হাওড়া ব্রিজ



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
কলকাতায় আইকনিক সেতু হাওড়া ব্রিজ, নির্মাণের পেছনের আকর্ষণীয় ইতিহাস রইল পাঠকদের জন্য।
লেখক : রাজ কুমার মুখার্জি
সালটা ১৮৫৫ বা ৫৬ হবে, হুগলি নদী দুই পাড়ে দুই যমজ শহর হাওড়া, কলকাতায় জাঁকিয়ে ব্যবসা করছে ইংরেজ সাহেবরা, গড়ে উঠছে নতুন নতুন কারখানা কিন্তু সমস্যা ওপার এপারে যাতায়াত নিয়ে। একটাই সেতু পন্টুন ব্রীজ, বড়ই কমজরি। নীচে নৌকা ভাসছে, তার উপর কাঠের পাটাতন। মাঝবরাবর ২০০ ফুট মতন খুলে দেওয়া যায়। অবশ্য সব সময় নয়। স্টিমার বা জাহাজ এলে, তখন এই ব্যবস্থা।
১৮৭১ সাল বাংলার ছোটলাট জর্জ ক্যাম্পবেল, হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট তৈরি করলেন। টোল টাক্স আদায় শুরু হল, এই টাকা দিয়ে হাওড়া ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণ হবে। তৈরী হল আর একটি সংস্থা, ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্ট (বর্তমান নাম: কলকাতা পোর্ট কমিশন) যার তত্ত্বাবধানে তৈরী হবে নতুন ব্রিজ। স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলি কে নতুন ব্রিজের নকশা আঁকার ও বানানোর বরাত দেওয়া হলো। স্যার লেসলি ইংল্যান্ডে বসে ব্রিজের একটা একটা অংশ বানান আর জাহাজে করে ভারতে পাঠাতে থাকেন। এখানে সেটা জুড়ে জুড়ে ব্রিজ হতে থাকে। এই ব্রিজ বানাতে খরচ হয়েছিল ২২ লক্ষ টাকা। মোট টোল আদায় হয়েছিল ৩৪ লক্ষ টাকার কিছু বেশি।

সময় গড়িয়েছে, ব্যবসা বেড়েছে। ১৯২১ সাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ। ব্রীজ খুলে জাহাজ বা স্টিমার যেতে দিলে, ব্রিজ বন্ধের ফলে রাস্তায় যানজট। ইংরেজ সরকার বাহাদুর ভেবে দেখলেন গরুর গাড়ি যাবার চাইতে জাহাজ চলাচল বেশী জরুরি। নতুন রকমের ব্রিজের কল্পনা শুরু হল। দেশ বিদেশ থেকে বহু নামি দামী কোম্পানির থেকে নকশা এলো। ক্যান্টিলিভের ব্রিজের নকশা এলো। স্যার লেসলি, ক্যান্টিলিভার ব্রিজের নকশা নাকচ করে দিলেন। যথেষ্ট সঙ্গত কারণ ছিল। কিছুদিন আগেই ১৯১৭ সালে কানাডা তে কান্ট্রি লিভার পদ্ধতি তে বানানো পোঁ দ্যা কেবুক নামে একটি ব্রিজ ভেঙে পড়ে।

শেষমেশ ১৯২১ সালের শেষ দিকে ইংরেজ সরকার স্যার রাজেন্দ্র নাথ মুখার্জি কে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি গঠন করেন। স্যার আর এন মুখার্জি তখন মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি সহ অনেক গুলি কোম্পানির মালিক। সেই কমিটিতে ছিলেন তৎকালীন বন্দরের চেয়ারম্যান ক্লিমেন্ট হিন্ডলে, তৎকালীন খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার বেসিল মট। মট সাহেব প্রস্তাব দিলেন সিঙ্গেল স্পান আর্চ ব্রিজের।এক বছর বাদে সেই কমিটি বহির্বাহু সেতু বা ক্যান্টি লিভার ব্রিজ অনুমোদন করে। কারণ এই রকম ব্রিজ হলে নীচে দিয়ে স্টিমার জাহাজ চলতে পারবে আবার উপর দিয়ে গাড়ি, মানুষ। ১৯২৬ সালে পাশ হল নিউ হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট।
টাটা আইরন স্টীল কোম্পানির প্রায় ২৪০০০ টন ইস্পাত দিয়ে তৈরি হল হাওড়া ব্রীজ। ব্রিজের ফেব্রিকেটরের কাজ করেছিল বার্ন কোম্পানি, ব্রিথওয়েট কোম্পানি এবং জেশপ কোম্পানি। এটাই বোধহয় প্রথম “মেক ইন ইন্ডিয়া“। এখন যে স্লোগান নিয়ে আমরা লাফালাফি করি। দীর্ঘ সাত বছর লেগেছিল ব্রিজটি বানাতে। ১৯৪৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি ব্রিজটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৯৬৫ সালে ব্রিজটির নতুন নাম হয় রবীন্দ্র সেতু। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে এই সেতুর উপর দিয়ে প্রায় এক লক্ষ গাড়ি এবং দশ লক্ষের বেশী লোক পায়ে হেঁটে যায়।

সম্প্রতি নিঃশব্দে ব্রিজটির ৮০তম জন্মদিন পেরিয়ে গেল। আমাদের শহরের বিশেষ বিশেষ দ্রষ্টব্য গুলির মধ্যে এটি একটি — রবীন্দ্র সেতু। কত মিছিল, কত যানবাহন, কত মানুষের যাওয়া আসা এর উপর দিয়ে। আমরা একবারও এর ইতিহাস ভেবে দেখি না। East India Story র তরফ থেকে প্রবীণ অথচ সমর্থ, দুই শহরের প্রধান যোগাযোগের সেতু কে আমার কুর্নিশ।
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.