Now Reading
পরোপকারীর ফোন চোর

পরোপকারীর ফোন চোর

Avatar photo
ফোন সিম চোর

দিপালীদির ফোন চুরি গেল ।সমস্যাটা ফোন নিয়ে নয় ফোনের যে নম্বরগুলো টোকা ছিল সেগুলো নিয়ে। ওটা না হলে যে বিদেশ যাওয়া যাবে না । পাবে কি ফোনটা ফিরে?

ফোন চুরির পর দিপালীদি অসহায় হয়ে পড়েছিল কারণ ফোনটা না থাকলে তার বিদেশ যাওয়া হবে না । সেদিনের ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি ।

শাশুড়ির পুরনো কাজের লোক ঊষাপিসির মেয়ে- দিপালীদি ছেলেবেলা থেকেই ভয়ানক উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তার মা দীর্ঘদিন আমার শাশুড়ির ডান হাত ছিল, বাপ মরা ছোট্ট দিপালীকে এ বাড়িতে রেখে সে দশ বাড়ি ঠিকে কাজ করতো ; রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেত।

শাশুড়ি পড়াশুনো করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু দিপালীদির সেসবে কোনো কালেই মতি নেই, বরং শাশুড়ির একমাত্র কন্যার বান্ধবীদের সাজগোজ, চালচলনের দিকে বেশি নজর। সঙ্গে, একটু বড় হওয়ার পর মাধুরী দীক্ষিত তার মাথা একেবারে খেয়ে নিয়েছিলেন। শাশুড়ির জুলুমে কোনমতে ক্লাস সেভেনে উঠে- এক পয়সাওলা ঠিকাদারের ঘোর বকাটে ছেলের সঙ্গে ইলোপ করল। তবে ক্যালকুলেশনে কিঞ্চিৎ ভুল হয়েছিল; ছেলের পরিবার- তাদের ঘরে তুললো না, মেয়ের মাও ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করলো।

সৎপাত্রটি বোধহয় দুঃখ ভোলার জন্যই – মদ, গাঁজা, গুলি, জুয়া নিয়ে ব্যস্ত রইলো, আর দিপালীদি চললো ভবানীপুরে এক রাজস্থানী বাড়িতে আয়ার কাজে। সে বাড়ির মাইনেপত্র, আদর যত্ন দুইই ভালো ; সংসার আর বরের নেশা ভাং জুয়া দিব্যি চলে যায়।

এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, দিপালীদির এক মেয়ে হয়েছে, সে মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্লাস এইটে এক অপাত্রের সঙ্গে ভেগেছে, এখন সতেরো বছরেই দু মেয়ের মা ; মনিব বাড়িতে গৃহকর্তা- মেসোমশাই দেহ রেখেছেন, একমাত্র মনিব পুত্র আবু ধাবিতে সেটল করেছে, এখানে গৃহকত্রী- মাসিমা থাকেন দিপালীদির তত্ত্বাবধানে। দিপালীদির বরই শুধু যেমন ছিল তেমনই আছে, কেবল নেশা খানিক বেড়েছে।

এমন সময় রাজস্থানী মাসিমার হালকা স্ট্রোক হল, ছেলে- মাকে আর একা একা কোলকাতায় ফেলে রাখতে সাহস পেল না, চল আবু ধাবি ! এদিকে মা আবার পুরনো কাজের লোককে ছাড়া স্বর্গে গেলেও নাকি বাঁচবেন না, সুতরাং সেও চলুক ! এমন সৌভাগ্য দিপালীদি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি, সে এক পায়ে খাড়া ! কিন্তু পরিবার নারাজ, বরের ভয়- আরবের শেখেরা নাকি তার বউকে দেখলেই নিকে করে নেবে !

বেজায় ঝামেলা চললো কদিন, অবশেষে আমার শাশুড়ির চমক ধমকে বর নিমরাজি হল, আর দিপালীদিও চললো ফরেন ! বছরে একবার এক মাসের জন্য বাড়ি আসার সুযোগ পাবে, ফেরৎ পাঠানোর সব ব্যবস্থা করবে মাসিমার দিল্লী নিবাসী ভাইপো।

সে বছর দিপালীদি প্রথমবার ছুটিতে বাড়ি এসেছে, একদিন এল শাশুড়িকে খেজুর দিয়ে প্রণাম করতে; তিনি শুধোন- ‘ফিরবি কি কইরা ?’
– ‘দিল্লীর দাদাবাবু পেলেন তেকে নামিয়ে টেরেনে তুলে দেচে, বলেচে- ফেরার টিকিট একেনে এক বন্দু করে দেবে একন ! সবার ফোন নম্বর সব মোবাইলে তুলে দেচে !’

