সাধনবাবু ছেলের জন্য পাত্রী পেলেন?
A lady with a passion in homemaking has started experimenting…
সাধনবাবু মরিয়া হয়ে ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। এই গল্পে জেনে নিন কি নাটকীয়ভাবে শেষমেষ উনি পাত্রী খুঁজে পান।
আজ বলবো আমার মামাবাড়ির গল্প। বাড়িতে যেমন দিদি, মামাবাড়িতে তেমনি দিদিভাই – পরিবারের প্রাণ। মানুষটি কেমন ? এক কথায় বলি, এমন মানুষদের দেখেই বোধহয় শরৎচন্দ্র- বিন্দু বা রামের সুমতির নারায়ণীদের সৃষ্টি করেছিলেন। নিজের লোককে তো সবাই সুন্দর দেখে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির এক পিঠ কোঁকড়ানো চুল, ঈষৎ বাদামী আয়ত চোখ আর অতুলনীয় চিবুকের অধিকারিণী দিদিভাই – পৃথিবীর যে কোনো মাপকাঠিতেই সুন্দরী।
ষাটের দশকে মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে অগাধ ভূসম্পত্তি আর পাঁচটি খুদে ছেলেমেয়ে নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন, বড়টি, মানে- আমার মায়ের বয়স তখন আট, বড় মাসী ছয়, দুই মামা – চার, আর তিন ; আর সবচেয়ে ছোট- মাসীমণি তখন তিন মাসের শিশু। সাংসারিক জ্ঞান- শূন্য, কারণ অপরূপ সুন্দরী স্ত্রীকে আমার সাহেবী মেজাজের যুবক- দাদুভাই তুলোয় মুড়ে রেখেছিলেন। তিনি CPWD র বড় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, বিবাহ পরবর্তী জীবনে দেশের নানা জায়গায় ইংরেজ আমলের ইয়া ইয়া সরকারি বাংলোতে দাসী চাকর পরিবৃত হয়ে আমার দিদিভাই মহাসুখে কাটিয়েছেন, কর্তার কড়া হুকুম ছিল – কোনো কাজ করা বারণ !
এক্ষেত্রে শতকরা নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে যা হয় – অর্থাৎ সম্পত্তি বারো ভূতে লুটেপুটে খায়। আশ্চর্যজনক ভাবে দিদিভাইয়ের ক্ষেত্রে তা হল না, তিনি ছেলেপুলে নিয়ে বড় ভাসুরের বাড়ি উঠলেন; আর শ্বশুর, ভাসুর, দেওররা মিলে, কাছেই- দাদুভাইয়ের নির্দিষ্ট করে যাওয়া জমিতে, তাঁরই বানিয়ে রাখা প্ল্যানে বাড়ি তৈরিতে হাত দিলেন। সেই বাড়িতে অকৃতদার ছোটকাকার তত্ত্বাবধানে- মায়েরা, মায়েদের বেজায় দুষ্টু মামারা – সবাই মানুষ হলেন। দিদিভাইয়ের কাউকে একটুও বকুনি দিতে হল না, শাসনও করতে হল না ; তিনি স্রেফ ছেলেপুলের- আদরের মা, আর ভাইবোনের একান্ত ভরসাস্থল- ভাইদিদি হয়ে মাথার ওপর রয়ে গেলেন।
আমার মায়েরও যথা সময়ে মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেল…
কালক্রমে মায়ের মামারা, একমাত্র মাসী- তাঁদের আদরের ভাইদিদির বাড়ির কাছেই সব বাড়ি বানালেন। সকাল হতে না হতেই মায়ের জ্যাঠামশাই, মেসোমশাই আর মামারা বাজারের থলে হাতে মর্নিংওয়াকের নামে বেরোতেন, আর সোজা আমার মামাবাড়ি এসে উঠতেন। পুরনো মালি বরকোদালি, যাঁর আসল নাম বোধহয় বরকত আলী- এক গাল হেসে, বাড়ির বিরাট বাগানে ঘাসের ওপর তাড়াতাড়ি বড় মাদুর পেতে দিত। সকলে গোল হয়ে বসতেন, আমার তরুণী বড়মাসী গানের রেওয়াজ সেরে- চা নিয়ে আসতেন… চলতো জমাটি আড্ডা, বেলা আটটা নাগাদ পড়িমরি উঠে বাজার করে, সব নাকে মুখে গুঁজে সকলে আপিস ছুটতেন…
এই আড্ডায় পাড়ারও অনেকে এসে জুটতেন, কখনো সখনো পথ চলতি অচেনা মানুষও গেট খুলে সটান ঢুকে পড়তেন, যেমন হত সেকালের মফস্বলে। মাসীও হাসি মুখে তাঁদের চায়ের কাপ ধরিয়ে দিত।
এমনই এক ভোরে জনৈক সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক গেটের বাইরে থেকে বললেন – ‘আপনাদের আড্ডায় একটু বসতে পারি ?’
