হোটেল রজার্স স্টে
Saptarshi, a finance professional, has a camaraderie with his camera…
পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি তার মধ্যে আজ আকাশ মেঘলা , বিকেল থেকে জাঁকিয়ে এলো বৃষ্টি । ওরা চার বন্ধু এসে নামে রজার্স স্টে হোটেলের সামনে । রাতের অন্ধকারে একশো বছর পেরুনো সেই হোটেলে কিসের সাক্ষী হয়ে রইল তারা ? কার উপস্থিতি জানান দিয়ে গেল তাদের মুহূর্তের পলে অনুপলে ?
গাড়িটা যখন দার্জিলিং এর খাড়াই পথে এসে মলের কাছে দাঁড়ালো তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা বেজে গ্যাছে। সারা রাস্তায় মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু যাত্রাশেষের আধ ঘন্টায় জাঁকিয়ে বৃষ্টি এলো। শিলিগুড়ির ছেলে সুরেশের এসব রাস্তায় চলে অভ্যাস। সে ভরসা দিয়েছিল যতই আবহাওয়া খারাপ হোক পাঁচটার মধ্যেই সে হোটেলে পৌঁছে দেবে আমাদের। কাদা মাখা রাস্তার এক পাশে গাড়িটা পার্ক করে সে অভয় দিলো ‘আপনারা হোটেলের ভিতরে গিয়ে ওদের লোককে এসে মাল পত্র গুলো নিয়ে যেতে বলুন স্যার। আমি আছি। ‘আমরা, মানে আমি রঞ্জনা, পার্থ ও জয়শ্রী, একসঙ্গে ঢাল বেয়ে উঠে এলাম হোটেল রজার্স স্টে এর রিসেপশনে। কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই ভেতরের উষ্ণতায় শরীর জুড়িয়ে গেল।
ম্যানেজার মিস্টার ব্রেগাঞ্জা কলকাতার লোক। মাঝ বয়সী। একমুখ হাসি নিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খ্যানখ্যানে গলায় একটা “Good Evening” ছুঁড়ে দিলেন।
পার্থ বলল “If you can please tell you man to collect our luggage from the car…”
– “Oh yes, he must have gone by this time.”
বলতে বলতেই দেখি দুটো নেপালি ছেলে আমাদের তিনটে সুটকেস আর দুটো হ্যাবার স্যাক নিয়ে উপস্থিত, পিছনে সুরেশ। সে এসেছে গাড়ির ভাড়া বুঝে নিতে। আমি পকেট থেকে টাকা বার করে দিয়ে বললাম, ভাই গুনে নাও একবার।
টাকা গুনতে গুনতেই সে আমায় চাপা গলায় বলল, স্যার এখানে কদিন থাকবার প্লান আপনাদের? আমি একটু বিরক্তই হলাম তার এই প্রশ্নে।
কেন বলো তো? দিন তিনেক আছি আমরা।
“না স্যার, মানে যদি তার আগেও দরকার হয় জানাবেন, এই আমার ফোন নম্বর।“ এই বলে ঝটপট আমার হাতে একটা ছোট্ট কার্ড ধরিয়ে সে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল।
দার্জিলিং এসে পৌছতে পারবার আনন্দে ক্রমশ ভুলেই গেলাম সুরেশের কথা। রজার্স স্টে হোটেল টা পাহাড়ের গায়ে চারটে ধাপ কেটে বানানো। প্রথম ধাপে বেশ বড় রিসেপশন আর লবি। তার ওপরের দুটো ধাপে সব মিলিয়ে খান দশেক কামরা। একদম ওপরে কি আছে বোঝা গেলো না। আমাদের তেতলায় দুটো ঘর। সামনে একফালি কাঁচে মোড়া বারান্দা। সেখানে চেয়ার টেবিল পাতা। আড্ডা মারার জন্য অনবদ্য|
জয়শ্রী কে অনেকক্ষন দেখছি না। খোঁজ করতে জানা গেল সে তাদের ঘরে বাথরুমে ঢুকেছে। আমরাও নিজেদের ঘরে এসে জিনিসপত্র বার করে গুছিয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। বাথরুমে ঢুকে দেখি সেটা পেল্লায়, কিন্তু সেই অনুপাতে আলো কম। একটাই জানালা, সেটা বন্ধ। ভারি মিষ্টি একটা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাবলাম রুম ফ্রেশনার দেওয়া হয়েছে বুঝি।
