Now Reading
বাদামটাম – এক অনাবিষ্কৃত স্বর্গ

বাদামটাম – এক অনাবিষ্কৃত স্বর্গ

Avatar photo
বাদামটাম চা বাগান
মোহন জির রান্নাঘরের জানালা
ফেরার দিন অভিমানী পুণ্ডি
স্কুলের পথে স্থানীয় ক্ষুদে
রুং দুং খোলা +5
View Gallery

বাদামটাম নয়া বস্তির গত দুটি পর্বে ছিল ওখানকার মোহন সুব্বাজির কাহিনী। সাথে ছিল ওখানে কিভাবে পৌঁছাবেন এবং ওই হোমস্টে তে কি ধরনের খাওয়া-দাওয়া এবং আতিথেয়তা পাবেন তার বিশদ বিবরণ। এই শেষ পর্বে রইল লেখকের পরের দুটি দিনের অভিজ্ঞতা।

বাদামটাম গিয়ে দ্বিতীয় দিনের সকালটা শুরু হলো অন্যভাবে। আগের দিন রাতেই মোহন জি আমাদের বলে রেখেছিলেন ভোর ভোর উঠে পড়তে। সেই মতো প্রায় কাক ভরে উঠে, দারুন রিফ্রেশিং এক কাপ করে চা খেয়ে, মোহন জির সাথে বেরিয়ে পড়লাম। ছোট্ট পুন্ডি ও আমাদের সঙ্গ নিল। হোমস্টের পিছনের মাঠের মতো সমতল জমিটি পেরিয়েই উঠে গেছে খারাই রাস্তা, যে রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে নেমেছিলাম হোমস্টেতে। কিন্তু মোহন জি দেখলাম সেই রাস্তায় না গিয়ে ওই রাস্তার পাশ দিয়ে এক ফালি সরু রাস্তা, যা জঙ্গলের মধ্যে নেমে গেছে, সেই রাস্তায় হাঁটা শুরু করলেন। রাস্তাটি মোটামুটি দেড় ফুট মত চওড়া, আর তার সাথে বেশ খাড়া উতরাই। দেখেই রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম, পারবো তো নামতে? পা বাড়াবো কি বাড়াবো না এই ভাবতে ভাবতেই একটা করে লাঠি নিয়ে হাজির হলেন মোহন জি। সেই লাঠির উপর ভরসা করেই খুব ধীরে ধীরে নেমে চললাম জঙ্গলের মধ্যে।

মোহন জির বারান্দায় বসে চা
মোহন জির বারান্দায় বসে চা

চারপাশের সদ্য ভোরের প্রকৃতি প্রতিমুহূর্তে জানান দিচ্ছে, আমরা এসে পড়েছি এক নতুন জগতে। শেষমেষ অনেকটা উতরাই পেরিয়ে নেমে এলাম উপত্যকার সর্বনিম্ন অংশে। দেখলাম ছোট জলধারা বয়ে যাচ্ছে পাথরের মধ্যে দিয়ে। মোহন জি নিজের তালে চলতে থাকলেন আমাদের জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন মেডিসিনাল প্লান্ট চেনাতে চেনাতে। সাথে সংগ্রহ করতে লাগলেন এক ধরনের জংলি শাক বা পাতা, যার নাম নিঙ্গুরো। এটা নাকি জয়েন্ট পেইন সারাতে কাজে লাগে। এবং জানালেন এটি খেতেও বেশ ভালো, আজ দুপুরে আমাদের রান্না করে খাওয়াবেন সেজন্যই সংগ্রহ করছেন।

বাদামটাম চা বাগান
বাদামটাম চা বাগান

জঙ্গল দিয়ে নামলেও আমরা শেষমেশ উপরে উঠলাম কিন্তু চা বাগানের মধ্যে দিয়ে। বিস্তীর্ণ চা বাগান, আর মধ্যে মধ্যে  বিশাল উঁচু উঁচু গাছ মাথাচাড়া দিয়ে রেখেছে বাগানের মধ্যে দিয়ে। প্রকৃতির এই নৈসর্গিক রূপ দেখে নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। চিন্তায় ছেদ করলো ময়ূরের ডাক শুনে, কাল রাতে ও ঘুমানোর সময় অনেক বার শুনেছি ডাক। চা বাগানের চড়াই পেরিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে শেষমেষ বিশ্রাম নিলাম ছাউনি ঘেরা একটি জায়গায়। কাল আসার পথেই দেখেছিলাম জায়গাটি, অনেক ব্যাগ ঝুলছিল এখান থেকে। মোহন জি বলেছিলেন এটি চা বাগানে শ্রমিকদের বিশ্রাম নেবার এবং টিফিন খাওয়ার জায়গা।

বাদামটাম চা বাগান
বাদামটাম চা বাগান

এইভাবে গল্প আড্ডার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে হোমস্টে ফিরে এলাম, আর পেয়ে গেলাম গরম গরম লুচি তরকারি আর সেই বিখ্যাত অমলেট। এতটা পথ হেঁটে খিদেও পেয়েছিল খুব, প্রায় গোগ্রাশে গিলে নিলাম সবটা। তারপর বাকিটা সময় কাটালাম বারান্দায় বসে পুন্ডি আর কালীর খুনসুটি দেখতে দেখতে। স্নান সেরে আসতেই যশোদা দিদি ডেকে নিলেন লাঞ্চ খেতে। লাঞ্চে অন্যান্য সুস্বাদু আইটেমের সাথে ছিল সেই নিঙ্গুরো শাক পেঁয়াজ দিয়ে ভাজা, অসাধারণ স্বাদ।

