রূপকথার মতো – গ্রন্থ সমালোচনা



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
‘রূপকথার মতো’ বইটি প্রকাশ পেয়েছে এবার বইমেলায় । আমরা বইটির কিছু সংক্ষিপ্ত অংশ প্রকাশিত করেছিলাম ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩এ । আজ বইটির সমালোচনা রইল রাজকুমার মুখার্জির কলমে ।
“রূপকথার মতো স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়” নামটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে কারো একটি স্মৃতি নির্ভর করে বইটি লেখা। বইটি পড়তে পড়তে একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে এলিট ক্লাস এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা মোটা দাগের ফারাক।
বইটি সত্যি ই রূপকথার মতো। রূপকথায় যেমন পক্ষিরাজ ঘোড়া, রাজপুত্র, রাজকন্যা এদের নিয়ে গল্প বলা, যা আমাদের আটপৌরে জীবনে স্বপ্নের বহু ঊর্ধ্বে, এ গল্প সেই রকম। একটি মেয়ের রাজ পরিবারে বেড়ে ওঠার গল্প। বৈভব, বিলাসিতার প্রকাশ প্রতিটি ছত্রে। সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা, সামাজিক অবস্থার কথা, অর্থনৈতিক অবস্থার কথা – খুব একটা চোখে পড়ে না। সমাজের খুব উঁচু তলায় থেকে নিচের দিকে তাকালে সেসব চোখে পড়ার কথাও নয়। বইটি থেকে রাজা মহারাজাদের কাহিনী তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা তৈরি হতে পারে মাত্র।
শ্রীমতি প্রণতি রায়, যাঁর স্মৃতিকথায় বইটি লেখা, তাঁর জন্ম ১৯৩৪ সালে। ১৯৪১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসান, ১৯৪২ সালে গান্ধীজীর ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো‘ আন্দোলন, ১৯৪৬ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ, ১৯৬৯ সালে নকশাল আন্দোলন, এসবের ঢেউ রাজ পরিবারে এসে পড়েনি। অন্তত তাঁর বলা থেকে সেরকম কোনো আভাস পেলাম না। অথচ সে সময়ে বাংলায় বসবাসকারী যে কোন পরিবারে তার আঁচ লাগেনি, খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই আত্মকথায় বিশেষ কিছু খুঁজে পেলাম না। প্রাক্ স্বাধীনতা কালে জন্ম একজন ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে আশা করেছিলাম আরো অনেক কিছু। নিদেন পক্ষে সেকালের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে স্বাধীনতা উত্তর দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভালো মন্দের একটা সামগ্রিক চিত্র।
মহারানা প্রতাপ বা শিবাজী মহারাজ এর মতন যুদ্ধ জয় করে রাজা উপাধি পাওয়া নয়। উপাধি পাওয়া মুঘল সম্রাট এবং পরবর্তীকালে ইংরেজ বাহাদুরকে তুষ্ট করে। রাজ পরিবারের আয় হতো খাজনা থেকে।
একটা কথা এখানে মনে রাখতে হবে যে একজনের স্মৃতির উপর নির্ভর করে লেখককে এই বইটি রচনা করতে হয়েছে। যাঁর স্মৃতিকে নির্ভর করে লেখা, তাঁর পৃথিবী হেতমপুর এবং বালিগঞ্জের বাড়ির চাকচিক্যের মধ্যেই আটকে আছে। বাড়ির পুরুষদের খেটে রোজগার করতে হতো না। তাই সময় কাটানোর জন্য এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি তে মন নিয়োজিত থাকত। নাট্য চর্চা করা, সখের ড্রামা ক্লাব করা ছাড়া আর কি উপায় থাকতে পারে।
বইটিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগের মধ্যে পড়ে শুরু থেকে ‘অন্দরমহলের আনাচে কানাচে’ অবধি। যেখানে তিনটি রাজপরিবারের বংশ পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কৃষ্ণনগর রাজবংশ, হেতমপুর রাজবংশ, এবং লালগোলা রাজবংশ। দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ ‘মেয়ে বালার বারোমাস্যা’ থেকে ‘কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী’। বলতে গেলে গল্পের শুরু এখান থেকে। অথচ প্রথম অংশটি না পড়লে পরের অংশের পারিবারিক সম্পর্ক বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। এই অংশে আমরা পাই শ্রীমতি রায়ের মেয়েবেলার গল্প, বড় হবার গল্প। তৃতীয় এবং শেষভাগ ‘আমার বড়বেলা’ থেকে বইয়ের শেষ। এই অংশে বিবাহ পরবর্তী সময়ের কথা বলা আছে। লালগোলা রাজ পরিবারে কুমার বীরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের সঙ্গে তার বিবাহ। কুমার বীরেন্দ্র নারায়ণ রায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
একটি স্মৃতিকথাকে লেখক মালার মতন এক সুতোয় গেঁথেছেন। সব ঘটনাকে তার গুরুত্ব অনুসারে গল্পের খাতিরে তুলে ধরা, খুব একটা সহজ কাজ নয়। লেখক সপ্তর্ষি রায় বর্ধন এইখানে তার মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এখানে লেখকের পরিশ্রমকে কুর্নিশ জানাতে হয়।

বংশপরিচয়ের তালিকা কেন প্রথম পর্বের পরে এলোনা, বুঝে উঠতে পারলাম না। ঝকঝকে অফসেটে সঠিক মাপের অক্ষরের ছাপা এবং শক্ত মলাটে বাঁধাই, পাঠক পাঠিকার কাছে বইটির গ্রহণ যোগ্যতা বাড়াবে আশা রাখি। শ্রী পার্থ দাশগুপ্তের কাছে আর একটু ভালো প্রচ্ছদ আশা করব। সবশেষে ধন্যবাদ জানাতে হয় প্রকাশক মায়া আর্ট ও স্পেসের কর্ণধার মধুছন্দা সেনকে। ওনার একান্ত ইচ্ছার ফসল “রূপকথার মতো স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়।”
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.