হেঁকু বিদ্যালোচনে
Saptarshi, a finance professional, has a camaraderie with his camera…
এই কয়েক দিন আগেই গেল সরস্বতী পুজো। হেঁকু ছাত্রজীবনের স্মৃতি হাতড়ায়। দুজন মাস্টারমশাই কে সে কখনোই ভুলতে পারে না। ভুলতে পারে না সেই তাৎক্ষণিক মুহূর্তগুলো। এবারের গপ্পে সেই সব চরিত্র আর ঘটনার ঘনঘটা
লেখক : সপ্তর্ষি রায় বর্ধন
“হেঁকু – সিরিজ”
মাস্টার মশাই দের সঙ্গে হেঁকু র সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। কি একটা অদ্ভুত কারণে ছাত্রাবস্থায় নানা সময়ে সে অদ্ভুত অদ্ভুত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে তার কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে। একি নিছক কাকতালীয় না পৌরুষের অনিবার্য সংঘাত, তার সদুত্তর দূরে থাক, কোনো উত্তরই ছিল না হেঁকুর কাছে।
শিক্ষিকা কূলের সঙ্গে কিন্তু এ ধরনের কোনো গন্ডগোল হয় নি। সে সম্পর্ক বরাবরই বড়ই মধুর।
অনেক ঘটনার ঘনঘটার মাঝে হেঁকু এখনও মাঝে মাঝে কিরকম উদাস হয়ে পড়ে দুটো দিনের কথা মনে পড়লেই। যদিও এই দুটো দিনের মধ্যে প্রায় সাত বছর সাড়ে সাত মাসের ব্যবধান তাও হেঁকু কিছুতেই ভুলতে পারেনা সেই ঘটনাপ্রবাহ।
প্রথম ঘটনায় যদিও বা তার বালখিল্য ভাবের কিছুমাত্র প্রকাশ ছিল, দ্বিতীয় ঘটনায় জরিয়ে পড়েছিল সে নেহাতই অবস্থার পরিপ্রক্ষিতে কিন্তু সে আর কেই বা বোঝে, মনেই বা রাখে কে !
সেদিন এক শীতের সন্ধ্যা । দুপুর থেকে ঝুপ ঝুপিয়ে নেমেছে বৃষ্টি। মঙ্গলবার অর্থাৎ বলাই বাবুর আসবার কথা হেঁকু কে পড়াতে। হেঁকু সবে ক্লাস ওয়ান এ ভর্তি হয়েছে শহরতলীর পাড়ার এক কোণে পড়ে থাকা শিশু নিকেতন নামে সেই স্কুলটায়। গত এক বছর ধরে বলাই বাবু পড়াচ্ছেন তাঁর এই ছাত্রকে। বাড়িতে ছিল আম কাঠের তৈরি এক ঢাউস টেবিল আর তার লাগোয়া দু চারখানা হাতল ওয়ালা চেয়ার। তার একটা তে বসতেন মাষ্টারমশাই। ছাত্র হেঁকু কে তিনি আদর করে বসাতেন টেবিলের উপরে।
এরকম একটা আসন সমন্বয় বেশ সুবিধেজনক হয়েছিলো উভয় পক্ষের জন্যই। অক্ষর আর সংখ্যা জ্ঞান বিতরণ ও আহরণ চলছিল বেশ। মাঝে মাঝে অবশ্য হেঁকুর বায়নককা লেগে থাকত।
‘আজ এই কবিতা পড়বো না, ছবি আঁকব ‘, এ ধরনের ছোটোখাটো আবদার হাসি মুখে মেনে নিতেন বলাই বাবু।
সেদিনের ব্যাপারটা অবশ্য ছিল কিছু আলাদা। আগেরদিন নতুন স্কুলের বুক লিষ্ট মিলিয়ে হেঁকুর বাবা কিনে এনেছে খান তিনেক বই। সেগুলো হাতে পেয়ে অবধি হেঁকুর পুলক ধরে না। সব থেকে মন কেড়েছে রঙিন ছবি দেওয়া ইংরেজি রিডার।
সারাদিন সেটা নিয়ে সে এদিক ওদিক ঘুরেছে, পাতা উল্টে পাল্টে দেখেছে ছবিগুলো। লেখা অবশ্য বোধগম্য হয় নি। সে নিয়ে সে খুব একটা বিচলিত, এমনটাও নয়। তবে মনে মনে একটা সুপ্ত বাসনা দানা বেঁধেছে , আজ মাস্টার মশাই কে সে এই বইটাই পড়াতে বলবে।