– ‘আরে আসুন আসুন ! বলার কি আছে !’
তিনি লাজুক মুখে এসে বসলেন, মাসীও যথারীতি চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল। নাম- সাধন মিত্র, পার্ক স্ট্রিটে তাঁর আসবাবের শোরুম, সদালাপী মানুষ, বললেন – একটু দূরে থাকেন, আড্ডায় বেশ নিয়মিত হয়ে উঠলেন অচিরেই।
দিন কতক যাবার পর সাধনবাবু একদিন কাঁচুমাচু মুখ করে আড্ডার বয়োজ্যেষ্ঠ – মায়ের জ্যাঠামশাইকে বললেন, ‘আমি বড় অপরাধ করে ফেলেছি দাদা, আপনাদের কাছে আসল কথা লুকিয়েছি !’
– ‘কি লুকিয়েছেন ?’
লুকোনো আসল কথাটি বেশ অভিনব, উনি নাকি তিন চার স্টেশন দূরে দমদমে থাকেন, সেখান থেকে মামাবাড়ির পাড়ায় মর্নিংওয়াকে আসেন দৈনিক। আড্ডার সদস্যদের চোখ কপালে ! খড়দা কি সাঁওতাল পরগনা হয়ে গেল – যে রেলে চেপে স্বাস্হ্যদ্ধারে আসতে হবে ? নাকি ভদ্রলোকের মাথায় ছিট ?
ছিটই বটে ! সাধনবাবুর সাত মেয়ে, আর সবার ছোট একটি মাত্র ছেলে। ছেলে খুব গুনী, মাত্র আঠাশ বছর বয়স, লেখাপড়ায় রত্ন, চাইলেই গুরুগম্ভীর চাকরি জোটাতে পারতো, কিন্তু বাপকে ছুটি দেবে বলে – এই বয়সেই শোরুমের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে, দিদিদেরও ভালো ঘর বরে বিয়ে হয়ে গেছে ; এবার বাপ ঝাড়া হাত-পা হয়ে ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজতে লেগেছেন। বেশ কজন ঘটক ওভার টাইম খাটছে, খবরের কাগজে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন তাঁর সাংবাদিক মেজোজামাই, কিন্তু সাধনবাবু আর তাঁর গিন্নীর কোনো পাত্রীই মন মতো হয় না, তাঁদের খোকন লাখে এক, পাত্রীও চাই লাখে এক !
ঘটকের ওপর তিতিবিরক্ত হয়ে নিজেই মর্নিংওয়াকের নাম করে ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরোন, আর পাড়া বেপাড়ায়- সক্কাল বেলার মেকআপ বিহীন, নাগরিক মুখোশবিহীন গৃহস্থের মেয়েদের দেখেন, কি জানি, এর মধ্যেই হয়তো তাঁর হবু গৃহলক্ষী লুকিয়ে আছেন !
-‘আইডিয়াটা অভিনব সন্দেহ নেই, কিন্তু বাড়ি বাড়ি লুকিয়ে মেয়ে দেখে বেড়ালে যে কোনো দিন হেনস্থা হতে পারেন !’ মায়ের বড়মামা বলেন।
– ‘অলরেডি হয়েছি !’ সাধনবাবু মিনমিন করে বলেন।
জ্যাঠামশাই বলেন – ‘কেমন মেয়ে চাই আপনার, বলুন দেখি !’
-‘মেয়ে তো অলরেডি পছন্দ হয়ে গেছে !’
– ‘তাই নাকি ? কোথায় ?’
– ‘আপনাদের ঘরে !’
-‘কে ? বুল্টি ?’ পাত্রীর মেসোমশাই এক চান্সে ধরে ফেলেন, কারণ তাঁদের এই আড্ডায়- চায়ের কাপ হাতে হাসি মুখে ঘুরে বেড়ায়, ফুল তোলে, বরকোদালীর সঙ্গে বাগানের তদারক করে, গানের রেওয়াজ করে তো- ওই একজনই, ছোটবোন নেহাত কিশোরী, আর তার তখন মাঝরাত !
