নীল বসনে চিরবসন্ত
Saptarshi, a finance professional, has a camaraderie with his camera…
ডেনিম বা জিন্স ছাড়া আজকের ফ্যাশন দুনিয়া ভাবা যায় না! পৃথিবীর যে কোন দেশে পরিধেয় হিসেবে এর জনপ্রিয়তা সমাজের নিচু তলা থেকে উপর অবধি। জাহাজের নাবিক অথবা সোনার খনির মজুরের বেশ হিসেবে যার আত্মপ্রকাশ সে আজ এক বিশাল শিল্প পৃথিবী জুড়ে। দেড়শ বছরের ইতিহাস কে পিছনে ফেলে রেখে আজও সে নবীন, তরতাজা, চিরবসন্তের প্রতীক।
সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের কলমে আজ সেই ডেনিম বা জিন্স এর সার্ধ শতবর্ষের কাহিনী!
খুব বেশিদিন নয়। এই তো গত বছরের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। মার্কিন দেশে এক নিলামে নাকি একটা ছেঁড়া পুরোনো পাৎলুন বিক্রি হল এক লক্ষ চোদ্দ হাজার ডলারে। কি এমন জিনিস সেটা? সেটা নাকি উদ্ধার হয়েছে ১৮৫৭ সালে পানামা থেকে নিউ ইয়র্ক গামী এস এস সেন্ট্রাল জাহাজের ধংসাবশেষ থেকে যা আবিষ্কৃত হয় ১৯৮৮ সালে দক্ষিণ ক্যারোলিনার কাছে সমুদ্রের গভীরে। কিন্তু তাতেই বা কি এলো গেলো? আসলে এটি নাকি আমাদের চির পরিচিত জিন্স এর এখন অব্দি পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো নমুনা। বস্ত্র ব্যবসায়ী জনৈক জন ডেমন্ট ট্রাঙ্ক বন্দি করে জামা কাপড় কিনে দেশে ফিরছিলেন, আর তার মধ্যেই ছিল ধাতব বোতাম লাগানো এই পাৎলুন। পরে অবিশ্যি এ নিয়ে ট্রেসি প্যানেক মুখ খুলেছেন। তিনি কে এবং কি বলেছেন সে কথায় পরে আসব।
খবরটা পড়ে আমি পিছিয়ে গেলাম সত্তর দশকের মধ্য ভাগে। সেটা ‘৭৬ সাল হবে বোধ হয়। আমি কলকাতার যে স্কুলে পড়তাম সেখানে ক্লাস ফাইভে উঠেছি। হাফ প্যান্টের পাশে ফুল প্যান্ট পরবার রীতি রেওআজ সবে চালু হয়েছে। প্রাইমারি থেকে হাই স্কুলে আসা মানেই বেশ খানিকটা বড় হয়ে যাওয়া – বয়েসে তো বটেই, হাবে ভাবে, জ্ঞানগম্মি বা পছন্দ অপছন্দের তালিকা চয়নে। আমাদের সেরকমটাই হয়েছে।
আমাদের স্কুল ইউনিফর্মে সে সময় একধরণের কালচে রঙের ডেনিম কাপড়ের প্যান্ট পড়তে হতো। “ডেনিম” কে তখনও লোকে আদর করে “জিন্স” নামে ডাকতে শুরু করেনি। তার রঙ কালো না নীল না নীলচে সে নিয়েও আমাদের খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না। দক্ষিণ কলকাতার ত্রিকোণ পার্কের কাছে এক বস্ত্র বিপণিতে পাওয়া যেত আমদের স্কুল ইউনিফর্ম এর জন্য নির্ধারিত কাপড়। অর্ডার দিলে, তারাই মেপে জুপে, কেটে কুটে সেলাই করে বানিয়ে দিতেন সাইজ মতন। জামা নিয়ে খুব একটা কেতা গিরির জায়গা না থাকলেও, প্যানটুল নিয়ে কিছু সপ্রতিভ, ফ্যাশন দুরস্ত ছেলেপুলেরা সেই বয়সেই বেশ ইনোভেটিভ হয়ে পড়েছিল।