বলাই বাবু সময় মতো এসে পড়লেন। হেঁকু চটজলদি উঠে পড়লো টেবিলের ওপর অন্য চেয়ারটা বেয়ে। মাস্টার মশাই এর হাতে সে তুলে দিলো তার নতুন বইএর সম্ভার।
বলাই বাবু বেশ একটা গদ গদ ভাব দেখিয়ে বললেন ” বাঃ কি সুন্দর সব নতুন বই। এবার তবে আমরা নতুন ক্লাসের পড়া পড়বো।”
হেঁকু এ কথা শুনে হাতে চাঁদ পেয়েছে। চটজলদি ইংরেজি রিডার তুলে নিলো সে হাতে। মাস্টার মশাই এর দিকে এগিয়ে দিয়ে তার দাবি সনদ পেশ করল , ” তবে এটাই পড়বো।”
“না আইজ এইটা নয় কো, আইজ আমরা অঙ্ক করবো …”
“আজি পড়বো এটা আমিই ই ই -” হেঁকু আধো আধো গলায় বায়না ধরে।
“না, আগেরদিন এর অঙ্ক গুলা শেষ করুম আজ আমরা। তারপর, ওইটা পড়ন যাইব…অঙ্ক খাতা টা খোল…”
এবার হেঁকু জেদ ধরে বসে। বইটাকে আঁকরে ধরে থাকে সে।
বলাই বাবু এবার খানিক রেগে গিয়ে বলেন “কইতাসি বার বার তরে, অঙ্ক খাতা বাইর কর।”
এবার খানিক নীরবতা। হেঁকু মাথা নিচু করে বসে আছে।
বলাই বাবু এবার একটা ঈষদুষ্ণ হুংকার ছাড়লেন ” কিরে কানে কথা যাইতাসে না তোর?”
পরের মুহূর্তে যা ঘটলো তার জন্য বলাই বাবু শারীরিক ও মানসিক, কোনো ভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না এ কথা হলফ করে বলা যায়।
“আমার কথা তোর কানে যাচ্ছে না? বলছি তখন থেকে যে এই বইটা পড়বো …’, সামনে বসা হেঁকু হাঁক পাড়ে।
বলাই বাবু র চোখ খানিক কুঁচকে গিয়ে ভুরু দুটুকে ওপরে ঠেলে তোলে; মোটা কালো চশমাটা নাক বেয়ে সরাত করে নেমে আসে নিচে; তাঁর খুব গরম লাগে কানে আশে পাশে, ডান হাতটা কেঁপে উঠে রওনা হয় হেঁকুর দিকে, একটা আঘাত হানার প্রস্তুতি নিয়ে!! কিন্তু চকিতে তার মুখের উপর সজোরে এসে পড়ে হেঁকুর হস্ত নিক্ষেপিত ইংলিশ রিডার !!
“বাবা রে”, একটা আর্তনাদ প্রতিধ্বনি তোলে।
কি এক অজানা কারণে এর পরের ঘটনা আর মনে পড়ে না হেঁকুর। খুব মধুর স্মৃতি নয় হয়ত !
দ্বিতীয় ঘটনা কোনো এক শীতের রাতের বাঁকুড়ায়। হেঁকু এখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। সেবার স্কুল থেকে বেড়াতে যাওয়া হলো বাঁকুড়া বেশ বড় সর একখানা বাস ভাড়া করে। নৃপতি বাবু , পিটি টিচার, তিনি একাধারে দলপতি ও নির্দেশক। শুধু ছেলেপুলে কেনো, অন্য শিক্ষক দের চালনা করবার দায়িত্ব তাঁর। কখন বাস ছাড়বে, থামবে, কোথায় কখন কি খাওয়া দাওয়া হবে, কে কোন ঘরে থাকবে, কেউ কথা না শুনলে কড়া হাতে শৃঙ্খলা রক্ষা এ সবই তাঁর কাজ।
পরনে তার ধব ধবে সাদা ট্রাক সুট, পায়ে কেডস জুতো, হাতে দস্তানা, মাথায় টুপি, গলায় একটা দূরবীন আর ঠোঁটে একটা হুইসিল!!
সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে বাঁকুড়া পৌঁছতে বেশ রাত হয়েছিল। কখন যে ইউথ হোস্টেলের ভেতরে বাস এসে দাড়িয়েছে হেঁকু টের পায় নি, ঘুমে অবসন্ন সে। জানালার পেটিতে মাথা রেখে, পাশের খালি সিট এর ওপর পা জোড়া তুলে গুরি সুরি মেরে শুয়েছিল সে। আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা।
ওদিকে নৃপতি বাবু হুইসেলের আওয়াজে মাতিয়ে তুলেছেন হোস্টেল চত্বর।
“সব্বাই তোমরা খাবার টেবিলে বসে পড়। সব্বাই না বসলে খাবার দেওয়া যাচ্ছে না”, ঘোষণার আগে পিছে বাঁশির কানফাটা আওয়াজ।
এ সবের মধ্যে একবার রোল কল করতেই ধরা পড়লো হেঁকু র অনুপস্থিতি। বাঁশি বাজিয়ে এদিক ওদিক ডাকাডাকি করা হলো হেঁকু কে। কিন্তু কে কোথায় ?
নৃপতি বাবুর চোখে খানিক চিন্তার ছাপ। কিন্তু দমবার পাত্র নন তিনি মোটেই। রাতের অন্ধকারে বাথরুম, বাগান এসব দেখে এলেন। তারপর টর্চ লাইট জ্বেলে উঠে পড়লেন বাসের ভেতর।
উঁচু সিট এর পিছনে ঘুমন্ত হেঁকু কে আবিষ্কার করতে বেগ পেতে হলো না নৃপতি বাবুর। প্রথমে কানের কাছে লম্বা হুইসেল বাজালেন। চাদর মোড়া হেঁকুর কোনো হেল দোল নেই।
এবার সামনের আর পিছনের সারির সিট এর ওপর ভর দিয়ে তিনি ঝুঁকে পড়লেন ঘুমন্ত মানুষটার ওপর। সন্দেহ হলো এটা হেঁকু তো ?
একটা জোরে ঝাঁকুনি দিলেন।
“ঐ হেঁকু , ওঠ ওঠ”!
বেশ খানিক ধস্তা ধস্তির পর চাদরের নিচে থেকে দেখা মিলল হেঁকু র ঘুম জড়ানো মুখের। স্বপ্নে দেখা বাঁকুড়া র মাটির ঘোড়া কেনো যে হঠাৎ ” ওঠ ওঠ ” করে ডাক ছাড়লে সেটা বোঝে নি সে। পর মুহূর্তে চটকা ভাঙতে সেটা হয়ে গেল নৃপতি বাবুর মুখ!
“সব্বাই নেমে গেল আর তুই ঘুমিয়ে আছিস ? ” টর্চ টা মুখের ওপর ফেলে গম্ভীর গলায় বললেন , “গেট আপ কুইক, শিগগির হাত মুখ ধুয়ে খেতে চল “, বলেই হুইসেল বাজালেন দু বার; হেঁকু র কান দুখানা বিশ্রী ভাবে ভো ভো করে উঠলো।
হেঁকু এবার মাথার ওপরে তাক থেকে তার সুটকেস খানা নামানোর চেষ্টা করে। কোথাও আটকাচ্ছে বাক্সটা। ঠেলা ঠেলি করে লাভ হয় না। নৃপতি বাবুর তর সয় না।
“কি করিস তুই ? ”
“স্যার, মনে হয় পিছনে কিছুতে আটকাচ্ছে “।
“সর দেখি তুই , আমি দেখছি “!
নৃপতি বাবুর কব্জি র জোর বটে। এক হ্যাঁচকা টানে হেঁকু র সুটকেস ওপর থেকে আলগা হয়ে নিচে নেমে আসে।
একটা তাচ্ছিল্যের সুর শোনা যায় নৃপতি বাবুর মুখে।
“হুঃ, তোদের ফিটনেস বড্ড কম। বরাবরই লক্ষ্য করি আমি… নে এবার তাড়াতাড়ি কর…”!
