মানুষগুলো তোমায় কম দেয়নি ! সেখান থেকে দশ কিছুই নয়, তোমায় দশ ছাড়তেই হবে।
শিব: কি করবো মা, দশই দিতাম। কিন্তু তোমার দুই কাকা নন্দী ভৃঙ্গী এসে বললে মহাজনের কাছে অনেক টাকা ধার। টাকা না দিলে সাপ্লাই লাইন কেটে দেবে। এখন সিদ্ধির যা আকাল, খোলা বাজারে কেনা যায় না। একটু বোঝার চেষ্টা করো।
এই সময় গনেশ নেংটির পিঠে চড়ে হাজির।
গনেশ: মা কবে যাবে মামার বাড়ি? গণেশ চতুর্থীর পরে আসতে ইচ্ছে করছিল না। যা সব ঘি জবজবে লাড্ডু প্রসাদ চড়িয়েছিল….। আহা স্বাদ এখনো জিবে লেগে আছে।
শিব: সে কি গনশা? তুই ওখানে লাড্ডু খেয়েছিস নাকি?
গনেশ: হ্যাঁ। লাড্ডু আর আমি খাব না, তাই কখনো হয়?
শিব: ওরে হতভাগা, ওরা লাড্ডুতে ঘিয়ের সঙ্গে গরু ছাগলের চর্বি মিশিয়ে দিচ্ছে। তিরুপতি তে এই নিয়ে কি ঝকমারি কান্ড! তুই কি কোন খবরই রাখিস না?
দূর্গা: সারাদিন খালি খাই খাই। নোলা, সক সক করছে। পই পই করে বলি, নোলাটা এবার বন্ধ কর। তা শোনে আমার কথা? তুই পিওর ভেজিটেরিয়ান হয়ে শেষে জাত খোয়ালি!!??তাছাড়া ঘি জবজবে লাড্ডুতে ফ্যাট, কোলেস্টেরল — সব বাড়বে। হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।
গনেশ: সে তুমি যাই বলো মা, লাড্ডু, কলা, কলাগাছ – আমার দারুন লাগে।
দূর্গা: সে কি আর আমি জানি নে। গতবার তো নিজের বউকেই আরেকটু হলে সাবড়ে দিচ্ছিলি।
লক্ষী: বাবা আমার টাকার কি হল ? গণশা এসে পুরো ব্যাপারটা চটকে দিলো।
শিব: আমি তোমায় পাঁচের বেশি দিতে পারবো না। একটু বোঝার চেষ্টা করো। এর বেশি আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।
লক্ষী: তুমি বুঝতে পারছো না। পাঁচে হবে না। মিনিমাম দশ লাগবে। একটু মেকওভার না করে গেলে, প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন হয়ে যাবে।
দূর্গা: আহ লক্ষ্মী। কি সব ভাষা!! বাবা-মায়ের সামনে এইরকম ভাষায় কথা বলতে হয় বুঝি??
লক্ষী: জাস্ট চিল মা। চিল করো। চিল, চিল।
এরই ফাঁকে সরস্বতী কখন চুপিচুপি এসে বসেছে। বীণা হাতে নিয়ে ‘আহির ভৈরবী’ রাগ বাজাচ্ছে। শিব চোখ চোখ বুজে শুনছেন। দুর্গা গদগদ মুখে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে শুনছে। গণেশের চোখ এদিক সেদিক — কোথায় কি খাবার পাওয়া যায়।
বীণা বাদন থামলো। শিব চোখ খুললেন।
শিব: মা সরো, কতদিন বাদে তোমার বাজনা শুনলাম।
সরস্বতী: মনটা বড় খারাপ, বাবা।
দূর্গা: কেন, কি হয়েছে? শরীর ঠিক আছে তো?
সরস্বতী: মা এতদিন বাঙালি মানুষগুলো দূরত্ব সময় দিয়ে মাপতো। এখন তরল, কঠিনের একক দিয়ে মাপছে।
দূর্গা: ঠিক বুঝলাম না।
সরস্বতী: ধরো তুমি কাউকে শ্যামবাজারে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে ‘হেঁদুয়া কতটা’? উত্তরে সে বলবে আধঘন্টা। কখনোই বলবে না এক কিলোমিটার বা দু কিলোমিটার। দূরত্বের একক সময়। এখন আবার কুইন্টাল কুইন্টাল জল। কঠিনের এককে তরল। এরপর হয়তো বলবে পুষ্পকরথ পৌঁছাতে দশ মেগাবাইট দেরি!!
শিব: এসব ভেবে কি হবে মা, এখন থ্রেট কালচার। পরীক্ষায় পাশ-ফেল, কম নম্বর-বেশি নম্বর — সব এখন থ্রেট। তোমার বাজনাটি নিয়েও আমি চিন্তিত। তোমার বীণু আবার কোথাও রাখতে যেও না। মর্তে তোলাবাজদের ভীড়, বীণা রাখার জন্য কর ধার্য করে নেবে। ওদের কিছুই বলা যায় না। বালি, গরু পাচারের মতন তোমায় বিনা পাচারকারী ভেবে বসবে।
সরস্বতী: আমার সঙ্গে আমাদের সেনাপতি কার্তিক থাকবে। কার্তিক সব সামলে নেবে।
শিব: দাঁড়াও, দাঁড়াও; কাতুর উপর ভরসা করে বসে থেকো না। ওটা মহা ধড়িবাজ।
শিব দুর্গাকে বললেন একবার কাতুকে ডাকো তো।
দূর্গা: কাতু, কাতু। একবার এদিকে আয় তো বাবা। তোর বাবা ডাকছেন।
কার্তিক এসে হাজির।
কার্তিক: ডাকছিলে কেন, ঝটপট বলে ফেলো। হাতে একদম টাইম নেই। আজ বাদে কাল মত্তে যেতে হবে, সামনে পুজো। একটু ঝিংকুনাকু না সাজলে মেয়েরা পাত্তা দেবে কেন।
দূর্গা: বাবা কি বলছেন, মন দিয়ে শোন।
কার্তিক: বাবা আবার কি বলবে? সব সময় টান্টু হয়ে আছে।
দূর্গা: ছিঃ কাতু, বাবা গুরুজন। লোকে কত মান্যি গন্যি করে, বাবাকে নিয়ে এসব কেউ বলে?
