হেঁকু – খেজুরের রস!
Saptarshi, a finance professional, has a camaraderie with his camera…
নীলমণি আর মলিনা সোনাঝুড়িতে খেজুরের রস খুঁজতে গিয়ে কি পেল? জানতে হলে পড়েতে হবে ঐ মজার গল্পটি।
লেখক : সপ্তর্ষি রায় বর্ধন
বোলপুর পৌঁছে ইস্তক নীলমণি আর তার বউ মলিনা মাথা খারাপ করে তুলেছিল হেঁকুর। এটা কিনবো সেটা কিনবো তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাউল গান, সাঁওতালি নাচ, কালীবাড়িতে পুজো, রবীন্দ্র ভবন দর্শন, ডিয়ার পার্ক ভ্রমন, এমন আরো কত কিছু টুকি টাকি। এই সব আবদার সামলাতে হচ্ছে হেঁকু কে, হাসি মুখে।
তখন সন্ধ্যা হয় হয়। সোনাঝুড়ির হাট সেদিনকার মতো শেষ। মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বেলে শেষ বেচা কেনা টুকু করতে ব্যস্ত সবাই। আচমকা ভূঁই ফোর উদয় হলো সুখরাম। ব্যাটা কেলে ভূত, এক পাটি সাদা দাঁত দেখিয়ে হেঁকুর সামনে এসে দাঁড়ালো সে।
– ‘ বাবু কবে আসা হলো বটে ?’
– ‘ আজ সকালে ‘
-“বউ দিদি আসে নাই , দেখছি লাতো …”
– ‘ না আমি এসেছি আমার বন্ধুদের নিয়ে। বৌদি আসে নি। তোমার ব্যবসার কি খবর ‘ ?
” ইবার তো সি ভাবে ঠান্ডা পরে লাই গ দাদা। খেঁজুড়ের রস কোম, স্বাদ ও তেমন লয়। শিউলিরা ভাল গাছ কাটা রস অন্য জায়গায় বিচা দ্যায়। তবু গুড় হচ্ছে …. তার মধ্যে তো ই অবস্থা, বিচা কিনা বড়ো কোম “, বলেই চলে সুখরাম।
কখন মলিনা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে, অন্ধকারে ঠাহর করেনি হেঁকু।
-“কিসের কথা বলছে হেঁকু দা ? খেঁজুর গুড় বুঝি ??? আমি কিনবো।” মলিনার চোখ মুখ চিক চিক করে ওঠে, অন্ধকারেও !
হেঁকু বুজল, কুমির ঢোকার মতো একখানা খাল সে নিজে হাতেই কেটেছে নিজের অজান্তে !!
ব্যাস হয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লিস্টি তে জমা পড়েছে নতুন অভিযানের অনুরোধ।
এর মধ্যে কোথা থেকে নীলুও এসে পড়েছে। মলিনা গদ গদ হয়ে বলে, ” শুনছো, এখানে টাটকা খেজুরের গুড় পাওয়া যাচ্ছে। আমরা নেব না ?? বলো বলো …!” এসব ক্ষেত্রে নীলুর “না” বলা যে একেবারেই সমীচীন নয়, তা হেঁকু বেশ বোঝে।
হলোও তাই। সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল সে। এরকম যুদ্ধের বাজারে খরিদ্দার পেয়ে মহা খুশি সুখরাম।
– “ভোর ভোর পৌঁছে যেও দাদা। ” এই বলে আবার এক প্রস্থ দন্ত বিকশিত করে উধাও হলো সুখরাম।
সে রাত্তিরে নীলু আরো এক কান্ড করলো। – ” আচ্ছা হেঁকু, তোর ওই লোকটা খেজুরের গুড় বানায় যখন, তখন নিশ্চই রস ও বিক্রি করে। আহা, কতদিন খাইনি রে খেজুর রস। কাল পাওয়া যাবে নিশ্চই …. কি বলিস ?” মলিনা আরো মেতে উঠলো তার বরের কথায়।
– ” সেই রূপনারাণপুরে মামা বাড়ি গিয়ে শেষ খেয়েছিলাম ….কাল খেতেই হবে গো ঠাকুর পো, তুমি কিন্তু ওই সুখিয়া কে বলে ব্যবস্থা করতে, যে করে হোক।”