কিন্তু আমি নিশ্চিত এই গন্ধ কোনো বাজার চলতি রুম ফ্রেশনারের গন্ধ নয়। একধরনের পাহাড়ি লিলি ফুলের গন্ধ এটা। জানালা বন্ধ। অন্য কোনো ফাঁক ফোকর চোখে পড়লো না। ঘরে ফিরে এলাম। সামনের বারান্দায় আলো জ্বলে উঠেছে। রঞ্জনা আমাদের জন্য মেনু কার্ড নিয়ে বসে। পার্থ ছবি তুলতে ব্যস্ত।
খানিক বাদেই গরম গরম চিকেন পকড়া, মোমো আর ধূমায়িত কফিতে ডুবে গেলাম আমরা। বাইরে বৃষ্টি বেড়েছে। ছাতা নিয়ে লোকজন চলেছে। ডানদিকে একটু চড়াই উঠলেই মল। বাইরে চলমান দৃশ্য দেখে এই হোটেলের ভেতরের নিস্তব্ধতার আন্দাজ মিলবে না। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছে এসে এখানে। রিসেপশনে লাগানো ছবি দেখে জানলাম রজার কেন্ট নামে চা বাগানের এক ম্যানেজার তৈরি করেছিলেন এই বাড়িটা, ১৯০৪ নাগাদ, অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের এক বছর আগে। কেন্টের সঙ্গে কোম্পানির বনিবনা না হওয়াতে তিনি চাকরি ছেড়ে এই হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন। ইংল্যান্ড থেকে আসা মানুষ জন এসে উঠতো এখানে।
সাহেব তাঁর সঞ্চয়ের টাকা লাগাতে কার্পণ্য করেন নি। দিনের পর দিন একটু একটু করে সাজিয়ে তুলছিলেন হোটেলটা।
‘বুজলে সারা বাড়িটা কিন্তু আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে ‘, পার্থ বললো। জয়শ্রীর নেশা হেরিটেজ ।
‘বাড়িটার ওপরে একটা attic আছে, খেয়াল করেছ, মানে বাংলায় যাকে বলে চিলেকোঠা ‘সাহেবি বাড়িতে এ ধরণের attic থাকে আর তাকে ঘিরে থাকে নানা কাহিনী।’ জয়শ্রীর শেষ কথাটা আমার কানে লাগলো ।
‘কাহিনী বলতে?’
‘কাহিনী না না রকম, ওই যেমন হয় আর কি!’
রঞ্জনা কফির কাপ হাতে নিয়ে প্রায় নিঃশব্দে একটা চুমুক দিল। মোবাইল ফোনে চার্জ থাকলেও সিগনালের নামগন্ধ নেই। পার্থ ফোন ছাড়া থাকতে পারে না। এই মুহূর্তে সেও হতাশ।
‘যাবে নাকি, একবার বাড়িটা ঘুরে দেখে আসি? আমি বললাম পার্থকে।
জয়শ্রীর যাবার ইচ্ছে থাকলেও সে রঞ্জনার সঙ্গে আড্ডা দেবে বললো। পার্থ আর আমি বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। ডান দিকে ঘুরলে রিসেপশন। আমরা বাঁদিকে গেলাম।
এটা বাড়ির পিছনের দিক। বেশ খানিক আলো আঁধারি। আসলে রিসেপসনের ঝকমকে আলোর পাশেই বলে হয়ত অন্ধকারটা চোখে লাগছে। যেখান দিয়ে হেঁটে এগুচ্ছি সেটা একটা একফালি করিডোর। দুপাশের দেয়ালে দামি কাঠের প্যানেলে বেশ কিছু হাতে আঁকা ছবি টাঙানো।
আগে পার্থ। তার মোবাইলের আলো একটা ছবির ওপর পড়তেই চিনতে অসুবিধে হলো না, এটা হলো পাহাড়ের গায়ে রজার্স স্টে এর ছবি, ওপরের চিলেকোঠা সহ।
এক ঝলক ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। আধ অন্ধকারেও চিলেকোঠাটা যেন বেশ উদ্ভাসিত। আর্টিস্ট কে বাহবা না দিয়ে পারলাম না তার এই অঙ্কন কুশলতার জন্য কিন্তু মনের মধ্যে আরেকটা খটকাও লেগে রইলো।
