পাইস হোটেল



Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and…
কলকাতার একসময়ের বিখ্যাত ‘পাইস হোটেল’। বহু উঠা পড়ার মধ্যে দিয়ে আজও টিঁকে আছে। পাইস হোটেল নিয়ে একটি প্রতিবেদন। কলমে: রাজ কুমার মুখার্জী
আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে কোন এক বৈশাখে তারকেশ্বরের দুধ পুকুরে (কোন কালই সে পুকুরে দুধ ছিল না) ডুব দিয়ে, বাবার মাথায় (শিবলিঙ্গের মাথায়) জল ঢেলে, ভিজে গা মুছে, শুকনো জামা প্যান্ট পরে, এক পেট খিদে নিয়ে, এক ভাতের হোটেলে খাবার পর, কাউন্টারে পয়সা দেবার সময়, যে ছেলেটি খাবার দিচ্ছিল, সে সুর করে বলে উঠলো, ‘ডাল-ডালনা-ভাজা-পাতা-গেলাস-নেবু’ অর্থাৎ আমার অর্ডার দেয়া খাদ্য তালিকা। এই ছয়টি শব্দের মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত মানে আছে, সেটা হোটেলের খাদ্য পরিবেশক এবং ক্যাশ কাউন্টারে বসা মালিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভাতটা কমন, সঙ্গে ডাল ডানলা এবং আলু ভাজা, কলাই এর থালার উপরে কলা পাতা পেতে খাবার দেওয়া এবং মাটির গেলাসে জল, ভাতের পাশে এক টুকরো পাতিলেবু। এইগুলোই একসঙ্গে সুর করে বলা ‘ডাল-ডালনা-ভাজা-পাতা-গেলাস-নেবু’। এটাই ‘পাইস হোটেল’।
‘পাইস হোটেল’ নাম কেন বা কিভাবে এলো তার কোন সদুত্তর নেই। বহুজনের বহু মত। আসুন বেশ কিছু বছর পেছনে চলে যাওয়া যাক্। সময়টা ১৯১০ সালের আশেপাশে। কাজের খোঁজে গ্রামবাংলার শিক্ষিত যুবকেরা কলকাতা শহরে আসতে শুরু করেছেন। তখন কলকাতা শহর বলতে উত্তরে শ্যামবাজার, দক্ষিণে চৌরঙ্গী পার্ক স্ট্রীট ছাড়ালেই শহর শেষ। শুরু হলো শহরতলী। বড়জোর কালীঘাট, তারপর হোগলা বনের জঙ্গল, শিয়াল।
কলকাতায় এসে যুবকেরা, বউবাজার, হ্যারিসন রোড, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট চত্বরে থাকতে শুরু করলেন। একা বাড়ি ভাড়া করে থাকবেন, সে সামর্থ্য কোথায়? বেশ কয়েকজন মিলে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু। মেসবাড়ি, রান্না করে উড়িয়া বামুন। তার হাতের রান্না খেয়ে মুখ বদলানোর জন্য অন্য রান্নার সন্ধান খোঁজা। সাহেব অফিসে কাজ করলেও সাহেব দোকানে খাবার জন্য যে ট্যাঁকের জোর দরকার, তা নেই। এখানেই পাইস হোটেলের আবির্ভাব। বাড়ির রান্নার স্বাদ পাওয়া, পেট চুক্তি খাওয়া, (অবশ্যই ভাত, ডাল এবং সবজি)। তখন বাজার ছিল সস্তা। এক পয়সা, দু পয়সায় পেট চুক্তি খাওয়া যেত। সাহেবরা ইংরেজিতে পয়সাকে পাইস বলতো, সেই থেকেই পাইস হোটেল (এটা একটা মত)।
‘বেঙ্গলি এথনিক কুইজিন’ এর ঠেলায় পাইস হোটেলের কদর এখন কমে গেছে। তবে যাঁরা কলকাতার শহরতলী থেকে বড়বাজার, কলেজ স্ট্রীট, শিয়ালদা ইত্যাদি অঞ্চলে এসে নিজেদের ব্যবসার জন্য সওদা করেন, তাঁদের বাঙালির রসনায় নিজেকে তৃপ্ত করার আদর্শ জায়গা ‘পাইস হোটেল’।
পাইস হোটেলের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে। বেশ ঠাসাঠাসি করে বসে খেতে হয়। সব সময় একটা সরগরম। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির হেঁশেলে যেমন ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ – সবমিলিয়ে একটা গন্ধ থাকে, এখানেও সেই গন্ধ আপনার নাকে ভেসে আসবে। খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়াবেন, যিনি আপনাকে খাবার পরিবেশন করছিলেন, ওই দূর থেকে বলে উঠবেন আপনার টেবিলের নম্বর এবং আপনি কি কি খেয়েছেন। একইসঙ্গে অনেক লোককে খাবার পরিবেশন করছে অথচ কোথাও এতটুকু ভুল নেই। দাম মেটাতে হবে ক্যাশে। কার্ড, পেটিএম, google pay-এসব এখানে ব্রাত্য। অবশ্য আধুনিকতার ঢেউ যেভাবে আছড়ে পড়ছে, তাকে ঠেকানো দায়। যিনি টাকা নিচ্ছেন, তাঁর টেবিলের উপরে একটা অ্যালুমিনিয়ামের বা প্লাস্টিকের বাটিতে মৌরি। এক মুঠো তুলে মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে আসুন। টিপস কেউ চাইবে না। পাইস হোটেলে টিপস দেওয়ার কোন চল নেই। এখানে বাসি খাবার পাবেন না, কারণ যাঁরা এখানে খান, তাঁরা প্রায় নিয়মিত খদ্দের।