– ‘কিন্তু সে তো তেমন সুন্দরী না, রঙও তেমন খোলতাই নয়’, বুল্টির ছোটমামার গলায় সংশয়, ‘না, মানে- যেভাবে আপনি চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছেন, তাতে হেমামালিনী না হলে আপনার তো মন ওঠার কথা নয়।’
– ‘ভাই, আমি গৃহলক্ষী চেয়েছি, ফিলিম স্টার থোড়াই চেয়েছি, মা আমার সক্কাল বেলায় হাসি মুখে যেভাবে বাপ, খুড়োদের যত্ন করে, বাগানের মালীকে বিশ্রাম দিয়ে মাটি কোপায়, তাতেই আমি যা বোঝার বুঝে নিয়েছি ! আর গান যা শুনেছি, তাতে তো মনে হয় মা লক্ষী তাঁর বোনের কলাবিদ্যাও ভালই আয়ত্ব করেছেন, আর কি চাই !’
জ্যাঠামশাই হেসে বলেন, ‘দাঁড়ান, আগে আমার বাড়ির মা লক্ষীকে ডাকি !’
ভাসুরের ডাকে দিদিভাই বাইরে আসেন ; সাধনবাবু লাজুক মুখে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছেলের একটি ছবি বের করে দিদিভাইয়ের হাতে দেন -‘দেখুন দেখি, আমার প্যাঁচাটাকে ! মা লক্ষীকেও দেখান, বাহন পছন্দ হয় কি না !’
ফটো বড়রা দেখবে কি ! বাড়ির সবচেয়ে আহ্লাদী- কিশোরী মাসীমণি তার আগেই ঘুম চোখে উস্কোখুস্কো চুলে দিদিভাইয়ের হাত থেকে ছোঁ মেরে ছবি নিয়ে হওয়া !
সাধনবাবু হেসে বলেন- ‘দেখুক দেখুক ! ওদেরই তো শখ আহ্লাদের জিনিস !’
– ‘ও কে আপনি জানেন ?’
-‘হ্যাঁ, মা লক্ষীর ছোট বোন তো !’
– ‘আপনি কি সিআইডি নাকি ! শুধু বাইরে থেকে দেখে আমাদের পুরো গুষ্ঠির নাড়ি নক্ষত্র জেনে ফেলেছেন !’ দাদা চোখ গুল্লে বলেন…
হেনকালে পাত্রের ছবি হাতে মাসীমণির রঙ্গমঞ্চে পুনঃপ্রবেশ…
– ‘কেমন লাগলো মা, আমার ছেলেকে ?’
– ‘মন্দ নয়, তবে কেমন যেন কার্তিকের মত দেখতে !’ স্পষ্টবাদী মাসীমণির চাঁছাছোলা উত্তর।
হো হো করে হেসে ওঠেন সবাই…
এক শনিবার- আমার বাবা খুড়শ্বশুরের জরুরী তলব পেয়ে আপিস ফেরতা শ্বশুরবাড়ি রওনা হলেন, পরদিন ভোরবেলায়ই সাধনবাবু তাঁর খদ্দরের পাঞ্জাবী পরা খোকনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে আড্ডায় এলেন ; মাসী তেমন আটপৌরে ভাবেই দুবিনুনী দুলিয়ে চা পরিবেশন করলেন..
মামারা আর বাবা সেই কার্তিক ঠাকুরকে ঘরে নিয়ে গেলেন…
সব্বাইকে তাজ্জব করে মাসীমণি হবু ছোট জামাইবাবুকে এত পছন্দ করে ফেললো যে, সদ্য শেখা – ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যাবেলা’… গান গেয়ে শুনিয়ে দিল ! তাই দেখে, বড় জামাইবাবু অভিমানে আড়ি করে দিলেন…
পাত্র, পাত্রীর কাছে শুধু জানতে চাইলো – পাহাড় ভালো লাগে, না সমুদ্র ?
ব্যস, বিয়ে ফাইনাল ! দিন পনেরোর মধ্যেই সানাই বেজে উঠলো…
সাত ননদ, নন্দাই, তাঁদের ছেলেপুলে, নাতি নাতনী, তাদের পরিবার, আসো জন বসো জন- সবাইকে নিয়ে মাসী- মেসোর সঙ্গে আজও মহাসুখে সংসার করছেন।
হালকা হওয়ার মত সেই দিনগুলোকে হয়তো আপনাদের অনেকের কাছে অলীক মনে হবে, আমারই মনে হয় আজকাল ! গত ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে যে ! কালের স্রোতে কোথায় ভেসে গেছে সেই সব হাসি, কলরব… তবু, আমরা যারা সেই আনন্দযজ্ঞের খুদকুঁড়োটুকু পেয়েছিলুম, তাদের কাছে জীবন আজও এক বকুল বিছানো পথ, যার বাঁকে বাঁকে জীবন দেবতা কত না মণি মাণিক্য জমা করে রেখেছেন…
What's Your Reaction?
A lady with a passion in homemaking has started experimenting on putting her thoughts on pen and paper. She loves reading stories, listening to stories and most importantly chatting with oldies.