” সুখরাম…”
” ওই হলো, তোমার সুখরাম! ”
ঘুম যখন ভাঙলো তখন সকাল পৌনে ছ’টা । দরজা খুলে হেঁকু দেখছে কত্তা গিন্নি সেজে গুজে একদম রেডি। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে সে নীচে নেমে আসে। শুরু হয় গোয়ালপাড়া অভিমুখে যাত্রা।
কাঠের উনুনে তখন ইয়া বড় একটা কড়াইতে টৈ টুমবুর খেজুরের রস জ্বাল বসেছে। সাদা ধোঁয়া আর মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ইদিক সেদিক। ওদেরকে দেখে সুখরাম মাঙ্কি টুপির মধ্য থেকে দন্ত রাশির আলো জ্বালে। নীলু আর মলিনা দুখানা মোবাইল ফোন নিয়ে পটাপট ছবি তুলতে লেগেছে। সুখরাম ও আজকাল বুঝে গ্যাছে সোশ্যাল মিডিয়ার চমক দমক। কাজের মাঝেই উদার মনে শট দিয়ে চলেছে সে।
“ ও সুখিয়া দাদা, তোমার কাছে খেজুরের রস আছে, খাওয়া যাবে ?” মলিনা জিজ্ঞেস করে বেশ একটা আধো আধো গলায়। কোন উত্তর নেই। শুনতে পায় নি ভেবে এবার হেঁকু হাঁক ছাড়ে, “ কি গো সুখরাম, দাদা বউদি কে একটু খেজুরের রস খাওয়াবে না ?
মুখখানা ব্যাজার করল এবার সুখরাম।
-“ হাড়ি ফাঁকা গ, সব রস তো জ্বাল বসয়ে দিয়েছি; কাল এসো, কাল খেও “ !
মলিনার মুখখানা এবার মলিন হয়ে উঠল। আজই কলকাতা ফিরে যাওয়া; সুতরাং এ যাত্রা আর খেজুর রস জুটবে না কপালে। পাঁচ দশ কিলো গুড় কিনে বাড়ির দিকে রওনা দিল তিনজনে।
উত্তরপল্লির দিক থেকে তখন হু হু করে হাওয়া বইছে। পুলিশ ব্যারাকের পিছনে মেঠো রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে তারা। আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টি নামলে সামনের বাঁশ বাগান বা হনূমানজী বটের নীচে আশ্রয় নিতে হবে।
নীলুই লক্ষ্য করেছে।
লাল মেঠো রাস্তার বাঁকে সাইকেল চড়ে একটা লোক এদিকেই আসছে , হ্যান্ডেলে ঝুলছে দুটো খেজুর রসের হাড়ি। হেঁকু কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীলু চেঁচিয়ে ওঠে – “আরে ও ভাই, তোমার কাছে কি খেজুরের রস আছে ? না হাঁড়ি ফাঁকা ?”
লোকটা শুনতে পেয়েছে। সাইকেল এর গতি কমিয়ে সে এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। একটা দেঁতো হাসি তার মুখে, বলল, “ হবে স্যার, একিবারে টাটকা রস, গাছ কেটে লিয়ে এলাম।“ মলিনার মুখেও খুসির আভাস। ততক্ষণে রসের হাঁড়ি সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে খুলে নিয়ে লোকটা খুলে ধরেছে নীলুর নাকের নীচে।
“ আহহা, কি সুন্দর গন্ধ রে; দেখেছিস হেঁকু, রাখে হরি মারে কে? রস না খেয়ে এবার শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাওয়া নেই।“
হেঁকু মিন মিন করে কিছু বলবার চেষ্টা করে। কিন্তু কত্তা গিন্নি কেউই তাকে পাত্তা দিতে রাজি নয়।
“তোমার কাছে গ্লাস আছে তো ভাই ?”, মলিনা জিজ্ঞেস করে , “ খাব কিসে ?”