অন্ধকার করিডোর যেখানে শেষ সেখানে ভারী পর্দা টাঙ্গানো। চারদিকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ।
‘এর পিছনে কি আছে বলত ‘? পার্থ প্রশ্ন ছোঁড়ে আমাকে।
‘পর্দা সরিয়েই দেখা যাক না।’
দুজনে মিলে হাত লাগিয়ে পর্দা সরাতেই এক রাশ ধুলো উড়ে এল। দুটো মোবাইল টর্চ এর আলোয় দৃশ্য মনে হলো ভাঙা চোরা একটা রেস্তোরাঁ। কি বীভৎস ভাবে পুড়ে গ্যাছে চারদিক। টেবিল, চেয়ার, বার কাউন্টার, দেয়াল, কার্পেট ছাড় কার হয়ে গিয়ে তাদের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। সিলিং থেকে ঝাড়বাতি, ইলেকট্রিক তার, পলেস্তারা খসে ঝুলছে চারদিকে।
আমি আর পার্থ দুজনেই চুপ মেরে গেছি । একটা ঠান্ডা যেন ঘুরপাক খাচ্ছে ঘরটার মধ্যে আর তার সঙ্গে একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে ঢুকছে। সেই পাহাড়ি ফুলের গন্ধ।
‘চলে এস পার্থ’, বলেই আমি পিছন ফিরলাম। খানিক এগিয়ে এসে সিঁড়ির কাছে এসে দেখছি পার্থ নেই। দৌড়ে ফেরৎ গেলাম সেই রেস্তোরাঁর দরজায়। দেখলাম পার্থ কেমন অসার এক দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে সম্বিৎ হীন অবস্থায়। হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে ওকে নিয়ে আসতে হলো সেই মুহূর্তে।ওপরে উঠে দুজনে কেউই ভাঙলাম না সেই ঘটনার কথা।
রাতে খাওয়া দাওয়ার আগেই পার্থর জ্বর এলো।
আওয়াজ শুনে বোঝা যাচ্ছে বাইরের বৃষ্টিটা এখন আর ইলশেগুঁড়ি নয়, বরং ঝমঝমিয়ে। পার্থ কে বিছানায় শুইয়ে তার গায়ে একটা কম্বল আর একটা লেপ ঢাকা দেওয়া হয়েছে। রিসেপশন থেকে আমি গিয়ে একটা থার্মোমিটার নিয়ে এসেছি খানিক আগে। প্রায় ১০৩ ডিগ্রির কাছাকাছি জ্বর। জয়শ্রী তার মোবাইলে চেস্টা করে চলেছে ডঃ রণজিৎ চৌধুরী কে ধরবার। রণজিৎ আমাদের প্রতিবেশী, ডাক্তার হিসাবে বেশ নাম করেছে সে। চিকিৎসার ব্যাপারে সেইই আমাদের ভরসা।
বার পাঁচেক চেষ্টা করেও লাইন পাওয়া গেলো না। পালা করে আমরা এবার একে একে সবাই নিজেদের ফোন থেকে চেষ্টা করে চলেছি। একবার আমি বাইরের করিডোরে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজের মনে ফোনটা কানে নিয়ে কখন যেন একদম সিঁড়ির কাছে চলে এসেছিলাম। হঠাৎ নজর গেল নিচের দিকে, যেখানে সিঁড়িটা শেষ হয়েছে। একরাশ জমাট বাঁধা অন্ধকার সেখানে। বুকটা ছাঁত করে উঠলো। চোখের ওপর ভেসে উঠলো রজার্স স্টে র সেই পুরোনো ছবিটা, যেখানে চিলেকোঠার মধ্যে যেন আলো জ্বলে উঠেছে। তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকতেই একটা অস্পষ্ট গোঙানি। বুজলাম পার্থর জ্বর বাড়ছে। জয়শ্রী একটা ছোট টিফিন বাটি তে জল নিয়ে একটা রুমাল ভিজিয়ে চেপে ধরলো পার্থর কপালে। ঘরের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা। আচমকা বাতি নিভে গেল। লোডশেডিং। আর ঠিক তখনই বাথরুমের কাঁচের জানালাটার পাস দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম একটা মানুষের ছায়া সরে গেল। দৌড়ে বাথরুমের দিকে যাবো ভাবছি, কারেন্ট চলে এলো। আর সেই মুহূর্তেই ঝনঝনিয়ে বেজে উঠলো জয়শ্রীর ফোন।
