বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় কে শ্রদ্ধাঞ্জলি

Avatar photo
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা সাহিত্যের আকাশে তিনটি বন্দ্যোপাধ্যায় – উজ্জ্বল নক্ষত্রের সমাহার। একটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। কলমে: রাজ কুমার মুখার্জি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবৎকালে বাংলা সাহিত্যের আকাশে যে তিন উজ্জ্বল নক্ষত্রের আবির্ভাব হয়েছিল তাঁরা তিনজনেই ছিলেন বন্দোপাধ্যায়। তারাশংকর, বিভূতিভূষণ এবং মানিক।

কিছুদিন আগেই এই কলমে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় কে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছিলাম। আজ বলবো শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সমালোচনা করার মতন স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য – কোনটাই আমার নেই।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় আগে। আমার বয়স তখন নয়। উপনয়ন উপলক্ষে বেশ কিছু বই উপহার পেয়েছিলুম। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’, জুল ভার্নের লেখা, বাংলায় তর্জমা করা, ‘এরাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আম আঁটির ভেঁপু’ ইত্যাদি প্রভৃতি। সে সময় – ছোট বড় সবাইকেই, অনায়াসে, যে কোন উপলক্ষে, বই উপহার দেওয়া যেতো। এখন অনেকেই বই উপহার পেতে এবং দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। সে যাক্।

উপনয়নের সময়, ব্রহ্মচর্য পালনের তিনদিন অসূর্যংস্পর্শ থাকাকালীন, আমার দিদি, যার বয়স তখন ১৩ অথবা ১৪, যিনি কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন, দুপুরে ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পড়ে শুনিয়েছিলেন। বইয়ের গল্প আজ আর মনে নেই। তবে গল্পের এক জায়গায় ‘দুর্গা নারকেল মালায় করে কাঁচা আমের ছড়া এনে অপুকে বলছে মাকে লুকিয়ে সরষের তেল নুন আনতে — মাখিয়ে খাবে। অপু মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেই অমৃতসম টাকনা দুর্গার হাতে তুলে পারিশ্রমিক বাবদ দু-তিন ছড়া আমের টুকরো পেয়ে সন্তুষ্ট। সিংহভাগ দুর্গার এবং মুসিক ভাগ অপুর। কৈশোরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সেই ঘটনার সঙ্গে নিজেকে এক করে নিতে কোন অসুবিধা হয়নি। ঐরকম কাজ আমিও করেছি এবং বখরা কোনদিনই সমান সমান হয়নি। ‘আম আঁটির ভেঁপু’ আসলে লেখকের ‘পথের পাঁচালী’র ক্ষুদ্র সংস্করণ। ওই বয়সে আমার ও দিদির স্কুলের গরমের ছুটির সময় বাড়ির দালানে এক্কাদোক্কার ঘর কেটে খেলা — অপু দুর্গার দে ছুট দে ছুট খেলার মতনই। ভাই বোনের নিবিড় সম্পর্ক।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি

সাধারণ আটপৌরে গ্রাম্য জীবন নিয়ে লেখকের রচনা। লেখকের উপন্যাসে ফিরে আসে তৎকালীন সমাজের কথা, সাধারণ মানুষের কথা। বিভূতি ভীষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবন ছিল সংগ্রামের। ঘনঘন বাসস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। কখনও ঘাটশিলা, কখনও ভাগলপুর, কখনও ছোটনাগপুরের মালভূমি, কখনও বা বিহারের ছোট শহর। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা চরিত্রগুলো বাস্তব জীবনের চরিত্র হয়ে উঠেছে অনায়াসে। তাঁর কথায় “যেসব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে, তাদের কথা বলতেই হবে। তাদের সে গোপন সুখ দুঃখকে রূপ দিতেই হবে। ”

প্রবাসী সাময়িক পত্রে ‘উপেক্ষিতা’ ছোট গল্প দিয়ে সাহিত্য জীবন শুরু এবং শেষ উপন্যাস ‘ইছামতি’। ছোট গল্পের মধ্যে লেখক বাস্তব জীবনের অখ্যাত চরিত্রগুলোকে এঁকেছেন। ‘সই’ নামক ছোটগল্পে বাগদী বউ দুলে তার ছোট ছেলেকে নিয়ে আশায় বসে আছে যদি সই তার ছেলেকে কিছু খেতে দেয়। গৃহস্থ বাড়িতে শুধু জল দেয় না, জলের সঙ্গে যদি কিছু খাবার পাওয়া যায়, তবে সকাল থেকে উপোস করা বাছার পেটে কিছু পড়ে। বাছার বাপ হাটে পাটালি বিক্রি করে যদি পয়সা আনে তবেই রাতে দুমুঠো ফুটিয়ে খাওয়া হবে। খুব কাছ থেকে জীবনকে না দেখলে এভাবে বোধহয় লেখা যায় না। সাবলীল লেখা অথচ হৃদয়স্পর্শী।

