বেশিরভাগ কলকাতাবাসী সিগারেট খান য়। বলা বাহুল্য তারা স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতন, তবুও তারা ধূমপান করেন। আজ সেই সিগারেট নিয়েই এক মজার গল্প রাজকুমার মুখার্জির কলমে।
বহু বছর আগে বাংলা সিনেমার একজন নায়িকা কোন একটি স্বাস্থ্য পানীয়টির বিজ্ঞাপনে বলতেন, “আমি কেন খাই, দারুন লাগে।” অনেকেই হয়তো এইবার মনে করতে পেরেছেন সেই পানীয়টির নাম এবং অবশ্যই নায়িকার নাম। আচ্ছা আরেকটু সহজ করে বলি। মনে পড়ে সেই ক্যাপশনটার কথা ‘একটু জিরিয়ে নিন, একটা চারমিনার ধরান।’ চারমিনার সিগারেট সেটাও কিন্তু একটা দারুণ ক্যাপশন ছিল। আজকে কথা বলবো সিগারেট নিয়ে।
আমারও সেই ‘দারুন লাগে’ থেকেই খাওয়া শুরু। বাঙালির ছেলে প্রেম করবে না, কবিতা লেখার চেষ্টা করবে না, সিগারেটের টান মেরে দেখবে না – তা কখনো হয়? সবজান্তা জ্যাঠামশাই জাতির এটাই বৈশিষ্ট্য। সবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ শেষ হলো, আপনি বাসে ট্রেনে কত বোদ্ধা পাবেন। বলে দেবে শেষ ওভারে কাকে দিয়ে বল করালে ম্যাচটা বেরিয়ে যেত অথবা আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এখন কূটনৈতিক কি রকম সম্পর্ক থাকা উচিত কিংবা লাম্বার বা স্যাক্রো তে যদি কোন অসুবিধে হয়, তবে কি রকম ব্যায়াম করা উচিত।
অতএব ‘মুখেনো মারিতং জগত’ এবার এলো শিভালরী দেখাতে। সদ্য গোঁফ গজানো ছোঁড়া, দশ ক্লাসের গণ্ডি পেরিয়েছে অথবা বারো ক্লাসের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে। বাঁ হাতের তর্জনী ও মধ্যমার মাঝে জলন্ত কাঠি। অনেকেই বলবেন আমি সিগারেট খাই না। একটু ভেবে দেখুন, জীবনে কোনদিন কি সিগারেট বা বিড়ি বা হুঁকো টান মেরে দেখেননি? তারপর কেশে কেশে এক শেষ। বাবাঃ, আর নয়, সেই হয়তো শেষ। আমার গপ্পোটা একটু অন্যরকম। যখন থেকে খেলার মাঠ ছেড়ে গলির রোয়াক ধ্যানজ্ঞান হলো, এই বছর ১৭ কিংবা ১৮, তখন থেকে নিয়মিত ধূমপায়ী হলেম। প্রথম প্রথম একটু হিরো হিরো লাগতো, তারপর ওই, ‘আমি কেন খাই, দারুন লাগে।’
অল্প বয়স, পকেটে পয়সা কম। প্লেন ক্যাপ্সটান। সম্ভবত তখন তিন টাকা প্যাকেট। হালকা আমেজ, আঙুলে যতক্ষণ না ছ্যাঁকা লাগছে, টানা যায়। সেসময় মেয়েদের সিগারেটের খাওয়ার চল যে একদম ছিল না, তা নয়। ছিল তবে আড়ালে আবডালে।
এক মজার ঘটনা বলি। তখন ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে রিডিং রুমের কার্ড করিয়ে রোজ পড়তে যাই। পড়ার বই ছেড়ে দিয়ে কার্ল মার্কসের ‘দাশ ক্যাপিটাল’, ডস্টোভয়েস্কির ‘ব্রাদার কার্মাজভ’, থমাস হার্ডির ‘আন্ডার দি গ্রীনউড ট্রি’ — এসব পড়ি (এগুলোর বেশিরভাগই তখন মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে)। একদিন
পড়ার ফাঁকে রিডিং রুমের বাইরে এসে দেখি এক মেমসাহেব লম্বা একটা সিগারেট বার করে লাইটার জ্বালিয়ে ধরাচ্ছে। বয়স বড়জোর ২৫। আমি সিগারেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে জ্বালাতে ভুলে গেছি, হ্যাঁ করে দেখছি। মেম সাহেব আমার দিকে এগিয়ে আসছেন আমার বুকের ধুকপুক, ধমাস ধমাস করে চলতে শুরু করে দিয়েছে। যেন হাজার অস্ত শক্তির রেলগাড়ি। মেম সাহেব একগাল হেসে, মুখের সামনে লাইটার জ্বালিয়ে দিলেন। ওফ: আমি যেন গ্রিগরী পেগ আর মহিলা যেন আন্ধ্রে হেপবার্ন! সেই যে সিগারেট ধরালাম — বিশ্বাস করুন যতবার সিগারেট ছাড়ার কথা ভেবেছি, ততবার মেম সাহেবের মুখ ভেসে উঠেছে। ‘আমি তো এমনি এমনি খাই।’