এবার বলি কলকাতার কিছু পাইস হোটেলের কথা, যেহেতু আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে, তাই কিছুটা পক্ষপাতিত্ব করেই প্রথমেই বলবো ভবানীপুর অঞ্চলের পাইস হোটেলের কথা:
পার্বতী হোটেল: আশুতোষ মুখার্জী রোডে যদু বাবুর বাজারের উল্টোদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া দ্বারিক ঘোষের মিষ্টির দোকানের পাশে সরু গলতা দিয়ে নির্ভয় ঢুকে যান। টাটকা চারা পোনা মাছের ঝোলের স্বাদ পেতে এর চাইতে ভালো জায়গা বোধহয় আর কোথাও নেই। এছাড়াও আরো পাঁচ ছ’ রকমের মাছের পদ এখানে পাবেন।
তরুণ নিকেতন: রাসবিহারী মোড় থেকে লেক মার্কেটের দিকে একটু এগোলেই ডানহাতে ‘তরুণ নিকেতন’। আগে এখানে মাটিতে আসন পেতে কলা পাতায় খাবার দেওয়া হতো। এখন অবশ্য চেয়ার টেবিল। মোচার ঘন্ট, কচু শাক, হাঁসের ডিমের কালিয়া বিখ্যাত।
নিউ তারা মা হোটেল: ডাকনাম মাইতি হোটেল। গড়িয়াহাট নিউ কমপ্লেক্সের দোতলায় উঠে মাইতি হোটেল বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। পাবদা, চিতল, বোয়াল মাছের স্বাদ নিতে এখানে আসতেই পারেন।
ইয়ং বেঙ্গল হোটেল: খিদিরপুরের কার্ল মার্কস সরণি, ফ্যান্সি মার্কেট এর কাছে ১০০ বছর আগে তারাপদ গুহরায় এই হোটেলে সূচনা করেন। ডালের বড়ার ঝাল, মুড়িঘন্ট, আলু পোস্ত, বিউলির ডাল, পাঁঠার মাংস – এদের খাদ্য তালিকায় থাকবেই।
জগন্নাথ ভজনালয়: তালতলায় সুরেন ব্যানার্জি রোড ও রফি আহমেদ কিদোয়ায় রোডের সংযোগস্থলে। এদের মূল আকর্ষণ সরষে ভেটকি।
সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম: গলদা চিংড়ি, রুই ভাপা,পোস্তর বড়া। ওহো, ঠিকানাটা বলা হল না। তালতলা মির্জা গালিব স্ট্রীট।
কমলা হোটেল: শোভাবাজার রবীন্দ্র সরণী। নব্বই বছরের প্রতিষ্ঠান। জিরে বাটা দিয়ে মাছের ঝোল, সরষে বাটা দিয়ে মাছের ঝাল। নয় নয় করে দশ রকমের মাছের স্বাদ পাওয়া যাবে এখানে।
জগনমাতা ভজনালয়: দেড়শ বছর পেরিয়ে যাওয়া পাইস হোটেল। উড়িয়া রাধুনীর হাতে আজও রান্না হয়। পার্সে, কই, মাগুর, পমফ্রেট, চিতল – বাঙালিকে মাছে ভাতে রাখার দৃঢ় সংকল্প। বিবেকানন্দ রোড ধরে বিধান সরণীর মোড় থেকে শ্রীমানি মার্কেটের দিকে একটু এগোলেই কৈলাস বোস স্ট্রিট, শিমলা, মেছুয়া। এসব মাছের স্বাদ পেতে, এখানে আসতেই হবে।
স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল: প্রেসিডেন্সি কলেজের পাশে জেরক্স গলি দিয়ে একটু এগলেই, পেয়ে যাবেন। শোনা যায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সহ বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী মাঝেমধ্যেই এখানে খেতে আসতেন। ১৯২৭ সাল থেকে আজও নিজেদের খাদ্যগুণ বজায় রেখে চলেছেন। মাছের মাথা দিয়ে ছ্যাঁচড়া, মাছের ডিমের বড়া, তোপসে মাছের ফ্রাই এর স্বাদ বহুদিন আপনার মনে থাকবে।
এছাড়াও কলকাতা শহর জুড়ে বহু নামী অনামী পাইলস হোটেল আছে। যাদের সবার কথা এখানে বলা গেল না। কম পয়সায় ভালো বাঙালি খাবার খেতে পাইস হোটেলের জুড়ি মেলা ভার।
পরিশেষে বলি কলকাতায় থাকেন বা কলকাতায় কোন কাজে অথবা বেড়াতে এসেছেন, অথচ পাইস হোটেলে খাননি, আপনার বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে না। বাঙালি রান্নার স্বাদ পেতে পাইস হোটেলের খাবার একবার পরখ করে দেখতেই হবে। চকচকে কাঁচের দরজা ঠেলে, ঊর্দ্দি পরা দাররক্ষী, খাদ্য পরিবেশক – এসবের মোড়ক উপেক্ষা করে কলকাতার শতাব্দী প্রাচীন কোন পাইস হোটেলে ঢুকে পড়ুন, খুঁজে নিন হারিয়ে যেতে বসা তিলোত্তমা কে।
What's Your Reaction?

Raj Kumar Mukherjee - sexagenarian. A father, a husband and a son, who has finally let go of excelsheets and PowerPoints and picked up a pen instead. A child at heart, he reminisces his childhood days and wishes that the world was a better place for all of us. An avid reader and storyteller at heart, he is spending his retirement by reading books, experimental cooking (mostly failures!) and writing.