হাতের মুঠোয় স্বর্গ – বুমলাপাস



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
কয়েক দিন আগেই ভারতের মাটিতে চীনের অনুপ্রবেশ। অরুণাচলের তাওয়াং অবধি ছিল চীনের অগ্রাসন। এরই কিছুদিন আগে শীত পড়ার মুখে সেলাপাস, তাওয়াং, বুমলাপাস ঘুরে এলেন আমাদের কলমচি রাজকুমার মুখার্জি। তাঁর কলমে আজ আমরা বেড়াবো সেই ঘুরে আসা অরুণাচলের কিছু অংশ।
চীনারা দামামা বাজিয়ে নয়, চুপিসাড়ে আমাদের দেশে এই কদিন আগে ঢুকে পড়েছিল – তাওয়াং অবধি চলে এসেছে। তার কিছুদিন আগেই ঘুরে এলাম সিলাপাস – তাওয়াং – বুমলাপাস।
অরুণাচল — প্রথম সূর্যদয়ের দেশ। প্রথম আলো এখানে এসে পড়ে। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে পুব আকাশকে রাঙিয়ে দিয়ে এখানে ভোর হয়। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শীতের কামড় কিছু কম নয়। তাওয়াং শহরে দিনের তাপমান ১ ডিগ্রী, রাতে আরও কম। হোটেলের কাঁচে ঢাকা বারান্দায় গরম চাদর মুড়ি দিয়ে বসে, এক পেয়ালা গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রভাতী আলোয় নিজেকে রঙ্গীন করে নেবার স্বর্গসুখ অতুলনীয়। পাহাড়ের ঢালে আলো কুয়াশায় আবছায়া – কোথাও গাঢ় সবুজ কোথাও হাল্কা থেকে ধূসর।

কলকাতার ইঁট কাঠের জঙ্গল ছেড়ে মক্ত বাতাসে শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য নিজের ফুসফুসকে গত দুদিন ধুরে তৈরী করেছি। অরুণাচলের প্রবেশ দ্বার ভালুকপং – সেখানে একরাত্রি বাস, দ্বিরাং – সেখানে একরাত্রি বাস। অতপর ১৩৭০০ ফুটের সীলাপাস পেরিয়ে শেষমেশ ১০০০০ ফুট নিচে নেমে তাওয়াং। সিলাপাস্ পার হবার সময় বুক ভরে হাওয়া নিতে যে অসুবিধা হবে না, একথা বলা যাবে না। যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে তবেই আসা উচিত। নীল টলটলে জলের লেক। চারপাশে সাদা বরফের মুকুট পরে পাহাড়ের চূড়া। লেকের জলে পাহাড় চূড়ার প্রতিবিম্ব। জলে হাওয়া ঢেউ তুলে চলেছে। ঢেউ পাড়ে এসে ভাঙছে – ছলাৎ ছল। গাড়ি থেকে নামলেই তাপমানের তারতম্য মালুম হয়। এই লেকটার নাম প্যারাডাইস লেক। স্বর্গের হ্রদ। হয়তো কোন ঋতুতে এর জলে নীলপদ্ম ফোটে। এইখানেই তো নীলপদ্ম ফোটা চাই – শ্রীরামচন্দ্র অকাল বোধনের মহাষ্টমী মহানবমীর সন্ধিক্ষণে দেবী দুর্গার বন্দনা স্বর্গের দুয়ারে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যাক সে কথা। গাড়ি থেকে নেমে সাবধানে হাঁটাচলা করবেন। বেশী উত্তেজিত হলে শরীর সহ্য করবে না।
তাওয়াং এসে তাওয়াং মনেস্ট্রি দেখতে ভুলবেন না। এশিয়ার বৃহত্তম মনেষ্ট্রি। কোন এক দলাই লামা এখানে এসেছিলেন। কমবেশি ৪৫০ বৌদ্ধ সন্যাসী এখানে থাকেন, গৌতম বুদ্ধের উপাসনা করেন। উপাসনা কক্ষে ভগবান তথাগত – গম্ভীর ধ্যানমগ্ন মর্মর মূর্তি – একটু চুপ করে বসে দেখুন – কি স্নিগ্ধ, মন্ত্রমুগ্ধ পরিবেশ। মনেস্ট্রির চাতাল থেকে তাওয়াং শহর – পিকচার পোস্টকার্ড। তাওয়াং এর ওয়ার মেমোরিয়াল দেখতে ভুলে যাবেন না। ২১ বছরের বীর সেনা যশবন্ত সিং এর বীরগাথা শুনতে শুনতে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। তাওয়াং থেকে ফেরার দিন দেখে নিন জঙ্ঘ ফলস। পাহাড়ের মাথা থেকে এক লাফে একটা খাঁজে, তারপর সেখান থেকে সটান পাহাড়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ছে। ঝর্না তার নিজের নিয়মে পাহাড়ের পা ধুইয়ে দিচ্ছে – অভিভূত।
আমাদের গাড়ি বুমলা যাবে না। Bumlapass যেতে গেলে তাওয়াং থেকে গাড়ি ভাড়া করতে হবে। সকাল সকাল চললাম ১৫২০০ ফুট উচ্চতায় Bumlapass। ৪৫ কিমি রাস্তা এবং উচ্চতা ৫২০০ ফুট, সুতরাং পথ যে খাড়াই, বলাই বাহুল্য। আড়াই ঘণ্টার যাত্রাপথ। আর্মি, অনুমোদনের কাগজ দেখতে চাইবে বারবার। পাক দিয়ে গাড়ি যত উপরে উঠবে, বরফের আধিক্য বাড়বে। রাস্তার দুপাশে নাম না জানা লেকের জলে সাদা পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি। গাড়ি চলার পথটুকু পরিষ্কার করা, বাকি শুধুই বরফ। মাথার উপর নীল আকাশ। মনে হচ্ছে পৃথিবীর ছাদে দাঁড়িয়ে। তাপমান -৮ ডিগ্রী, রাতে সেটা -১৬/-১৮ হয়ে যায়। চীন – ভারতের সীমানা। ভারতীয় সেনারা পাহারারত। আমার মত ষাট পার হয়ে যাওয়া, বাইপাস সার্জারি করা বুড়ো যদি চারদিনের পথযাত্রা কে অগ্রাহ্য করে আসতে পারে, তবে আপনি নয় কেন ?

চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় “পৃথিবীতে যদি স্বর্গ বলে কিছু থাকে, তবে এটাই সেই, এটাই সেই, এটাই সেই।”
নামার পথে দেখা যেতে পারে সঙ্গাসারা লেক — যার প্রচলিত নাম মাধুরী লেক। কেন মাধুরী লেক, ড্রাইভারের থেকে জেনে নিন।
ব্যগপ্যাক:
গোহাটি বা তেজপুর থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে তাওয়াং।
তাওয়াং থেকে স্থানীয় গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে Bumlapass।
পর্যাপ্ত গরম জামা সঙ্গে আনতে ভুলবেন না।
তাওয়াং ছোট শহর, হোটেলের সংখ্যা কম, আগে থেকে হোটেল বুক করে আসাই ভালো।
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.