– ‘হ্যাঁ রনদা, আমি ফোন করছিলাম। আমি – মানে আমরা দার্জিলিংয়ে। হ্যালো , শুনতে পাচ্ছ ? আরে পার্থর ১০৩ /৪ জ্বর উঠে গিয়েছে সন্ধ্যা থেকে ….. কি কি বলছো …. কি …”
আমার ইশারা দেখে জয়শ্রী দৌড়ে বারান্দায় চলে গেল। বাকি কথাবার্তা আমরা ঘরের ভিতর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম।
– “আমরা তো ফিরতে ফিরতে আরো তিনদিন রনদা। ও ওষুধ হোয়াটস আপ করে দিচ্ছ। ঠিক আছে তুমি না আমার সঙ্গে পার্থর ফোনেও করে দিও – এখানে কানেকটিভিটির চ্যালেঞ্জ আছে …. ”
খানিকক্ষনের মধ্যেই ওষুধের নাম ইত্যাদি পাওয়া যেতে আমি গিয়ে ব্রেগাঞ্জার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলাম। আসলে ঘড়িতে দশটা বেজে গ্যাছে। এই বাদল ঘেরা রাতে ওষুধের দোকান খোলা না পেলে আমার চেয়ে অনেক বেশী কাজে আসবে কোনো স্থানীয় মানুষ। এই জন্যই হোটেলের কোনো কর্মচারীর সাহায্য চাই।
– “Mr Braganza, Can you open the door please” ?
ভিতর থেকে একটা অদ্ভুত খ্যাস খ্যাসে গলায় প্রশ্ন এলো “Who’s that”?
নিজের পরিচয় দেওয়াতে কাজ হলো। কিন্তু খুট করে ছিটকিনি খুলে যে মানুষটা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি যেন এক অন্য মানুষ। গলার স্বর তো পাল্টে গেছেই, সেই সঙ্গে খানিক আগে আলাপ হওয়া হাস্যমুখ মানুষটাও যেন কেমন বদলে গ্যাছেন।
পার্থর অসুস্থতার কথা বলতেই কিরকম একটা অদ্ভুত চাহনি দিলেন ‘Oh, so what can I do? You want a doctor to be called?’
না তার আর দরকার হবে না, শুধু এত রাতে এই ওষুধ গুলো জোগাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে, বুঝিয়ে বললাম আমি।
ব্রেগাঞ্জা তার ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। আমি ভেজানো দরজার বাইরে। অস্পষ্ট একটা কথাবার্তার আভাস পেলাম। ব্রেগাঞ্জা আবার এলেন। “Dhonu is coming, he will help you.” আমি একটা ধন্যবাদ আর শুভ রাত্রি জানাতেই খানিক আকস্মিকভাবে বললেন “Rest of the night, close your room doors well, good night!”
কেন হঠাৎ এই কথাটা বললেন সেটা জিজ্ঞেস করবার আগেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
ধনু বেশ চটপটে আর করিতকর্মা। আধ ঘন্টার মধ্যে ঠিক ঠিক ওষুধপত্র কিনে নিয়ে এলো। পাশের একটা দোকান থেকে গরম স্যান্ড উইচ ও বানিয়ে এনেছে সে। আমাদের অবস্থা দেখে খানিক মায়া হলো বুঝি তার। কিচেন থেকে এক ফ্লাস্ক গরম জল করে নিয়ে এলো। সঙ্গে কয়েকটা টি ব্যাগ।
পার্থ চোখ বুজে আছে। কোনরকমে তাকে ধরে তুলে ওষুধ গুলো খাওয়ানো গেল। কারোরই সেরকম ক্ষিদে নেই। তাও প্রায় জোর করেই স্যান্ড উইচ আর ঘরে বানানো চা খেলাম আমরা তিনজন।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। সারাদিন ধকলের পর আমরা ক্লান্ত। জয়শ্রী কে বললাম যদি রাতে দরকার হয় যেন আমাদের দরজায় টোকা দেয়। আর সেই মুহূর্তে ব্রেগাঞ্জার কথা মনে এলো, “close your room doors well”
