হেঁকু আর ওর টর্চ



Saptarshi, a finance professional, has a camaraderie with his camera…
হেঁকু সেদিন বসে ছিল যখন তার স্ত্রী এসে টর্চের আবদার করলেন। অবশ্য কারণটা খুবই হাস্যকর। কেউ একজন বলেছিলেন টর্চ বা বাতি জ্বালালে নাকি করোনা ভাইরাস চলে যাবে। তবে স্ত্রীর ফরমাইস রাখতে হবে, ও পারবে কি টর্চ খুঁজে বের করতে ? জানতে হলে পড়তে হবে।
“হেঁকু – সিরিজ”
শনিবার সকাল থেকে বাড়িতে হুলুস্থূল। আপিসের নিয়মে আজ ছুটি। হলে হবে কি, হেঁকুর বড়াত মন্দ। তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে নতুন এক কর্মময় সকাল। ঠিক যেন আকাশবাণীর প্রভাতী অধিবেশন। কাল সারা রাত ধরে হেঁকু ভেবেছে আজ সকালে কাজটা সে কোথা থেকে শুরু করবে। আসলে সে ভাবতেই পারেনি এরকম একটা সময়ে এরকম একটা জিনিস তাদের সংসারে দরকার হবে। চিনে রোগ ছিনে জোঁকের মতো লেপটে রয়েছে গত দু হপ্তা ধরে। আপিস যাওয়া নেই, নেই লাট্টুদার দোকানের চা আড্ডা। তাড়িয়ে তাড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ার মজা নেইl পাত্র পাত্রী সংবাদ এর পাতা বেরোচ্ছে না, যেটা সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। সিনেমা হলে তালা। নেই তাই সিনেমার খবর। যা রয়েছে তা হল বউ এর এটা – সেটা, ফাই ফরমাশ খাটা। সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে হেঁকু। এসবের মাঝেই হেঁকু র বউ, গতকাল ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় দাবি জানালো সেই জিনিসটার ।
“বুজলে একটা টর্চ লাইট দরকার। সে একটা ছিল না বাড়িতে, দেখো তো পাও কিনা …”!
এক চিলতে দোখনে বারান্দায়, ফুরফুরে হাওয়ায় বসে হেঁকু সবেমাত্র তখন আবিষ্কার করেছে Marie বিস্কুটের গায়ে ১৮ টা ফুটো আছে… এবং ভাবছে বিপিন কে এই তথ্য টা জানাবে কি জানাবে না, একটা বাজ পড়লো তার মাথায়।
“টর্চ? টর্চ দিয়ে কি হবে? আর সেতো তোমার মোবাইল ফোনের পিছনেই আছে একটা। খাটের তলায় খুঁজবে কিছু ??”
“তুমি তো দেখছি কিছুই ই খবর রাখো না। সারাক্ষণ তো ফোন টায় মুখ গুঁজে রেখেছ, এটাও জাননা? যাক গে, শোনো রবিবার রাতে ওটা লাগবে আমার। ওসব ফোন টোন এর বাতি দিয়ে হবে না। টর্চ টাই চাই। খুঁজে বার কর। “
চা খাওয়া মাথায় উঠলো হেঁকুর। এই বসত বাড়ির কোন কোণে সেই মহামূল্য বস্তু টি ঘাপটি মেরে আছে এটা ভেবেই আকুল হয় সে। বিলকুল মনে পড়ছে না কিছু। আসলে যে টর্চ নিয়ে হেঁকু র বউএর দাবিদেওয়া, সে বস্তুটি বহুদিন আগে হেঁকু দের বাড়িতে এসেছিল এক চোরের হাত ধরে। সে সময় এই শহরতলির আনাচে কানাচে ছিল প্রচুর চোর যাদের মধ্যে ছিঁচকে দের সংখ্যা ছিল বেশি| কোনো এক বর্ষনসিক্ত রাতে সেরকমই একটি দূর্বলমতি তস্কর ফেলে গেছিলো পাঁচ সেলের লম্বাটে ধাতব টর্চ খানা। হেঁকুর দিদু ভয় পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ওই ধাতব বাতি খানা সযত্নে আগলে তুলে রেখেছিল। এর পর পরই শুরু হয় লোডশেডিং। হারিকেনের