আরেকটা ব্যাপার ঘটল সে সময়েই।
সিনেমার ৭০ মিলিমিটার পর্দা জুড়ে এক মহানায়কের আবির্ভাব হল যার প্যান্টের “ঘের” সামনের সারিতে বসা দর্শকের নাকে প্রায় হাওয়া খেলিয়ে দিলো। একটু দূর থেকে যারা দেখল, তাদের মন উঠল নেচে। তিনি নাকি আবার বাংলার জামাই বাবু। চোখা ডায়লগ, রোখা হাবভাব আর কুন্তল বাহারের যাদুতে তিনি বলিউডে সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইমেজ !! সেই জনপ্রিয়তার ঢেউয়ে কলকাতাও ভেসে গেল। ছেলে ছোকরা দের যেমন হয়। নায়কের স্টাইলের নকল নবিশি করে তারা বেলবটম, বেলবটস গায়ে চাপালে। দর্জির সুদক্ষ্য হাতে সে পরিধেয়র ঘের সতের থেকে কুড়ি ইঞ্চি প্রসারিত হলো। কখনও বা সে পাতলুনের গায়ে অন্য রঙা কাপড়ের তেকোনা তাপ্পি লাগাল তারা।
এসব কাণ্ড যখন ঘটছে তখন আমাদের স্কুলের রসায়নের মাস্টারমশাই সমীরদা পড়লেন মহা ফাঁপরে! বিদ্বান মানুষটি থাকতেন সোনারপুরের দিকে; ফ্যাশন, কেতা দুরস্ত নন মোটেই। সেখান থেকে তিনি সাত হস্ত দূরে আর ছাত্রদের এ হেন ফ্যাশন বিলাসিতা তাঁর কাছে ঘোরতর অপছন্দের। স্কুল নির্ধারিত প্যান্টের ঘেরের মাপ ছিল নয় – সাড়ে নয়, বড় জোর দশ ইঞ্চি। সমীরদা সন্ধানী চোখ জোড়া কুঁচকে এক খানা কাঠের স্কেল হাতে নিয়ে এসেম্বলি লাইনের এক পাশে এসে দাঁড়ালেন। ধরে ধরে ছেলেদের প্যান্টের ঘের মাপা শুরু হলো।
ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল সেদিন!! দশ ইঞ্চির ওপর ওয়ালাদের ধরা দিতে হল সমীরদার শ্যেন দৃষ্টির কাছে। সিকি, আধা ইঞ্চির পাপও সেদিন ক্ষমা পেল না। দাবি নাকচ হওয়ায় দর্জির দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় রইল না।
এরপর কেটে গেল আরও চার পাঁচ বছর। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছিলেন “ জগতে পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুব “, সেই নিয়মেই হয়ত বা হাওয়া বদল হোল ফ্যাসান দুনিয়ায়। এবার পাতলুনের ঘের দিক পরিবর্তন করে কমতে লাগলো। আমাদের সমীরদা আবার এসে দাঁড়ালেন স্কেল হাতে, এসেম্বলি লাইনের একপাশ ঘেঁষে। চলল নিরীক্ষা! এবার তাঁর জালে ধরা দিতে হল সেই সব দুষ্টু ছেলে পুলেদের যারা হালের ফ্যাসান মেনে স্কুল ড্রেসের সেই কালচে ডেনিম এর প্যান্ট কে চামড়া সাঁটা ( স্কিন টাইট) বানিয়ে ফেলেছে !!