সকালের জলখাবার
সকালের জলখাবার

দুপুরে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে, বিকেলে মোহন জির সাথে বেরিয়ে পড়লাম স্থানীয় পাহাড়ী নদীটি দেখতে। নদীটির নাম রুংদু্ং, কিন্তু সাইজে ছোট হওয়ায় এটিকে স্থানীয় লোকজন নদী না বলে খোলা বলে থাকেন। হোমস্টে থেকে নদীর পথ একে একে নেমে গেছে নিচের উতরাইতে। সেই রাস্তা বরাবর বেশ কিছুটা হাটার পর পেলাম প্রায় সমতল একটি জায়গা।

রুং দুং খোলা
রুং দুং খোলা (নদী)

মোহনজি জানালেন, এখানে উনি আগে জনা ১৫ লোকজন নিয়ে ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করতেন। তখন ওনার হোমস্টে তৈরি হয়নি। এখনো স্থানীয় লোকজন মাঝেমধ্যে এখানে পিকনিক করেন। এরপর থেকে প্রায় সমতল রাস্তা, সেই বরাবর বেশ কিছুটা এগিয়ে দেখতে পেলাম বেশ কিছু মানুষজন এবং কিছু ঘর বাড়ি। নদীর কাছাকাছি বলেই হয়তো ঘরবাড়ির আধিক্য এখানে একটু বেশি। সুন্দর সুন্দর রং বেরঙের বাড়িগুলি সাজানো রয়েছে ফুলের গাছ দিয়ে। এমনকি একটি ছোট দোকানও আছে এখানে, আলু পেঁয়াজ থেকে শুরু করে কোল্ড্রিংস চিপস লজেন্স বিস্কুট সবই পাওয়া যায় এখানে। ওই দোকানে আলাপ হলো ইউসুফের সাথে। সে ফিরছিল নদী থেকে মাছ ধরে। এই হাসিখুশি মানুষটি বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলেন আমাদের সাথে, উপলব্ধি করতে পারলাম ওনার স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব। আলাপ হল আরো একজন বয়স্ক মহিলার সাথে, অস্বাভাবিক দক্ষতার সাথে হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভাঙছিলেন তিনি।

See Also
সিকিম ডায়েরি পার্ট ২: দারাপ

এইসব আলাপচারিতা পেরিয়ে চলে এলাম নদীর তীরে। সুন্দর পাহাড়ি নদী, দুপাশে দুটি সাঁকো, একটি বাঁশের এবং অন্যটি কাঠের। মোহন জি বললেন এই নদী পেরিয়েই ওপারে রয়েছে আরেকটি গ্রাম যার নাম মানেদারা। সাথে এও জানালেন যে বর্ষায় এই নদীর জল ফুলে ফেপে উঠে নষ্ট করে দেয় এই সাঁকো গুলিকে, প্রত্যেক বছরই গড়তে হয় নতুন করে।

যাইহোক সন্ধ্যে নামার আগেই হোমস্টে ফেরার পথ ধরলাম। পথে পড়ল একটি বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ এবং কমিউনিটি সেন্টার, এগুলি স্থানীয় মানুষরাই বানিয়েছেন কোনরকম সরকারি সাহায্য ছাড়াই নিজেদের খরচে। দিনটা শেষ হলো যশোদা দিদির হাতের সুস্বাদু ডিনার দিয়ে। পরের দিনটা পুরোটাই কাটলো প্রায় অলস ভাবে, অগোছালোভাবেই ঘুরে বেড়ালাম এদিক ওদিক। কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে এবং মোহন জির সাথে গল্প করে সময় কাটালাম। বাদামটাম গিয়ে তিনটি দিন যেন কেটে গেল স্বপ্নের মত, এবার ফেরার পালা। যদিও মন চাইছিল না ফিরে যেতে, মনে হচ্ছিল হঠাৎ করে হারিয়ে পাওয়া কাছের মানুষগুলোকে ফিরে পেয়েছি এতদিন বাদে। ছেড়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিল পুন্ডি কেও, এই তিন দিন সারাক্ষণ ও এটুলির মতো লেগেছিল আমাদের সাথে। হয়তো ওরও কষ্ট হচ্ছিল, তাই আমাদের ব্যাগ গোছানোর সময় পিছন ফিরে বারান্দায় বসেছিল ও। কিন্তু কিছু করার নেই, ফিরতে তো হবেই। তবে আবার আসবো শহরের ধুলোবালি পেরিয়ে বাদামটাম নয়াবস্তিতে, প্রকৃতির মাঝে, রক্তের সম্পর্ক নয় এমন কিছু আত্মীয়তার টানে। আমাদের ভ্রমণের কিছু ছবি এবং ভিডিও লিংক এখানে শেয়ার করছি…

ভিডিও লিংক:

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.


Scroll To Top