পাশাপাশি টর্চ টার রীতিমত কদর বেড়ে যায়। অন্ধকার ভেদ করে ফুটে ওঠে আলো। ব্যাটারি এর জোর থাকলে, লোডশেডিং এর সময় আকাশ অবধি একটা আলোর পথ তৈরি হতো। দিদু আবার যত্ন করে টর্চের সামনের দিকে আর পিছনের আঙটায় বেঁধেছিলো দেড় বিঘৎ একটা দড়ি। প্রয়োজনে সেটা কে কাঁধে ঝুলিয়ে নেওয়া যায়। হেঁকু দের বাড়িতে তখন হাতে হাতে (বা কাঁধে কাঁধে) ঘুরত সেই টর্চ। কিন্তু মুশকিল ছিল একটাই। মাঝে মাঝেই টর্চটা আত্মগোপন করতো। তখন তাকে কিছুতেই পাওয়া যাবে না। তাকের ওপর, টেবিলের নিচে, আলমারির চালে, রান্নাঘরের কুলুঙ্গি তে, বালিশের খাঁজে এবং আরও আরও নানা অকুস্থলে তাকে খোঁজা হতো।
কিন্তু না । কিছুতেই তাকে পাওয়া যাবে না। অবশেষে সবাই মিলে ভাববার চেষ্টা করতে হবে শেষ বার লোড শেডিং হবার সময় কার হাতে ছিল ওটা। এরকম স্মৃতি বাহী হয়ে সেই টর্চ কখনো বা পাওয়া গ্যাছে , তিনতলার সিঁড়ির শেষ ধাপে, কখনো তুলসী গাছের নিচে, কখনো বা বাথরুমের শাওয়ার এর ডাঁটিতে দোদুল্যমান অবস্থায়!! হারিয়ে অবিশ্যি সে যায় নি কখনো। তারপর লোডশেডিং এর যুগ পেরিয়ে আলোক উদ্ভাসিত হয়েছে জীবন যাপন। এসেছে মোবাইল ফোন। কালের নিয়মে অদৃশ্য হয়েছে হেঁকু র সেই টর্চ। শেষ কবে দেখা গেছিলো তাকে, তাও অনেকবার মনে করবার চেষ্টা করলো হেঁকু। কিন্তু নাঃ! কিছুই মনে পড়লো না। আজ তাই সকাল সকাল উঠে হেঁকু গোখোঁজা শুরু করে দিয়েছিল। সম্ভাব্য সব জায়গা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে। ফেসবুক এ ছুঁড়ে দেওয়া নির্বাক, নির্বোধ চ্যালেঞ্জ এর থেকে এ ঢের ঢের বেশি বড়ো এ চ্যালেঞ্জ!! মাঝে মাঝেই নীচ থেকে বউএর গলা পায় হেঁকু ।
” পেলে ? খোঁজো ভালো করে , আসবো আমি ? “
অবশেষে শনিবারের বার বেলায় দুটো বেজে সাতান্ন মিনিটে হেঁকু র ঠোঁটে বিজয়ীর হাসি। হেঁকু র মায়ের আলমারির লকার থেকে বেরিয়ে এলো সেই টর্চ। বেশ একটা পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে হেঁকু বসেছে টর্চ হাতে। কিন্তু খানিক বাদেই সে বুঝতে পারলো লড়াই এখনও বাকি। কারণ, যতই স্মৃতিবিজড়িত হোক না কেনো, না- জ্বলা টর্চের কোনো দাম নেই এই পৃথিবীতে এবং তার গিন্নির কাছে তো বটেই! অতএব এবার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বগলা ভরসা। বগলার দোকানের সামনের শাটার আধখানা খোলা। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে দুখানা সিরেঙ্গে মার্কা কালো হাত খোলা ছেঁড়া কিছু ইলেকট্রিক তার আর সুইচ নিয়ে কিসব করছে। হেঁকু মাথা নিচু করে গলা ঢুকিয়ে বগলা কে আবিষ্কার করে।
“ওরে বগলা এটা তে ব্যাটারি ভর দেখি”, এই বলে খুব সন্তর্পনে টর্চটা রাখে কাঠের কাউন্টারে।
“কি করেছ গুরু !! এই মান্ধাতার আমলের মাল টা পাইলা কোথা থিকা ?? ” বিশ্রী খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঠে বগলা, ” তবে হ্যাঁ, এসব মাল যদি একবার জ্বলে, তবে কিন্তু হেব্বি পাওয়ার ….!!”