আসলে যে ডেনিম বা জিন্স কে নিয়ে সারা বিশ্ব ব্যাপি এতো আলোড়ন, উৎসাহ, ২০২৩ সালে তার ১৫০ বছর পূর্তি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে ১৫০ বছর আগে ১৮৭৩ সালে কি এমন ঘটল যে সে সময়টাই ডেনিম বা জিনস এর উৎপত্তি কাল হিসেবে মানা হবে? এর জন্য ইতিহাসের পাতা উলটে দেখা দরকার। ১৮২৯ সালে লেভি স্ট্রস ( Levi Strauass) জন্মেছিলেন জার্মানির ব্যাভেরিয়া প্রদেশের ছোট্ট শহর বাটেনহেম এ। জাতে ইহুদী। তিন দাদা আর তিন দিদির সব চেয়ে ছোট ভাই লেভি। ১৮৪৬ এ বাবা হিয়ার্স স্ট্রস যক্ষা রোগে মারা যেতে স্ট্রস পরিবার জার্মানি ছেড়ে আমেরিকায় চলে আসা মনস্থ করে, কারণ, মূলত পিতৃভূমির ইহুদী বিরোধী আইন। এর আগে অবিশ্যি লেভির সব চেয়ে বড় দুই ভাই, জ্যাকব আর লুই, নিউ ইয়র্ক শহরে চালু করে দিয়েছিলেন এক পাইকারি ব্যবসা “জে স্ট্রস ব্রাদার অ্যান্ড কোম্পানি” নাম দিয়ে। কি নেই তাদের ভাণ্ডারে! চা, কফি, তামাক, চিনি, মশলা, শস্য, ময়দা, বাদাম এই সব তো ছিলই আর তার সঙ্গে নানা ধরনের কাপড়, সুতো, পরিধেয়, প্রসাধন ও তৈজস পত্র এসবেরও ফিরিওয়ালা তারা। এ দেশে এসেই সবাই মিলে নিজেদের ব্যবসার কাজে লেগে পড়তে দেরী হল না। ধর্মীয় অত্যাচারের থেকে ত্রাণ এবং আর্থিক স্বাধীনতা লাভের যে লক্ষ্য নিয়ে আসা মার্কিন মুলুকে, স্ট্রস পরিবার আস্তে আস্তে সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে লাগলো।
১৮৪৮ সালটা ছিল আমেরিকান অর্থনীতির ক্ষেত্রে আরেকটি মোড়। পশ্চিম উপকূলের ক্যালিফোর্নিয়া তে আবিস্কার হল স্বর্ণ খনি। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই পার্শ্ববর্তী রাজ্য অরেগন, অ্যারিজোনা, নেভাদা, দক্ষিণের দেশ মেক্সিকো থেকে মানুষ জন এসে পৌঁছল সেখানে। তার পিছনে এল আমারিকার পুব উপকূল থেকে আরও মানুষ। এল ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, চিন দেশ থেকে আরও আরও। সংখ্যায় তারা পিছনে ফেলে দিলো স্থানীয়দেরও। সানফ্রান্সিসকোর মতো ছোট শহরের জনসংখ্যা একলাফে ২০০ থেকে হয়ে গেলো ৩৬০০০ ছয় বছরে ( ১৮৪৬ -১৮৫২ )। “ফরটি নাইনার” ( ১৮৪৯ এ আসা স্বর্ণ সন্ধানী দের ঐ নামেই ডাকা হতো তখন) দের হাতে তৈরি হল নতুন বসতি, নতুন সমাজ। ১৮৫৩ সালে লেভি ভাগ্যান্বেষণে পৌঁছে গেলেন সানফ্রান্সিসকো পরিবারিক ব্যবসার প্রতিনিধি হয়ে। পরে তাঁর এই নতুন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হল “লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোম্পানি”।
ওদিকে নেভাদার রেনও শহরের এক দর্জি জ্যাকব ডেভিস। তাঁবু , ঘোড়া গাড়ির ঢাকনা, এই সব বানায় সে। সঙ্গে শ্রমিকদের পরিধেয়। তার দোকানে সোনা সন্ধানকারীদের ভিড় লেগেই থাকে। কয়েকজন খদ্দের অনেকদিন থেকেই বলে আসছে এমন একটা প্যান্ট বানিয়ে দেওয়ার জন্য যা সোনা খোঁজার সময় শারীরিক চলা ফেরার কারণে ছিঁড়ে বা ফেটে যাবে না, কাজের ধকল অনায়াসে সইতে পারবে। ততদিনে এক ধরনের মোটা