Now Reading
কলকাতার আওয়াজ – “জাস্টিস ফর অভয়া”

কলকাতার আওয়াজ – “জাস্টিস ফর অভয়া”

Avatar photo
২৪ জন

আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনার প্রতিবাদে কলকাতার আওয়াজ এখন সকলের মুখে মুখে। সমাজের যৌথ প্রতিবাদ এবং ন্যায়র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লেখা এই প্রবন্ধ । লেখক ডিকেন্সের “A Tale of Two Cities”-এর সাথে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করেছেন এবং আশা ও কর্মের গুরুত্বের উপর জোর দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়াছেন ।

পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, কোর্টে চলা যে কোনো কেস নিয়ে সরাসরি কোনো লেখালেখি করায় বেশ কিছু আইনী সমস্যা আছে। এবং সেই কারণেই এই প্রবন্ধে সরাসরি কোনো ঘটনা, নাম ও অন্যান্য সংবেদনশীল তথ্যের ব্যবহার ছাড়াই যথাসম্ভব বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সমস্ত প্রাণীর থেকে মানুষকে যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলাদা করে তার মধ্যে অন্যতম হল, ভাব বিনিময়ে শব্দের ব্যবহার। আর তাই খুব অদ্ভুত ভাবেই শব্দেরা মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েও সুগভীর অর্থ, আবেগ বয়ে নিয়ে চলে—যেমন, “দুগ্গা-দুগ্গা”। আর আজ সেই মা দুর্গার নিজের মাটিতেই কলঙ্কিত রাতে, পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে শুভ্র অ্যাপ্রন রাঙিয়ে উঠলো রক্তে। ধর্ষণ ও খুনের বিবরণ অত্যন্ত নিষ্প্রয়োজন। এই মর্মান্তিক ঘটনা বর্ণনায় প্রয়োজনীয় শব্দ যুগিয়ে ওঠবার মতো সামর্থ্য নেই এবং তা গুরুত্বহীন। কিন্তু এই বর্বরোচিত ঘটনার পরের বিষয়গুলো আরো ভাবাবার মতো। ভালো খারাপ দুই দিক থেকেই। প্রথমেই এমন বেশ কিছু বিবরণ অফিসিয়ালি, আনঅফিসিয়ালি উঠে আসে যা পরবর্তীতে যথেষ্ট মিসলিডিং প্রমাণিত হয়। সারা বাংলা যখন প্রতিবাদে উত্তাল, তখন ১৪ই আগস্ট প্রায় মাঝরাতে হঠাৎই দুষ্কৃতীদের আক্রমণ হয় আর সাথে কলেজে ভাংচুর আর প্রমাণ লোপাটের আপ্রাণ চেষ্টা। এর মাঝেই একের পর এক অডিও, স্ক্রিনশট সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যেতে থাকে যেখানে উঠে আসে বেশ কিছু রক্ত জল করা সম্ভাব্য সত্য। এই পরিস্থিতিতে অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তিকে আমরা দেখলাম মৌন থাকতে, বহু জনপ্রতিনিধিকে দেখলাম পিঠ বাঁচানোর চেষ্টায় হাস্যকর কার্যকলাপে লিপ্ত হতে। আকস্মিকভাবে বাতিল করা হলো ডুরান্ড কাপের ডার্বি। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই, এই সবের সমষ্টিগত ফলাফল হিসেবে আমরা সবাই বড্ড নেতিবাচক হয়ে পড়েছি। ন্যায় বিচারের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায়, প্রশাসনের স্বচ্ছতায় আর সমগ্র মানবতার উপরেই হাজার হাজার মানুষের যে বিশ্বাস পূর্বেই খুব ক্ষীণ হয়ে এসেছিল তা প্রায় পুরোপুরিই মুছে গেল। কিন্তু এই নারকীয় ঘটনা যে পুরো মানবতার হত্যা করতে পারেনি এবং বর্তমান তীব্র রাজনৈতিক ও সমাজিক বিপর্যয়ের মাঝেও যে কিঞ্চিৎ আশার আলো আছে তা আমাদের খেয়াল করা প্রয়োজন। আমাদের মনে করা প্রয়োজন চার্লস ডিকেন্সের কালজয়ী উপন্যাস A Tale of Two Cities-এর শুরুর সেই লাইনগুলো যা আমাদের রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতির ক্ষেত্রে ভীষণ প্রাসঙ্গিক, “It was the best of times, it was the worst of times, it was the age of wisdom, it was the age of foolishness, it was the epoch of belief, it was the epoch of incredulity, it was the season of Light, it was the season of Darkness, it was the spring of hope, it was the winter of despair, we had everything before us, we had nothing before us…..” বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভারতে, ন্যায় বিচারের হতাশাজনক সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আমাদের কাছে আশার আলো দেখা দিয়েছে যে কয়েকটা রূপে আমাদের সেই প্রসঙ্গেও খুব সংক্ষেপে কথা বলা দরকার।

