Now Reading
মলু ঠাম্মার লাঠি 

মলু ঠাম্মার লাঠি 

Avatar photo
মলু ঠাম্মার লাঠি 

মলু ঠাম্মা লাঠি দিয়ে কাকে পেটালেন ? এই গল্পটি পাঠকদের পারিবারিক উপাখ্যান, রঙিন চরিত্র এবং ঘটনাগুলির একটি আশ্চর্যজনক মোড় দিয়ে ভরা একটি প্রাণবন্ত জগতে নিয়ে যাবে। একটি দশ বছর বয়সী দৃষ্টিকোণ থেকে বলা গল্পটি পশ্চিমবঙ্গের একটি অস্থির সময়ের পটভূমিতে উদ্ভাসিত হয়েছে, দৈনন্দিন জীবনের উপাদানগুলিকে অসাধারণের সাথে মিশ্রিত করেছে।

দুপুর তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ সব কাজ সারা হয়ে গেলে, আমাদের দোতলার টানা বারান্দায় ঠাকুমা, আর তাঁর জা-ননদদের এক জমাটি আড্ডা বসত। সে আড্ডা রঙিন গুজবের মৌতাতে ম ম করতো। ইশকুল থেকে ফিরে ছোটঠাম্মার কোলে মাথা দিয়ে পিঠে সুড়সুড়ি খেতে খেতে- চোখ গোলগোল, আর কান খাড়া করে সে সব শুনতাম। তাঁরা ভারী ভালো ছিলেন, কক্ষনো মা-পিসিদের মত চোখ পাকিয়ে, ‘এখানে কি চাই ?’ বলে উঠিয়ে দিতেন না।

মজলিশে সম্ভব অসম্ভবের সীমানা বলে কিছু থাকতো না, যুক্তি-তক্কোকে কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়িয়ে তবে এই আড্ডার রস উপভোগ করা যেত। নানা বিপজ্জনক আইডিয়ার চাষও হত সেখানে। যেমন- বড় পিসিঠাম্মা বলতেন, নারীর স্বাবলম্বীতা আসলে কিছু কুচুটে আর হিংসুটে মেয়েদের তৈরি এক বেজায় ফালতু কনসেপ্ট। যারা জীবনে কোনো সুখ পায়না, সাত সকালে দুটো নাকে মুখে গুঁজে, ফুটানির থলে কাঁধে ভিড় বাসে যুদ্ধ করতে করতে আপিস যায়, আর বসের মুখনাড়া খায়, তারাই নাকি ফ্রাস্ট্রেশন থেকে ওসব রটায়।

জানতে চাইবেন নিশ্চই, জীবনের সুখগুলো কি ? সেগুলো হল- সকাল থেকে সংসার ধম্ম সেরে একটি ছোট্ট দিবানিদ্রা; উঠে আয়েশ করে একটি পান সেজে মুখে পোরা, গরমকালে গল্পগুজব করতে করতে কাঁথা পাতা, নুন শো দেখতে যাওয়া…
শীতের দুপুরে মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে বসে কমলালেবু খেতে খেতে উলবোনা, ইডেনে দলবেঁধে এক আধ দিন টেস্ট ম্যাচ দেখা। সন্ধ্যেবেলা সব কাজ মিটিয়ে এক সঙ্গে ভালো সিরিয়াল দেখা, কি রেডিওর নাটক শোনা।

বাড়ির তরুণী প্রজন্ম শুনে অনুকম্পার হাসি হাসত; আসলে বড় দুঃখ থেকে পিসিমা এই কথাগুলো বলেন, তাঁর চার চারটে গুনবতী মেয়ে সাত সকালে পড়িমরি মোটাসোটা চাকরি করতে বেরিয়ে যায়, আর তিনি ইয়া বড় বাড়িতে একা একা বোর হন। তাই চাকুরে রমণীকুলের ওপর ভদ্রমহিলা হাড়ে হাড়ে চটা।

এই আড্ডাতেই পিসিঠাম্মার মুখে শুনেছিলাম তাঁর এক মলুঠাকুরঝির কান্ড। মলুর আসল নাম- মল্লিকা। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। একেবারে খাঁটি বরিশালি স্পেসিমেন। প্রথমে চেহারা- বৃষস্কন্ধ, শালপ্রাংশু, মহাভূজ … ইত্যাদি তাবৎ সংস্কৃত পালোয়ানী বিশেষণই তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তবে মুখশ্রী বেশ তরতরে। সঙ্গে মানানসই স্বভাব, খিল দিয়ে বাঘ তাড়াতে পারে, কিন্তু আখ পেষাই কলে পেষাই করলেও তাঁর থেকে এক ফোঁটা রসও মিলবে না! সাজ পোশাকও ইউনিক ; শাড়ির সঙ্গে শার্ট আর পায়ে বারো মাস কেডস। তাঁরা তিন বোন, প্রত্যেকে সুচাকুরে, আর জেনেটিক্যালি ভয়ংকর পুরুষ বিদ্বেষী, ছেলে কুকুর পর্যন্ত পোষে না। তাঁদের বাপ, সংসারের একমাত্র পুরুষ সদস্য, সারা জীবন বউ-মেয়েদের কাছে হেনস্থার একশেষ হবার পর ইদানিং মরে বেঁচেছেন। মা’টি নেহাত সেকালে উইমেন্স লিবের কনসেপ্ট ছিল না, তাই বে থা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু মলুরা তিন বোন আর ও রাস্তায় হাঁটেনি। সবাই বলে- ভাগ্যিস হাঁটেনি, তাই নাকি কিছু পুরুষের বংশ পরম্পরায় জীবন বেঁচে গেছে!

