Now Reading
মোহন সুব্বা – এক অচেনা পাহাড়ি

মোহন সুব্বা – এক অচেনা পাহাড়ি

Avatar photo

কিছু কিছু মানুষ আমাদের জীবনে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা দিয়ে যায়। আসুন আজ এমনই এক মানুষ যার নাম মোহন সুব্বা তার সাথে পরিচয় করে নেওয়া যাক আবিরের কলমে।

জনৈক সপ্তর্ষি চৌধুরীর একটি পোস্ট দেখেছিলাম ফেসবুকে, বাদামটাম নয়া বস্তি। পাহাড়ের উপত্যকায় একটি ছোট গ্রাম, যার চারিদিক ঘেরা নদী পাহাড় জঙ্গল এবং চা বাগান দিয়ে। কেন জানিনা দেখেই মনে হল এই জায়গাটিতে না গেলেই নয়।

উত্তরবঙ্গের টিকিট আগে থেকেই কাটা ছিল, কিন্তু এক্সাক্টলি কোথায় যাব সেটা ঠিক ছিল না। তাই নির্দ্বিধায় একদিনের নোটিশে ঘর বুক করে চলে গেলাম সেই জায়গাটিতে। বাদামটামের বিখ্যাত গুডরিক টি এস্টেট পেরিয়ে পড়ে এই বাদামটাম নয়া বস্তি। এখানে পৌঁছাতে গেলে দার্জিলিং থেকে শেয়ার কার ধরে চলে যেতে হবে, বাদামটাম জিরো পয়েন্ট। তারপর বাকিটা পথ পায়ে হেঁটে, কিছুটা পিচের খাড়াই রাস্তা । আবার কোন কোন জায়গায় রাস্তার কোনো অস্তিত্বই নেই, মাটি বালি পাথরের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে বড় বড় ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ির চাকার দাগ। এখানে নেই কোন টুরিস্টের ভিড়।

তবে এখানে এসে জায়গাটির সাথে সাথে এক্সপ্লোর করলাম একজন বড় মাপের মানুষকে, আমাদের থাকার জায়গা অর্থাৎ লিভ ইন নেচার হোমস্টের মালিক মোহন সুব্বা। বড় বড় শহরের অসংখ্য মুখ ও মুখোশের ভিড়ে হারিয়ে যায় অনেক মানুষ, তাদের চিনে নিতে গেলে যেতে হবে বাদামটাম নয়া বস্তির মত নির্জন স্থানে।

মোহন সুব্বা ও তার স্ত্রী
মোহন সুব্বা ও তার স্ত্রী

সৌভাগ্যবশত মোহন সুব্বা জি একটি বিশেষ কাজে দার্জিলিং এসেছিলেন আমাদের পৌঁছানোর দিন। সেই সুবাদে ওনার সাথেই ওনার হোমস্টে অব্দি পৌঁছে গেলাম। জিরো পয়েন্টে নামার পর প্রায় আধঘন্টা থেকে ৪০ মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম মোহন জির বাড়ি লিভ ইন নেচার হোমস্টেতে। এই এতটা পথ হেঁটে আসার মাঝে, চোখে পড়েছিল মাত্র তিন থেকে চারটি অসম্ভব সুন্দর কালারফুল এবং গাছ পালায় মোড়া কাঠের বাড়ি, অর্থাৎ যা বুঝলাম এখানে মানুষের বসতি খুবই কম। মোহন জির কথা শুনে বোঝা গেল আশেপাশের অনেকগুলি বাড়িতেই যারা থাকেন তারা হয়তো ওনারই বিভিন্ন সম্পর্কের আত্মীয়, কেউ কাকা কেউ মাসি ইত্যাদি।

ওনার নিজের বাড়িটিও কাঠের তৈরি একটি অসম্ভব সুন্দর বাড়ি যার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটি হল একটি বেশ বড় চৌকো বারান্দা, যার দুপাশে পাতা আছে দুটি বেঞ্চ এবং মাঝে একটি টেবিল, এছাড়া বসার জন্য একটি রকিং চেয়ার ও রাখা আছে এখানে। এই জায়গাটিতেই আমরা বাদামটামে থাকার তিনটি দিনের সর্বাধিক সময় কাটিয়েছি। এছাড়া হোমস্টেটিতে আছে আরো তিনটি থাকার ঘর, যার মধ্যে একটি ওনার ছেলের, একটি মেয়ের এবং অন্যটি গেস্ট রুম। আমরা ছিলাম ওনার মেয়ের ঘরটিতে। বেশ ছোটখাটো একটি রুম, চারিদিকে ছড়িয়ে আছে ওনার মেয়ের শৈশব এবং কৈশোরের বিভিন্ন সামগ্রী, বইখাতা ফ্যামিলি অ্যালবাম ইত্যাদি। সবমিলিয়ে বেশ একটা হোমলি ফিলিং আসছিল।

