Now Reading
“লাফ দিয়ে Laughing” – একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি

“লাফ দিয়ে Laughing” – একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি

Avatar photo
Young boy asking his elder brother who is Shibram Chakraborty

১৩ই ডিসেম্বর শিবরাম চক্রবর্তীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি সুমানের কলমে।

প্রচ্ছেদ : সিড ঘোষ

সকালের দ্বিতীয় রাউন্ড চা খাচ্ছি, সঙ্গ দিচ্ছে আমার মোবাইল ফোন খানা, আজ সপ্তাহের সেকেন্ড ওয়ার্কিং ডে, শান্তিতে চায়ে চুমুক দেবারও উপায় নেই। প্রেজেন্টেশনের কচকচিতে জড়িয়ে পড়েছি। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে কলকাতায় মোটামুটি ঠান্ডা পড়ে গেছে।  হঠাৎ পাশের ঘর থেকে শ্রীমান গোবরচন্দ্রের আগমন হলো। ও বলে রাখি তিনি হলেন আমার পিতা-মাতার হার্ড ওয়ার্ক এর দ্বিতীয় ফসল। আমার অনুজ। গোবরচন্দ্র কোন ভুমিকা না করে আমার পাশের চেয়ারে বসেই আমাকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো-

-“এ দাদা, শিবরাম চক্রবর্তী সম্বন্ধে কি জানিস?”

আমি এতক্ষণ মোবাইল স্ক্রিনে থেকে চোখ সরাই নি এবার যুগপৎ বিস্ময়ে গোবরের দিকে চোখ মেললাম। ঠিক তেমন বিস্ময়ে, যেমনভাবে প্রথম যেদিন গোবরচন্দ্র মায়ের কোলে চড়ে হাসপাতাল থেকে আমাদের বাড়ি পদার্পণ করেছিল সেই দিনের মত বিস্ময়ে। বললাম –

-“কি?!”

-“আরে শিবরাম চক্রবর্তী সম্বন্ধে কি কি জানিস, একটু বলনা..”

আমি ততক্ষণে এমন ভ্রূ-কুঞ্চন করে ফেললাম, যেমনটা একজন বিখ্যাত WWE কুস্তিগীর করে থাকেন।

-“দাদা, সময় নেই তাড়াতাড়ি বলনা, কলেজ ম্যাগাজিনে একটা আর্টিকেল লিখব।“

আমি বললাম-

-“তোর কথা শুনে আমার মনটা আজ ‘লাফ দিয়ে laughing’…”

এবার গোবরের অবাক হবার পালা সে বলে-

-লাফ দিয়ে লাফিং?! সে আবার কি?!

– হুঁঃ.. সাধে কি তোকে গোবর চন্দ্র  নাম দিয়েছি!

গোবরের মুখ এবার ভরা শীতেও আষাঢ়ের আকাশের মতো কালো হয়ে উঠল। বলল-

-বলবি কিনা বল?! না হলে..

-না হলে কি?! ‘বল প্রয়োগে বলাবি’?!

-না.. মা-কে বলব যে তুই আমাকে হেল্প করছিস না, আর রাত জেগে জেগে মোবাইলে যে ‘ফিস-ফাস’ করিস, সেটাও জানিয়ে দেবো..

-আচ্ছা, ‘ফিস-ফাস’ টা জানিয়ে দিবি.. আর প্রত্যেকদিন কলেজ যাবার আগে আমার পকেট কেটে টাকা নিয়ে, তোর ‘ফিস-ফ্রাই’ খাওয়ার খবরটা.. তোর জন্য রাতে ভাত নষ্ট হওয়ার খবরটা…

-ওকে ওকে  done… কিছু বলবো না। কিন্তু তুই যদি আমাকে আজ হেল্প করিস তবে আমি তোকে খাওয়াবো।

-তুই খাওয়াবি.. মানে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমাকেই খাওয়াবি.. আবার সেটার থেকে ভাগ-ও নিবি।

-দাদা, ভাগ তো সেদিন থেকেই হয়ে আসছে, যেদিন থেকে আমি এসেছি। হে হে হে…

গা-টা রি-রি করে উঠলো.. বললাম-

-ওরে এটা আমার গুন্ রে যে হাসিমুখে ভাগ দিয়ে দি.. ‘ভাগ্ ইহাঁ সে’ বলি না.. আমি জ্যেষ্ঠ..