যাই হোক, বাজে কথা বাদ দিয়ে এবার কাজের কথায় আসি; এটা সে সময়ের ঘটনা, যখন পশ্চিমবঙ্গে বেশ একটা ডামাডোল চলেছে। পুলিশ, নকশাল, রাজনীতিবিদ সবাই মিলে বেজায় গুলোচ্ছেন। মলু ডুয়ার্সের এক টাউনের কলেজে ফিলোজফি পড়াতো, আর লোকালয় থেকে খানিক দূরে একটা ছোট ছিমছাম বাড়িতে একলাই থাকতো। সকালে দুধভাত খেয়ে কলেজ যেত, ফেরার সময় মিডিয়াম পেসে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরত, ওটা নাকি এক্সারসাইজ। সন্ধ্যায় সখ মত কিছু রান্না করে খেয়ে, খানিক রেডিও শুনে জলদি ঘুমিয়ে পড়ত। একটা কাজের লোক পর্যন্ত ছিলনা, কারণ নিজের কাজ অন্যে করবে- এটা তাঁর না পসন্দ। আর কোনো মহিলা হলে সবাই চিন্তা করতো- একলা মেয়ের এমন একটেরে বাড়িতে থাকা কি উচিৎ ? কিন্তু মেয়েটি মলু বলেই কেউ বিন্দুমাত্র চিন্তিত হত না।

সেবার হেমন্তে, বড় শহরের অশান্তির ঢেউ পাহাড়তলির ছোট্ট টাউনেও পৌঁছাল। গুজব শোনা যেতে লাগলো- নকশালদের বড় বড় কিছু মাথা নাকি প্রশাসনের হুড়ো খেয়ে সেই টাউনে আত্মগোপন করেছেন। তাঁদের পিছু পিছু এসেছে নকশাল সেজে খুন রাহাজানি করে বেড়ানো খান কতক বাছাই গুন্ডা বদমাশ। টের পেয়ে কিছু বাঘা পুলিশকেও টাউনের ছোট্ট থানায় পোস্টিং করা হয়েছে; মানে, কেস গুরুচরণ !

এবার মলুকে সবাই বলতে লাগলো, অমন ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে আর থাকা উচিত নয়, বরং কলেজের হোস্টেলে আপাতত থাকুক। মলু পাত্তাও দিল না, শুধু একটি বেঘো মার্কা বাঁশের লাঠি নিয়ে যাতায়াত শুরু করল। পাকা বাঁশের সে লাঠি লোহা দিয়ে বাঁধানো, তার ভয়াবহ চেহারা দেখে সকলে প্রমাদ গণলো- এর ঘা যার ওপর পড়বে তার কি দশা হবে ! আবার মলু নাকি ছাত্র জীবনে রীতিমত লাঠি খেলা শিখেছে।

যাই হোক, জীবন পুরনো রুটিনেই চলতে থাকে, শুধু ফেরার সময় লাঠি বাগিয়ে ধরে মলু একটু দ্রুত লয়ে দৌড়য়- বেলা ছোট হয়ে এসেছে, দিনকালও ভালো নয়, কি দরকার রাত করার …

সেদিন, ক্লাস শেষে, কলিগদের জোরাজুরিতে ইভিনিং শোতে সিনেমা দেখে, মলু যখন নিজের ডেরায় পৌঁছল, তখন বেশ রাত হয়ে গেছে; এক চিলতে বাগানের কাঠের গেটটা হাট করে খোলা।
ব্যাপার কি ? মলু গুঁড়ি মেরে ভেতরে ঢোকে…

See Also
Knock

পেছনের জানলা দিয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারছে এক ষন্ডা গোছের মানুষ…
নির্ঘাৎ নকশাল সাজা গুন্ডা! পেছন থেকে মলু নিঃশব্দে চিতার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে… পাকা হাতের বেঘো বাঁশের খান কতক মোক্ষম বাড়িতে গুন্ডাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, মা ডাকার পর্যন্ত সময় পায় না।
এবার মলু টর্চ জ্বালে, ইয়া মুশকো মাঝবয়সী এক জোয়ান, মাথায় কদমছাঁট চুল, মিলিটারি গোঁফ… বড়সর গুন্ডা না হয়ে যায় না! মোক্ষম মার মেরেছে, দু এক জায়গা থেকে রক্তও গড়াচ্ছে…
মলু দরজা খুলে ওই দেড়মণি লাশকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে তোলে… খানিক চিন্তা ভাবনা করে পেছনের অব্যবহৃত বাথরুমে মানুষটাকে ঢুকিয়ে দেয়। ক্ষততে লাল ওষুধ দিয়ে, মাথার কাছে এক ঘটি জল রাখে। তারপর আচ্ছা করে চারিদিকে তালাচাবি দিয়ে থানার পথ ধরে…

