Now Reading
আমার পেরিয়ে যাওয়া কিশোরবেলার আবহাওয়া

আমার পেরিয়ে যাওয়া কিশোরবেলার আবহাওয়া

Avatar photo
রাজকুমার মুখার্জির কলেজের আবহাওয়া

ছোট বয়সে সবারই একটু দুষ্টুমি থাকে, কিন্তু যখন বয়সটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে তখন দুষ্টুমিটা অন্যরকম হয়ে যায়। কিশোর বেলা দুষ্টুমি নিয়েই আজকের গল্প অনেকের হয়তো  রিলেট করতে পারবেন। এই নিয়ে আজকের গল্প রাজকুমার মুখার্জির কলমে।

আবহাওয়া, জলবায়ু দুটোর মধ্যে একটা বড় তফাৎ আছে। জলবায়ু হল গড়পড়তা, আবহাওয়া ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রকমের। ওটার কোন গড়পড়তা হয় না। আবহাওয়া এখন ভালো, আবার খারাপ। আমার ছেলেবেলা যার গপ্পো আগে অনেকগুলো পর্ব ধরে বলেছি, সেগুলো জলবায়ু। বেগতিক কিছু হলেই প্যাঁদানি। আজ বলবো আমার ছেলেবেলা পেরিয়ে যাবার পরের গল্প – আবহাওয়া।

লোহা, পিতল, তামা এইরকম ধাতুর মতন আর একটি ধাতু টিন (Tin) এই ধাতু যে বয়সের সঙ্গে জুড়ে গেলে বেশ মিষ্টি শুনতে লাগে, সেটা বহুপরে উপলব্ধি করেছি। বোঝাগেল না তো? দুরছাই আমিই কি বুঝতে পেরেছি! আমি টিন (Tin) যার রাসায়নিক symbol Sn, তার কথা বলছি না। আমি বলছি Teen অর্থাৎ teenage এর কথা। সেই teenage এর মাঝের age এ, মানে ষোলো বছর বয়সে এলাম, তখন মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের দোরগোড়ায়। এবারের আবহাওয়া অন্য রকম। আমাদের সময়, প্রায় ৪৫ বছর আগের কথা, তখন শিক্ষার আবহাওয়া ছিল একটু আলাদা। ইস্কুলে পড়ানো হত বেশী। শিক্ষক শিক্ষিকাদের পাঠশালার দৌরাত্ম্য ছিল না। উচ্চ মাধ্যমিক ইস্কুল কলেজ, দুজায়গায় পড়ানো হত। মাধ্যমিকে আমার যা নম্বর ছিল, আমি বিজ্ঞান পড়তে পারতাম। বিজ্ঞান পড়লে অঙ্ক করতে হবে। অঙ্ক ! কি আতঙ্ক! অতএব বাণিজ্য, commerce। ওই যে বলে না বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। আমার কপাল কে সরস্বতী কোনদিন ভরসা করতে পারেন নি, লক্ষ্মী ভরসা করেন কি যুক্তিতে। আমার আবহাওয়া বলুন আর জলবায়ু বলুন, সরস্বতী লক্ষ্মী – কারো দেখা নেই।

যাক সেসব কথা। আমি কলেজে ভর্তি হলুম। এযেন সাপের পাঁচ পা দেখা। কলকাতার এক নামকরা কলেজে আমার মতন এক কুখ্যাত ছেলে বেঞ্চি দখল করে ফেললো। কলেজের প্রথম দিন সিগারেটের দোকান থেকে একটা ফিল্টার উইলস সিগারেট কিনে একটু ভাজা মৌরি মুখে ফেলে সিগারেট এক লম্বা টান। তখন ফিল্টার উইলস সিগারেটের দাম ছিল তিরিশ পয়সা। কলেজের আবহাওয়া মানেই সিগারেট ফোঁকা। ওটার সঙ্গে মানিয়ে না নিলে তো কলেজ যাওয়া বৃথা। ওরে বাবা! ধোঁয়া গলায় জট পাকিয়ে কেশে কেশে প্রাণ যায় আর কি! কোথায় যেন ছোটবেলায় পড়েছিলাম practice makes a man perfect, সেই practice আমায় শেখালো মুখ দিয়ে টেনে নাক দিয়ে ধোঁয়া বার করা, ধোঁয়ার রিং বানানো – ইত্যাদি, ইত্যাদি।