হেঁকু র সামনে সিট এর ওপরে সুটকেস টা বসে আছে। পকেট থেকে একটা ছোট্ট চাবি বার করে হেঁকু ঢোকালো গা তালার গর্তে। তারপর বাঁদিকে মোচড়। খুললো না তালা। এবার অন্য দিকের তালাটা খোলার চেষ্টা। না, সেও একই অবস্থা। ওদিকে নৃপতি বাবু অস্থির হয়ে পড়ছেন।
“স্যার, সুটকেস ত খুলছে না” ! হেঁকু মিন মিন করে বলে।
“খুলছেনা? খুলছেনা মানে টা কি? চাবি ঘোরাবি, তালা খুলবে, এই তো দস্তুর। কই দেখি সরে দাঁড়া।”
এক কোণে জড় সড় হয়ে অপরাধীর মত দাড়িয়ে থাকে হেঁকু। ব্যাপক টানা হ্যাচড়া চলে খানিক সুটকেস আর নৃপতি বাবুর। না, এবার আর তাঁর পেশী বল কাজ করে না।
এই ঠাণ্ডা তেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তাঁর কপাল জুড়ে।
এবার কঠিন গলায় নির্দেশ আসে “রাস্তা থেকে একটা আধলা ইঁট নিয়ে আয় তো”
হেঁকু নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারে না।
“স্যার, ইঁট দিয়ে কি হবে ?’
“ভাঙতে হবে সুটকেস! আর কোনো উপায় নেই। জানিস না, when the going gets tough, tough gets going… ইট নিয়ে আয়”।
হেঁকু র বুকের ভেতর টা হাহাকার করে ওঠে। বাবা কে কতরকম ভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সুটকেস টা সে নিয়ে এসেছিল। বাড়ি ফিরে এই ভাঙ্গা বাকসো সে দেখাবে কোন মুখে। রাস্তায় নেমে খানিক ইতস্তত করলো হেঁকু। বাসের ভেতর থেকে নৃপতি বাবুর হুইসেলের আওয়াজ সঙ্গে চিৎকার ভেসে আসে। হেঁকু একখানা পাথর পায় হাতের কাছে। সেটাকেই হস্তগত করে ফেরে সে অকুস্থলে। এর পরের মুহূর্তের ঘটনা খুব ছোট কিন্তু অতীব তাৎপর্যময়।
নৃপতি বাবু টর্চ টা ধরতে দেন তার ছাত্রকে এবং সেই পাথরের এক এক ঘায়ে সুটকেসের গা তালা দুটির দফারফা করে ফেলেন চক্ষের নিমেষে। কিন্তু ডালা খোলার পরে হেঁকু র কেমন যেন অচেনা লাগতে লাগে ভেতরের জিনিসপত্র গুলোকে। কিছুতেই সে খুঁজে পায় না তার মা এর হাতে সযত্নে ভাঁজ করে দেওয়া সেই লাল ডোরাকাটা গামছাটা।
নৃপতি বাবু পাথরটা ছুঁড়ে ফেলেছেন জানলা দিয়ে বাইরে। দু হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলছেন “নে, এবার তাড়াতাড়ি কর, অনেক দেরি হয়ে গেছে, যত্ত রকম উটকো ঝামেলা তোদের জন্য”
ততক্ষনে হেঁকু বুঝেছে কোথাও একটা বিরাট গন্ডগোল হয়ে গেছে। সে বলে ওঠে ” স্যার, এ সুটকেসটা আমার না …” !!
“কি? কি বললি? সুটকেস টা তোর নয়? ইডিয়েট, তোর নয় তো কি ওটা তবে আমার ?? ” এবার রাগে ফেটে পড়েন তিনি।
এই কথা বলে নৃপতি বাবু ফিরে আসেন হেঁকু র সিট এর সামনে। টর্চের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সুটকেসের ভেতর।
নৃপতি বাবু এক ঝলকে দেখতে পান সেই আকাশী নীল রঙা গুরু কলার দেওয়া শার্টটা যেটা উনি নিয়ে এসেছেন দল মাদল কামানের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবেন বলে।
এর পরের ঘটনা হেঁকু ভুলতে চেয়েও ভোলে নি কোনোদিন এ আমি নিশ্চিত। কিন্তু আমাকেও সে বলে নি এ ব্যাপারে কিছু কোনোদিনই !!
What's Your Reaction?
Saptarshi, a finance professional, has a camaraderie with his camera and pen as he tries to capture the wonderful light and sight along his way and write about the world and people around him.