দিপালীদি সগর্বে দামী ফোন দেখায়। বসেরা নাকি স্মার্ট ফোনই দিতে চেয়েছিল, নেহাত দিপালীদি সেই ফোনের আগা মাথা কিস্যু বোঝেনা, তাই সবার সেরা বোতাম ফোন কিনে দিয়েছে।

শাশুড়ি বলেন – ‘কাউরে দিয়া দরকারি নম্বরগুলা একটা নোটবুকে লিখাইয়া রাখ ! যন্তরের উপর নির্ভর করা উচিৎ না, কখন বিগড়ায় ঠিক নাই।’

সে কথা আদৌ দিপালীদির কানে গেল কিনা কে জানে ! তিনি তখন আমাদের দুই জাকে আবু ধাবির চমক ধমকের খবর দিতে ব্যস্ত !

এর কদিন পরই ঝোড়োকাকের মত চেহারা নিয়ে মায়ের সঙ্গে দিপালীদির আগমন…

– ‘সব্বোনাশ হয়ে গ্যাচে বোদি গো ! আমার ফোন ছেনতাই হয়ে গ্যাচে!’

– ‘সেকি ! কিভাবে ?’

সে এক কান্ড ! অনেক দিনের সাধ পূরণ করতে দুপুরে দিপালীদিরা মায়ে ঝিয়ে গেছে দক্ষিণাপণে বাজার করতে; ফিরতি ট্রেনে সাত আটটা ব্যাগ নিয়ে দমবন্ধ ভিড়ে বেসামাল, এই ফাঁকে মোবাইল লোপাট !

এখন আর তার আবু ধাবির সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। বরের নম্বর একটা মনিব বাড়ি দেওয়া ছিল বটে, কিন্তু হতভাগা সে ফোন বেচে দিয়েছে কবেই !

– ‘তরে না কইলাম- নোটবুকে জরুরী নম্বর টুইক্যা রাখতে, কথা কানে ঢোকে নাই ?’ শাশুড়ি ক্ষেপে ওঠেন।

– ‘মাসীমা, অত বুদ্দি তাকলে তো তোমার মত বিচানায় বসে চল্লিশ হাজার পেনশন টানতুম, লোকের এঁটো ঘাঁটতুম ?’

– ‘পুলিশের কাছে যা !’

– ‘ওরা ব্যাঙ করবে ! ও দাদারা বাঁচাও গো !’ দিপালীদি তার দুই দাদাবাবুকে ধরে পড়ে।

শাশুড়ির ছেলেদের জনসংযোগ সাংঘাতিক, দুনিয়ার আইন রক্ষক থেকে আইন ভঙ্গকারী – সবাই তাঁদের বন্ধু; সারা জীবন পড়াশুনায় ফাঁকি দিয়ে ওই সবই করেছে কিনা ! তবে মিথ্যে বলবো না, সেই জনসংযোগ মাঝে মধ্যে বেজায় কাজে লাগে, যেমন লাগলো সেদিন।

ভাসুরের বন্ধু এক পুলিশ অফিসার- তিনি খোঁজ দিলেন রেলের সাউথ সেকশনের এক মোবাইল চোরের, খুব নাকি করিৎকর্মা।
‘বুঝলি, আমাদের অনেক প্রটোকল মানতে হয়, এরা বরং অনেক জলদি কাজ সারে।’ তাঁর নিজের মেয়ের ফোন নাকি কদিন আগেই বাঘাযতীন স্টেশনে চুরি গেছিল, বন্ধুর ফোন পাওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই এই মহামানব সে মোবাইল উদ্ধার করে দেন ! সঙ্গে উপদেশ দিলেন- ‘এট্টু ভালো ব্যবহার করিস ! এরাও কিন্তু এক ধরনের সমাজসেবী! হাঃ হাঃ !’

পুলিশের হুকুমে ঘন্টা খানেকের মধ্যে বাড়িতে চোর মহারাজের আগমন হল। ভীষণ রোগা, নিরীহ ভালো মানুষের মত চেহারা ; কিন্তু খুব পোক্ত ! বললে বিশ্বাস করবেন না, দিপালীদিকে জেরা করছিল পুরো ব্যোমকেশ বক্সীর কায়দায় !

– ‘ফোনের মডেল কি ? কোতায় চুরি গেল ?’

– ‘মরণ ! সে আমি জানবো কি করে ?’

– ‘তবে তো মুশকিল হল !’