শিব: দেখতে সুন্দর বলে আরো লাই দিয়ে ওর মাথাটা তুমিই খেয়েছো পারো, এখন এসব বললে শুনবে!!
দূর্গা: আমি লাই দিয়েছি? তুমি দাওনি? ঐশ্বরিক বর্শা ‘ভেল’ কে দিয়েছে কাতুকে?
কার্তিক: তোমরা দুজনে এখন বাওয়াল করবে, না আমাকে কি জন্য ডেকেছো বলবে?
শিব: তোর মা তোদের নিয়ে মামার বাড়ি যাবে বলছে। ওখানে এখন দমে ঝামেলা চলছে, তুই বাবা বোনেদের একটু দেখিস।
কার্তিক: ওসব তুমি একদম ভেবো না, ওখানে এখন দারুন আন্দোলন চলছে। মিছিল করে আন্দোলন হচ্ছে।
দূর্গা: সে কিরে! আমি তো এসব কিছুই জানি না। কি হয়েছে?
শিব: তুমি তো দেখছি কোন খবর রাখো না। সুবিচারের জন্য সবাই রাস্তায়। পেয়াদাগুলো এখন অসুরদের রক্ষা কর্তা। একটু কান পাতলেই শুনবে মানুষগুলোর স্লোগান।
কার্তিক: এখন রাত দখল, দিন দখলের পালা। মেয়েদের সঙ্গে খারাপ কাজ করে আর ছাড় পাওয়া যাবে না। সবাই একসঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছে।
দূর্গা: জবরদখল শুনেছি। রাত দখল, দিন দখল – কখনো শুনি নি।
কার্তিক: মা যুগ বদলেছে, এখন আর মেয়েরা ঘরের মধ্যে বন্দী নয়। তারা দিনে রাতে, সব সময় কাজ করতে চায়। সেটাই তাদের অধিকার। সেই অধিকারের জন্যই রাত দখল, দিন দখল।
শিব: কাতু, এবারে তুই কোন প্যান্ডেলে যাবি ঠিক করেছিস?
কার্তিক: এবারে বুঝতে পারছি না। বালিগঞ্জ না রাসবিহারী, শ্যামবাজার না টালাপার্ক – কোথায় যাবো। দেখি কোথায় কি রকম থিম। কোন থিমটা আবার তার মধ্যে একটু ভালো।
শিব: এবারেও কি থিমের পূজা হবে? সবাই তো বলছে উৎসব এবার নয়।
কার্তিক: বাবা, এবারে সব নতুন থিম। এই যেমন ধরো, ‘ঘোলা জলে মাছ ধরা’, ‘খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা’, ‘ডিভিসের জলে ভাসলো শহর, ম্যান মেডের কদর’। আর উৎসব বাদের কথা বলছো, মানুষগুলোকে আমার জানা আছে। যারা মিছিলে ‘বিচার চাই, বিচার চাই’ করছিলো, তারাই দেখবে সব সেজেগুজে রাস্তায় বেরিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।
গনেশ: আচ্ছা অসুর ঠিক সময় পৌঁছে যাবে তো?
শিব: না রে গনশা। অসুর এবারে একটা নয়, অনেক। একজন সিবিআইয়ের জালে, বাকি সব আড়ালে আবডালে। এরা আবার লবি বানায়; উত্তর-পশ্চিম, পূব-দক্ষিণ। মরা মানুষের দেহগুলো নিয়ে ব্যবসা করে।
সরস্বতী: বাবা জানো মানুষগুলো এখন একজনকে দুর্গা মানে। ওই যে ডাক্তার মেয়েটা, যে হাসপাতালে খুন হল, তাকেই এখন সবাই মা দুর্গা বলে।
কার্তিক: আমার মর্তের মানুষ গুলোকে জানা আছে। দুদিন আগে ঘরের মেয়ে বলে বুক চাপড়াচ্ছিলো, সেই লোকগুলোই দেখবি প্যান্ডেল হপিং করছে। আটটার সময় বালিগঞ্জে, দশটায় ম্যাডক্স স্কয়ার, বারোটায় কাশি বোস, দুটোয় টালা — সেলফি তুলে ফেবুতে আপডেটও দেবে।
দূর্গা: সময়টা বড় তাড়াতাড়ি বদলে গেল। এবার আমাদের সবাইকেই সাবধানে থাকতে হবে। দিনকাল একদম ভালো নয়।
শিব: তোমরা সবাই এখন এসো, গোছগাছ করে নাও। তোমাদের আবার তো বেরোতে হবে।
লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, দুর্গা একে একে সবাই চলে গেল। শিব গলা ছেড়ে ডাকলেন —
শিব: ওরে নন্দী-ভৃঙ্গী, কোথায় গেলি সব। একটু সিদ্ধি বেশি করে বাট বাবা। পারলে কোমরে বাঁধা তামার পয়সাটা শীলে ঘষে নিস। নেশাটা জমবে ভালো। বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি করে আমার সাধের নেশাটাই দিলে চটকে।
================= সমাপ্ত ================
সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং মজার।
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.