এবার লোকটা মাথা চুলকতে থাকে। “ আইগ্যে, গেলাস তো লাই ;”। হেঁকু নিশ্চিন্ত হল, যাক মাঠে ঘাটে খাওয়াটা আটকান গেল তবে। কিন্তু পরক্ষনেই তার ভুল ভাঙল।
“ও ভাই, তুমি এই বোতলে ভরে দাও রস”। যে জলের বোতল টা এতক্ষন ছিল মলিনার হাত ব্যাগের ভেতর, সে হাটের মাঝে ছিপি খুলে আত্মপ্রকাশ করে। মুহূর্তে লোকটার মুখ খুসি তে ভরে উঠল। সঙ্গে নীলুরও !
“ কত দেব তোমায়, এই এক বোতল রসের ?”
“ দ্যান, পনের টাকা”…
টাকা নিয়ে লোকটা সাইকেল চালিয়ে দিল। হেঁকুর পাশ দিয়ে যাবার সময় সে স্পষ্ট শুনল লোকটা গুন গুন করে গান ধরেছে … “ অ পশ্চিমের বাতাসে দক্কিনের ম্যাঘেতে সুনার ছাতা ভাঙ্গিল রে…” !
নীলু ততক্ষণে বোতল থেকে দু চুমুক মেরে দিয়েছে। দুবার চোখ বুজে “ আহহ আহহ “ করল সে। উত্তুরে হাওয়ার শিরশিরানি আরও বেরেছে এর মাঝেই।
“ বুজলি হেঁকু, কোথায় লাগে মিনারেল ওয়াটার বা কোল্ড ড্রিঙ্ক … একি দামে কত স্বাস্থ্যকর জিনিস খাচ্ছি ভাবতে পারছিস ?“ এই ফাঁকে মলিনাও দু চুমুক মেরে দিয়েছে বোতল থেকে। তার মুখ জুড়ে এক পরিতৃপ্তি ।
কত্তা গিন্নির এ হেন রস আস্বাদনের মাঝে তেঁতো ভাব ছড়াতে মন চায় না হেঁকুর , কিন্তু কোথাও যেন খটকা লেগেই থাকে তার মনের মধ্যে।
আর দশ মিনিটের মধ্যেই সেদিন বাড়ি পৌঁছনো গেল। তারপরেই নীলু বাবু আর বিবি সোজা বিছানায়। খালি হ্যা হ্যা করে হাসে আর জরানো গলায় বলে “ বুজলি হেঁকু শরীরটা কেমন কেমন হাল্কা লাগছে !” এর মাঝে আরও দু এক চুমুক মেরেছে তারা বোতল থেকে। অসহায় লাগে হেঁকুর কি করবে এখন সে। ডাক্তার ডাকবে ? কি মনে হওয়াতে , “ দশরথ ,দশরথ” করে হাঁক পারল সে। দশরথ হল এ বাড়ির করিতকর্মা কেয়ার টেকার। এক ডাকেই সে হাজির ।
ঘরের এক কোনায় তখন সেই বোতল গড়াগড়ি যাচ্ছে। ভেতরে তরলের অভিমানী তলানিটুকু।
হেঁকুর নির্দেশে বোতলের ছিপি খুলে সে নাকের সামনে ধরে। পর মুহূর্তে টুক করে গলায় ঢেলে দ্যায় সে তলানিটুকু। দশরথের মুখ চোখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে , “ বেশ ভাল বানাইছে বটে , সকালের গাছ কাটা রস তো … তাড়ির স্বাদ একিবারে অন্যরকম …”।
ভেতরের ঘর থেকে নীলমণি আর মলিনার হাসি ভেসে আসে আবার !!!
What's Your Reaction?
Saptarshi, a finance professional, has a camaraderie with his camera and pen as he tries to capture the wonderful light and sight along his way and write about the world and people around him.