ক্লাসে স্যারেরা ইংরেজিতে পড়াতেন — আমার মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যেত। আমার পিতৃদেব ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আমার অবস্থা ল্যাজে গোবরে। আমি বাঙালি বুদ্ধি লাগিয়ে দিলাম। বইয়ের দোকানে গিয়ে সেই পাঠ্য বইগুলো কিনে আনলাম, যেগুলো অপেক্ষাকৃত পাতলা। একটু বুঝিয়ে বলি। আমাদের সময় উচ্চমাধ্যমিকে Business Organisation পড়ানো হত, দুশ নম্বরের পরীক্ষা। সব ইয়া মোটা মোটা বই। কোনটা ৬০০, কোনটা ৭০০ পাতার। আমি অনেক খুঁজে J P Basu র ইংরেজিতে লেখা বই কিনে আনলাম। ১৯৬ পাতা। কমপক্ষে ৪০০ পাতা পড়ার থেকে রেহাই। এবার দু একটা চ্যাপ্টার বাদ। আরও ২০ পাতা বাদ। এবার বইয়ের পাতার মধ্য থেকে কিছু লাইন দাগিয়ে দিলাম পেন্সিল দিয়ে। কোনো পাতায় ১০, কোনো পাতায় ১৫ লাইন। লাইনকে পাতায় রূপান্তর করলে বড়জোর ৬০/৭০ পাতা। অর্থাৎ এক দশমাংশ পড়েই আমার সিলেবাস শেষ। এটা জলবায়ু, আমার ধরন এরকম। একে আবহাওয়া বলে ভুল করলে হবে না।

যারা পড়াশুনা করে না, আমার মতন, তারা এই রকম ফন্দি ফিকির খোঁজে। আমার পিতৃদেবের খুব ইচ্ছে ছিল আমি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হই। সারাদিন এক গাবদা খাতায় খতিয়ান লেখা — হরজাই খাতে এতো টাকা এতো আনা, নাজাই খাতে এতো টাকা এতো আনা — ধুস। এরকম আবহাওয়া থাকলে আমি বাঁচবো না। অসম্ভব।

আমার কলেজের বন্ধুরা, কেউ মস্ত উকিল, কেউ হাইকোর্ট এর জজ, কেউ ব্যাংকের মস্ত অফিসার, কেউ বড় কোম্পানির মস্ত কেউকেটা। তারা আর আমার বন্ধু নেই। ওই যে ইংরেজিতে একটা কথা আছে না স্ট্যাটাস, আমি সেই শ্রেণীর নই। আমি কিছু হই নি। আমার হয়ে ওঠা হল না। আমি যখন খুব ছোট, আমায় যদি কেউ জিজ্ঞেস করতো, ‘তুমি বড় হয়ে কি হবে?’ আমি বলতুম মিনি বাসের হেল্পার হব। বাসের গেটে দাঁড়িয়ে – এই হাজরা, কালীঘাট, রাসবিহারী, টালিগঞ্জ বলে ডাকবো। সবাই হাসতো, ওরা জানতো না, আমি আসলে পাখির মতন উড়তে চাইতাম।

See Also
Into the comic verse

আমি ওদের মতন ডাক্তার, মোক্তার হতে পারিনি। সারাজীবন সওদাগরী অফিসের কেরানি হয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। না, আমার তাতে কোনো দুঃখ নেই। সবাই যদি প্রথম হবে, ফেল করবে কে? আমি না হয় সে দায়িত্ব নি।

পরিচিত কেউ যখন গাড়ি হাঁকিয়ে হুস করে চলে যায়, আমি একলাফে ফুটপাথে উঠে পড়ি। আবহাওয়া এখন ভালো নয়।

What's Your Reaction?
Excited
1
Happy
0
In Love
1
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top