-“জয়শ্রী রাতে দরকার হলো ফোন করিস”, এই বলে গুড নাইট করে আমি আর রঞ্জনা প্রায় অন্ধকার বারান্দা দিয়ে হেঁটে এসে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়লাম। দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে একটা বিশ্রী ক্যাঁচ করে আওয়াজ হলো ।
ঘরে ঢুকেই অন্ধকার বাথরুমের দিকে নজর গেল। আমার আগেই রঞ্জনা গেল। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আমি ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই আলো নিভে গেল হঠাৎ। মুহূর্তের মধ্যে নাকে এলো সেই মিষ্টি ফুলের গন্ধ। এবার সেটার ঝাঁঝ খুব বেশি। মনে হলো যেন আমার ঠিক আসে পাশেই আছে গন্ধের সূত্র। নিমেষে দৃষ্টি গেল জানালার দিকে। এবার আর স্পষ্ট দেখলাম সেই ছায়া মূর্তি কে। এবার সে স্থির, অপেক্ষমান। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে আসতে দেখি ঘরের আলো দিব্বি জ্বলছে।
সকালে ঘুম ভাঙল যখন তখন মেঘ কেটে গিয়ে নরম রোদ। রাতটা মোটামুটি নিরূপদ্রব কেটে গ্যাছে। পার্থর জ্বর কমলেও পুরো সুস্থ্য নয় সে। আমরা ঠিক করলাম ব্রেকফাস্ট করবো খানিক দূরে কেভেন্টার্স এর ছাদে বসে। পার্থ কে জিজ্ঞেস করাতে সে বেশ খুশিই হলো, কারণ কেভেন্টার্স এ খাওয়ার কথা সে কলকাতা থেকেই ঠিক করে এসেছিল, সুতরাং এ সুযোগ হাতছাড়া করতে সে রাজি নয় মোটেই!
কেভেন্টার্স এর ছাদে বসে এদিক ওদিক তাকালে বহু পুরোনো বাড়ি চোখে পড়ে। দূরে আমাদের হোটেলের চিলেকোঠাও দৃশ্যমান হয়। সেদিকে তাকিয়ে পার্থ খানিক আনমনা হয়ে যায়। ইংলিশ ব্রেকফাস্টের স্বাদ অসাধারণ। গরম কফি তে চুমুক দিতেই গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে। তাড়াতাড়ি পার্থ কে নিয়ে আমরা ভিতরে চলে আসি।
দাম মিটিয়ে বেরুতে বেরুতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তারপরেই আকাশ পরিষ্কার। এই ফাঁকে আমরা একবার টুক করে মলে নাথমলের চা এর দোকানে ঢুঁ মেরে এলাম। পার্থ চড়াই উৎরাই বেয়ে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়াতে হোটেলের ঠিক নীচে রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চে বসে খানিক দম নিতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পর আমরা উপরে উঠে আসতে মিস্টার ব্রেগানসা একঝলক হাসি দিয়ে একখানা জবরদস্ত ‘Good Morning’ ঝাড়লেন !
কালকের রাতের কথা ভোলেন নি দেখছি ।
– How are you now Mr Partha? শরীর ok ?
– “হ্যাঁ , মানে it’s ok ই বলতে পারেন আর কি।“
আমরা এখন রিসেপ্সানের লবিতে বসে আছি। জয়শ্রী আর রঞ্জনা পালা করে তাদের মোবাইল ফোনে ছবি তুলে চলেছে। পার্থ ভারী বিমর্ষ মুখে Gilian Wright এর লেখা “ The Darjeeling Tea Book” এর পুরনো যে কপিটা বইয়ের তাকে রাখা ছিল সেটা নামিয়ে পাতা উলটে পাল্টে দেখছে। আমি সবে আনন্দবাজারের পাতায় উত্তর বঙ্গের বর্ষার গতি প্রকৃতি নিয়ে খবরের দু লাইন পড়েছি কি পড়িনি, ব্রেগানসা সাহেব একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলেন
“কাল রাতে এমনিতে আর কোন disturbance হয় নি আশা করি ? It was a peaceful night otherwise ?”
