মূল্যবোধ ও অবক্ষয়
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
মূল্যবোধ ও অবক্ষয়, প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের গলা টিপে ধরেছে। যত দিন যাচ্ছে তত মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে, অবক্ষয় বাড়ছে; দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এর থেকে কি আমাদের কোন মুক্তি নেই? আসুন একটু আলোচনা করে দেখা যাক। কলমে: রাজ কুমার মুখার্জি।
ভারতের ইতিহাসে আগস্ট মাসের একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। ১৫ ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস, একথা যেমন ভুলি না, সেইরকম ৯ই আগস্ট ১৯৪২, মহাত্মা গান্ধী ডাক দিলেন ‘ইংরেজি ভারত ছাড়ো।’ ইংরেজ ভারত ছেড়ে চলে গেছে আজ ৭৫ বছর। দাসত্ব থেকে মুক্তি ঘটেছে, পেয়েছি স্বাধীনতা। আমরা নিজেদের দাসত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছে কি? প্রশ্নটা নিজেকে করার সময় বোধহয় এসেছে। আমরা আজও দাস , তবে ইংরেজের নয়, দাস চাহিদার। গ্রাস করেছে অবক্ষয়, হারিয়ে গেছে মূল্যবোধ ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পর ইংরেজ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল একটা কথা বলেছিলেন “আমরা সেই বাড়িতেই বাস করি, যেখানে আনন্দ নেই; আমরা সেই খাবার খাই, যাতে পুষ্টি নেই; আমরা আমাদের সন্তানকে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে এমন একটা শিক্ষা দিই, যা থেকে তার লোভ ক্রমাগত বেড়ে চলে।”
১৯৯০ সালে ভারত, আমাদের দেশ, উদারীকরণ নীতি নিয়ে আসলো। অর্থনৈতিক দিক থেকে তার সুফল বা কুফল কি সেটা আলোচ্য বিষয় নয়। এর প্রভাব আমাদের জীবনের ভারসাম্য কিভাবে নষ্ট করেছে এবং ভবিষ্যতে আরো কি করবে তার একটা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
বাড়ি, সে ছোট ঘর ও বা আকাশ ঝাড়ু আবাসনের ফ্ল্যাট হোক, মানুষের সংখ্যা সেখানে তিন বা চার। সবাই এক একটা দ্বীপ। কাজের শেষে বাড়ি ফিরে সবাই নিজেদের মুঠোফোনে ব্যস্ত। একে অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। আমার মোবাইল ফোন আপনার ফোনের চেয়ে দামি হতেই হবে, কব্জিতে কালো চৌক স্মার্ট ওয়াচ থাকতেই হবে, বসার ঘরের দেওয়াল জুড়ে সিনেমা হলের স্ক্রিনের সাইজের টিভি থাকতেই হবে। চাহিদার শেষ নেই। শুধুমাত্র নিজের চাহিদা নয়, নিজের চাহিদা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। আমি যা হতে পারি নি, আমার স্বপ্নকে তোমায় বাস্তবে রূপ দিতে হবে। আপনার সন্তান যদি পরীক্ষায় ৯৩ শতাংশ নম্বর পায়, তবে আমার সন্তানকে ৯৫ শতাংশ পেতেই হবে। হাতের সব আঙুলকে জোর করে টেনে এক মাপে করা। টানাটানিতে যদি একটা দুটো আঙুল ছিঁড়ে যায়, যাক্।
শুধুমাত্র বাবা-মায়ের প্রত্যাশার মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে কত কিশোর কিশোরী আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তার খবর আমরা কি রাখি? সবার আগে দরকার অভিভাবক সম্মেলন, অভিভাবকদের কাউন্সিলিং। বুঝতে হবে সবাই জীবনে প্রথম হবে না, নিজের মতন করে সন্তানকে বাঁচতে দিন। আপনি বলবেন “ছেড়ে দিলেই হাতের বাইরে চলে যাবে।” আপনি আমি অভিভাবক হয়ে, কি আদর্শ ওদের সামনে রাখি?
চলুন একটু দেখে নেওয়া যাক। ঘরে বসে খাবার অর্ডার করি সুইগীতে। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে, জমা জলের ধাক্কা সামলে যে ছেলেটি আপনার বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে, যদি একটু দেরি হয় — হম্বিতম্বির শেষ নেই। এটাই তো শিখছে আমাদের সন্তান আমাদের থেকে। একবার ভাবুন তো ওই ছেলেটি যদি গরীব ঘরে না জন্মে আপনার ঘরে জন্মাতো, একটু ভালো লেখাপড়া করার সুযোগ পেত? চিত্রটা কিন্তু বদলে যেত। কখনো এক প্যাকেট অতিরিক্ত খাবার অর্ডার করে ডেলিভারি বয়ের হাতে সেই প্যাকেটটা ধরিয়ে বলেছি “আপনি এটা নিয়ে যান ভাই, আপনি খাবেন।” বলি না। সে মূল্যবোধ নেই। আমার সন্তানকে আমি সে মূল্যবোধ শেখাবো কি করে? এটাই অবক্ষয়।
বাড়ির ভাত, ডাল, তরকারি এখন আর মুখে রোচে না। নামিদামি রেঁস্তোরাতে বাঙালি খাবার খেতে যাই। সোশ্যাল মিডিয়াতে আপডেট দিই। আমি খরচ করছি, তুমি পারছো না। কি অদ্ভুত কম্পিটিশন। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। চার মাথা এক হলে – পার্টি। মদের ফোয়ারা। যেদিন নিজের সন্তান নেশা করে টলতে টলতে ফিরবে — সে দৃশ্য সহ্য করতে পারবেন তো?
ফিরে চলুন ১৯৯০ সালের আগে। ভেবে দেখুন তো এইরকম অবস্থা কি ছিল? সে সময়ের মূল্যবোধ, এখনের মূল্যবোধ — কোনটা ভালো? আপনি যে কাজ করবেন তার কুফল আপনাকেই ভোগ করতে হবে। দরকার নিজেকে শুধরে নেবার। সবই আমার আপনার হাতে। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, আমি কি চাই?
আমাকে কেমন লাগছে? আমি কত ভালো আছি? আমাকে সবাই চায় কিনা? আমার সুখ, আমার স্বাচ্ছন্দ্য। ‘আমি’ ময় জীবন থেকেএই আমিটা এবার ছেড়ে দিয়ে ‘তুমি’ ভাবতে শিখতে হবে। তুমি ভালো আছো কিনা? তুমি ঠিকমতো খেতে পাচ্ছো কিনা? তোমার সন্তান ঠিক মতন শিক্ষা পাচ্ছে কিনা? এটা যখন ভাবতে শুরু করতে পারবো, তখনই আবার আমাদের নিজেদের মূল্যবোধ ফিরে আসবে। অন্যের কথা ভাবতে গেলে নিজের মন থেকে সংকীর্ণ মানসিকতা কে দূর করে উদার হওয়া জরুরি।
শেষ করব বিশ্বকবির গানের কটি লাইন দিয়ে
” অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে —
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে।।
জাগ্রত করো, উদ্যত কর, নির্ভয় করো হে —
মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে।। “
What's Your Reaction?
Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.