‘বেণীগীর ফুলবাড়ী’ গল্পে মুঙ্গেরের মেয়ে মুনিয়া তার দ্বিগুণ বয়সী বাঙালি স্বামীর প্রতি যে আনুগত্য দেখায় তা পড়ে পাঠক/পাঠিকা অবশ্যই বুঝতে পারেন শুধুমাত্র স্বামী/প্রভু বা স্ত্রীর সম্পর্ক নয়, ভালবাসার গূঢ় সম্পর্ক। মুনিয়ার গলার হার, বেশ কিছু টাকা আত্মসাৎ করে ললিতের কলকাতা চলে যাওয়া। তিন বছরের মাঝে কোন যোগাযোগ না রাখা এবং তারপর ফিরে এসে মুনিয়ার কাছে সযত্নে থাকা — স্ত্রীর স্বামীর প্রতি ভালবাসার এক নিদর্শন। গল্পে মুনিয়া লেখককে গয়না টাকার কথা না ভেবে বলছেন “আমার এক ছড়া হার উড়িয়ে বসে আছেন-সে যাক্ গে, কিন্তু শরীরের কি হাল করেছেন! বাংলার জল হাওয়া ভালো নয়, আর দেশে যেতে দিই নে। ওখানে গেলে শরীর আবার খারাপ হবে।”

See Also
Swarup Bhattacharya the boatman

লেখকের উপন্যাস গুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘পথের পাঁচালী’ – সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখকের শেষ উপন্যাস ‘ইছামতি’। পূর্ব বাংলার নদী ইছামতির পাশের মানুষদের নিয়ে লেখা। বিশেষতঃ নীলকর সাহেবদের নিয়ে। এখানে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ এর সঙ্গে এই লেখাকে এক আসনে বসালে ভুল হবে। বাঙালি দেওয়ান, বাঙালি চাষির ক্ষতি করার প্রবণতা। নীলকর সাহেবের দেওয়ান রাজারাম রায় এবং আমীন প্রসন্ন চক্কত্তি। রাজারামের জোর করে জমিতে নীলের দাগ দেওয়া, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সব কুকর্মে সিদ্ধ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের স্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে। যদিও পরবর্তী সময়ে রাজারাম খুন হন, সে অন্য গল্প। তৎকালীন জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে।

"দাদা বিভূতিভূষণের আম খাওয়ার জন্য ভাই নটু বিহারী এই গাছটি লাগিয়েছিলেন।"
বিখ্যাত আম গাছ

লেখকের আদি বাড়ি ঘাটশিলায়। ঘাটশিলার মেন রাস্তা থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে সুবর্ণরেখার দিকে — ‘অপুর পথ’। এই পথের শেষে লেখক এর আদি বাড়ি ‘গৌরিকুঞ্জ’। বাড়ি চৌহদ্দি তে একটি বৃদ্ধ আম গাছ, সিমেন্টের বেদি করা। টিনের ফলকে লেখা “দাদা বিভূতিভূষণের আম খাওয়ার জন্য ভাই নটু বিহারী এই গাছটি লাগিয়েছিলেন।” আম গাছের পাশে লেখকের সন্তান এবং সৃষ্ট চরিত্র একসঙ্গে দণ্ডায়মান ‘তারাদাস মঞ্চ ও অপুর পাঠশালা’।

ফুলডুংরি পাহাড় এর পথে লেখক Rajkumar Mukherjee
ফুলডুংরি পাহাড় এর পথে লেখক রাজ কুমার মুখার্জি

জীবনের গোধূলি বেলায় এসে লেখকের জন্মস্থান ঘাটশিলা, ছোটবেলার স্মৃতি ফুলডুংরি পাহাড়, সুবর্ণরেখা নদী, লেখকের বাড়ি ইত্যাদি দেখে নিজেকে ঋদ্ধ করলাম। মনে হল একটি বৃত্তের পরিধি বরাবর অন্তত কিছুটা হাঁটা গেলো। আমার মতন অতি নগণ্য, সাধারণ মানুষ, লেখক কে আমার মতন করে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে এই প্রবন্ধ – এটাই বড় পাওয়া।

What's Your Reaction?
Excited
1
Happy
3
In Love
2
Not Sure
0
Silly
1
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll To Top