কাপড়ের সন্ধান পেয়েছে মার্কিন মুলুক। ইউরোপের দুই দেশ, ফ্রান্স এবং প্রতিবেশী ইতালিতে জন্ম নিয়েছিল যথাক্রমে ডেনিম এবং জিনস (যদিও আমাদের কাছে এই দুটি আপাত সদৃশ)। ‘জিন্স’ নামটি “ Genes” ইংরেজি শব্দ থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়, ইতালির জেনোয়া থেকে আসা লোকেদের বলা হতো “Genes”। জেনোয়া ১৭ এবং ১৮ শতকে বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র ছিল। জেনোয়া থেকে পালতোলা বণিকরা সমগ্র ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে তাদের পণ্যের ব্যবসা করত। জেনোয়াতে উতপন্ন হতো একধরনের মোটা কাপড় যা নাবিক, জেলে , বন্দর কর্মী, খনি শ্রমিক এদের পছন্দের ছিল। খুব টেঁকসই হতো এই কাপড়ে বানানো প্যান্ট। ময়লা লুকবার জন্য নীল ( indigo) এবং ওঅ্যাড (woad – এক ধরনের গুল্ম লতা যা থেকে নীল রঙ তৈরি হয় ) দিয়ে নীল রঙে রাঙানো হতো এই কাপড়। ফরাসি ভাষার কল্যাণে এর নাম হল ‘bleu de Gênes’ (the blue of Genoa)। আর সেখান থেকেই তার ইংরেজি রুপান্তর “Jeans”! ওদিকে ইতিহাসবিদরা এখনও ডেনিমের জন্মস্থান নিয়ে যদিও বিতর্ক করছেন, কিন্তু, মোটামুটি ভাবে ফ্রান্সের নাইমস (Nîmes ) শহর কেই আপাতত মেনে নেওয়া গেছে এর জন্ম স্থান হিসেবে। আসলে “জিন্স” এর মত একটা শক্ত সুতির কাপড়ের প্রতিলিপি তৈরি করার প্রচেষ্টায়, নাইমসের তাঁতিরা বুঝতে পেরেছিল যে তারা সম্পূর্ণ অন্য রকম একটি কাপড় বানিয়ে ফেলেছে যার গুণগত মান জিন্সের থেকে উন্নততর। নীলে ছোপানো একটি রঙিন সুতো এবং একটি সাদা সুতো ব্যবহার করে এই টুইল জাতীয় কাপড় তৈরি হতে এর নাম রাখা হল “Serge de Nîmes” (the twill of Nîmes ) যার ইংরেজি অপভ্রংশ হল “Denim” !!
আবার উঁকি দিই জ্যাকবের দোকানে!
ডেনিম কাপড় তো পাওয়া গেল। এই কাপড় সে কিনেছে লেভির কাছ থেকেই। প্যান্টও তৈরি হল। কিন্তু সেটাকে শক্ত পোক্ত করা যায় কি ভাবে? অনেক মাথা খাটিয়ে জ্যাকব এক বুদ্ধি বার করলে! পাতলুনের বিভিন্ন অংশে, যেখানে কায়িক বিচলন বেশী, সেখানে সে লাগিয়ে ফেলল ধাতব রিভেট ( rivet)। কেল্লা ফতে! মার্কিন দেশে কোন কিছু নতুন উদ্ভাভন করলেই তার পেটেন্ট নেওয়া জরুরি। ১৮৭২ সালে লেভিকে সে এক চিঠি লিখে জানাল তার মনোবাঞ্ছার কথা, এই পেটেন্ট কে ব্যবসায়িক ভাবে কাজে লাগানোর জন্য সে লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারি তে যেতে চায়। লেভি বুজতে পেরেছিলেন এই পেটেন্টের ভবিষ্যৎ। অবশেষে ২০ মে , ১৮৭৩ যৌথ ভাবে ১৩৯১২১ নম্বর পেটেন্টটি জ্যাকব ডেভিস এবং লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোম্পানিকে দেওয়া হল ; জন্ম হল নীল জিন্সের। এরপর আরও অন্যান্য কোম্পানি যেমন লি (Lee), র্যাংগ্লার (Wrangler), পেপে (Pepe), কেল্ভিন ক্লেইন (Calvin Klein) এরা ঢুকে পড়ল ব্যবসায় বিভিন্ন সময়। কিন্তু জিন্সের জন্মদাতা হিসেবে ইতিহাস চিনে রাখল জ্যাকব ডেভিস এবং লেভি স্ট্রস কেই!