-জ্যেষ্ঠ না জ্যাঠা.. গুন-ভাগ-জ্যাঠামি বাদ দিয়ে বল না.. দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!

দেরিটা আমারও হচ্ছিলো, তাই আর কথা না বাড়িয়ে বললাম-

-এক কেজি রাবড়ি, খাওয়াতে হবে কিন্তু…

-একক্ কেজি?!

-সে আর এমন কি.. আমি যখন কেজি-টু তে পড়তাম তখনি দু-কেজি রাবড়ি সাঁটাতে পারতাম। তোর মত পেটরোগা তো ছিলাম না…

-ঠিক আছে.. এবার বলতো..

বলতে শুরু করলাম –

-শিবরাম চক্রবর্তীকে বা তাঁর লেখাকে কয়েক পাতায় ব্যক্ত করা কিন্তু খুব কঠিন। প্রথম জীবনে স্বদেশী করা এই লেখক…

-স্বদেশী?! মানে, শাহরুখ খানের ‘স্বদেশ’ সিনেমাটা এনার লেখা?!

-আরে মূর্খ.. স্বদেশী মানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দলের কাজ করা.. সত্যিই তোর মাথায় গোবর পোড়া,কলেজে উঠলি কি করে?! ইতিহাসে তো তুই সত্যিই পাতিহাঁস..

-হেঃ হেঃ হেঃ..করোনাভাইরাস নামের ব্রম্ভাস্ত্র দাদা.. পরীক্ষাই তো হয়নি.. হিঃ হিঃ।

আমি কটমট করে তাকালাম। তারপর বলতে শুরু করলাম-

-প্রথম জীবনে স্বদেশী করে তিনি জেল খাটেন, জেল খাটার সময় তার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পড়ে এবং তিনি পরীক্ষা দিতে অপারগ হন..

-‘ম্যাট্রি’ কি? ‘ম্যাট্রিক-লেসন’ (matrik-lession)? মানে ম্যাট্রিমনি সাইট (matrimony site) নিয়ে পড়াশোনা? মানে বিয়ে-শাদী কিভাবে করা যায় এইসব নিয়ে পড়াশোনা তাইতো?!

See Also
Mud Cafe তে বসে দার্জিলিং চা খাওয়ার সময়ে বন্ধুর সাথে জর্জ বিশ্বাস কে নিয়ে আড্ডা

-আরে গাধা। ম্যাট্রিকুলেশন মানে তখনকার দিনের মাধ্যমিক পরীক্ষা.. ধুসস্ আর একবার আটকাবি তো আর বলবো না।

-আরে, জানি না, বলেতো আটকালাম.. ঠিক আছে বল বল।

-ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিতে না পেরে, পরবর্তীতে তিনি আর স্কুলের পড়াশোনা চালিয়ে যাননি। নিজের ইচ্ছায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন..

-রবীন্দ্রনাথের মত?!

-এই ‘রবীন্দ্রনাথ’ কে রে?! তোর ইয়ার-দোস্ত?! নাকি, পাড়ার মোড়ের চপ-ওলা?!

-সরি সরি.. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত?!