– ‘কেন কেন ?’ আমরা পরম উৎসাহে জানতে চাই।

– ‘এক এক এরিয়ায় এক এক জন অপারেট করে বোদি ! কোতা তেকে টেরেনে উটেচিলে সেটা মনে আচে?’

– ‘ডাকুরিয়া ! কোতায় নেমিচি সেটা বলতি হবে ?’

See Also
নোনাদা আবহাওয়া তে গালাগালির বন্যা বইয়ে দিত

– ‘ফাজলামি করোনাকো !’ ব্যোমকেশ ধমক লাগায়, গম্ভীর মুখে নিজের লড়ঝড়ে মোবাইল থেকে খান কতক ফোন করে…

– ‘কাল বিকেলের মধ্যে ফোন পেয়ে যাবে গো দিদি ! হাজার ট্যাকা লাগবে কিন্তু !’

– ‘দোবো দোবো, সঙ্গে তোমাকেও মিষ্টি খেতে ট্যাকা দোবো একন !’
সমাজসেবী একগাল হেসে বিদায় নেয়…

ওমা ! পরদিন এক ব্যাগ ফোন নিয়ে হাজির, ‘খুঁজে নাও !’

ওপরেই জ্বল জ্বল করছে দিপালীদির ঝকঝকে ফোন !

কিন্তু সমস্যার সমাধান হল কই ? ফোনের সিমকার্ড গায়েব, আর অধিকাংশ দরকারি ফোন নম্বরই- কেন কে জানে, সিমে তোলা;

ফোনে রয়েছে গুটিকয় অদরকারি নম্বর। দিপালীদি ডুকরে ওঠে …

– ‘নক্বী বাই আমার ! সিমটা জোগাড় করে দে !’

– ‘অসম্ভব ! সিম জোগাড় করা কি চাট্টিখানি কতা ! ওতো আমরা তোলা মাত্র ফোন তেকে খুলে ফেলে দেই।’
সমাজসেবী কোনো কথাই শুনতে নারাজ !

অগত্যা ফোন যায় পুলিশ বন্ধুর কাছে, তিনি বলেন- ‘দে দেখি ব্যাটাকে ফোনটা!’
চোরে পুলিশে গুজগুজিয়ে কি শলা হয় কে জানে, চোরমশাই বলেন- ‘কাল সিম আনচি দিদি, আর কেঁদোনি !’

পরদিন ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলির এক প্যাকেট ভর্তি সিম নিয়ে হাজির হন দিপালীদির মধুসূদনদাদা – ‘তোমার সিম খুঁজে নাও !’মুন্ডু ঘুরে যাওয়ার জোগাড়, এর থেকে এক মাথা চুল গোনা সহজ ! কিন্তু দিপালীদির কিনা জীবন মরণ সমস্যা, অগত্যা শুরু হল ওই সিম সমুদ্র মন্থন করে দিপালীদির মুশকিল আসান উদ্ধার পর্ব !

বাড়ির যে যেখানে ছিল- একসঙ্গে বসে নিজের নিজের ফোনে হরেক সিম ভরে পরীক্ষা শুরু হয়, আশপাশের কিছু মহানুভব পড়শীও হাত লাগায়… সে এক উকুন বাছা কাজ ! মাঝে মাঝে চলে সরস মন্তব্য…ঊষাদি স্বেচ্ছাসেবকদের ঘন ঘন চা সাপ্লাই করতে থাকে…
আর, ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে চলতে থাকে দিপালীদির লাগাতার হা হুতাশ…
সাতষট্টি নম্বর সিমে এসে অবশেষে পরশ পাথর মেলে, দিপালীদির ফরেনের চাকরি অক্ষত থাকে। আর আমরাও সমাজবন্ধুটির ফোন নম্বর যত্ন করে নিজেদের কাছে রেখে, তাকে লুচি মাংস খাইয়ে বিদায় করি, কি জানি কবে আবার দরকার পড়ে !

শুধু যাবার আগে শাশুড়ি জানতে চান – যার কাছে এক ব্যাগ ফোন, সে নিজে একটা সেলোটেপ মারা ফোন ব্যাবহার করে কেন ?
উত্তরে মানুষটি ঘাড় চুলকে লাজুক হাসে…

ভাসুর বলেন – ‘আহা মা, গুনী মানুষরা একটু সিম্পলই হন। যেমন ধর আমাদের- রতন টাটা !’

What's Your Reaction?
Excited
0
Happy
0
In Love
0
Not Sure
0
Silly
0
View Comments (0)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll To Top