জিন্সের জনপ্রিয়তা ক্রমশ শ্রমিক শ্রেণীকে ছাড়িয়ে সাধারণের ফ্যাশন দুনিয়ায় প্রবেশ করতে থাকে। এর মুলে হলিউড এবং দুটি বিশ্ব যুদ্ধ। প্রথমত, পশ্চিম আমারিকার বন্য, রুক্ষ পরিবেশ ঘিরে যে অদ্ভুত এক এডভেঞ্চার তৈরী হয়েছিল যার অন্যতম উপাদান ছিল কাউ বয়, ঘোড়া এবং আগ্নেয়াস্ত্রের খোলা মেলা ব্যবহার – সেটাকেই মূলধন করে হলিউডি ছবি ব্যবসা শুরু করে। ফিল্ম ব্যবসার পরিভাষায় একে বলা হতো “Hollywood westerns”। জিন্সের তৈরি ট্রাউসার, জ্যাকেট এক অর্থে হয়ে উঠল এ সব সিনেমার অপরিহার্য অঙ্গ। সাদা কালো যুগে বোঝা না গেলেও, সিনেমা রঙ্গিন হতে এর কদর বেড়ে গেল বহু গুণ।
‘৪০ এর দশকে আমেরিকান সৈন্য (GI) রা তাদের সাধের ডেনিম জোড়া সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে গেল পৃথিবীর নানা প্রান্তে। তখন ও এর পরিচিতি “waist overall” হিসেবে। কাজের অবসরে জিনস পরে তারা বোঝাতে চাইত “আমাদের মুলুক আমেরিকা, আমরা আমেরিকান”। সেদিক থেকে ডেনিম বা জিনস এক ধরনের জাত কৌলীন্য প্রকাশের প্রতীকও বটে। যদিও কাঁচামালের অভাবে যুদ্ধের বাজারে ডেনিম উৎপাদন কমে যায়, কিন্তু যুদ্ধের সমাপ্তিতে ডেনিম বা জিন, কাজের পোশাকের থেকে ক্রমশ অবসর পরিধান হিসেবে হই হই করে ফেরত আসে। ডেনিমের তৈরি পোশাকের বৈচিত্র্য তৈরি হতে থাকে ক্রমান্বয়ে এবং তার বেশীটাই হয় স্কুল, কলেজ পড়ুয়া এবং তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে। যদিও ‘৫০ এর দশকে, আমেরিকায়, ডেনিম কে প্রতিবাদের প্রতীক হিসাবে দেখে স্কুল, থিয়েটার এবং রেস্তোরাঁতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল একটা লম্বা সময়ের জন্য কিন্তু তাতে এর জনপ্রিয়তা ঠেকিয়ে রাখা যায় নি। অনুপ্রেরনা আসে মারলন ব্রানডো, জেমস ডিন, মেরিলিন মনরো প্রভৃতিদের রূপালী পর্দায় ডেনিম পরিহিত উপস্থিতি থেকেও। এক মার্কিন খবরের কাগজ তো লিখেই বসলো “90% of American youth wear jeans everywhere, except in bed or church”!! ১৯৬০ সালের হিপিদের সামাজিক উত্থান কেও খানিক দায়ী করা যেতে পারে জিনস সংস্কৃতির কারণ হিসেবে। এই পোশাক যেন এক নিয়ম ভাঙ্গার প্রতীক, বিপ্লবের নির্ঘোষ। তথাকথিত অভিজাত, প্রাতিষ্ঠানিক শ্রেণী বা শক্তির নিঃশব্দ বিরুদ্ধাচারণ। একই সময়ে, মহিলারা তাদের পোশাকের মাধ্যমে নারী মুক্তিকে আলিঙ্গন করতে শুরু করেছিল। এই চেতনা প্রতিফলিত হল পাতলা কোমর এবং চওড়া ‘বেল-বটম’ সহ আরও সাহসী স্টাইলের পোশাকে। মোটামুটি ’৭০ র দশকে
ভারত উপমহাদেশ জুড়ে বইতে থাকে ডেনিম জিনস এর ফ্যাশন ঝড় যার কথা শুরুতেই বলেছি।