-কিছুটা। যাই হোক তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় কবি হিসেবে, তার প্রথম কবিতার বই ছিল “মানুষ”। পরবর্তীতে সংবাদপত্র বিভাগে এবং ম্যাগাজিন বিভাগে ফিচার লেখক হিসেবে তিনি কাজ করেন। ‘বসুমতী’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ও ‘দেশ’ ম্যাগাজিন তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল। এখান থেকেই তাঁর লেখার মূলধন humor, witt এবং punning (মেজাজ, শ্লেষ এবং মজা) পাঠককুলের চোখে পড়ে। এর সাথে সাথে তিনি গল্প এবং উপন্যাস লেখাও শুরু করেন। এমনকি নিজের পিতৃদত্ত নাম নিয়েও ছেলেখেলা করেন তিনি, নিজের নাম তিনি লিখতেন- “শিব্রাম চকরবরতি”। তাঁর বেশিরভাগ গল্পে তিনি নিজেকেই চরিত্রে রূপদান করতেন। তাঁর গল্পে তিনি বিভিন্ন ধারাকেই ছুঁয়েছেন যেমন ডিটেকটিভ চরিত্র “কল্কে-কাশি”, কিংবা হাস্যরসের “হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন-বিনি”। তার রাজনৈতিক পটভূমিকায় লেখা “মস্কো বনাম পন্ডিচেরি”, নাটক “যখন তারা কথা বলবে”, ছোট গল্প “দেবতার জন্ম” ও আত্মজীবনীমূলক লেখা “ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা” উল্লেখযোগ্য। ছেলেবেলায় তিনি একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছিলেন –“বাড়ি থেকে পালিয়ে”, এর একটি সিক্যুয়েলও লিখেছিলেন- “বাড়ি থেকে পালিয়ে-র পর”। ঋত্বিক ঘটক পরবর্তীতে “বাড়ি থেকে পালিয়ে” থেকে সিনেমা করেন..

গোবর এবার বলে ওঠে –

-হ্যাঁ হ্যাঁ সিনেমাটা দেখেছি। তবে ওটা যে শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা সেটা জানতাম না।

আমি এবার সপ্রশংস দৃষ্টিতে গোবরের দিকে তাকালাম, বললাম-

-তবে জানিস তো শিবরাম বাবুর শেষ জীবনটা কিন্তু খুব কষ্টে কেটেছে, চঞ্চল রাজবাড়ীর রয়্যাল বংশের ছেলে হয়েও শেষ জীবনে মুক্তারাম স্ট্রিটের দোতলা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। সম্বল ছিল শুধু লেখার খাতা আর নিজের হাতে তৈরি ক্যালেন্ডার, যেখানে তিনি নিজের সময়টুকু ধরে রাখতেন। তিনি তাঁর অনেক পান্ডুলিপি হারিয়েও ফেলেন। কখনো বিয়েও করেন নি, তাই তার জীবনটা ছিল অকৃতদার এর। জীবনের শত অভাব-অনটন এবং কষ্টের মধ্যেও তার বন্ধু বিখ্যাত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর মতে তিনি ছিলেন সদা হাস্যমুখ ও ফ্রী স্পিরিট (free-spirit)। শেষ জীবনে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে তাকে সামান্য মাসোহারার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়। 1980 সালে তাঁর মৃত্যু হয়। সারা জীবন ধরে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করা এই মানুষটির মৃত্যুর পরেও কোন আড়ম্বর বা সমারোহ হয়নি। তাঁর শেষকৃত্যেও খুব হাতে গোনা মানুষই উপস্থিত ছিলেন।

আমি চুপ করলাম। গোবর, মোবাইলে রেকর্ড নিচ্ছিল, এবার বন্ধ করে বলল-

-দাদা, তোর বুক সেলফে যে “শিব্রাম সমগ্র”-টা আছে পড়তে দিবি?

আমি মনে মনে খুশি হলাম, কিন্তু মুখ গোমড়া করে বললাম-

-দিতে পারি, তবে দু-কেজি রাবড়ি লাগবে..

এবার গোবর মুখ ভেঙ্গচে উঠে বলল-

-হুঁঃ.. দু-কেজি?! দিন-দিন তো চেহারাটা তোর হাতির মতো হচ্ছে.. আবার দু-কেজি রাবড়ি?!

আমি এবার চেয়ার থেকে উঠতে গেলাম ওর কান পাকড়ে এক চড় কষাবার জন্য, কিন্তু গোবর পালিয়ে মা-বাবার ঘরে ঢুকে পড়ল হয়তো “হাতির সাথে হাতাহাতি” হবার ভয়েই..

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
6
In Love
1
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top