মোহন জির মতে স্থানীয় অনেক লোকজন হাতে কিছু টাকা পয়সা এলেই গ্রাম ছেড়ে উঠে যাচ্ছেন পাহাড়ের উপরের শহর গুলিতে, কিছু অতিরিক্ত সুখ স্বাচ্ছন্দের আশায়। উনি তাই নিজের থাকার বাসস্থানটিকেই হোমস্টে বানিয়ে চেষ্টা করছেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করার, যাতে বাকিরা অনুভব করে যে নিজের শিকড় কে ভুলে না গিয়েও, নিজের এবং নিজের পারিপার্শ্বিকের উন্নতি সাধন করা সম্ভব।

প্রায় দু বছরের পুরনো এই হোমস্টেতে সাধারণত খুবই কম লোকজন আসেন, যারা আসেন তারা মূলত বিদেশী এবং কিছু অন্যান্য প্রদেশের লোকজন, বাঙালির সংখ্যা সেই অনুপাতে কম। বর্তমানে উনার পথ অনুসরণ করে উনার ভাইও একটি হোমস্টে বানিয়েছে ঠিক পাশেই, নাম ইভিয়ানা হোমস্টে।

মেডিসিনাল প্লান্ট হাতে মোহন সুব্বা
মেডিসিনাল প্লান্ট হাতে মোহন সুব্বা

বাদামটামে এসে কাটিয়ে যেতে পারেন বেশ কয়েকটি অলস দিন, দুপুরের রোদ মিশ্রিত হালকা হাওয়া খেতে খেতে শুয়ে থাকতে পারেন মোহন জির বারান্দায় পাতা বেঞ্চে। সকালে উনার সাথে জঙ্গলে মর্নিং ওয়াক করে আসতে পারেন। ভাগ্য ভালো থাকলে দেখতে পাবেন ময়ূর। জঙ্গল ঘেটে তুলে আনতে পারেন বিভিন্ন মেডিসিনাল প্লান্ট যা কিনা রান্না করলে স্বাদ হয় অসাধারণ। এছাড়াও হোমস্টে থেকে মিনিট ১৫ নিচের দিকে হেঁটে গেলেই রয়েছে রুংদুং নদী, খুবই কম জলের এই পাহাড়ি নদীকে স্থানীয় লোকেরা নদী না বলে খোলা বলে থাকেন। নদীর ধারের আড্ডায় পেয়ে যেতে পারেন ইউসুফের মতো হাসিখুশি এবং মিশুকে মানুষকে। যারা ৮ ঘন্টা চা বাগানে কাজ করার তুলনায় স্বাধীনভাবে চাষবাস এবং পশুপালন করে জীবন কাটাতে গর্বিত বোধ করেন।

See Also
Sunshine at the dawn-lit mountains of Arunachal

মোহন জির বাড়িতেও পেয়ে যাবেন মুরগি ও শুকরের খামার, দেশি ও পোল্ট্রি ছাড়াও এখানে আছে কড়কনাথও। তাই মাংস আর ডিমের চাহিদাটা পূরণ হয়ে যায় এখান থেকেই, আর অসাধারণ খেতে এই স্থানীয় মুরগির ডিম। এখানে এলে অন্তত তিন রাত থাকা বাঞ্ছনীয়, আরো বেশি হলে আরো ভালো। নইলে উপভোগ করতে পারবেন না এখানকার জীবনযাত্রাকে। নদীর ধারের আড্ডার জটলা, জঙ্গলে মর্নিং ওয়াক, বা কোন সময় শুধুই অলস ভাবে শুয়ে থাকা কাঠের বারান্দায়, অথবা সন্ধ্যেবেলায় অন্ধকার বারান্দায় বসে ময়ূরের ডাক শুনতে শুনতে মোহন জির সাথে আড্ডা – এইসব মিলিয়েই বাদামটাম নয়াবস্তি। যারা গান বাজিয়ে বা হৈ-হুল্লোড় করে নয়, প্রকৃতির মধ্যে বন্য প্রাণীর ডাক শুনতে শুনতেই ছুটি কাটাতে চাইবেন তারা অবশ্যই এখানে ঘুরে যেতে পারেন একবার। মোহন জির ফোন নাম্বারটি এখানে দিয়ে রাখলাম।

মোহন সুব্বা – 7384611343

উনাকে এতটাই ভালো লেগে গিয়েছিল যে এবারে হোমস্টে বা জায়গার উপর ভিডিও না বানিয়ে, উনার উপরেই একটি ভিডিও বানালাম, যা এই ইউটিউব চ্যানেলে পেয়ে যাবেন।

What's Your Reaction?
Excited
2
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll To Top