থানায় তখন মেজোবাবু, সেজোবাবু আর কজন কনস্টেবল মিলে গুলতানি করেছে… বেশ শান্তিপূর্ন আবহাওয়া…
মলু টাইফুনের মত আছড়ে পড়ে- ‘বলি, আপনাদের দারোগাবাবু কোথায় ? এখানে বসে গল্প করছেন, আর সাধারণ মানুষের বাড়িতে গুন্ডা বদমাশ ঢুকে আসছে, এসব হচ্ছেটা কি ?’
– ‘বড়বাবুর এখন অফ্ ডিউটি। কিন্তু গুন্ডা বদমাশ কোথায় ঢুকলো ?’ মেজোবাবু মোলায়েম স্বরে বলেন।
-‘আমার বাড়িতেই একটা ঢুকেছে, বাঁশের বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে খবর দিতে এলাম !’
থানার পুলিশ তো বটেই, এমন কি লকআপের কয়েদিগুলো পর্যন্ত মলুকে সমীহের চোখে দেখে…
মেজোবাবু, সেজোবাবু সদলবলে চললেন ডাকাত ধরতে। বাঁশ হাতে মলু চলল আগে আগে দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের মত…

বাড়ি এসে বাথরুমের তালা খুলে গৃহকর্ত্রী আগে উঁকি মারে; ব্যাটার জ্ঞান ফিরেছে, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কোঁকাচ্ছে।
-‘হতভাগা! যেমন কর্ম তেমনি ফল!’ নিজের হাতযশের নমুনা দেখে মলু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে।
তার কাঁধের ওপর দিয়ে মেজোবাবু উঁকি দিয়ে ডাকাতের চেহারা দেখে আঁতকে ওঠেন- এ কী ! এ যে দারোগাবাবু !

মলুর বিস্ফারিত চোখের সামনে পুলিশরা ধরাধরি করে তাঁদের বসকে বৈঠকখানার কৌচে এনে শোয়ায়।
তারপর যেন টাইফুন বয়ে যায়- জল লাও, ডাক্তার লাও, ওষুধ লাও, দুধ লাও…
দারোগাবাবু খানিক সামলানোর পর আসল ঘটনা জানা গেল। নকশাল ধরতে কলকাতার এক বাঘা থানা থেকে অভিজ্ঞ দারোগাবাবুটিকে মলুদের এঁদো থানায় সম্প্রতি পাঠানো হয়েছে। তিনি নাকি আরব্য রজনীর সুলতান, হারুন অল রশীদের কায়দায় প্লেন ড্রেসে রাতের বেলা চারিদিকে টহল দিয়ে বেড়ান। মলুর একটেরে বাড়িটির দিকে তাঁর বেশ কিছুদিন নজর পড়েছে- গা ঢাকা দেওয়ার আদর্শ জায়গা; তাই সেদিন বাড়ি অন্ধকার দেখে একটু উঁকিঝুঁকি মারতে এসেছিলেন।
মলু বেজায় অপ্রস্তুত, কিন্তু দারোগাবাবু ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে হেসে বললেন, ‘একদম লজ্জা পাবেন না, আপনাদের মত নারীদের দেখেই তো গুরুদেব ‘সবলা’ কবিতাটি লিখেছিলেন ! যা বাঁশ পেটা করেছেন, সারা জীবন মনে থাকবে !’

গল্প শেষে পিসি ঠাম্মার কাছে জানতে চাই- ‘মলুঠাম্মা তো এখন ঝাড়গ্রামে থাকে, না ?’
– ‘হ্যাঁ!’
– ‘তাঁর বর তো জিয়াগঞ্জে পুলিশ ?’
– ‘হ্যাঁ; তো ?’
তো, তো অনেক কিছু! তখন বছর দশেক বয়স, আর ছোট নই, লুকিয়ে চুরিয়ে বড়দের বই পড়ে তাঁদের বিটকেল মতিগতির অনেক খবরই রাখি।
সবজান্তার মত হেসে বলি- ‘ওহ্ ! মলুঠাম্মা বুঝি ওঁর হবু বর- পুলিশদাদুকে বাঁশ পেটা করেছিল সেদিন?’
– ‘চুপ চুপ, ও কথা কইতে নাই, শুনলে পুলিশদাদু লক আপে ভইরা দিবে কিন্তু !’

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
1
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top