লাল লাল পাঁচ খানা ব্যাটারি মুহূর্তে সেঁধিয়ে গেলো টর্চটার বর্তুলাকার পেটে। পিছনের ঢাকনা বন্ধ। এবার সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ।বগলা টর্চের চাবি টিপেছে। জ্বললো না। আবার – আবার। না তাও একরত্তি আলো ফুটলো না। এর পর এই বন্ধের বাজারে একজন হিতৈষী হিসেবে বগলা যা করলো তার তুলনা হয়না! বাল্ব, ভেতরের ধাতব পাত সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আধঘন্টা পরে সে মুখখানা ব্যাজার করে বললো,
“মনে হয় শর্ট সার্কিট হইয়া গ্যাসে ভিতরে। লক ডাউন টা যাউক, দিয়া যাইও, ঠিক কইরা দিমু “।
চরম হতাশা নিয়ে বাড়ি ফেরে হেঁকু। বাড়িতে ঢুকতেই বউএর গলার স্বর পায় সে।
” হ্যাঁগো রমাবৌদি , আমি তো একটা বড়ো টর্চ জ্বেলে দেবো ঠিক করেছি। কাকলি তো বললো কচি মোমবাতির প্যাকেট ব্ল্যাক হচ্ছে।”
রান্নাঘরের জানালায় গপ্পো চলেছে তখন। সারা সন্ধ্যে গুম হয়ে বসে রইলো হেঁকু। মাঝে বিপিনের ফোন এসেছিল। তার সঙ্গেও কথা বলে নি সে ভালো করে। টর্চ টা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। আগে পিছে করে সুইচটাকে। কিন্তু কিছু হয় না। রাত নটা বেজে বেয়াল্লিস মিনিটে হেঁকুর কি যেন মনে পড়ে। আতি পাতি করে খুঁজে বার করে সেই তামার এক পয়সা টা ঠাকুরের আসনে রাখা লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে। টর্চের পিছনে ঢাকনা আর ব্যাটারি র মধ্যে সেটা রেখে চেপে বন্ধ করে।সোনার কেল্লার মুকুলের মতো সব যেন মনে পড়ে তার!! এবার তিনবার , এক এক সেকেন্ড বাদে বাদে, আলতো ধাক্কা, তারপর একখানা জোরদার চাটি মারতে হবে টর্চের পিছনে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না হেঁকু। সেই কট কট করে আওয়াজ টা হলো মনে হচ্ছে। এবার সামনে কাঁচের ওপর একটু মোলাওম করে টুসকি মারতে হল…..!!! আলো জ্বলে উঠলো টর্চের। দীপ্তময় হলো হেঁকুর মুখ। গিন্নির হাতে টর্চ লাইট জ্বেলে তুলে দেয় হেঁকু। টর্চ তো নয় , যেন অলিমপিকের মশাল। ছোটখাটো টিপস দিতে ভোলেনা ;
“আলোটা জ্বালিয়ে বেশি নড়াচড়া করো না। বেশি এদিক ওদিক করলেই কিন্তু আস্তে আস্তে নিবে যেতে পারে।”
মুখে হাসি ফোটে গিন্নির।
তবে যেটা বলে উঠতে পারে নি হেঁকু সেটা বড়ো সাংঘাতিক। টর্চের পুরনো স্প্রিং টা ভয়ঙ্কর শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল শেষ দিকে। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ বিদ্যুৎ গতিতে ঢাকনা খুলে ছিটকে বেরিয়ে আসতো, আর তার পিছনে পিছনে ধেয়ে আসতো পাঁচ পাঁচ টা ব্যাটারি কামানের গোলার মতো। ঐ ধাবমান ব্যাটারি র আঘাতে বেশ কয়েক জন আহত হয়েছিলো সে সময়ে মনে পড়ে হেঁকুর !!
আজ রবিবার। আর কয়েক ঘণ্টা বাদেই নাকি জ্বালা হবে টর্চ। দেশের নাকি তাতেই প্রভূত মঙ্গল। কে জানে …!! বিপিন কে ফোন করে হেঁকু “শোন, রাত পৌনে ন’টার সময় একবার বাড়ির বাইরে আসিস… আমি যাবো !!’
(এই কাহিনীর প্রেক্ষাপট হয়তো বা অনেকের মনে থাকবে। সেই রবিবারটা ছিল একটা দুঃসময়ের শুরু সারা দেশ জুড়ে; পৃথিবীর ওপর নেমে এসেছিল ঘোর অভিশাপ ।)
What's Your Reaction?

Saptarshi, a finance professional, has a camaraderie with his camera and pen as he tries to capture the wonderful light and sight along his way and write about the world and people around him.