ডেনিম ফ্যাশানের মধ্যমণি নীল রঙ হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রঙের বৈচিত্র্য আসে। নীলের ওপর হলুদ অথবা কমলা রঙের সেলাই, পিছনে ডানদিকে একখণ্ড চামড়ার পট্টিতে প্রস্তুতকারকের নাম, সামনে পিছনে মিলিয়ে পাঁচটি পকেট, যার মধ্যে সামনের সবচেয়ে ছোট পকেটটি ট্যাঁক ঘড়ি রাখবার জন্য (যা আজকের দিনে অপ্রয়োজনীয়), তামা বা ষ্টীলের রিভেট এবং বড় ধাতব বোতাম – এগুলো ছিল এই পোশাকের এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
এক সময় কলকাতার মানচিত্রে জিনস কেনার জুতসই জায়গা ছিল অবশ্যই পার্ক স্ট্রীট, ধর্মতলা, নিউ মার্কেটের দোকান। পাশে পাশে ছিল খিদিরপুর অঞ্চলের কিছু দোকান যেখানে নাকি খাঁটি বিদেশি জিনস পাওয়া যেত! এখন সেখানেও থাবা বসিয়েছে দেশীয় ব্যবসায়িক স্বার্থ। মেটিয়াবুরুজ, চট্টাবাজার এলাকা এখন এই শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান। শহরের মাঝখানে আছে আরেক মহল্লা যার নাম নীলমাধব সেন লেন। এই রাস্তা নামেও নীল, রঙেও নীল!! এখানে বিভিন্ন বাজার, হাট থেকে পুরনো জিনস এসে পৌঁছয় প্রতিদিন আর তা ধুয়ে, রাঙিয়ে, শুকিয়ে, সেলাই করে নতুন অবয়ব পায়। অতি সস্তা দামে বিকিয়ে যায় সেগুলো ধর্মতলা, হাতিবাগান, গড়িয়াহাটের ফুট পাথে।
ট্রেসি প্যানেক অনেকদিন যাবত লিখে চলেছেন লেভিস কোম্পানির ইতিবৃত্ত। এর কথা বলেছিলাম আগে, এই লেখার শুরুতে। ডেনিম ও জিনস পোশাক এবং তাকে ঘিরে না না ধরনের জিনিসপত্র সংগ্রহ করে প্রতিদিন একটু একটু করে গড়ে তুলছেন এক অসাধারন আর্কাইভ। কোথা থেকে না পেয়েছেন পুরনো জিন্সের প্যান্ট; কখনও নিলামে, কখনও পুরনো জিনিস বিকিকিনির বাজারে, কোন সোনার খনির গুদাম ঘরে, ঘোড়ার আস্তাবলে অথবা কোন ভুতুড়ে বাড়ির দেরাজে। এসব তৈরি হয়েছিল ১৮৭৯ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে। ঠিক এই কারণে ডুবে যাওয়া জাহাজের যে পাতলুন নিয়ে এত মাতামাতি হল তার ডিজাইন বা কাপড়ের সঙ্গে আসল লেভিস কোম্পানির জিনিসের রয়েছে অনেকটাই ফারাক!
ডেনিমের ভবিষ্যত কেমন হবে?
আসলে মানব সভ্যতার অন্যতম প্রয়োজনীয়তার একটি অবশ্যই তার বস্ত্রের সংস্থান। এবং ফ্যাশানের হাটে ঘাটে মাঠে এই টেঁকসই টেক্সটাইল এর যে ঊর্ধ্ব গতি তার কোন নিকট প্রতিযোগী এখনো অবধি খুঁজে পাওয়া যায় নি। ট্রাউজার থেকে শুরু করে এখন সে ব্যবহৃত হচ্ছে অনান্য পোশাক বানানোর কাজে। ফ্যাশন দুনিয়ায়, অতএব, ডেনিমের জয়যাত্রা রোখা “মুশকিল নেহি, না মুমকিন হ্যাঁয় “।
What's Your Reaction?
Saptarshi, a finance professional, has a camaraderie with his camera and pen as he tries to capture the wonderful light and sight along his way and write about the world and people around him.