পার্থ যে কোন কারণেই হোক প্রশ্নটা শুনতে পায় নি আর আমি যখন এই প্রশ্নের খানিক সূত্র বুঝবার চেষ্টা করছি, রঞ্জনা বলল “কাল রাতে আপনাদের হোটেল এ কি কোন পার্টি ছিল? অনেক রাতে খুব হই হই হচ্ছিল – যেমন পার্টি তে হয়ে থাকে আর কি!“
“হ্যাঁ ঠিক, আমিও শুনেছি। সঙ্গে কাঁচের গ্লাস, প্লেট, ছুরি কাঁটা চামচ নড়া চড়ার শব্দ।“ কিন্তু জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে তো কোন মানুষজন চোখে পড়েনি। রাস্তা ঘাটও শুনশান, জয়শ্রী বলে ওঠে।
“What time was it Madam?”
আমাদের অবাক করে দিয়ে দুজনেই সময়টা বলে রাত আড়াইটের আশেপাশে। জয়শ্রী এবং রঞ্জনা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। কারণ এই ঘটনার কথা তারা সকাল থেকে কেউ কাউকে বলেনি! আমাকে বা পার্থ কে তো নয়ই।
ব্রেগানসা খানিক অন্যমনস্ক হয়ে দুবার টোকা দিলেন নিজের কপালে।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হতেই পার্থর আবার জ্বর এল।
খানিক অন্ধকার নামতেই রজারস স্টে জুড়ে প্রসারিত হল এক অদ্ভুত নিঃশব্দতা। নীচের রাস্তা দিয়ে চলেছে মানুষজন। একধরণের ব্যস্ততা! জীবনের আভাস। আর ঠিক তার পাশে এ যেন এক চলতশক্তিহীন, জীর্ণ শীর্ণ ইমারত। ওপরে দিকে তাকাতে বুজলাম বেশ কুয়াশা হয়েছে আজ। আরেকটা জিনিস প্রায় নজর এড়াতে গিয়েও এড়াল না তা হল হোটেলের চিলেকোঠা খানিক আলোক উদ্ভাসিত। হলদেটে মোমের আলো জানালার সারশি বেয়ে বাইরে আসছে। গতকালের মতো না হলেও পার্থর জ্বর রয়েছে। “এবারের বেড়ানোটা যেন কি রকম বেরঙিন হয়ে গেল …” রঞ্জনাই কথাটা বলল “আমার না এই হোটেলটায় আর একটুও থাকতে ভাল লাগছে না!“
“আমারও। দেখো দিব্বি সুস্থ মানুষটা এসে কেমন জ্বর বাঁধিয়ে বসলো, And not for any good reason, জয়শ্রী বলে।
কাল সন্ধ্যেবেলা থেকে আজ এখন অবধি ঘটনাক্রম আমাকেও খানিক ভাবিয়ে তুলেছে বলা বাহুল্য। আমাদের ট্রেনের টিকেট পরশু রাতে। এখনো প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টার ধাক্কা। কি ভেবে কলকাতায় ট্র্যাভেল এজেন্ট কৃষ্ণ মৌলিক কে ফোন করলাম। শনিবারের বাজারে কৃষ্ণকে অফিস এ পেয়ে যাওয়াটাও কাকতালীয়।
“দাঁড়ান দেখি কাল দুপুরের ফ্লাইটের কি অবস্থা । …”
খানিকক্ষণের মধ্যেই আমার মোবাইল ফোনে রবিবার দুপুরে বাগডগরা কলকাতা বিমানের তথ্য তালাশ চলে এল। রাত দশটায় যখন আমরা ঘুমুতে গেলাম তার আগে ট্রেনের টিকেট ক্যান্সেল করে কাল দুপুরের বিমানে আমাদের কলকাতা ফেরবার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে কৃষ্ণ। ব্রেগানসা কেও আমরা সেই মতো জানিয়ে দিয়েছি। হঠাৎ মনে পড়ল গাড়ির ড্রাইভার সুরেশের কথা। সে কি দরকারের কথা বলেছিল সেদিন? সে কি বুঝেছিল আমাদের নির্দিষ্ট দিনের আগেই ফিরে যেতে হবে? সাত পাঁচ না ভেবে সুরেশ কে ফোন করতেই সে রাজি হয়ে গেল। কাল সকালেই সে চলে আসবে আমাদের বাগডগরা পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
মনের মধ্যে একটা ভাবনা আর আশঙ্কা নিয়ে শুতে গেলাম।
তখন কটা বাজে জানিনা। দরজা ধাক্কার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল জয়শ্রীর গলা। ঘুমের মধ্যে প্রথমে মনে হয়েছিল দূর থেকে ডাকটা আসছে, কিন্তু রঞ্জনা ধাক্কা দিতেই বুজলাম, ডাকটা এসেছে আসলে দরজার ওপার থেকে। আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলতেই জয়শ্রীর ফ্যাকাশে মুখ থেকে তিনটে কথা বেরুল যা শুনে আমার গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গ্যাছে।
“পার্থ ঘরে নেই” !!