বাঙালি জাতে উঠেছে। হাতের মুঠোয় স্বর্গ। আকাশ ঝাড়ু বাড়ির মগডালে থাকার পরিকল্পনা। চকচকে বড়, মেজ, ছোট সাইজের গাড়ি। সেইসঙ্গে বদলেছে সিগারেটের ধরন। সিগারেটের মশলায় গাঁজা মিশিয়ে মারো টান। পরের ধাপ-চরস। চরসের বড়ি আগুনে পুড়িয়ে, গুঁড়ো করে, সিগারেটের মশলার সঙ্গে মিশিয়ে দে টান, দে টান। ভাঙা মাঠের কোণে বসে তিন চার জন মিলে টান মার হেঁইয়ো। তবে হ্যাঁ খামচে খামচে খেলে চলবে না। গোল হয়ে থেবড়ে বসে একদিক থেকে সেই সিগারেট ঘুরবে। একবারে একটান। কি ডিসিপ্লিনড! নিশীথদা, ভাঙামাঠের ওই কোনের বাড়িতে থাকে। একদিন ডেকে বলল “হ্যাঁরে ভাঙামাঠে কারা যেন রোজ সন্ধ্যের পর গাঁজা টানে। আগুন ঘুরে ঘুরে যায়!” এহে, দেখতে হচ্ছে। ঠেক বদল। এবার পালা সেন্ট পলস চার্চ এর উল্টোদিকে ভিক্টোরিয়া ঢোকার পুরানো লোহার গেট (তখন ছিল, এখন নেই)। বরফ জল, ঝালমুড়ি, বাদাম, ভেলপুরি সারি দিয়ে দুধারে দোকান। দোকানের পাশের মাঠে বসে নেশা।
এরপর চাকরি বিয়ে। সব গেল ঘুচে। আমার স্ত্রী সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারেন না। সে এক মহা ঝামেলা। ধুত্তোর বলে এক কথায় সিগারেট খাওয়া দিলাম ছেড়ে। দশ বছর খাইনি, কোন অসুবিধা হয়নি। সবাই বলে ছাড়তে ভীষণ কষ্ট। দূর বাজে কথা। আমি এরকম তিনবার ছেড়েছি। প্রথমবার দশ বছর সিগারেট খাইনি, পরেরবার পাঁচ বছর, শেষেরবার এখনো খাই না। মানে এই লেখা অবধি খাই না। আমায় নেশা ধরবে কেন? আমি নেশাকে ধরবো, ছাড়বো। এই সাধারণ তত্ত্বটা কেউ বুঝতে পারে না। মুখে ভাব করবে পুরুষ সিংহ অথচ কাজের বেলায় মেনুপুষি বেড়াল। ছোঃ।
এখন মেয়েরা প্রগতিশীল। মেট্রো স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানে। ছেলেরা যদি খায়, তাহলে মেয়েদের খেতে আপত্তি কোথায়? অনেকটা ডাল ভাত খাওয়ার মতো। বেশ লাগে। টকটকে লাল লিপস্টিক লাগানোর ঠোঁটে, ধবধবে সাদা সিগারেট। দুরন্ত ম্যাচিং। আমি রিটায়ার্ড, কাজ নেই। মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশনের বাইরে অমিতের সিগারেটের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে সামানুপাতিকের অংক কষি। আজ প্রতি কুড়ি মিনিটে কতজন ছেলে এবং কতজন মেয়ে সিগারেট কিনলো। কখনো ৪:৩ অনুপাত, কখনো ৫:৪ অনুপাত, কখনো আবার ৪:৬ অনুপাত। আমি অংকের সঠিক উত্তর বের করতে পারি না। কাল থেকে খাতা, কলম, ক্যালকুলেটর নিয়ে বসবো। বিজ্ঞাপনের সেই মা হলে পারতেন। যিনি সাধারণ পানীয়র প্যাকেটের গায়ে এগারো শতাংশ প্রোটিন এবং বিশেষ পানীয়র প্যাকেটের গায়ে আঠারো শতাংশ প্রোটিন দেখে এক পলকে অংক কষে বলে দিতে পারেন ৬৮ শতাংশ বেশি। আমার এক ভ্রাতৃসম সহকর্মী তার ছেলের জন্য অংকের শিক্ষক খুঁজছিলেন, বিজ্ঞাপনের সেই মায়ের রেফারেন্স দিয়েছিলাম। সেই মা পড়াচ্ছেন কিনা জানিনা। আজ একবার খবর নেবো।
কে কি রকম ভাবে সিগারেট টানে সেটাও দেখি। কেউ মুখে ধোঁয়া নিয়ে ছেড়ে দেয়, যেন কুলকুচি করছে। কেউ পুরোটা বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে ল্যারিংস ফ্যারিংসের ডুগডুগি বাজিয়ে তবে বার করে। কেউ আবার মুখ দিয়ে টেনেই নাক দিয়ে বার করে। তবে আসল খেলুড়ের দেখা এখন আর বেশি পাই না। একের পর এক রিং ছেড়ে যাবে। দেখলে মনে হবে সার্কাসের বাঘ যেন ওই রিং এর মধ্যে দিয়ে ‘হালুম’ বলে মারবে মস্ত লাফ।
সবাই বলে সিগারেট খেও না, কিন্তু সরকার কি বলে? সেও এক মজার ব্যাপার। সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা দেখবেন “বিধি সম্মত সতর্কীকরণ।” অর্থাৎ লিখতে হয় লিখছি, না লিখলেও চলে।
সবশেষে বলি সিগারেট ছাড়ুন আপনার বাড়ির লোকের স্বার্থে। ভবিষ্যতে অসুখ বিসুখ নিয়ে আপনি যে থাকবেন বিছানায় শুয়ে, বাড়ির লোক হবে জেরবার।
“সিগারেটের মহাজ্বালা,
বুড়ো বয়সে খুঁড়িয়ে চলা।”
Raj Kumar Mukherjee
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.