লাখ লাখ মানুষ—বয়স, ধর্ম, পেশা নির্বিশেষে রাস্তায় নেমেছে। বহু পাবলিক ফিগার মুখ খুলছেন, শিল্পীরা নিজের শিল্প বেছে নিচ্ছেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা প্রশাসনিক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে তাদের শতাব্দী প্রাচীন প্রতিদ্বন্দ্বীতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে হয়তো প্রথমবারের জন্য ব্যাপক পরিসরে একত্রে নেমেছে রাস্তায়। বাঙালির যে ফুটবল পরাধীন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ছাপ ফেলছিল, সেই ফুটবল আবারো প্রায় এক শতাব্দী পরে আসমুদ্রহিমাচলে ছড়িয়ে দিলো ঐক্যের বার্তা। কলকাতার জায়গায় জায়গায় আমরা দেখলাম সবুজ-মেরুন, লাল-হলুদকে মিশে যেতে, সাথে যোগ দিলো কলকাতার আরেক ফুটবল ক্লাব মহামেডান স্পোর্টিং-এর সাদা-কালো রঙ। সবার লক্ষ্য এক—বিচার চাই। সমবেত কণ্ঠের এই অভিন্ন আবেদনের প্রত্যুত্তরে ভেসে এল সুদূর ইউরোপের একটা শব্দ “Suo Motu”। Suo Motu বা Sua Sponte হল একটি ল্যাটিন শব্দ যা আক্ষরিক অর্থে বোঝায় ‘নিজের উদ্যোগে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা’। আইন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, ‘Suo Motu’ হল সেই বিশেষ ঘটনা যেখানে আদালত কোনো আর্জি ছাড়া স্বতস্ফূর্তভাবে (Of its Own accord) কোনো বিচারাধীন মামলা অথবা কোনো তদন্তাধীন মামলা নিজের কাছে নেয়। অভয়ার সাথে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও খুনের এই পৈশাচিক ঘটনার প্রারম্ভিক উদাসীনতার জন্য যখন সারা বাংলার সাধারণ মানুষ একইসাথে ক্ষুব্ধ, হতাশ ও অসহায়, ঠিক সেই সময়েই দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাদের সর্বাধিক আগ্রহ দেখালো। ১৮ই আগস্ট, সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ ঘোষণা করলো যে তারা কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া ঘৃণ্য কার্যক্রমের বিচার নিজেরাই করতে চায়। বিশ্বের দীর্ঘতম লিখিত সংবিধানের ১৪২ নম্বর আর্টিকেলে যে ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া হয়েছিল, আজ সেই ক্ষমতার প্রয়োগ বহু বিতর্কিত ভারতীয় বিচার ব্যবস্থাকে হয়তো তার গরিমা ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ করে দিল। এবার, অভয়ার ন্যায়-বিচার হবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। বিচারের বেঞ্চের নেতৃত্বে চিফ জাস্টিস অফ ইন্ডিয়া, DY Chandrachud। আর ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদের যে রব উঠেছে, এটাও একপ্রকার Suo Motu অর্থাৎ স্বতস্ফূর্ত। কারণ আমাদের কেউ রাস্তায় নামতে বলেনি, কেউ জোর করেনি, কেউ শিখিয়ে দেয়নি। আমরা রাস্তায় নেমেছি নির্যাতিতার জন্য, কোলে খালি হওয়া এক অভাগা মায়ের জন্য, মনুষ্যত্ব যে আজও পুরোপুরি মরেনি সেই সত্য প্রমাণের জন্য।

পরিশেষে আবারও বলবো, শব্দ। কিছু কিছু শব্দের উদ্ভাবন এবং তার অবিচল ব্যবহার মানব সভ্যতার কাছে কলঙ্কের। সেই সমস্ত শব্দেরা চিরতরে হারিয়ে যাওয়াই আমাদের মনুষ্যজাতির জয়। তাই মুছে যাক ‘ধর্ষণ’ এর মত অভিশপ্ত শব্দ পৃথিবীর সমস্ত অভিধান থেকে। কিন্তু যতদিন সেই চির আকাঙ্ক্ষিত বাস্তব কেবলমাত্র ইউটোপিয়া হয়ে থাকবে, আমাদের মনে রাখতে হবে ততদিন আমাদের ব্যবহৃত শব্দে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়; বিচার, বিচার, বিচার চাই।

See Also
Protest

Disclaimer : উপরে উল্লেখিত বক্তব্য অবকৃত এবং অপরিমার্জিত। পুরো বক্তব্য টি প্রাবন্ধিকের নিজস্ব মতামত ও অনুভব।

What's Your Reaction?
Excited
2
Happy
6
In Love
5
Not Sure
0
Silly
1
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top