“সেকি“ !!
রঞ্জনা আমার হাত চেপে ধরেছে। যেটা বোঝা গেল জয়শ্রীর কথায়, তা হল, খানিক আগে জয়শ্রী বাথরুমে গেছিল। পার্থ বিছানায় ঘুমন্ত। কিন্তু বাথরুম থেকে ফিরে এসে সে আর পার্থকে দেখতে পায় না। সামনের দরজাটা হাট খোলা ছিল। এক ঝলক বারান্দার ওদিকে চোখ যেতে দেখলাম নিকষ কাল অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে সিঁড়ির দিকটায়। মাথার মধ্যে বিদ্যুতের মত খেলে গেল … তাহলে কি …!
আমি সামনে আর পিছনে রঞ্জনা ও জয়শ্রী নামতে শুরু করেছি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে। রিসেপ্সানের উল্টো দিকে সেই করিডর । কিছু দেখা যায় না। শুধু আমাদের তিনটে মোবাইল ফোনের টর্চ থেকে বেরুন আলো ইতস্তত ধাক্কা মারছে কাঠের দেয়াল গুলোতে।
“এখানে কি আছে “ জয়শ্রী জিজ্ঞেস করল। এই মুহূর্তে সেই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই আমার কাছে। করিডোরের শেষে পৌঁছে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল। পার্থ দাঁড়িয়ে আছে সেই পর্দা ঘেরা রেস্তরাঁর সামনে। এক হাতে পর্দা সরিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে ভিতরের অন্ধকারের দিকে। আমরা তিন জনেই চীৎকার করে উঠেছি। বোঝা গেল না পার্থ আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে কিনা। আমি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারলাম। জয়শ্রী আর রঞ্জনাও ওকে ধরে সরিয়ে নিয়ে এল । খেয়াল করলাম সারা জায়গাটা ভরে গ্যাছে সেই পাহাড়ি ফুলের গন্ধে।
কোন রকমে পার্থ কে ঘরে এনে শোয়ানো হল। বেশ ভালই জ্বর। ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটে!
কাল রাতের ঘটনা সম্পর্কে আমরা আর কোন আলোচনা করিনি। পার্থকেও কোন জিজ্ঞাসাবাদ করাও অর্থহীন। সুরেশ ঠিক সকাল নটায় গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল রজারস স্টে এর সামনে। এখন আমরা প্রায় জলপাইগুড়ির কাছাকাছি। পার্থ গাড়ির সামনে বসে তার ফোন থেকে গান বাজিয়ে চলেছে একের পর এক।
আমার কিন্তু বীভৎস খিদে পেয়েছে রে , তোদের?’ দুদিন ধরে কুঁকড়ে পড়ে থাকা পার্থ বেশ ফুরফুরে মেজাজে বলে ওঠে।
“হ্যাঁ , আমারও। সময় আছে, একটু থামলেই তো হয়।“ আমার নির্দেশে সুরেশ একটা বেশ ভদ্রস্থ দোকানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দ্যায়। খাওয়াদাওয়া শেষে দুটো পঁয়ত্রিশের প্লেন ধরে আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম।
***********
আজ ১৪ ই জুলাই, ২০১৭। প্রায় এক হপ্তা হতে চলল আমাদের দার্জিলিং থেকে ফেরার। অফিসে বসে খবরের কাগজ উলটোতেই ছোট্ট খবরটা চোখে পড়ল।
“Mysterious death of manager at Darjeeling hotel” .. মিসটার ব্রেগানসাকে গতকাল সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া গ্যাছে হোটেল রজার্স স্টে এর চিলেকোঠায়
What's Your Reaction?
Saptarshi, a finance professional, has a camaraderie with his camera and pen as he tries to capture the wonderful light and sight along his way and write about the world and people around him.